চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস, নিয়ম নীতি - প্রথম বর্ষ

 চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস, নিয়ম নীতি - প্রথম বর্ষ



 প্রশ্ন-চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভব সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । 

উত্তর : জন্মের সাথে মৃত্যুর যেমন অচ্ছেদ্য সম্পর্ক , মানুষের জীবনের সঙ্গে রোগের সম্পর্কও তেমনি নিগূঢ় । কিভাবে রোগ যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া যায় , কেমন করে মানুষের দৈহিক ও মানসিক অক্ষমতা ও অপূর্ণতা দূর করে মানব জীবনকে সুখী ও সুন্দর করা যায় , তাই হলো মানুষের প্রাচীনতম ভাবনা । আর সেই ভাবনা থেকেই উদ্ভব হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের । কবে কোথায় থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন হয়েছিল তা সঠিক ভাবে বলা না গেলেও মানুষ পর্যায়ক্রমে চিকিৎসার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়েছে । ভারতবর্ষের সিন্ধু ও গঙ্গা অববাহিকায় , মিশরের নীল নদের অববাহিকায় সুমেরীয় , মেসোপটেমিয় ও ব্যাবিলনে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর অববাহিকায় , চীনে ও পেরুতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদিম ভিত্তিমুল গড়ে উঠেছিল । খৃষ্টপূর্ব ৪ র্থ ও ৩ য় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে গঙ্গা ও সিন্ধু অববাহিকায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে । আরবীয় , ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয় চিকিৎসা বিদ্যা তার উৎকর্ষের জন্য বহুলাংশে ভারতীয় চিকিৎসা বিদ্যার নিকট ঋণী । আরবীয় , মেসোপটেমিয় , গ্রীক ও মধ্য যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞান আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সৃষ্টির জন্য উলেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে । আরোগ্য বিধানের জন্য বিভিন্ন মনীষী ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন । ফলে আয়ুর্বেদ , হেকিমী , কবিরাজী , এলোপ্যাথিক , ইউনানী , এন্টিপ্যাথি , হোমিওপ্যাথি প্রভৃতি বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন হয় । 



প্রশ্ন -১.২ । চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসকে কয়ভাগে ভাগ করা যায় ? 

উত্তর : জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ইতিহাস যেমন হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষনীয় বিষয় , চিকিৎসাবিজ্ঞানও তেমনি । কিন্তু অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে , সব দেশে সব যুগে রোগ ছিল আর প্রায় একই রকমের রোগ । এর প্রতিকারও গড়ে উঠে প্রায় সব দেশে সব যুগে প্রায় একইভাবে অথবা কিছুটা ভিন্নতর পদ্ধতিতে ।মানসিক রোগ সম্পর্কে তিনি অনেক মূল্যবান তথ্য প্রকাশ করেন । মানসিক রোগও প্রাকৃতিক কারণে হইয়া থাকে বলিয়া তিনি মত প্রকাশ করেন । প্রাকৃতিক কারণেই মানসিক বিকৃতি ঘটে । মস্তিষ্কই সকল বুদ্ধিবৃত্তির কার্যকলাপের কেন্দ্রীয় যন্ত্র এবং মস্তিষ্কের অসামঞ্জস্য ক্রিয়ার প্রভাব ও যান্ত্রিক গোলযোগেই মানসিক রোগ সৃষ্টি । হয় । তিনি মানসিক ব্যাধির কারণ সম্পর্কে বংশগত প্রভাবকে উল্লেখ করেন । এই যুগান্তর সৃষ্টিকারী চিকিৎসকরা রোগীর শয্যা পার্শ্বে বসিয়া রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতেন এবং চিকিৎসা প্রদান করিতেন । মানসিক রোগীকে তিনি ৩ ভাগে ভাগ করেন । 

যথা- ( ক ) ম্যানিয়া ( খ ) মেলাঙ্কোরিয়া ( গ ) ফ্রেনাইটিস । তৎকালীন গ্রীসে মানবদেহকে দেব দেহের মত মহা পবিত্র মনে করা হইত । তাই সব ব্যবচ্ছেদ করা মহাপাপ মনে করা হইত । ফলে তাঁহার শরীর সংস্থান ও শরীর বিদ্যার জ্ঞানের দৈন্যতা তাঁহার চিকিৎসা অগ্রগতির পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করিয়াছিল । যাহা হোক চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁহার ধারণা প্রেতবাদের চেয়ে অনেক উন্নতমানের ও বিজ্ঞানসম্মত । হিপোক্রেটিসের সংগ্রহের সর্বাপেক্ষা হৃদয়গ্রাহী অংশ হইল “ হিপোক্রেটিসের শপথনামা ” । হিপোক্রেটিসের শপথনামা আজ পর্যন্তও মেডিকেল নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় । প্রাচীনকাল হইতে অদ্যাবধি চিকিৎসাবিদ্যাবিষয়ক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ডিগ্রীপ্রাপ্ত অনুষ্ঠানে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে এই শপথনামা উচ্চারিত ও ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে । 



প্রশ্ন - হিপোক্রেটিসের শপথনামা লিখ । 

উত্তর : হিপোক্রেটিসের শপথনামা নিম্নরূপ  ঃ হিপোক্রেটিসের শপথনামা ( Hippocratic Oath )

১। নিরাময়কারী অ্যাপেলো , স্বাস্থ্য ও আরোগ্যকারী সকল শক্তি ও দেব দেবতার নামে উচ্চারিত শপথ লইয়া আমি আমার শপথ , সামর্থ ও বিচার ক্ষমতা প্রয়োগ করিব । 

২। যিনি আমাকে এই কলায় দীক্ষা ও শিক্ষা দিলেন , চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেই শিক্ষককে আমি আমার পিতা - মাতার মতই জ্ঞান করিব । আমার যাহা সম্বল আছে তাহাতে তাহারও অংশ থাকিবে । তাঁহার অভাবের সময় আমিই তাঁহাকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করিব । তাহার সন্তান - সন্ততিগণকে আমার ভাইদের মত মনে করিব এবং তাঁহারা যদি শিক্ষা গ্রহণ করিতে চায় , বিনা পারিশ্রমিকে অথবা চুক্তিপত্র ছাড়াই তাহাদেরকে এই কলাই শিক্ষা দিব ।

৩। নীতি সূত্র ও নৈতিক বিষয়ে আদেশ , বক্তৃতা এবং শিক্ষাদানের অন্যান্য মাধ্যমে আমি আমার নিজ সন্তানদের , গুরুর সন্তানদের এবং শিষ্যবৃন্দকেও এই কলায় শিক্ষিত করিয়া তুলিব । 

৪। রোগীর কল্যাণের জন্য আমি আমার সকল জ্ঞান , সামর্থ্য ও বিচার ক্ষমতা প্রয়োগ করিব । কখনও আঘাত দেওয়া বা ক্ষতি করার জন্য নয় । 

৫। আমি কাহাকেও প্রাণনাশক ঔষধ বা বিষ সরবরাহ করিব না বা উহার সংবাদ প্রকাশ করিব না । বিশেষ করিয়া কোন মহিলাকে গর্ভপাত করার জন্য সাহায্য করিব না । 

৬। আমার অস্ত্র আর্তমানবতার ক্ষতির জন্য ব্যবহৃত না হইয়া সেবায় নিয়োজিত হই । চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাহিরে অন্য কোন পেশায় আমি নিয়োজিত হইব না । 

৭। যে গৃহে আমি প্রবেশ করিব , সে গৃহের পীড়িতের সাহায্যের জন্য ও ভাষা করার জন্যই আমি প্রবেশ করিব , সকল প্রকার অন্যায় কাজ ও দুর্নীতি হইতে আনি মুক্ত থাকিব । 

৮। রোগী দেখিতে গিয়া বা যে কোন ভিন্ন পরিস্থিতিতে যদি এমন কিছু দেখি বা শুনি বাহা বাহিরে প্রকাশ উচিত নহে , সেগুলি আমি নীরবে গোপন করিব এবং পবিত্র গোপনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য করিব । 

৯। এই শপথবাণী মানিয়া চলিলে যেন জীবনে ও পেশায় আমার উন্নতি ও সুনাম আসে এবং লংঘন করিলে যেন ইহার বিপরীত বা ক্ষতি হয় । হিপোক্রেটিসের শপথ নামায় একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব ও কর্তন । সুস্পষ্টভাষায় অংকিত হইয়াছে । 



প্রশ্ন - মানুষের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে হিপোক্রেটিসকি ৰলিয়াছেন ? 

উত্তর : মানুষের চিকিৎসা সম্বন্ধে হিপোক্রেটিস চিকিৎসাবিদ্যাকে দুই বিপরীত নিয়মে পরিচালিত করেন । নিয়ম দুইটি হইল 

( ক ) বিসদৃশ বিধানে আরোগ্য Curenture , রোগ নিরাময়ে ভিন্নমুখী বন্ধুর প্রয়োগ । Contrarna Contraris 

( খ ) সদৃশ বিধানে আরোগ্য সাধন Similia Simulibus Curentur , রোগ নিরাময়ে সমধর্মী বস্তুর প্রয়োগ । প্রথমোক্ত নিয়নটি বর্তমানে বহুল প্রচলিত এবং উপশমদায়ক চিকিৎসা বিদ্যা । দ্বিতীয়টি আরোগ্যদায়ক চিকিৎসা হিসেবে জগতে প্রচলিত , তাহা হইল হোমিওপ্যাথি ।


প্রশ্ন - প্লাটো সম্বন্ধে যাহা জান লিখ ।  

উত্তর : প্লাটো ( খৃষ্টপূর্ব ৪২৯-৩৪৭ )  ঃ দার্শনিক প্লাটো গ্রীসদেশে জন্মগ্রহন করেন । হিপোক্রেটিসের সমসাময়িক কালে তিনিই বড় দার্শনিক ছিলেন । প্লাটো চিকিৎসা শাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন অনেকটা সংস্কার মুক্ত মন নিয়া । তাঁহার প্রচেষ্টায় এই চিকিৎসাশাস্ত্রের বহু উন্নতি সাধিত হয় । তবে তখনকার সময়ের কুসংস্কারের প্রভাব হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর হয় নাই । তাই চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞান ও প্রকৃত তত্ত্ব তথ্য নির্ধারণ করিতে তিনি ব্যর্থ হন । তাঁহার মতে মানসিক রোগের কারণ হিসেবে দৈহিক কার্যকারণই দায়ী । ৩৪৭ খৃষ্ট পূর্ব অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । 



প্রশ - এরিস্টটল সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । 

উত্তর : এরিস্টটল ( খৃষ্টপূর্ব ৩৪৮-৩২২ ) : ম্যাসিডোন নিবাসী জনৈক গ্রীক চিকিৎসকের ঔরসে এরিস্টটল জন্মগ্রহন করেন । তিনি ছিলেন প্লাটোর শিষ্য , একজন মস্তবড় দার্শনিক এবং প্রখ্যাত চিকিৎসক । কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি প টোকে অনুসরণ করেন নাই । হিপোক্রেটিস ছিলেন এরিস্টটলের চিকিৎসা গুরু । প্লাটোর মৃত্যুর পর প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে তিনি অনেকবার প্রাণীদেহ কাটা ছেঁড়া করেন । তিনি তাঁহার মতবাদ দ্বারা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করিয়াছিলেন । তবে ব্যবহারিক বিজ্ঞান সম্পর্কে তেমন কোন গবেষণায় তিনি আত্মনিয়োগ করিতে পারেন নাই । তাঁহার মতে মানুষের বিক্ষিপ্ত মন ও চিত্তবিকার হেতু প্রলাপ ও কামভাব উপস্থিত হয় । খৃষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে তিনি মৃত্যু মুখে পতিত 


প্রশ্ন - গ্যালেন সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । চিকিৎসাজগতে গ্যালেনের অবদান কি ? 

উত্তর : গ্যালেন ( ১৩০-২০০ খৃষ্টাব্দ ) : ক্লডিয়াস গ্যালেন ১৩০ খৃষ্টাব্দে গ্রীস দেশে জন্মগ্রহন করেন । প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্লাটো ও এরিস্টটলের পরই তাঁহার আবির্ভাব ঘটে । হিপোক্রেটিসের পর প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসক হিসেবে গ্যালেনের নামই সবিশেষ স্মরণযোগ্য । চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনি পরীক্ষণ ও পুনঃপর্যবেক্ষণের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেন এবং সেভাবেই চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন । পীড়ার কারণ হিসেবে তিনি অত্যধিক মদ্যপান , ভয় , আঘাত , যৌবনের প্রারম্ভে অমিতাচার , নৈতিক অবক্ষয় , ব্যর্থপ্রেম প্রভৃতিকে উল্লেখ করেন । সে জন্যই তাঁহাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির জনক বলা হইয়া থাকে । তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নরদেহ বিজ্ঞানী । তাঁহার দ্বারাই চিকিৎসা ব্যবস্থা একটা নিয়মে গ্রথিত হয় । আরোগ্য বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি হিপোক্রেটিসের চিকিৎসা

পদ্ধতির প্রথমটি অর্থাৎ বিসদৃশ পদ্ধতি contraria contraris curentur গ্রহণ করেন । সেনসরি নার্ভের গঠন ও মানসিক পীড়া নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাঁহার অবদান অনেক । মানসিক পীড়ার কারণ হিসেবে তিনি দৈহিক ও আত্মিক এই দুইটি বিষয়ের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেন । গ্যালেন ঔষধের ক্রিয়া ও প্রয়োগ প্রণালী অনুসৃণ শ্রেণীবদ্ধ করেন । এই প্রণালী আজও তাঁহার নামানুসারে গ্যালেনিক্যাল প্রিপারেশান নামে পরিচিত । যদিও সে যুগে শবব্যবচ্ছেদ ধর্মীয় সংস্কারের বলে নিষিদ্ধ ছিল , তবুও তিনি বনমানুষ ও শুকরের মৃতদেহের উপর ছুরি চালাইতে কুণ্ঠাবোধ করেন নাই । গ্যালেন শারীরবৃত্ত ও শরীরস্থান বিষয়ে বহু গবেষণা করেন । শারীর অভ্যন্ত রস্থ রসকে তিনি কৃষ্ণপিত্ত , হরিৎপিত্ত , শ্লেষ্মা ও রক্ত বলিয়া আখ্যা দেন । দেহস্থ রসের মধ্যে শুধুমাত্র রক্তাধিক্য ঘটিলে পীড়ার সৃষ্টি হয় এ মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাধি নিরসনে রক্ত মোক্ষন ব্যবস্থার প্রসার ঘটে । হৃদপিন্ডের পাম্প ক্রিয়ার সাহায্যে রক্ত গতিশীল হয় বলিয়া তিনি মত দেন কিন্তু রক্তের চলাচল ক্রিয়া সম্পর্কে তাঁহ ধারণা দুর্বল ছিল । যাই হোক তাঁহার এ মতবাদ প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে একধাপ আগাইয়া নিয়া যায় এবং চিকিৎসা নীতির পরবর্তী নবযুগের সূচনা করে । গ্যালেনের মতবাদসমূহ দীর্ঘদিন যাবত চিকিৎসা জগতকে একটি অস্পষ্টতার মধ্যে নিবদ্ধ রাখে । পাঁচ শতেরও অধিক সংখ্যক বই তিনি রচনা করেন । ২০০ খৃষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । 



প্রশ্ন -  ভারতীয় চিকিৎসা সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । 

উত্তর : প্রায় তিন হাজার বৎসর পূর্বে এই চিকিৎসার সূত্রপাত হয় । এই চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা পদ্ধতি নামে সুপরিচিত । আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসার অবদানের উপরই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত বলিয়া অনেকে মনে করেন । আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানেও দুই ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি বিদ্যমান । একটি সদৃশ এবং অপরটি বিসদৃশ চিকিৎসা পদ্ধতি । এককালে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞান এমন উন্নতি লাভ করে যে তৎকালীন রোম , গ্রীস , মিশর , এমনকি অপরাপর দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রও ইহার প্রভাবে স্তিমিত হইয়া যায় । চতুর্বেদের শেষ গ্রন্থ অথর্ববেদে বর্ণিত চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে বিকশিত করিয়া পূর্ণাঙ্গ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রূপান্তর করা হয় । ইহা ' ত্রিদশা ' মতবাদ অর্থাৎ রোগের কারণ তিনটি - বায়ু , পিত্ত ও কফ । দেহের এই তিনটি রসের সাম্যাবস্থার বিপন্ন হইলেই পীড়ার উৎপত্তি হয় । খৃষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দে আত্রিয়া ছিলেন সর্বপ্রথম বিখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিৎসক । খৃষ্টাব্দের প্রথমদিকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি এমন উন্নতি লাভ করে যে ইহার প্রভাবে তৎকালীন মিশর , গ্রীকু , রোগ এবং অন্যান্য দেশের চিকিৎস । শাস্ত্র ম্লান হইয়া পড়ে । প্রাচীন ভারতের শল্য চিকিৎসা জ্ঞানের প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল চরক সংহিতা ' ও অদ্রুত সংহিতা ' নামক দুইটি চিকিৎসা শাস্ত্র পুস্তক । 


প্রশ্ন -  ইবনে সিনা ( আরব্য চিকিৎসা ) সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । চিকিৎসা জগতে ইবনে সিনর অবদান লিখ । 

উত্তরঃ ইবনে সিনা বা আবু সিনার পূর্ণ নাম আলী আল - হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা । ১৮০ খৃষ্টাব্দে তিনি রাশিয়ার বোখারায় জন্মগ্রহন করেন । চিকিৎসক হিসেবে তাঁহার কর্মজীবন শুরু হয় মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে এবং শুরুতেই তিনি রাজ চিকিৎসক নিযুক্ত হন । আরব্য চিকিৎসা জগতে মুসলমান চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম । রোগীর নাড়ী পরীক্ষা করতঃ হৃদপিণ্ড , রক্তসংবহন তন্ত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার মত ব্যক্তি সে যুগে একমাত্র তিনিই ছিলেন । তখনকার সময়ে অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্থানে জ্ঞান - বিজ্ঞানের চর্চা কেন্দ্র স্থাপন করা হয় । সেই সময়ে আরবীয়গণ গ্রীস দেশের চিকিৎসা পদ্ধতির সংস্পর্শে আসেন । আরবীয়দের নিকট গ্রীস ইউনান নামে পরিচিত । তাই এ চিকিৎসা পদ্ধতি ইউনানী নামে খ্যাত । ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাহাদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য তাঁহারা হইতেছেন প্রখ্যাত দার্শনিক আবু সিনা ও ইবনে রুশদ । দার্শনিক আবু সিনাই চিকিৎসাশাস্ত্রের রাজপুত নামে পরিচিত । বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৯০ টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন । । তন্মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের “ ক্যালন ” নামক গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য । খৃষ্টীয় বার শতক হইতে সতেরো শতক পর্যন্ত গ্রন্থখানা পশ্চিমী জগতে চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত ছিল । গ্রন্থ খানায় প্রতিটি রোগের বিবরণ প্রাঞ্জল ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে । পীড়ার কারণ , লক্ষণ , দেহস্থ কোষ কলায় রোগজনিত পরিবর্তন , পীড়ার ভাবীফল ও চিকিৎসা বিষয়ে ধারাবাহিক যে বর্ণনা গ্রন্থখানায় পাওয়া যায় অদ্যাবধি সর্বত্র সে পদ্ধতি অবিকৃতভাবে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে । চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে সকল ক্ষেত্রে ইবনে সিনা তাঁহার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সেগুলি হইল থেরাপি , সার্জারি , ট্রমাটোলজী , অনকোলজী , অকথ্যালমোলজী , গাইনোকোলজী , ডারমাটোলজী , এপেডেমিওলজী , প্যারাসাইটোলজী , প্যাথলজী , জিওলজী , ফারমাকোলজী , পেডিয়াট্রিকস , অবসটেট্রিক্স প্রভৃতি । আবূ মিনার মানসিক রোগ চিকিৎসার পদ্ধতি ছিল অভিনব । তাঁহার মনস্তাত্বিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ । চিকিৎসা বিষয়ক অসাধারণ জ্ঞান ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে লেখক , দার্শনিক , শিক্ষক ও কবি । চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ সৃষ্টিকারী এই মহান ব্যাক্তি ১০৩৭ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।



প্রশ্ন -  পাশ্চাত্যে ইবনে সিনা কি নামে পরিচিত । 

উত্তর : পাশ্চাত্যে ইবনে সিনা আভি সিনা নামে পরিচিত । 


প্রশ্ন - ইবনে সিনার পূর্ণ নাম কি । 

উত্তরঃ ইবনে সিনার পূর্ণ নাম আবু আলী আল হুসাইন বিন আবদুল্লাহ ইবনে সিনা । 


প্রশ্ন - প্যারাসেলসাস সম্বন্ধে যাহা জান লিখ । 

উত্তরঃ- প্যারাসেলসার ( ১৪৯০-১৫৪১ খৃষ্টাব্দ ) : ১৪৯০ খৃষ্টাব্দে সুইজ্যারল্যান্ডে প্যারাসেলসাস জন্মগ্রহণ করেন । চিকিৎসার ইতিহাসে তিনি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করেন । শৈশবকালে তাঁহার মাতার মৃত্যুর পর চিকিৎসক পিতার সাহচর্যে তিনি অল্প বয়সেই চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি ভিয়েনা হইতে চকিৎসা বিদ্যায় ডিগ্রী লাভ করেন । বহু দেশ ভ্রমণ করার পর ১৫২৫ খৃষ্টাব্দে তিনি চকিৎসা পেশায় নিয়োজিত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । তৎকালীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে মানবদেহে রোগ সৃষ্টির কারণ হিসাবে ভূত প্রেত , দৈত্য - দানব , অশরীরী শক্তির প্রভাব মনে করা হইত । অথচ এসব অশরীরী শক্তির কোন আলামতের সন্ধান তিনি বহুচেষ্টা করিয়াও পান নাই । তান্ডব রোগ একটি প্রাকৃতিক পীড়া এবং ইহা কোন অশরীরী শক্তির প্রভাবে হয় না বলিয়া তিনি মত প্রকাশ করেন । যেহেতু ইহা প্রাকৃতিক পীড়া তাই ইহার চিকিৎসাও প্রাকৃতিক নিয়মেই হওয়া দরকার বলিয়া তিনি মতামত দেন । যদিও তিনি ভূত - প্রেতের প্রভাব অস্বীকার করেন কিন্তু পীড়ার কারণ হিসাবে চন্দ্রের প্রভাবের ভ্রান্ত বিশ্বাসের মোহ কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই । তাঁহার মতে চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার ভাটাই শুধু হয় না , মানুষের মস্তিস্কের উপরও ইহার প্রভাব অনেক । তিনি মনে করিতেন যে , মানবদেহে একপ্রকার চুম্বক আছে উহার আকর্ষণ শক্তিও আছে । তিনি মোহনিদা চিকিৎসায় এই দৈহিক চুম্বক শক্তি সঞ্চালন পদ্ধতির সমর্থন করেন । পীড়ার নাম করণের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত ধারণার প্রবল প্রতিবাদ তিনি করেন । তিনি বলেন যে ঔষধসমূহ হইতে এই সকল নামের সৃষ্টি হয় না বরং সমনামে সদৃশ সদৃশের সাথেই তুলনীয় । তৎকালে রোগ নামক বস্তুকে ক্রমবর্ধমান ঔষধের পরিমাণ দ্বারা দূর করার ভাবধারা প্রচলিত ছিল । তিনি ভাবধারার ধীরে ধীরে পরিবর্তন সাধন করার প্রচেষ্টা চালান । ঔষধের ওজন বা পরিমান দ্বারা নয় বরং ঔষধ দ্বারাই রোগ দূরীভূত হয় । এই ধারণা প্রদান করেন । মিউনিক সংস্করণের নতুন এক খণ্ড হইতে এই অংশটি উদ্ধৃত " আপনি অবগত হউন যে ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত এইরূপ দ্রব্যের মাত্রা অবশ্যই এত ক্ষুদ্র ও সামান্য হইবে যে ইহা কদাচিৎ বিশ্বাসযোগ্য হইবে এবং অবশ্যই শুধু মদ অথবা অন্য রকম মদের সঙ্গে মিশাইয়া খাইতে হইবে । চিকিৎসা শাস্ত্রের নীতি সম্পর্কে বিবরণীতে রোগ নিরাময় সম্পর্কে তিনি লিখেন যে দর্শন , জ্যোতিষবিদ্যা , রসায়ন ও বিজ্ঞতা এই চারিটি বিষয়ের উপর নিরাময় নির্ভর করে । চিকিৎসা বিষয়ক বাণীর এক স্থানে তিনি লিখিয়াছেন “ চিকিৎসককে প্রকৃতির সেবক হইতে হইবে , শত্রু নয় , প্রকৃতি জীবন রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম চালাইতেছে চিকিৎসককে সেই সংগ্রামকে পথ প্রদর্শন ও সাফল্যমুখী করিতে হইবে । অযৌক্তিক প্রভাব খাটাইয়া প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিলে চলিবে না ।  চিকিৎসক রোগের স্রষ্টাও নহেন , ঔষধের আবিস্কারকও নহেন , কিন্তু রোগ বাড়াইয়া দিতে পারে , আব্বার নিরাময় ও প্রদান করিতে পারেন । এই বিষয়ে প্রকৃতিই তাঁহার শিক্ষক । ঔষধ এবং নিরাময় কৌশল প্রকৃতি প্রদত্ত , চিকিৎসকের নয় । সেই জন্য মুক্তচিত্তে চিকিৎসককে প্রকৃতি হইতে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করিতে হইবে । ” চিকিৎসাশাস্ত্রে প্যারাসেলসাসের অবদান অপরিসীম । তিনি প্রকৃতির সর্বত্র ও ঔষধের আরোগ্য ক্ষমতার ভিতরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন । গ্যালেনের বিসদৃশ চিকিৎসার সাথে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন এবং তাঁহাকে মিথ্যা পদ্ধতি ও তাঁহার অনুসারীগণ রোগের প্রকৃতি বুঝেন না বলিয়া উল্লেখ করেন । অভিজ্ঞতার মূল্য পুথিগত বিদ্যার চাইতে তাঁহার নিকট অনেক বেশী ছিল । চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে প্রকৃতির জ্ঞানের মূল্য অপরিসীম তাহা তাঁহার লেখা হইতে জানা যায় । কথিত আছে , প্রচলিত চলমান ভাবধারায় বিশ্বাসী কতিপয় চিকিৎসকের প্ররোচনায় তাঁহার এই অভিনৰ মতবাদ প্রচারের শাস্তি হিসেবে তাঁহাকে ১৫৪১ খৃষ্টাব্দে পাগলা কুকুর লেলাইয়া দিয়া নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । 



প্রশ্ন - প্যারাসেলসাস ও হ্যানিমানের মতবাদের মিল কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় ? প্যারাসেলসাসের মতবাদকে অমার্জিত হোমিওপ্যাথি বলা হয় কেন ? 

উত্তর : প্যারাসেলসানের মতবাদের সাথে হ্যানিমানের মতবাদের অনেক মিল ছিল । প্যারাসেলসাস চিকিৎসকদের পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করেন । যথা : Naturáles , Specifici , Characterales , Spirituales এবং Fidales । হ্যানিমানের উল্লেখিত Enantiopathy ও Allopathy এর সাথে যথা ক্রমে Naturales Specifici এর মিল আছে । তবে হ্যানিমানের মতে তাঁহার উল্লেখিত Homoeopathy অপর দুইটি পদ্ধতিতে অর্থাৎ Enantiopathy a Allopathy তে রোগী আরোগ্য হইতে পারে না । অথচ প্যারাসেলসাসের মতে সকল শ্রেণীর চিকিৎসাতেই যে কোন পীড়া আরোগ্য হয় ।

হ্যানিমানের ন্যায় প্যারাসেলসাসও এক ব্যবস্থাপত্রে নিম্ন বা একাধিক ঔষধ প্রয়োগের বিরোধিতা করিতেন । চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেভাবে পীড়াকে শ্রেণী বিভাগ করা হইয়াছে হ্যানিমানের ন্যায় প্যারাসেলসাসও তাহার বিরোধিতা করিয়াছেন । প্যারাসেলসাসের মতে যে ঔষধের সাহায্যে জন্ডিস সৃষ্টি হয় বা পক্ষাঘাত দূর হয় . ঐ ঔষধই জন্ডিস দূর করে বা পক্ষাঘাত সৃষ্টি করিতে পারে । এই কথার সাথে হ্যানিমানের সদৃশনীতি মিল দেখা যায় । প্যারাসেলসাস হ্যানিমানের মত ঔষধের ক্ষুদ্র মাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন । ঔষধ শক্তিকে ঔষধবস্তু হইতে পৃথক করা যায় বলিয়া প্যারাসেলসাস মনে করিতেন প্যারাসেলসাস বিশেষ বিশেষ রোগে বিশেষ বিশেষ ঔষধ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন । আপাততঃ ইহাকে খাঁটি হোমিওপ্যাথিক বলিয়া মনে হইলেও হ্যানিমান যে অর্থে রোগীর বিশেষত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন রোগে সদৃশ স্পেসিফিক ঔষধ প্রয়োগের বিষয় বলিয়াছেন সেই অর্থে প্যারাসেলসাস কিছু আলাদা ছিলেন । প্যারাসেলসাস হ্যানিমানের ন্যায় ঔষধের মুখ্য ও গৌন ক্রিয়া সম্বন্ধে জানিতেন । ঘ্রাণের সাহায্যে ঔষধ প্রয়োগের নিয়মটি হ্যানিমানের পূর্বেই তিনি প্রচলন করিয়াছেন । যদিও প্যারাসেলসাসের সহিত হ্যানিমানের অনেক মিল ছিল , যদিও গ্যারাসেলসাস তাঁহার আপনজনের উপর ঔষধের শরীর বিধানিক ক্রিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চাহিয়াছিলেন , যদিও প্যারাসেলসাস বিশ্বাস করিতেন “ যেই ঔষধ জন্ডিস সৃষ্টি করে তাহা আবার জন্ডিস দূরও করে ” - তবুও তিনি ছিলেন প্রাচীন মতাদর্শের অনুসারী । কারণ তিনি রোগীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করিতেন না । পীড়িত অংগেরই বিবেচনা করিতেন । সুস্থ দেহের উপর প্রুভিং করিয়া তাঁহার ঔষধ আবিস্কার হয় নাই , রুগ্ন ব্যাক্তির উপর ঔষধ প্রয়োগ করিয়া ক্রিয়া দেখিয়া তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন । সেই কারণে তাঁহার ঐ রোগতাত্ত্বিক জ্ঞান ছিল অস্পষ্ট ও অনির্ভরযোগ্য । প্যারাসেলসাসের পদ্ধতির সহিত হ্যানিমানের মতের অনেকাংশে মিল থাকিলেও এই পদ্ধতিকে হোমিওপ্যাথি বা সদৃশ বিধান বলা চলে না - বড় জোর ইহাকে অমার্জিত হোমিওপ্যাথি বলা যায় । 



প্রশ্ন - এন্টন মেসমারের উপর টিকা লিখ । 

উত্তর : এন্টন মেসমার ( ১৭৫৪-১৮১৫খৃষ্টাব্দ ) ও মেসমার ছিলেন একজন চতুর চিকিৎসক । তাঁহার মতে চুম্বকের প্রভাবের তারতম্যের ফলেই মানুষের সুস্থতা ও অসুস্থতা সৃষ্টি হয় । তাঁহার মূল বক্তব্য এই যে “ প্রত্যেক মানুষের দেহে চুম্বক শক্তি নিহিত আছে , যাহা রোগীদেহে সঞ্চালনের মাধ্যমে রোগ আরোগ্য করা সম্ভবপর ।  তাঁহার এই মতবাদ দ্বারা প্যারাসেলসাসের চান্দ্র প্রভাব মতবাদের বিশেষ উন্নতি লাভ হয় । ফ্রান্সের রাজধানীতে মেসমার সাহেব একটি ক্লিনিক খোলেন এবং জৈব চুম্বক শক্তির দ্বারা রোগ চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন । কিন্তু প্রকৃত আরোগ্য সাধিত না হওয়ায় তাঁহার সমসাময়িক চিকিৎসকগণ ভন্ড বলিয়া তাঁহাকে প্রত্যাখান করেন । যাই হোক তাঁহার চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু অনেক দিন যাবত একটা বিতর্কিত বিষয় হিসেবে স্থান লাভ করে । 



প্রশ্ন -  বিজ্ঞানমুখী যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আলোচনা কর । 

উত্তর : অষ্টাদশ শতাব্দী বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগ । দৈত্যদানব , ভূতপ্রেত ও অশরীরী শক্তির প্রভাবের ধারণা ধীরে ধীরে লোপ পাইতে থাকে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধীরে ধীরে উন্নতি সাধিত হইতে থাকে । এই যুগে প্রি - মেডিকেল বিষয় রসায়ন , পদার্থবিদ্যা , জীববিদ্যা , উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতির উন্নতি ঘটে । হিপোক্রেটিস বিসদৃশ বিধান এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় , যাহা বর্তমানে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নামে পরিচিত । মুসলিম যুগে গ্রীস ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলি আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয় , ফলে সারা মুসলিম জাহানে ইহা ছড়াইয়া পড়ে । খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান চর্চাকেন্দ্র স্থাপিত হয় । গ্রীস দেশের সংস্পর্শে আরব্য চিকিৎসা পদ্ধতির ইহাতে দ্রুত উন্নতি ঘটে । এই যুগে রোমীয় সেলসাস নামক জনৈক চিকিৎসক অস্ত্রোপচার বিষয়ক আশ্চর্যজনক কিছু তথ্য যেমন টনসিল উৎপাটন , অস্ত্রবৃদ্ধি বিষয়ক তথ্য , মুখমণ্ডলের জটিল পুনর্গঠন প্রভৃতি বিষয়ক লেখাগুলি হিপোক্রেটিসের তথ্যাবলীর সমকক্ষ । প্যারাসেলসাস চিকিৎসা শাস্ত্রে দার্শনিক বিবৃতি প্রদান করেন । যদিও প্রেতবাদ , ডাইনিবাদ প্রভৃতি স্থানে রোগের যুক্তিসংগত কারণ ধীরে ধীরে গৃহিত হইতে থাকে , তথাপি প্রাচীনপন্থীরা কল্পিত রক্তাধিক্যকে সমস্ত রক্তস্রাব ও প্রদাহের প্রধান স্থুল কারণ বলিয়া শিংগা লাগানো , শিরাকাটা , জোঁকের সাহায্যে রক্ত মোক্ষনের ন্যায় নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে যুক্তিসংগত চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে চালাইতে থাকে । এই সময়ে তিন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে - এলোপ্যাথিক , আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী । একমাত্র রাষ্ট্রীয় সাহায্যপুষ্ট এলোপ্যাথিক চিকিৎসাই বিজ্ঞানমুখী হইয়া শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে । এই যুগে বিভিন্ন সময় যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয় তাহা নিম্নে দেওয়া হইল।১৫৩১ খৃষ্টাব্দে ফ্রাসটরিয়াস যিনি এপিডেমিয়লজির জনক নামে পরিচিত তিনি ছোঁয়াচের দ্বারা রোগী হইতে সুস্থ দেহে রোগ সংক্রমণের তত্ত্ব প্রকাশ করেন । ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে রয়েল কলেজ অব সার্জন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৫৪১ খৃষ্টাব্দে প্যারাসেলসাস গ্যালেনের পুস্তক পোড়াইয়া ফেলেন এবং চিকিৎসা শাস্ত্র হইতে কুসংস্কার ও গোড়ামি অপসারণের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহন করেন । ১৫৫৫ খৃষ্টাব্দে ভেসিলিয়াস বহু শব ব্যবচ্ছেদ করেন এবং শরীর বিদ্যায় গ্যালেনের ভুলত্রুটি দেখাইয়া দেন । ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে আধুনিক শল্যবিদ্যার জনক অ্যামব্রোজ প্যারে সাজারী চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পুনর্জীবিত করেন । ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে লিউয়েন হয়েক অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিস্কার করেন । 



প্রশ্ন - বৈজ্ঞানিক যুগের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আলোচনা কর । 

উত্তর  ঃ অষ্টাদশ শতাব্দীকেই বিজ্ঞানের যুগ বলা যাইতে পারে । এই যুগে চিকিৎসা বিদ্যার ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফলে এক বিপবাত্মক পরিবর্তন সাধিত হয় । এইযুগের আবিষ্কারগণ ছিলেন লুইপাত্রর , নিউটন , ক্যাভেন্ডিস , ল্যাভয়সিয় , কক প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ । লুই পাস্তুরের জীবাণু আবিস্কার , কক কর্তৃক যক্ষ্মার জীবাণু আবিস্কার , আইজ্যাক নিউটনের পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিস্কার , রসায়ন , জীববিদ্যা ও উদ্ভিদ বিদ্যার ব্যাপক উন্নতি প্রভৃতি চিকিৎসা বিদ্যার উন্নতিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে । হিপোক্রেটিসের বিসদৃশনীতির চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় সাহায্যে পুষ্ট হইলেও সেই সাথে সাথে আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী চিকিৎসা প্রচলিত থাকে । অথচ হিপোক্রেটিসের অন্য দিকে সদৃশনীতির কোন উন্নতি সাধিত হয় নাই । তবে প্রচলিত শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসা বলিতে শুধু এলোপ্যাথিক চিকিৎসাই প্রাধান্য লাভ করে । 



প্রশ্ন - আধুনিক বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের চিকিৎসা সম্বন্ধে আলোচনা কর । 

উত্তর : বিজ্ঞানের যুগে চিকিৎসা বিদ্যার দ্রুত উন্নতি সাধিত হয় । তবে বিসদৃশ পদ্ধতিতে এই এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অগ্রগতির সাথে সাথে এর ব্যর্থতার দিকটিও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল । রোগীর প্রকৃত আরোগ্য সাধন ক্রিয়া বিফল হইল , কষ্ট দুর্দশা লাঘব হয় নাই , নতুন নতুন আবিষ্কার ও মনগড়া সিন্ধান্তের ফলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল । এই অবস্থায় প্রাকৃতিক সদৃশ আরোগ্য বিধানের আবশ্যকতা দেখা দিল । জার্মানীর এক সুসন্তান এলোপ্যাথিক সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ডাক্তার হ্যানিমান অষ্টাদশ শতাব্দীতেই হিপোক্রেটিসের প্রথম পদ্ধতি অর্থাৎ বিসদৃশ পদ্ধতি ব্যর্থ প্রমাণ করিয়া সদৃশ বিধানের সার্থকতা তুলিয়া ধরেন এবং রোগারোগ্যে প্রাকৃতিক বিধানের আবিষ্কার দ্বারা এক নবতর আরোগ্য কলার উদ্ভাবন করেন । এই চিকিৎসা পদ্ধতি হোমিওপ্যাথি নামে খ্যাত । এলোপ্যাথি চিকিৎসায় প্রকৃত আরোগ্য লাভে ব্যর্থতা এবং হোমিও চিকিৎসায় অর্থাৎ সদৃশ বিধানে রোগীর পূর্ণ সুস্থতা ও আরোগ্য লাভের ফলে হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসার বৃদ্ধি পাইতে থাকে । জার্মানী হইতে সারা বিশ্বে ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায় । সৃষ্টি হয় চিকিৎসার এক নব দিগন্ত , প্রত্যয়দীপ্ত সম্ভাবনার যুগ । আধুনিক বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে বর্তমানে হোমিওপ্যাথি, হোমিও এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী এই চারটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত । রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট একমাত্র এলোপ্যাথিক চিকিৎসা । হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যাপকভাবে এলোপ্যাথির ন্যায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা লাভ করিলে চিকিৎসা বিদ্যার শীর্ষে একমাত্র হোমিওপ্যাথি অবস্থান করিবে , ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । 



প্রশ্ন -চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস লিখ । কিভাবে হোমিওপ্যাথির আবিষ্কার হয় বা হ্যানিমান কিভাবে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করেন ? 

উত্তর : আরোগ্য বিজ্ঞানের ইতিহাস মানব জন্মের ইতিহাসের মতই সুপ্রাচীণ । আয়ুর্বেদ , এলোপ্যাথি প্রভৃতি চিকিৎসা পদ্ধতির বয়স তিন হাজার বৎসরেরও অধিক এবং সেগুলি চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত । হোমিওপ্যাথির প্রবর্তন হয় অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালে , ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে । কিভাবে রোগ যন্ত্রণা হইতে মানুষকে মুক্তি দেওয়া যায় , কিভাবে মানুষের দৈহিক ও মানসিক অক্ষমতা দূর করিয়া জীবনকে সুখী ও সুন্দর করা যায় সেটাই মানুষের প্রাচীনতম ভাবনা , আর সেই ভাবনা হইতেই চিকিৎসাশাস্ত্রের উদ্ভব ।  আরোগ্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে সদৃশনীতির বিধান অতি প্রাচীন । প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে সদৃশমতে চিকিৎসা ও বিপরীত মতে চিকিৎসা এই উভয় প্রকার চিকিৎসার সুস্পষ্ট বিধান ছিল । খৃষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে এরিস্টটল ঘোষণা করিয়াছিলেন যে রোগের সাদৃশ্য ও ঔষধের সাদৃশ্যের পরস্পর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল হইল পরস্পর বিনাশ , অর্থাৎ ঔষধের স্বাভাবিক গুণাবলীর বিনাশ এবং রোগের নিরাময় । এলোপ্যাথিক চিকিৎসার আদিগুরু হিপোক্রেটিস সদৃশমতে চিকিৎসার নীতি সমর্থন করিয়া গিয়াছেন । তাঁহার মতে যে ঔষধ যে রোগ উৎপন্ন করিতে পারে সেই রোগ আরোগ্যও করিতে পারে । ইংরেজ চিকিৎসা শাস্ত্রবিদ সিডেনহামের উপদেশ হইল প্রকৃতিকে অনুসরণ করিয়া প্রকৃতি নির্দিষ্ট পথে রোগ নিরাময় কর , নতুবা রোগ শক্তিকে সরাসরি কোন ঔষধ প্রয়োগে নির্মূল কর । কিন্তু এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে কোন বিধিবদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি গড়িয়া উঠে নাই , উপরন্তু বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্বে আবিষ্কারসমূহকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়া এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি অন্য সব চিকিৎসা পদ্ধতিকে ছাড়াইয়া বহু অগ্রসর হইয়াছে । অথচ সদৃশনীতি বিস্মৃতির গহ্বরে হারাইয়া গিয়াছে । কিন্তু এলোপ্যাথিক চিকিৎসা প্রথার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ইহার কিছু বিষময় ফলও অনতিবিলম্বে দেখা যাইতে লাগিল । আজ যে ঔষধ অমোঘ বলিয়া ঘোষিত হইল দুইদিন পর সেটাই মানুষের অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলিয়া পরিত্যক্ত হইল । তাহা ছাড়া যে রোগের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা হইল তাহা হয়ত সারিল , কিন্তু অন্য নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দিতে লাগিল । যন্ত্রণাকাতর যে রোগী চিকিৎসককে বিশ্বাস করিয়া নিজেকে তাঁহার হাতে সমর্পণ করিয়াছে , সেই চিকিৎসকই সুযোগ গ্রহণ করিয়া তাঁহার উপর বিভিন্ন ঔষধ ও তত্ত্বের নিত্য নতুন পরীক্ষা শুরু করিলেন । রুগ্ন মানুষ ঔষধ ও তত্ত্ব পরীক্ষার গিনিপিগের মত মাধ্যম হইয়া দাঁড়াইল । ফলে অনেক বিবেকবান লব্ধ প্রতিষ্ঠ খ্যাতিমান চিকিৎসক এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠিলেন । বিজ্ঞানাচার্য দার্শনিক ও চিকিৎসা শাস্ত্রবিদ স্যামুয়েল হ্যানিমান ছিলেন ইহাদের অন্যতম । তিনি প্রচলিত এই চিকিৎসা প্রথার ভয়াবহ পরিণামের কথা উপলব্ধি করিয়া সখেদে ঘোষণা করিলেন , “ আমি এমন সব ঔষধ প্রয়োগ করছি যেগুলি সম্বন্ধে আমি খুবই কম জানি , এমন দেহে প্রয়োগ করছি যার অন্তর্নিহিত ক্রিয়াধারা সম্বন্ধে বলতে গেলে আমি কিছুই জানি না । অতএব মানুষের চিকিৎসার নামে তার বৃহত্তর অনিষ্ট সাধন করা থেকে অব্যাহতি পেতে হলে এই চিকিৎসাবৃত্তি পরিত্যাগ করা ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর নেই । আমি বিশ্বাস করি আমি যে সমস্ত রোগের চিকিৎসা করছি সেগুলি বিনা চিকিৎসায় থাকলে বর্তমান অবস্থা থেকে ভালো থাকত । ” সেই মহাসত্যের অনুসন্ধানে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করিলেন । তিনি বিশ্বাস করিতেন , যথার্থ আরোগ্য কলার প্রকৃতি হইল বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা মূলক বিজ্ঞান , যেখানে কল্পনামূলক প্রজ্ঞার কোন স্থান নাই । দেশ বিদেশের চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন শাস্ত্রের গবেষণায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন । এমনিভাবে ছয় বৎসর কাটিয়া যাওয়ার পর ১৭৯০ সালটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় সাল । একটি ঘটনা হ্যানিমানের জীবনে নতুন এক সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করিয়া দিল । হ্যানিমান তখন উইলিয়াম কালেনের বিখ্যাত মেটিরিয়া মেডিকা পুস্তকটির অনুবাদ করিতেছিলেন । তিনি লক্ষ্য করিলেন , যে সিঙ্কোনা কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয় , সেই ঔষধই বৃহত্মাত্রায় প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বর সৃষ্টি হয় বলিয়া উলেখ আছে । হ্যানিমান নিজেকে প্রশ্ন করিলেন , তবে কি সদৃশমতে চিকিৎসার দ্বারা রোগ আরোগ্য সম্ভব ? তিনি কম্পিত হৃদয়ে অধিকমাত্রায় সিঙ্কোনা সেবন করেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বিশেষ ধরণের কম্পজ্বর তাঁহাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিল । তিনি বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেলেন । অতঃপর তিনি সিঙ্কোনার সূক্ষ্মমাত্রা সেবন করিয়া রুদ্ধশ্বাসে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন । ধীরে ধীরে যাদুমন্ত্রের মত সমস্ত কষ্টকর উপসর্গ অন্তর্হিত হইয়া গেল । আবার পরীক্ষা করিলেন , না কোন ভুল নাই । এরপর বিভিন্ন ঔষধ নিয়া পরীক্ষা নীরিক্ষা , পর্যবেক্ষণ আর গবেষণা শুরু হইল । অনেকগুলি ঔষধ আর্নিকা , বেলেডোনা , ব্রায়োনিয়া , একোনাইট প্রভৃতি ঔষধ স্থূলমাত্রায় প্রয়োগ করিয়া কষ্টকর উপসর্গ সৃষ্টি হওয়ার পর ঐ ঔষধের সূক্ষ্মমাত্রা প্রয়োগে আশ্চর্যজনক ভাবে সকল উপসর্গ দূরীভূত হইয়া গেল ।  



প্রশ্ন -  চিকিৎসা পদ্ধতির শ্রেণবিভাগ কর । 

উত্তর : চিকিৎসা পদ্ধতির শ্রেণী বিভাগ : প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে বিভিন্ন নামে যত প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল বা আবিস্কৃত হইয়াছে সেইগুলিকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায় । যথা : 

১ ) এলোপ্যাথিক বা হেটেরোপ্যাথি বা অসদৃশ বিধান : এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির জনক ডাঃ হিপোক্রেটিস । যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ লক্ষণ অপেক্ষা ভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টিকারী ঔষধ প্রয়োগ করিয়া চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করা হয় তাহাই এলোপ্যাথিক । এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয় যে সব ঔষধ সুস্থ দেহে এমন রোগলক্ষণ সৃষ্টি করে যাহার সাথে রুগ্নব্যক্তির রোগলক্ষণের কোন সাদৃশ্য থাকে না । যে কোন প্রকার রোগলক্ষণ দূর কবিরার চেষ্টা করা হয় সেখানে বিপরীত পদ্ধতির নীতিরই প্রাধান্য এলোপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকার । সেজন্য ঔষধগুলিকে ২৫ / ৩০ টি শ্রেণীতে ভাগ করা হইয়াছে এবং তাহাদের পূর্বে anti বা ঐ ধরনের কোন শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে । যেমন- anti - toxins , anti - spasmodic , anti periodics , anti - pyretics , anti - acids , anti - septics , tonics , counter - irritants প্রভৃতি । 

২ ) এন্টিপ্যাথি বা এনান্টিওপ্যাথি বা বিপরীত চিকিৎসা পদ্ধতি  ঃ এন্টিপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন গ্যালেন । এন্টিপ্যাথির অর্থ হইল , ' বিপরীত ক্রিয়াশীল বা বিরুদ্ধ রোগ বা দুর্ভোগ ' । এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর রোগ লক্ষণের বিপরীত অবস্থা সৃষ্টিকারী ঔষধের সাহায্যে চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করা হয় । এন্টিপ্যাথি বা এনান্টিওপ্যাথির বা উপশমদায়ক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর একটি মাত্র যন্ত্রণাদায়ক রোগলক্ষণ বাছিয়া নেওয়া হয় এবং এমন ঔষধ প্রয়োগ করা হয় যাহা রোগ লক্ষণের বিপরীত লক্ষণ সৃষ্টি করিতে পারে এবং ইহাতে দ্রুত উপশম বোধ হয় । যেমন বেদনায় আফিম প্রয়োগ , কোষ্টবদ্ধতায় জোলাপ , অনিদ্রায় আফিম প্রয়োগ প্রভৃতি ।

৩ ) আইসোপ্যাথি বা সমৰিধান  ঃ আইসোপ্যাথির জনক ডাঃ এম লাক্স । ' আইসো " অর্থ সমজাতীয় , আইসোপ্যাথির অর্থ হইল একই বা সমজাতীয় রোগ বা দুর্ভোগ । কোন রোগের জীবাণু দ্বারা সেই রোগেরই চিকিৎসা প্রথাকে আইসোপ্যাথি বলে । কিন্তু স্থুল রোগ জীবাণু ব্যবহারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । এইজন্য ঐ রোগবীজকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শোধিত করিয়া সূক্ষমাত্রায় পরিণত করা হয় । এই অবস্থায় ঔষধটির আর স্থুল রোগ বীজ থাকে না । একটি সদৃশ ঔষধে পরিণত হয় । 

( ৪ ) হোমিওপ্যাথি বা সদৃশবিধান : মহাত্মা হ্যানিমান এই পদ্ধতির জনক । হোমিওপ্যাথির অর্থ সদৃশবিধান । সদৃশনীতির উপরই হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠিত । যে ঔষধ সুস্থদেহে যে ধরণের রোগ সৃষ্টি করে সেইধরণের রোগ সেই ঔষধেই আরোগ্য করিতে সক্ষম । সদৃশনীতি বাস্ত ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত , এইজন্য হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রকে অভিজ্ঞতালব্ধ চিকিৎসা শাস্ত্র বলা হয় । হোমিওপ্যাথি রোগের চিকিৎসা করে না , সমগ্র রোগীকেই চিকিৎসা করে । 

৫ ) বায়োকেমিক চিকিৎসা : জার্মানীর বিখ্যাত চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ডাঃ সুসলার বায়োকেমিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন । তাঁহার মতে মানব দেহের কোষের মধ্যে যে অজৈব পদার্থসমূহ আছে সেগুলির ঘাটতির দরুনই নানা রকম ব্যাধির সৃষ্টি হয় । কাজেই অজৈব পদার্থের ঘাটতি ঔষধ আকারে প্রয়োগ করিলেই রোগ আরোগ্য হয় । এই অজৈব পদার্থ প্রধাণতঃ বারটি বলিয়া তিনি উলেখ করেন । 

৬ ) আয়ুর্বেদ চিকিৎসা : প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানাচার্যগণ কর্তৃক আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্র রচিত । আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সদৃশমতে চিকিৎসা এই উভয় প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে । আয়ুর্বেদ মতে ক্ষিতি , অপ , তেজ মরুৎ , ব্যোম এই পাঁচটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে মানব দেহের তিনটি উপাদান কফ , পিত্ত , বায়ুর সৃষ্টি হইয়াছে । মানব জীবন এই তিনটি উপাদানের সাম্যাবস্থার উপর নির্ভর করে । আয়ুর্বেদে রোগীর পথ্য ও জীবন যাপনের সংযমের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে । 

৭ ) চিকিৎসকের মহান আদর্শ এবং আরোগ্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে হইলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ করা প্রয়োজন । 

৮ ) অনুমানের উপর ভিত্তি না করিয়া প্রমাণ সিদ্ধ চিকিৎসার কৌশল সম্পর্কে এই বিজ্ঞান পাঠে জ্ঞান লাভ করা যায় । 

৯ ) চিকিৎসক নিজেকে কুসংস্কার মুক্ত রাখিতে হইলে অতীত কুসংস্কার সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার এবং সেজন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয় । 



প্রশ্ন -  হ্যানিমানের পূর্ণ নাম কি ? 

উত্তর : হ্যানিমানের পূর্ণ নাম স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিমান ।



প্রশ্ন -  স্যামুয়েল হ্যানিমান কখন এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ? 

উত্তর : স্যামুয়েল হ্যানিমান ১৭৫৫ খৃষ্টাব্দের ১০ ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রিতে জার্মানীর স্যাক্সনীর অন্তর্গত মিসেন নগরে জন্মগ্রহণ করেন । প্রশ্ন -১.২৬ । হ্যানিমানের পিতা ও মাতার নাম কি ? উত্তর : হ্যানিমানের পিতার নাম ক্রিশ্চিয়ান গডফ্রায়েড ও মাতার নাম জোহানা ক্রিশ্চিয়ানা হ্যানিমান । 


প্রশ্ন - হ্যানিমানের পিতা কি কাজ করিতেন ? 

উত্তর : হ্যানিমানের পিতা ছিলেন একজন মৃৎপাত্র চিত্রকর । তিনি চীনামাটির বাসনের উপর চিত্রকার্য করিতেন । 



প্রশ্ন -  হ্যানিমানের জন্মদিন সম্পর্কে মতভেদের কারণ কি ? 

উত্তর : হ্যানিমানের মৃত্যুর পর হইতেই জন্মদিন সম্পর্কে মতভেদ দেখা দিয়াছে । কেহ কেহ বলেন ১০ ই এপ্রিল , আবার কেহ বা বলেন ১১ ই এপ্রিল । ১০ ই এপ্রিলের পক্ষে যুক্তি হইল হ্যানিমান তাহার আত্মজীবনীতে লিখিয়াছেন “ I was born on April 10 , 1755 " সমগ্র জীবদ্দশায় তিনি ১০ ই এপ্রিল জন্মদিন পালন করিয়াছেন । অপরদিকে গীর্জা রেজিষ্টারের রেকর্ডে দেখা যায় “ Christian Friedrich Sammuel Hahnemann born on early morning of the 11th April , 1755 ” . ওয়াশিংটনে হ্যানিমানের স্মৃতিস্তম্ভে তাঁহার জন্মদিন ১১ ই এপ্রিল বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে । হ্যানিমান তাঁহার আত্মজীবনীতে জন্মদিনের উল্লেখ করিয়াছেন কিন্তু জন্মসময়ের উল্লেখ করেন নাই । তাঁহার কন্যা বলিয়াছেন যে , প্রায় মধ্যরাতি ১২ টার সময় তিনি জন্মগ্রহণ করেন । এই প্রায় মধ্যরাত্রি ১২ টা জন্মসময় বলায় সঠিক জন্ম তারিখ অবগত হওয়া যায় নাই । গীর্জা রেজিষ্টারে early morning of the 11th April বলা থাকায় উভয় বক্তব্যের মধ্যে এক ঘন্টা সময়ের তারতম্য লক্ষ্য করা যায় । তাই তাঁহার জন্ম তারিখ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে । 



প্রশ্ন - হ্যানিমানের বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বর্ণনা দাও । 

উত্তর  ঃ বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন ( ১৭৫৫-১৭৭৯ ) খৃষ্টাব্দ )  ঃ হ্যানিমানের পিতা চিনামাটির বাসনের উপর চিত্রকার্য্য করিয়া জীবিকা উপার্জন করিতেন বটে কিন্তু তিনি ছিলেন জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি অনুসন্ধিৎসু । তাই তিনি ৫ বৎসর বয়স্ক হ্যানিমানকে প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময়ে চিন্তা করিতে শিক্ষা দিতেন এবং উপদেশ দিতেন । সকল বিষয়ই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে , পরে যেটি সত্য তাহা গ্রহণ করিবে । ১২ বৎসর বয়সে তিনি মাষ্টার মুলারের নিকট গ্রীক ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন । মিসেন বেসরকারী বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি স্বহস্তে নির্মিত মৃত্তিকার প্রদীপ জ্বালাইয়া গোপন পাঠাভ্যাস করিতেন । এই সময়ের মধ্যে তিনি মিসেন ল্যাটিন স্কুল , টাউন স্কুল ও প্রিন্সেস স্কুল প্রভৃতি স্কুলে অধ্যয়ন কালে গ্রীক , হিব্রু , আরবী , ল্যাটিন প্রভৃতি ১১ টি ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন । অতঃপর ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে মাত্র ২০ টি থ্যালার ( জার্মান মুদ্রা ) সম্বল করিয়া লিপজিগের পথে যাত্রা করেন এবং বিশ বৎসর বয়সে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন । এই সময় তিনি কয়েকখানি ইংরেজী পুস্তক জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন । তৎপর ভিয়েনা নগরের লিওপোল্ড চিকিৎসালয়ে শিক্ষা লাভ করেন । তিনি তাঁহার ধীশক্তি , অসাধারণ অধ্যবসায় ও চারিত্রিক সরলতার দ্বারা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক ও চিকিৎসক ডাঃ কোয়ারিনের প্রধান শিষ্য হইয়া উঠিয়াছিলেন । ডাঃ কোয়ারিনের কৃপাদৃষ্টির ফলে ট্রানসেলভ্যানিয়ার শাসনকর্তার তিনি চিকিৎসক নিযুক্ত হন এবং তখনকার পুস্ত কাগারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন । এইখানে নিযুক্ত থাকিবার সময় তিনি ল্যাটিন ভাষায় " আক্ষেপিক পীড়ার কারণ তত্ত্ব ও ঔষধ প্রণালীর বিবেচনা ” নামক একটি চিকিৎসাবিষয়ক প্রবন্ধ লিখিয়া মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী এম , ডি উপাধি প্রাপ্ত হন । 



প্রশ্ন - হ্যানিম্যানের এলোপ্যাথিক চিকিৎসাজীবনের বর্ণনা দাও । 

উত্তর : এলোপ্যাথিক চিকিৎসা জীবন ( প্রাক - হোমিওপ্যাথি ) ১৭৮০-১৭৯০ খৃষ্টাব্দ : ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ছাত্র অবস্থাতেই হ্যানিমান ট্রানসিলভ্যানিয়ার গভর্ণরের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন । পাস করা এম , ডি ডিগ্রীধারী চিকিৎসক হিসেবে জার্মানীর ম্যানসফিল্ড রাজ্যের হেটস্টেড শহরে সর্বপ্রথম চিকিৎসা আরম্ভ করেন । ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে দেশৌ নগরের জনৈক ঔষধ ব্যবসায়ীর কন্যা হেনরিয়েটা কুচলেরিনের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ড্রেসডেন শহরে রাজকীয় হাসপাতালে প্রতিনিধি চিকিৎসকের পদপ্রাপ্তি , ডাঃ ওয়াগনারের নিকট ভেষজগুণ শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মের মধ্যে এই দশক পরিপূর্ণ । এই দশকেই তিনি চিকিৎসা ব্যবসায়ের যশঃশিখরে আরোহণ করেন । ১৭৮১ খৃষ্টাব্দের শেষ দিকে তিনি গোমেরনে জেলা মেডিক্যাল অফিসার নিযুক্ত হন । চিকিৎসা ব্যবসায় আত্মনিয়োগের সময় হইতে প্রচলিত পদ্ধতির উপর তাঁহার সন্দেহ গাঢ় হইতে থাকে । তাই এই চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করিয়া সাহিত্য ও রসায়ন শাস্ত্র আলোচনা করিবার মনস্থ করেন । তিনি তৎকালীন রসায়নবিদগনের অনেক মতবাদ খণ্ডন করিয়া নতুন নতুন গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রণয়ন করেন । এই সময়ে রসায়ণ শাস্ত্রেরে উন্নতির জন্য নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করেন । তাঁহার আবিষ্কারের মধ্যে ' মদ্য পরীক্ষণ পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য । ১৭৮৫ খৃষ্টাব্দে তিনি ড্রেসডেনে আসেন এবং এখানে তিনি শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন ও চিকিৎসা আইন বিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন । এই সময় এলোপ্যাথির প্রতি তাঁহার আরও বিরাগ জন্মে এবং তিনি এই বিষয়ে তাঁহার অভিজ্ঞতা ও মতামত “ আর্সেনিকের বিষ ক্রিয়া , তার চিকিৎসা ও বিচার বিভাগীয় সত্য উদঘাটন ” , “ পচন নিরোধক একটি অস্বাভাবিক শক্তিশালী ঔষধ ” প্রভৃতি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । ১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের পর তিনি লিপজিকে চিকিৎসা শুরু করেন । এই সময়ে “ যৌন রোগে সার্জনদের প্রতি নির্দেশনা " পুস্তিকা প্রকাশিত হয় এবং " সিফিলিস প্রসঙ্গে ” প্রবন্ধে সিফিলিসে পারদের সূক্ষ্মমাত্রা ব্যবহারের নির্দেশ দেন । এলোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে হ্যানিমান ছিলেন একনিষ্ঠ , জ্ঞানী , প্রগতিশীল ও অত্যন্ত সফল চিকিৎসক । এই সময় তিনি ডাঃ কালেন সাহেবের , যিনি একজন অভিজ্ঞ বক্তা প্রতিভাবান রসায়নবিদ , এডিনবার্গের প্রখ্যাত অধ্যাপক এবং মেটিরিয়া মেডিকা বিষয়ে অথরিটি মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদের সময় হঠাৎ দেখিতে পাইলেন যে , যে কুইনাইন জ্বর রোগে বিশেষ উপকারী অথচ সেই কুইনাইন সুস্থশরীরে সেবন করিলে জ্বর রোগীর কতগুলি লক্ষণ সৃষ্টি করিতে সক্ষম । সুতরাং সুস্থ শরীরে কোন ঔষধ সেবন করিণে যে যে লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায় যদি কোন পীড়ায় বা অসুস্থ শরীরে ঐ লক্ষণসমূহ বর্তমান থাকে তবে এই ঔষধ সেবন করিলে উক্ত অসুস্থ শরীরের লক্ষণসমূহ অন্ত হিত হইয়া শরীর রোগ মুক্ত হইবে । এই চিন্তা করিযা মহাত্মা হ্যানিমান প্রথমেই কুইনাইন নিজ শরীরে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন , তৎপর তিনি পারা , ধুতরা , গন্ধক ইত্যাদি ঔষধ পরীক্ষা করিয়া প্রথমে নিজ পারিবারিক লোকসমূহের উপর চিকিৎসা করিতে লাগিলেন এবং ইহাতে আশাতিরিক্ত ফল লাভ করিয়া ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে তাঁহা এই চিকিৎসা প্রণালী জগৎবাসীর নিকট প্রচার করিলেন যাহা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি নামে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে । 



প্রশ্ন - হ্যানিমানের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাজীবন আলোচনা কর । 

উত্তর : হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জীবন ( ১৭৯১-১৮৪০ খৃষ্টাব্দ ) : ১৭৯১ খৃষ্টাব্দ হইতে মূলতঃ হ্যানিমানের চিকিৎসা জীবন শুরু হয় । এই সময় তিনি তাঁহার নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতির জন্য গবেষণায় নিমগ্ন হইলেন । তাঁহার গবেষণার প্রবন্ধ " Medicine of Experience " হপল্যান্ডস জার্নাল নামক সাময়িকীতে প্রকাশ করেন এবং ইহার কিছুদিন পর তিনি তাঁহার শিষ্যবর্গ যে সমস্ত ঔষধ নিজ নিজ শরীরে পরীক্ষা করিয়াছিলেন সেইগুলির লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করিয়া “ মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা ” নামক বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন । ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে তিনি অর্তেস্থল এর পাগলা গারদের চিকিৎসকের পদ প্রাপ্ত হন । সেখানে তিনি নিষ্ঠুর ও পাশব চিকিৎসার স্থলে সহৃদয় ও মিষ্ট স্বভাবের দ্বারা লাক্ষণিক চিকিৎসা করিয়া আশতীত ফল লাভ করেন । ১৭৯২ খৃষ্টাব্দের শেষ দিকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করিলেও ১৮০৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত একই সময়ে হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করিতেন এবং এর পর হইতে পুরাপুরি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন । ১৭৯৩ খৃষ্টব্দে তিনি ওয়ালসেলভেন নামক স্থানে গমন করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে এ স্থান ত্যাগ করেন । এই সময় তিনি পরবিট উলবেন , কেনিগশ্লাটার প্রভৃতি স্থানে গমন করেন ও হোমিওপ্যাথিক সম্বন্ধে তথ্যবহুল পুস্তক রচনা করেন । ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে “ ঔষধের আরোগ্যকারী শক্তি নির্ধারণের নতুন নিয়মনীতি এবং পুরানো নিয়মনীতি সম্পর্কে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন এবং তাঁহার এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিকে সর্বপ্রথম “ হোমিওপ্যাথি ” নামে আখ্যায়িত করেন । এই সময় হ্যানিমান রক্তমোক্ষণকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা ও মানসিক রোগীর চিকিৎসায় নির্যাতনমূলক পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন । ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে কেনিগশ্লাটারে আরক্ত জ্বর বহুব্যাপক হারে প্রকাশ পাওয়ায় এবং তাহাতে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিতে আশানুরূপ ফল পাওয়ায় বিপক্ষ দল কর্তৃক নির্যাতিত হইয়া হামবার্গ গমন করেন । আরক্ত জ্বরের প্রতিকারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করিবার জন্য তিনি চেষ্টা করিতে লাগিলেন । “ বেলেডোনা ” নামক ঔষধটি উপযোগিতার সহিত ব্যবহৃত হইতে লাগিল । ১৮০২ খৃষ্টাব্দে তিনি হামবার্গে অবস্থান করেন । কিন্তু হামবার্গেও তিনি বেশী দিন থাকিতে পারেন নাই । মৌসেন গমন করেন , পরে ইলেনবার্গে যান । তৎপর মাতৃভূমি দর্শনের জন্য পুনরায় স্বদেশে যান । সেখানকার হেলথ অফিসার কর্তৃক বিতাড়িত হইয়া তিনি ম্যাচার্ন নামক গ্রামে যান । পরে তিনি ম্যাচার্ন হইতে উটেনবার্গ ও পরে দেশউ গমন করেন । অবশেষে সেখান হইতে বিতাড়িত হইয়া টারগাউ গমন করেন । টারগাউ এ অবস্থানকালে ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে তিনি হেলারের ভেষজতত্ত্ব গ্রন্থের অনুবাদ করেন ও “ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ” নামক চিকিৎসা পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ১৮১০ খৃষ্টাব্দে “ অর্গানন অব মেডিসিন ” নামক পুস্তক রচনা করেন । এই সময় কয়েকজন চিকিৎসক তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । ১৮১১-১৮২০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তিনি লিপজিগ শহরে যাইয়া প্রকাশ্যভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করেন । বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তির জন্য লিপজিগে তাঁহার সম্মান বর্ধিত হয় । কিন্তু পুনরায় এলোপ্যাথিক চিকিৎসকগণের ষড়যন্ত্রে রাজরোষে পতিত হন । ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে তিনি জটিল ও পুরাতন রোগ গবেষণায় নিমগ্ন হন । ১৮২০ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মের মত মাতৃভূমি ত্যাগ করিয়া আনহ্যান্টকিথেন নামক নগরে গমন করেন । ১৮২১ খৃষ্টাব্দে তিনি আনহ্যান্টকিথেন নগরীর বিউক কর্তৃক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করিয়া সনদ প্রাপ্ত হন । ১৮২২ খৃষ্টাব্দে তিনি কিথেনের হফরাথ অর্থাৎ কোর্টের কাউন্সিলার উপাধি প্রাপ্ত হন । এই সময় হইতেই হোমিওপ্যাথির জয়যাত্রা শুরু হয় । বহু এলোপ্যাথিক চিকিৎসকের হোমিওপ্যাথির উপর ভক্তি বাড়িতে থাকে । এই সময় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ডাক্তার কোয়েন হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমাণ করিতে আসিয়া মহাত্মা হ্যানিমানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং স্বদেশে ফিরিয়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করেন । এইভাবে ইংল্যান্ডে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রসার ঘটে । ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে তিনি ক্রনিক ডিজিজেস ’ নামক গ্রন্থটি ৪ খন্ডে প্রকাশ করেন । ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে কেবল মাত্র সংবাদপত্রে কলেরা লক্ষণ সমূহ পাঠ করিয়া হোমিও মতে উহার চিকিৎসা প্রচার করিয়া এবং সেই মতে বহুরোগী আরোগ্য হওয়াতে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অসারতা আর একবার প্রমান করেন । ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে তাঁহার সুখ দুঃখের সঙ্গীনি হেনরিয়েটার জীবনাবসান ঘটে । ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি হোমিও মতে “ কলেরা রোগের চিকিৎসা ” নামক পুস্তক রচনা করেন । ১৮৩৪ খৃষ্টাব্দে আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার হেরিং হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমান করিতে আসিয়া তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং স্বদেশে গমন করিয়া হোমিওপ্যাথিক কলেজ , হাসপাতাল প্রভৃতি স্থাপন করেন এবং এইভাবে আমেরিকায় হোমি প্যাথিক চিকিৎসার প্রসার ঘটে । । ভিন্ন সহযোগী চিকিৎসককে নিয়া হ্যানিমান “ লিপিজিক হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল ও শিক্ষা কেন্দ্র " প্রতিষ্ঠা করেন । হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপক সাফল্য সংগঠন , সভা - সমিতি , বই ও প্রবন্ধের দ্বারা দেশ বিদেশে হোমিওপ্যাথির বিপুল প্রচার , প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হন । 



প্রশ্ন - হ্যানিমানের দাম্পত্য জীবনের উপর আলোকপাত কর । 

উত্তর : দাম্পত্য জীবন ( সাংসারিক জীবন )  ঃ ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমান দেশাউ নগরের ঔষধ বিক্রেতা কুচলারের কন্যা জোহানা হেনরিয়েটা কুচলারকে বিবাহ করেন । তাঁহার গর্ভে ১১ টি সন্তান জন্মগ্রহণ করে । তাহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হইল 

( ১ ) হেনরিয়েটি ( ১৭৮৩- * ) হ্যানিমানের প্রথমা কন্যা । তাহার গর্ভে ২ পুত্র ও ২ কন্যা জন্মগ্রহণ করে । ( ২ ) ফ্রেড্রিক ( ১৭৮৬- * ) হ্যানিমানের প্রথম পুত্র । বাল্যকালে রিকেট হেতু এই পুত্রের বুক উঁচু ও মেরুদণ্ড বক্র হইয়া যায় । চিকিৎসা শাস্ত্রে তিনি এম , ডি ডিগ্রী প্রাপ্ত হন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন । ফ্রেড্রিক তাঁহার পিতার সাথে বহু ঔষধ প্রুভ করেন । ১৮২৮ সালের পর তাঁহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই । 

( ৩ ) ভিলহেলমিনি ( ১৭৮৮-১৮১৮ ) হ্যানিমানের দ্বিতীয়া কন্যা । তাঁর গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্মে । 

( ৪ ) অ্যামেলি ( ১৭৮৯-১৮৫৭ ) হ্যানিমানের তৃতীয় কন্যা । তাহার প্রথম বিবাহ হয় ডাঃ লিওপোল্ডসাসের সাথে । তার ঔরসে লিওপোল্ডসাস হ্যানিমান নামে এক পুত্র সন্তান জন্মে যিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন । অ্যামেলি পরে লিবে নামক এক মিল পরিদর্শককে বিবাহ করেন । 

( ৫ ) ক্যারেলিনি ( * -১৮৩১ ) হ্যানিমানের ৪ র্থ কন্যা । অবিবাহিতা অবস্থায় ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন । 

( ৬ ) আর্নষ্ট ( ১৭৮৪-১৭৯৪ ) হ্যানিমানের দ্বিতীয় পুত্র । শিশু কালেই তিনি দুর্ঘটনায় নিহত হন । ( ৭ ) ফ্রেড্রিকি ( ১৭৯৫-১৮৩৫ ) হ্যানিমানের ৫ ম কন্যা । দুইবার তিনি বিবাহ করেন । নিঃসন্তান এই কন্যা আততায়ীর হাতে মারা যান । 

( ৮ ) হ্যানিমানের ৫ ম কন্যা ফ্রেড্রিকির সাথে তাঁর অপর জমজ কন্যা মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে । ( ১৭৯৫ ) । ( ৯ ) ইলিওনোরি ( ১৮০৩- * ) হানিমানের ৭ ম কন্যা । তিনি দুইবার বিবাহ করেন । দ্বিতীয় স্বামীর নাম ডাঃ উলফ । 

( ১০ ) চার্লোটি ( ১৮০৫-১৮৭৮ ) হ্যানিমানের ৮ ম কন্যা । অবিবাহিতা অবস্থায় মারা যান । 

( ১১ ) লুসি ( ১৮০৬-১৮৭৮ ) হ্যানিমানের ৯ ম কন্যা । হ্যানিমানের সহকারী ডাঃ মসডফের সাথে লুসির বিবাহ হয় । হ্যানিম্নানের প্রথম পত্নী হেনরিয়েটি ছিলেন হ্যানিমানের সমস্ত সুখ - দুঃখের ও দারিদ্র্যময় জীবনের সুযোগ্য সহধর্মিনী । প্রথম জীবনের এই স্ত্রী ১৮৩০ খৃষ্টাব্দের ৩১ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন । তাঁহার কন্যাগণই গৃহকর্মের ভার ও দেখা শোনার ভার গ্রহণ করেন । পাঁচ বৎসর যাবত নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের পর ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারী তিনি ৩২ বছর বয়স্ক ফ্রান্সের মহিলা মাদাম মেলানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । বিবাহের পরই হ্যানিমান প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য চলিয়া যান । মাদাম মেলানী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী , ধনবতী নামকরা কবি । হ্যানিমানের জীবনে সাফল্যের দিনগুলিতে তিনি সার্থকভাবে সঙ্গদান করেন । শেষ জীবনে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করিতেন এবং স্বামীর চিকিৎসা কাজেও সহযোগিতা করেন । মাদাম মেলানীর গর্ভে কোন সন্তান সন্ততি জন্মগ্রহণ করে নাই মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিশ্বস্ততা ও ভালবাসার সহিত মেলানী হ্যানিমানকে সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন । হ্যানিমানের ধূমপান করার অভ্যাসটি দ্বিতীয় স্ত্রীর দ্বারাই পরিবর্তন ও দূরীভূত হইয়াছিল । পরিবার পরিজনের প্রতি হ্যানিমানের গভীর ঘনিষ্টতা ও মমত্ববোধ ছিল । ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি কবিতা , ছেলে ভুলানো ছড়া প্রভৃতি লিখতেন । ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দের ২ রা জুন হ্যানিমান তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি কন্যা ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের নামে উইল করিয়া দিয়া যান । 



প্রশ্ন -  ভাষাবিদ , অনুবাদক ও লেখক হিসেবে হ্যানিমানের মূল্যায়ন কর। 

উত্তর : হ্যানিমান ১১ টি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন , যেমন - জার্মান , গ্রীক , ল্যাটিন , ইংরেজী , আরবী , স্প্যানিশ , ইটালিয়ান , হিব্রু , সিরিয়াক , ফ্রান্স এবং চ্যালাডিয়াক । মিসেনে পাঠ্যাবস্থা তিনি নিম্নশ্রেণীর ছাত্রদের গ্রীক ভরা শিক্ষা দিতেন । লিপজিকে পাঠ্যাবস্থায় তিনি রাতে ধনী গ্রীক সম্ভনাদের জার্মান ও ফ্রান্স ভাষা শিক্ষা দিতেন । হিপোক্রেটিস হইতে শুরু করিয়া আড়াই হাজার বছরের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস হ্যানিমান বিভিন্ন ভাষায় পড়েন এবং তাহার বিশেষণ করেন । হ্যানিমান একজন নামকরা অনুবাদক ছিলেন । বিজ্ঞান , রসায়ণ , চিকিৎসা বিজ্ঞান , দর্শন , কৃষিবিদ্যা সাহিত্যকর্ম বিষয়ে বিভিন্ন ভাষা হইতে তিনি জার্মান ভাষায় বহু বই পত্র অনুবাদ করেন । লিপজিকে অবস্থান কালে হ্যানিমান কয়েকখানি ইংরেজী পুস্তক জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন । ড্রেসডেনের ডাক্তার ওয়াগনারের সহায়তায় বৈজ্ঞানিক পুস্তকসমূহের অনুবাদকারক ও রাসায়নিক পরীক্ষক হিসেবে তিনি প্রচুর খ্যাতি লাভ করেন । ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত স্কচ ডাক্তার উইলিয়াম কালেনের মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদ করেন এবং পুস্তক প্রকাশক ক্লিনারের ঔষধের ব্যবস্থাপত্র সম্বলিত একটি ইংরেজী পুস্তকের অনুবাদ করেন । ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ভন হেলারের ভেষজতত্ত্ব গ্রন্থের অনুবাদ করেন । “ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ” নামক চিকিৎসা পত্রিকা প্রকাশ করেন । তাঁহার প্রতিটি অনুবাদেই অনুবাদক হিসেবে তাঁহার প্রয়োজনীয় মন্তব্য , ব্যাখ্যা ও অনুবাদকের ভূমিকা উলেখ করিতেন যা কোন সময় মূল লেখা হইতেও অধিক আকর্ষণীয় ও সমাদর লাভ করিত । ১৭৯০ সালে উইলিয়াম কালেনের ইংরেজীতে লেখা “ এ ট্রিয়েটিস অন দি মেটিরিয়া মেডিকা ” এর দ্বিতীয় খন্ড অনুবাদ কালে তিনি “ হোমিওপ্যাথি আরোগ্যনীতি ” আবিষ্কার করেন ।  ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮৪৩ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন অসংখ্য মৌলিক রচনা , বই , পত্র পত্রিকা ও প্রবন্ধ রচনা করেন । গোমরান ধর্ম মন্দিরের চিকিৎসক থাকাকালীন তিনি “ পুরাতন ক্ষত চিকিৎসা ” নামক পুস্তক প্রণয়ন করেন । পুরাতন চিকিৎসা প্রণালীতে আস্থাহীন হইয়া “ চিকিৎসা শাস্ত্রের পুনঃজন্মের প্রয়োজন ” শীর্ষক এক পত্র লেখেন । ট্রানসেলভেনিয়ার শাসনকর্তার চিকিৎসা ও তথাকার পুস্তকাগারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকা কালীন তিনি ল্যাটিন ভাষায় “ আক্ষেপিক পীড়ার কারণ তত্ত্ব ও ঔষধ প্রণালীর বিবেচনা ” নামক একটি চিকিৎসা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখিয়া ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে এম , ডি উপাধি অর্জন করেন । ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে জার্মান ফর দি প্র্যাকটিসিং ফিজিসিয়ান নামক পত্রিকায় ঔষধের শক্তি নির্ণয়ের নতুন প্রথা শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন । উক্ত প্রবন্ধের নিন্দাবাদ হইতে থাকায় তাঁহার প্রবন্ধসমুহ সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক “ জার্মান গেজেট ” প্রকাশিত হয় । ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ফ্রেগমেন্টস ডি ভিরিবাস নামক পুস্তক ল্যাটিন ভাষায় মুদ্রিত করেন এবং সুস্থদেহে ২৭ টি ঔষধ সেবন করিয়া যে সকল লক্ষণ প্রকাশিত হইয়া ছিল তাহাই ইহাতে লিপিবদ্ধ করেন । ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি হুপিল্যান্ডের পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । ১৮১০ খৃষ্টাব্দে “ অর্গানন অব মেডিসিন " গ্রন্থের ১ ম সংস্করণ মুদ্রিত করিয়াছিলেন এবং ইহাতে ২৯১ টি সূত্র প্রকাশ করিয়া বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেন । ১৮১১ খৃষ্টাব্দে “ মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা ” এবং ১৮২১ খৃষ্টাব্দে তিনি “ ক্রণিক ডিজিজেস ” নামক পুস্তক প্রকাশ করেন । 



প্রশ্ন - হ্যানিমানের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বিবরণ দাও । বা , আবিস্কারক হিসাবে হ্যানিমানের অবদান সম্পর্কে বর্ণনা দাও । 

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান জার্মানের একজন উচ্চপদস্থ এলোপ্যাথিক ডাক্তার হিসাবে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার দায়িত্বভার গ্রহণ কালে তিনি যখন বুঝিতে পারিলেন যে এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রথম উপকার হইলেও তাহার পরিণতি ভয়ানক তখন তিনি বড়ই অনুতপ্ত হইলেন । ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে উইলিয়ম কালেনের মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদ কালে দেখিতে পাইলেন পেরুভিয়ান বার্ক বা সিঙ্কোনার ছাল সুস্থ শরীরে সেবন করিলে কম্পজ্বর উপস্থিত হয় আবার সিঙ্কোনাই কম্পজ্বরের মহৌষধ , ইহাই হইল নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি হোমিওপ্যাথিক আবিস্কারের মূল সূত্র । দীর্ঘ ৬ বৎসর ভেষজ ও বিষসমূহের গুণ সুস্থ শরীরে পরীক্ষার দ্বারা অবগত হইয়া তাহা লিপিবদ্ধ করেন । আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম সমমত তিনি আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া দাবী করেন নাই , প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যবহারিক ফল প্রচার করেন বলিয়া দাবী করেন । ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে তিনি ওলাউঠা রোগের উপযোগী ঔষধ প্রচার করেন । তাঁহার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি প্রধান ।
( ক ) সদৃশ বিধানমতে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি । 
( খ ) সুস্থমানবদেহে ঔষধ পরীক্ষা করিয়া ঔষধের কার্যকরী ক্ষমতা ধারণ । 
( গ ) মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি ও নির্যাতন মূলক চিকিৎসার বিরোধিতা । 
( ঘ ) আরোগ্যের ক্ষেত্রে জীবনী শক্তি তত্ত্বের আবিষ্কার । 
( ঙ ) চিররোগ তত্ত্ব আবিষ্কার । 
( চ ) অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ তত্ত্ব আবিষ্কার । 
( ছ ) রোগের চিকিৎসা নয় , রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি । 
( জ ) ঔষধের শক্তিকরণ পদ্ধতি আবিস্কার । 
( ঝ ) ঔষধের শক্তিকৃত ও অবিমিশ্র অবস্থায় সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ । 
( ঞ ) সার্জারিতে ড্রাই ড্রেসিং ও অস্থি চাচন পদ্ধতি । 
( ট ) পারদকে দ্রবীভুতকরণ এবং ইহার উগ্রতাবিহীন প্রস্তুতি ও ব্যবহার । 
( ঠ ) মদে ভেজাল নির্ধারণ পদ্ধতি আবিষ্কার । 
( ঢ ) বিষের ব্যবহার ও সংরক্ষণ বিধি । 
( ড ) ভেষজের জলীয়াংশ নিষ্কাশন , বাস্পীয় পাতন ও পানীয় মাধ্যমে ভেষজের নির্যাসের বাস্পী ভবন ; টাটকা গাছ গাছড়া হইতে আরক প্রস্তুতি । 
( ণ ) ডিসপেনসিং এর বিজ্ঞান ভিত্তিক কলাকৌশল ও প্রয়োগ পদ্ধতি । 
( ৩ ) এন্টিমনিয়েল , সীসা , পারদ , কর্পূর , সাকসিনিক এসিড , সোহাগা প্রস্তুতকরণ সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রদান । 
( থ ) বকযন্ত্রের সংস্কার সাধন । 
( দ ) সোনা , রুপা , ইউরেনিয়াম পাটিনাম প্রভৃতি ধাতু হইতে ঔষধ আহরণ পদ্ধতি । 



প্রশ্ন - মহাত্মা হ্যানিমানের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর । 

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন । সদৃশ বিধান মতে চিকিৎসা প্রণালী প্রচার কালে পদে পদে তাঁহাকে সংগ্রাম করিতে হইয়াছে । এমনকি মিথ্যা অপবাদে তাঁহাকে সরকারীভাবে জরিমানা দিতে বাধ্য করা হইয়াছে । কেহ বা তাঁহাকে হাতুড়ে ডাক্তার বলিয়া ভর্ৎসনাও করিয়াছেন । লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করিয়া এমন কি তাঁহাকে কুচক্রীদের কুচক্রে পড়িয়া দারিদ্রের চরম সীমায় পতিত হইতে হইয়াছে । ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে কোনিগশ্লাটারে আরক্ত জ্বরের নতুন চিকিৎসা পদ্ধাত আশানুরূপ ফল পাওয়ায় বিপক্ষ দল কর্তৃক নির্যাতিত হইয়া তিনি হামবার্গ গমন করেন । রাজকর্মচারীরা হোমিওপ্যাথিক বিরোধী হওয়ায় তিনি ডেমারনে যান কিন্তু সেখানেও সুবিধা করিতে না পারিয়া স্বদেশে গমন করেন । আবার স্বদেশে বিপক্ষ চিকিৎসকগণ বিরুদ্ধাচরন করায় পুণরায় তিনি ডেমারনে গমন করেন । তিনি কোথাও স্থায়ীভাবে থাকিতে পারেন নাই । হামবার্গে তিনি বেশী দিন থাকিতে পারেন নাই । মৌসেন গমন করেন , ইলেনবার্গে যান , তৎপর মাতৃভূমি দর্শনের জন্য পুনরায় স্বদেশে যান । সেখানকার হেলথ অফিসার কর্তৃক বিতাড়িত হইয়া তিনি ম্যাচাৰ্ণ নামক গ্রামে যান । পরে তিনি ম্যাচার্ণ হইতে উটেনবার্গ ও পরে দেশউ গমন করেন । অবশেষে সেখান হইতে বিতাড়িত হইয়া টারগাউ গমন করেন । লিপজিগে অবস্থান কালীন তিনি পুনরায় এলোপ্যাথিক চিকিৎসকগনের ষড়যন্ত্রের রাজরোষে পতিত হন । এত দুঃখ , কষ্ট , অত্যাচার সহ্য করিয়াও তিনি তাঁহার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ মানবকুলের মঙ্গলার্থে সদৃশ বিধান চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচার করিতে পিছপা হন নাই । 



প্রশ্ন — মানুষ হিসাবে হ্যানিমানের বিভিন্ন গুণাবলীর বর্ণনা দাও । 

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান ছিলেন একজন মহান আদর্শ পুরুষ । তিনি সদৃশ বিধান পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়া পৃথিবীর বুকে অমর হইয়া আছেন । পৃথিবীতে যেখানে যত মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হইয়াছিল তাঁহাদের সকলেই ছিলেন নির্মল চরিত্রের অধিকারী ও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অসীম বলে বলীয়ান । হ্যানিমানও ছিলেন চরিত্রবান ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী । তিনি এক জন সাধক পুরুষ এবং আধ্যত্বিক শক্তি সম্পন্ন ব্যাক্তি ছিলেন আমরা তাঁর চিন্তা ধারা ও কর্মের মধ্যে স্পষ্টই বুঝিতে পারি । শৈশবকাল হইতেই তিনি ছিলেন সৎ ধৈর্য্যশীল ও শান্ত স্বভাবের অধ্যয়নশীল জ্ঞান পিপাসু এবং সত্যানুসন্ধিৎসু । তিনি একজন সংগ্রামী , সত্যের প্রতি অবিচল আস্থাশীল , পেশাগত দিক হইতে সচেতন ও একনিষ্ঠ সবধরনের সংস্কার বর্জিত , অক্লান্ত পরিশ্রমী , সাহসী এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতি অসহিষ্ণু । তিনি ব্যাপ্টিষ্ট মতে দীক্ষিত ছিলেন । সমস্ত চিন্তায় ও কর্মে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করিতেন । দর্শনের প্রতি তিনি অধিক গুরুত্ব প্রদান করিয়াছেন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দর্শন ছাড়া চলিতে পারেনা সে কথা তিনি প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন । মার্জিত জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন । ২৫০০ বৎসর পূর্বে ভনহেলারের “ সমবিধান ” সম্বন্ধে চিন্তা ধারার কথা তিনি অকপটে স্বীকার করিয়াছিলেন , ভনহেলারের জীবদ্দশায় তাহা প্রচার করিয়া যাইতে পারেন নাই ঐ সংবাদ হ্যানিমান নিজে প্রচার করিয়াছেন । ইহা হইতেই আমরা তাঁহার চরিত্রের একটা জ্বলন্ত প্রমান পাই যে তিনি কখনও গর্ব বোধ করেন নাই , যাহ সত্য তাহাই তিনি প্রকাশ করিয়াছেন । কোন চিকিৎসা পদ্ধতিকেই তিনি অবহেলা করেন নাই । চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস তিনি এক দুর্লভ ব্যক্তিত্ব । 



প্রশ্ন - রসায়নবিদ ও ঔষধ প্রস্তুতকারক হিসাবে হ্যানিমানের অবস্থান লিখ । 

উত্তর : রসায়নবিদ্যা ও ফার্মেসীতে হ্যানিমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখিয়াছেন । তিনি এই বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আবিষ্কার করেন , অনেক বই প্রবন্ধ রচনা করেন এবং গ্রন্থ অনুবাদ করেন । তৎকালীন রসায়নবিদগনের অনেক মতবাদ খণ্ডন করিয়া নতুন গবেষনামূলক প্রবন্ধ প্রণয়ন করেন । তিনি এন্টিমনিয়াল , সীসক , পারদ , কর্পূর , সাকসিনিক এসিড , সোহাগা ইত্যাদির প্রস্তুতকরণ সম্বন্ধে নতুন তথ্য প্রদান করেন এবং বক যন্ত্রের সংস্কার সাধন করিয়া রসায়ণ শাস্ত্রে অদ্ভূত পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেন । তাঁহার আবিষ্কারের মধ্যে “ মদ্য পরীক্ষণ পদ্ধতি ” যাহা আজকালকার রসায়ণবিদগনও পরীক্ষাগারে ধাতু পরীক্ষণ হিসেবে ব্যবহার করেন , বিশেষভাবে উলেযোগ্য । তাহা ছাড়া ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সোডা তৈরির সহজ পদ্ধতি , ঔষধের পচন নিবারণ প্রক্রিয়া , পারদের দ্রবন , সোনা রুপা , ইউরেনিয়াম , পাটিনাম ইত্যাদি ধাতু হইতে ঔষধ আহরণ গদ্ধতি রসায়ন শাস্ত্রে মহাত্মা হ্যানিমানের এক বিশেষ অবদান । প্রশ্ন -১.৩৮ । হ্যানিমান রচিত হোমিও গ্রন্থাবলী কি কি এবং কতসালে সেগুলি প্রকাশিত হইয়াছে ? উত্তর : হ্যানিমান রচিত হোমিওপ্যাথিক গ্রন্থাবলী : 
১ ) ফ্রাগমেন্টা দ্য ভিরিবাস । প্রকাশকাল ১৮০৫ খৃষ্টাব্দ । 
২ ) অর্গানন অব মেডিসিন । প্রকাশকাল ১৮১০ খৃষ্টাব্দ । 
৩ ) মেটিরিয়া মেডিকা গিউরা । প্রকাশকাল ১৮১১ খৃষ্টাব্দ । 
৪ ) ক্রনিক ডিজিজেস । প্রকাশকাল ১৮২৮ খৃষ্টাব্দ । 
৫ ) রেপার্টিয়াম । প্রকাশকাল ১৮১৭ খৃষ্টাব্দ । 



প্রশ্ন - ফ্রাগমেন্টা দ্য ভিরিবাস সম্পর্কে টিকা লিখ । 

উত্তর : ফ্রাগমেন্টা দ্য ভিরিবাস : সুস্থ মানুষের উপর ঔষধ পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত লক্ষণের উপর ইহাই হ্যানিমানের প্রথম গ্রন্থ । ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে মিঃ জে.এ. বার্থ লিপজিগ হইতে গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন । গ্রন্থখানি দুই অংশে সম্পূর্ণ । প্রথম অংশের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৯ এবং দ্বিতীয় অংশের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৭০। গ্রন্থখানাতে ২৭ টি ঔষধের সুস্থ মানবদেহের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত লক্ষণসমূহ বর্ণনা করা হইয়াছে । গ্রন্থখানি বিশুদ্ধ মেটিরিয়া মেডিকার জন্ম দিয়াছে এবং পরবর্তীকালে সকল মেটিরিয়া মেডিকার অন্যতম উৎস হিসাবে কাজ করিয়াছে । এই গ্রন্থের রেপার্টরী অংশটি ( ২ য় অংশ ) হ্যানিমান রচিত সর্বপ্রথম রেপার্টরী । ২৭ টি ঔষধের পরীক্ষাকালীন যে লক্ষণ দৃষ্ট হইয়াছিল , তাহা সদৃশ্য লক্ষণের রোগীকে ঐ সকল ঔষধ আরোগ্য করিতে সক্ষম । ফ্রাগমেন্টা দ্য ভিরিবাস হোমিওপ্যাথিক নিয়ম নীতির অন্যতম উৎস । 



প্রশ্ন -  হ্যানিমানের অর্গানন অব মেডিসিনের গুরুত্ব , বিভিন্ন সংস্করণের প্রকাশ কাল , প্রকাশ স্থান , নাম শিরোনাম ও সূত্র সংখ্যা লিখ । 

উত্তর : অর্গানন অব মেডিসিন : চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষতঃ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রে মহাত্মা হ্যানিমানের লিখিত অর্গানন অব মেডিসিনের গুরুত্ব অপরিসীম । হ্যানিমানের সময়ে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির অবৈজ্ঞানিকতা , ক্ষতিকর প্রভাব , অনিয়মতান্ত্রিকতা , অনুমান নির্ভরশীলতা প্রভৃতি লক্ষ্য করিয়া প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পরিত্যাগ করেন এবং চিকিৎসা পদ্ধতির জ্ঞান প্রদর্শিকা বা বিধান হিসাবে তিনি অর্গানন অব মেডিসিন রচনা করেন । হ্যানিমান নব চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের সুদৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করিয়া ব্যবহারিক জীবনে ইহার সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতিও নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন । তাঁর অমর গ্রন্থ অর্গানন অব মেডিসিন হোমিওপ্যাথির মূলতত্ত্ব , রোগের স্বরূপ ঔষধ নির্বাচন ও প্রয়োগ পদ্ধতি সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন । এই গ্রন্থখানি তখনকার দিনের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সুত্র বা অনুচ্ছেদ আকারে লিখিত হয় । অর্গাননে মোট ২৯১ টি সূত্র বা অনুচ্ছেদ রহিয়াছে , ইহাকে প্রধানতঃ দুইটি অংশে বিভক্ত করা হইয়াছে । 

১ ) তত্ত্বগত অংশ -১ হইতে ৭০ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত । 
২ ) ব্যবহারিক অংশ -৭১ হইতে ২৯১ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত । 
তত্ত্বগত অংশে আছে : 
ক ) চিকিৎসকের লক্ষ্য  ঃ ( ১-৪ অনুচ্ছেন ) 
খ ) রোগ সম্বন্ধে জ্ঞান : ( ৫-১৮ অনুচ্ছেদ ) 
গ ) ঔষধ সম্বন্ধে জ্ঞান  ঃ ( ১৯-২৭ অনুচ্ছেদ ) 
ঘ ) ঔষধ নির্বাচন ও প্রয়োগ পদ্ধতি : ( ২৮-৩৯ অনুচ্ছেদ ) 
ঙ ) সারাংশ  ঃ ( ৭০ অনুচ্ছেদ ) ব্যবহারিক অংশে আছে : 
ক ) রোগ নিরাময় করিতে হইলে কি কি জানিতে হইবে : ( ৭১-১০৪ অনুচ্ছেদ ) 
খ ) ভেষজ গুনাগুন পরীক্ষা : ( ১০৫-১৪৫ অনুচ্ছেদ ) 
গ ) ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতিঃ ( ১৪৬-২৮৫ অনুচ্ছেদ ) 
ঘ ) ঔষধ ব্যাতীত অন্যান্য শক্তির যেমন তড়িৎশক্তি , চুম্বক শক্তি , মেসমেরিজম , স্নান প্রভৃতির ব্যবহার (২৮৬–২৯১ অনুচ্ছেদ ) মোট কথা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রথার যাবতীয় বিষয় হ্যানিমান তাঁহার অর্গানন গ্রন্তে লিপিবদ্দ করিয়াছেন । অর্গানন চিকিৎসা , দর্শনের এক শ্রেষ্ঠ রত্ন বলিয়া অভিহিত হয় । অর্গাননের বিভিন্ন সংস্করণের প্রকাশকাল প্রকাশের স্থান , নাম শিরোনাম ও সূত্র সংখ্যা নিম্নরূপ :






প্রশ্ন - অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিক বর্ণনা দাও । 

উত্তর : অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিক বর্ণনা : প্রথমেই মুখবন্ধ'- এই অংশে কোথা হইতে এবং কেন গ্রন্থটি লিখিয়াছেন এবং অপরাপর চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা ও সদৃশ্লীতির পক্ষে মতামত রাখা হইয়াছে । 
দ্বিতীয় : ‘ সূচিপত্র ' অংশে উপক্রমনিকা ও সূত্রের বিষয়বস্তুর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উল্লেখ আছে । 
তৃতীয় : উপক্রমনিকা অংশে তিনি অসদৃশ প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা করেন এবং প্রাচীন পন্থী চিকিৎসকেরা যে কালক্রমে অনুবাধন করিয়াছিল সদৃশ বিধানে আরোগ্য হয় ইহা এই অংশে উল্লেখ করেন । 
চতুর্থত : সূত্র বা অনুচ্ছেদ অংশ হইল বই এর অংশ । এই অংশে চিকিৎসকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য , চিকিৎসকের জ্ঞাতব্য বিষয় , কর্তব্য , আদর্শ আরোগ্যের শতাবলী , নিয়মনীতি , রোগ নিরাময়ে জ্ঞাতব্য বিষয় , ঔষধ সম্পর্কে জ্ঞান, ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় আলোচনা কর হইয়াছে। 
হোমিওপ্যাথিকে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে বিকশিত ও গতিশীল করার জন্য অর্গাননের বার বার সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন । অর্গাননের প্রথম সংস্করণের নাম ছিল “ অর্গানন অব দি র‍্যাশনাল হিলিং সায়েন্স ” বাংলা অর্থ হইল যুক্তি সংগত আরোগ্য বিজ্ঞানের সংবিধান গ্রন্থ " Rational কথাটি যোগ করার কারণ হিসাবে বলা যায় , তদানীন্তন সমাজে একমাত্র প্রতিষ্টিত আরোগ্য বিজ্ঞান ছিল এলোপ্যাথিক । হ্যানিমান এলোপ্যাথিক বড় ডাক্তার হইয়াও লক্ষ্য করেন যে এলোপ্যাথিক আরোগ্য বিজ্ঞান অনিয়মতান্ত্রিক ও যুক্তিহীন । তাই বহুদিনের সাধনার ফল যুক্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিজ্ঞানের পূর্বে Rational কথাটি যোগ করিয়া তখনশর দিনে প্রচলিত অন্যান্য আরোগ্য বিজ্ঞানকে অযৌক্তিক প্রমান করাই উদ্দেশ্য ছিল । দ্বিতীয় সংস্করণে Rational কথাটি বাদ দিয়া Science কথাটি পরিবর্তন করিয়া Art কথাটি যুক্ত করেন । Rational কথাটি বাদ দেওয়ার কারণ হিসাবে বলা যায় ১৮১০ খৃঃ হইতে ১৮১৯ খৃঃ পর্যন্ত এই নয় বৎসরে হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিজ্ঞান সত্য বলিয়া অনেকটা প্রমানিত হইয়াছে এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে । আরোগ্য কার্যে এবং বাস্তবে যাহা যুক্তিসংগত তাহাকে বার বার যুক্তিসংগত বা Rational না বলাই ভাল । দ্বিতীয়তঃ Healing art বলার পিছনে যুক্তি হইল Science শব্দের অর্থ হইল বিজ্ঞান । শুধু Theoretical নয় এবং ইহা যে বাস্তব ও প্রয়োগমুখী আরোগ্য বিজ্ঞান তাহাই প্রমানিত হয় । কাজেই নামকরণটি যথার্থ ও যুক্তিপূর্ণ হইয়াছে । 
৩ য় , ৪ র্থ , ৫ ম সংস্করণে এই নামকরণটি বহাল রাখা হয় । 
৬ ষ্ঠ সংস্করণে ইহার নামকরণের পরিবর্তণ সাধন কারয়া " অর্গানন অব মেডিসিন ” নাম রাখা হইয়াছে । বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংবিধান গ্রন্থ " Healing art শব্দ দুইটির পরিপূর্ণ অর্থ Medicine শব্দ দ্বারা প্রকাশিত হইতেছে । একমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তি সম্পন্ন ও বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলিতে হোমিওপ্যাথিককে বুঝানো হইয়াছে । বিভিন্ন কারণে অর্গানন ৬ ষ্ঠ সংস্করন হ্যানিমানের মৃত্যুর ৭৮ বৎসর পর ১৯২১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় । ৬ ষ্ঠ সংস্করণে বিষয়বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশ ঘটিয়াছে । 




প্রশ্ন - মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা সম্পর্কে টিকা লিখ । 

উত্তর : মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা  ঃ হ্যানিমান তাঁহার মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা হছে বিভিন্ন ঔষধের লক্ষণরাজি সুপরিকল্পিত ভাবে এবং বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন । ৬ ষ্ঠ খণ্ডে বইটি সমাপ্ত এবং জার্মাণ ভাষায় রচিত । বিভিন্ন সংস্করণের প্রকাশকাল ও পৃষ্ঠা সংখ্যা নিন্টুে দেওয়া হল ।
হ্যানিমানের নিজের এবং তাঁহার অনুসারীদের সুস্থদহে ঔষধ পরীক্ষা করিয়া যে সব লক্ষণ সংগ্রহ করেন ঐ সব লক্ষণের মূল্যায়ন , ব্যাখ্যা ও ঔষধের ক্রিয়া ফলকে এই গ্রন্থে তিনি প্রকাশ করেন । বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থখানি অনুদিত হইয়াছে । এই গ্রন্থে ৬৬ টি ঔষধ অন্তর্ভূক্ত ছিল । 





প্রশ্ন - হ্যানিম্যান রচিত মেটিরিয়া মেডিকা পিউরার গুরুত্ব লিখ । 

উত্তর : মেটিরিয়া মেডিকা পিউরার গুরুত্ব  ঃ হ্যানিমান রচিত মেটিরিয়া মেডিকা পিউরার গুরুত্ব অপরিসীম । নিম্নে গ্রস্থখানার গুরুত্বের কারণ আলোচিত হইল ।
( ক ) মেটিরিয়া মেডিকার পিউরার ঔষধের লক্ষাবলী সুস্থ মানবদেহে ঔষধের পরীক্ষণের মাধ্যমে আবিস্তৃত । উক্ত লক্ষণগুলি ঔষধের নিশ্চিত লক্ষণ । 
( খ ) এই গ্রন্থের অনেক ঔষধই বহুক্রিয় , যে কোন জানা অজানা রোগ এই সকল ঔষধ দ্বারা আরোগ্য লাভ হয় , আবার একই রোগে লক্ষণানুসারে অনেক ঔষধই কাজ কারতে পারে । 198 
( গ ) নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অদ্যাবধি ইহার কোন ঔষধই অকার্যকরী বা বাতিল গন্য হয় নাই । Fast Relat 
( ঘ ) এই গ্রন্থে উলেখিত ঔষধের লক্ষণরাজির মধ্য হইতে অসাধারণ , অদ্ভুত , একক ও বিরল লক্ষণের সমন্বয়ে রোগীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লক্ষণগুলি ভালভাবে অবহিত হইয়া যিনি রোগী ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিবেন তিনি আরোগ্যের ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করিবেন । 
( ঙ ) এই গ্রন্থের ঔষধ সমূহ নিশ্চিত ও নির্ভুল । অতুলনীয় বিচক্ষনতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির ও পর্যবেক্ষণের ফল । 
( চ ) চিকিৎসা বিজ্ঞানের পূর্ণতাপ্রাপ্তি একমাত্র মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা রচনার ফলেই সম্ভবপর হইয়াছে । 
( ছ ) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অনুমান নির্ভর ও অবৈজ্ঞানিতার পরিবর্তে সঠিক নিয়মনীতি ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার নিশ্চিত ফলশ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠা করিয়াছে । 
( জ ) হ্যানিমানের সময়কার এবং তৎপরবর্তী অসংখ্য মেটিরিয়া মেডিকা ও রেপার্টরীর মৌলিক উৎস হিসাবে গ্রন্থখানা ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে । 



প্রশ্ন - মেটিরিয়া মেডিকা পিউরাকে বিশুদ্ধ মেটিরিয়া মেডিকা বলা হয় কেন ? 

উত্তর - মেটিরিয়া মেডিকা পিউরাকে বিশুদ্ধ মেটিরিয়া মেডিকা বলা হয় । কেননা 
( ক ) মেটিরিয়া মেডিকা ‘ পিউরা ' গ্রন্থখানি গভীর অন্তর্দৃষ্টি নির্ভুল পর্যবেক্ষণ , ইহার ঔষধের লক্ষণসমূহ সুস্থমানব দেহের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কৃত । গ্রন্থখানিতে অনুমানের উপর ভিত্তি করিয়া কোন কিছু লিখিত হয় নাই । তাই ইহাকে'পিউরা ” বা বিশুদ্ধ বলা হইয়াছে । 
( খ ) গ্ৰন্থখানায় যে সকল ঔষধ স্থান পাইয়াছে ইহার একটিও আজ পর্যন্ত অকার্যকরী বা বাতিল বলিয়া গণ্য হয় নাই ।
( গ ) রোগী আরোগ্যের ক্ষেত্রে ইহার ঔষধ সমূহ নিশ্চিত ও নির্ভুল ভাবে সদৃশ লক্ষণসমূহ দূরীভূত করিতে সক্ষম । উক্ত কারণেই মেটিরিয়া মেডিকা পিউরাকে বিশুদ্ধ মেটিরিয়া মেডিকা বলা হয় । 




প্রশ্ন -  হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকার উৎস কি ? 

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান স্বয়ং নিজদেহে এবং তাঁহার অনুসারীগণ তাঁহাদের দেহে যে সকল ঔষধ পরীক্ষা করিয়াছেন ঐ সকল গরীক্ষণের ফলে সৃষ্ট লক্ষণ সমূহ , পরীক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন পরীক্ষণ রেকর্ড বহি হ্যানিমানের নিজ লিখিত এবং সমসাময়িক সময়ে বিভিন্ন মেটিরিয়া মেডিকা রচিত হইয়াছিল , ঐ সকল মেটিরিয়া মেডিকা অবলম্বন করিয়াই পরবর্তী কালে অসংখ্য হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা প্রণীত হইয়াছে । হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকার উৎসসমূহ নিম্নরূপঃ 
( ক ) হ্যানিমান এবং তাঁহার অনুসারীগণ স্বীয় সুস্থ দেহে যে ঔষধ পরীক্ষা করিয়াছেন এবং আমেরিকা , ভিয়েনা ও অস্ট্রেলিয়ার ঔষধ পরীক্ষণ সমিতি সুস্থ দেহে ঔষধ পরীক্ষা করিয়া যে ফল লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাঁহাদের রেকর্ডসমূহ । 
( খ ) মহাত্মা হ্যানিমানের রচিত গ্রন্থাবলী : 
১ ) ফ্রাগমেন্ট । ডি ভিরিবাস , ২ ) অর্গানন অব মেডিসিন , ( ৩ ) মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা ( ৪ ) ক্রণিক ডিজিসেস । 
( গ ) ডাঃ হেরিং - গাইডিং সিস্টেমস অব আওয়ার মেটিরিয়া মেডিকা ( ১০ খন্ড ) 
( ঘ ) ডাঃ জে , এইচ , ক্লার্ক - ডিকশনারী অব প্র্যাকটিক্যাল মেটিরিয়া মেডিকা 
( ঙ ) ডাঃ টিএফ এলেন এনসাইক্লোপেডিয়া অব পিউর মেটিরিয়া মেডিকা ( ১২ খন্ড ) 
( চ ) ডাঃ , ই , এম , হেল — নিউ রিমেডিস । 
( ছ ) ডাঃ , টি , এল , ব্রাডফোর্ড— হ্যানিমানিয়ান্স প্রুভিংস প্রভৃতি । 



প্রশ্ন - ক্রণিক ডিজিজেসর উপর টিকা লিখ । 

উত্তর : ক্রনিক ডিজিজেস : মহাত্মা হ্যানিমানের " দি ক্রনিক ডিজিজেস , দেয়ার নেচার এন্ড হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট ” গ্রন্থখানি জার্মান ভাষায় ইহার ১ ম , ২ য় এবং ৩ য় খন্ড ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে এবং ৪ র্থ খন্ড ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় । পরে হ্যানিমান পাঁচখণ্ডে ইহার দ্বিতীয় পরিবর্ধণ সংস্করণ রচনা করেন । গ্রন্থখানি পরবর্তীকালে ফ্রান্স , ইটালিয়ান , ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন মনীষী অনুবাদ কাজ সম্পন্ন করেন । ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থখানির প্রথম খন্ড তত্ত্বীয় অংশ এবং পরবর্তী খন্ডগুলি একত্রে ব্যবহারিক অংশ হিসাবে পরিগণিত । ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের প্রথম ভাগে চিররোগের প্রকৃতি , ঔষধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে আলোচিত হইয়াছে এবং শেষ অংশে ৪৮ টি সোরাদোষনাশক ঔষধের তালিকা প্রদান করা হইয়াছে । দ্বিতীয় ভাগে ঐ ঔষধ সমূহ সুস্থ মানবদেহে ঔষধ পরীক্ষা করিয়া যে সকল লক্ষণ পাওয়া গিয়াছে তাহার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে । চিররোগ সম্পর্কে গ্রন্থখানিতে আলোচনা করিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন যাবতীয় চিররোগের মূল কারণ হইতেছে সোরা , সিফিলিস ও সাইকোসিস । ইহার মধ্যে সোরাই হইতেছে সবচেয়ে সংক্রামক এবং আটভাগের সাত ভাগ চিররোগ সোরা হইতেই সৃষ্ট । ক্রণিক ডিজিজ গ্রন্থে আলোচিত ঔষধগুলির উল্লেখজ নাম , ভিন্ননাম , প্রাপ্তিস্থান , উৎস , হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হিসেবে এবং ইহার পূর্বে ব্যবহারের ইতিহাস , ঔষধ প্রস্তুতপ্রণালী , শক্তি ও মাত্রা প্রয়োগ পদ্ধতি ক্রিয়ানাশক , অনুরূপ ও পরবর্তী সদৃশ ঔষধের নাম উল্লেখিত হইয়াছে । 



প্রশ্ন —  হ্যানিমান রচিত ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের গুরুত্ব বর্ণনা কর । 

উত্তর : ক্রনিক ডিজিজেস এর গুরুত্ব : হ্যানিমান রচিত ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম । চিররোগীর আরোগ্যের জন্য গ্রন্থখানিতে চির মায়াজমের উৎপত্তি , বৈশিষ্ট্য , প্রকৃতি , চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ঔষধের সুনির্দিষ্ট লক্ষণসমূহের বর্ণনা প্রদান করা হইয়াছে । পরবর্তী ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের আলোকে অসংখ্য মেটিরিয়া মেডিকা এবং রেপার্টরী রচিত হইয়া রোগী চিকিৎসার পথ সুগম এবং চিকিৎসা ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করিয়াছে । তাই সকল চিকিৎসকের ক্রণিক ডিজিজেস গ্রন্থ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । হ্যানিমানের এই গ্রন্থে চিররোগ সমূহকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করিয়াছেন । 
( ১ ) সোরা হইতে সৃষ্ট চিররোগ 
( ২ ) সিফিলিস হইতে সৃষ্ট চিররোগ এবং 
( ৩ ) সাইকোসিস হইতে চিররোগ সোরা সম্পর্কে হ্যানিমান বলিয়াছেন সোরা মানুষের আদি রোগ । যাবতীয় অযৌন প্রাকৃতিক রোগকে তিনি সোরা বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন । যে আদি রোগ বীজ সকল প্রকার অযৌন ব্যাধির মূল কারণ তাহাকেই সোন্ত্রিক মায়াজম বলে । সোরা দেহ যন্ত্রের ক্রিয়ার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে । আত্মমুখী লক্ষণ উৎপন্ন করে । মানবদেহে সোরা দোষ সংক্রমণের পর তাহা সমগ্র প্রাণসত্তার ছড়াইয়া পড়ে । তারপর অনুকূল পরিস্থিতি পাইলে আত্মপ্রকাশ করে । সোরার পরিচায়ক লক্ষণ হইল প্রচন্ড দৈহিক ও মানসিক কন্ডুয়ন , রোগলক্ষণের পরিবর্তনশীলতা ও বার বার প্রত্যাবর্তন , শীতে ও শৈত্যে বৃদ্ধি , উজপে উপশম প্রভৃতি । নদৃশমতে এন্টিসোরিক ঔষধ নির্বাচন করিয়া শক্তিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করিলে সোরদোেষ প্রতিকার সম্ভব । সিফিলিস সম্পর্কে বলিয়াছেন সিফিলিস যৌনব্যাধি , উপদংশ রোগ চাপা দিলে সিফিলিস বিষের সৃষ্টি হয় । ইহাৰ প্ৰাথমিক লক্ষণ যৌনাঙ্গে ক্ষত , দ্বিতীয় পর্যায়ের লক্ষণ নানা প্রকার আলসার , গলক্ষত , চর্মের উপর চুলকানিবিহীন তাম্রবর্ণ উদ্ভেদ , কেশপতন প্রভৃতি । সিফিলিসের ক্রিয়া ধ্বংসাত্মক । সিফিলিস সব কিছুকে ধ্বংস করে , বিকৃত করে । সদৃশমতে এন্টিসিফিলিটিক ঔষধ শক্তিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করিলে সিফিলিস দোষ নিরাময় হয় । সাইকোসিস সম্পর্কে বলিয়াছেন , সাইকোসিস হইল ক্রণিক গনোরিয়া চাপা দেওয়ার ফল । আঁচিল টিউমার , হাজাকারক স্রাব , বাত , শ্লথগতিতে আরোগ্য ক্রিয়া অগ্রসর হওয়া প্রভৃতি সাইকোসিসের লক্ষণ । দেহের আভ্যন্তরীণ যন্ত্রসমূহ বিশেষ করিয়া যৌনাঙ্গ সমূহ ইহার প্রধান ক্রিয়াস্থান । সদৃশনীতিতে এন্টিসাইকোটিক ঔষধ শক্তিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করিলে সাইকোসিসের প্রতিকার সম্ভব । 




প্রশ্ন - রেপার্টরিয়াম সম্পর্কে টিকা লিখ । 

উত্তর : রেপার্টরিয়াম : মহাত্মা হ্যানিমান লিখিত রেপার্টরীর নাম “ ফ্রাগমাল্টা ডি ভিরিবাস ” এবং দ্বিতীয় রেপার্টরীর নাম " রেপার্টরিয়াম ” । ১৮১৭ সালে তিনি “ রেপার্টরিয়াম ” গ্রন্থখানি ল্যাটিন ভাষায় লিখিয়াছেন । গ্রন্থখানিতে কতকগুলি লক্ষণাবলীর সংক্ষিপ্ত রেপার্টরী উলেখ ছিল । ইহার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪২৩৯ । তখনকার সময়ে আবিস্কৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সমূহের লক্ষণগুলিকে মন এবং মাথা হইতে আরম্ভ করিয়া হাত পা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন অংশে বর্ণক্রমিক ভাবে সাজাইয়া নেন এবং তাহার পার্শ্বে তাহাদের সংশ্লিষ্ট ঔষধের নামও বর্ণক্রমিক ভাবে উল্লেখ করেন । ইহার বিশেষ সুবিধা ছিল এই যে , ঔষধের প্রয়োজনীয় লক্ষণগুলি এবং সংশ্লিষ্ট ঔষধটি বা ঔষধগুলি এবং রোগীর জন্য সুনির্দিষ্টি ঔষধটি অতি সহজেই খুঁজিয়া বাহির করা সম্ভব । হ্যানিমান তাঁহার রেপার্টরী লিখার পর ডাঃ বোনিং হোসেন , ডাঃ গ্রস , ডাঃ রুকার্ট , ডাঃ জার প্রভৃতি অনুসারী চিকিৎসকে লিখিতে উৎসাহ করেন । হ্যানিমানের সময়ের অনেক পরেও বিভিন্ন সময়ে অনেক হোমিওপ্যাথিক রেপার্টরী লিখিত হইয়াছে । ইহার মধ্যে ডাঃ কেন্টের লিখিত রেপার্টরী বিশেষ ভাবে উলেখযোগ্য ।  




প্রশ্ন -  হ্যানিমান কেন তৎকালীন এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বর্জন করেন ? 

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ এলোপ্যাথিক চিকিৎসক । এলোপ্যাথিক চিকিৎসার সাফল্যের সাথে সাথে ইহার কিছু বিষময় ফল হ্যানিমান অনতিবিলম্বে প্রত্যক্ষ করলেন । আজ যে ঔষধ অমোঘ বলিয়া ঘোষিত হইল দুইদিন পর উহা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলিয়া পরিত্যক্ত হইল । তাহা ছাড়া যে রোগের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা হইল তাহা হয়ত সারিল কিন্তু অন্য নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দিতে লাগিল । চিকিৎসা বিদ্যার উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন বিভাগে বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হইল । ফলে মানুষের এক একটি অঙ্গ মানুষের চাইতেও বেশী প্রাধান্য পাইতে লাগিল । রোগ রোগীর না হইয়া তাহার কোন অঙ্গের রোগ বলিয়া আখ্যা পাইল । সামগ্রীক সত্ত্বা ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে পড়িয়া গেল । যন্ত্রণাকাতর যে রোগী চিকিৎসকের উপর বিশ্বাস করিয়া নিজেকে সমর্পণ করিল সেই চিকিৎসকই তাহার উপর গিনিপিগের মত বিভিন্ন ঔষধ ও তত্ত্বের নিত্য নতুন পরীক্ষা শুরু করিলেন । ফলে অনেক বিবেকমান খ্যাতিমান চিকিৎসক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠেন । বিজ্ঞান।চার্য দার্শনিক ও চিকিৎসা শাস্ত্রবিদ স্যামুয়েল হ্যানিমান ছিলেন ইহাদের অন্যতম । তিনি প্রচলিত এই চিকিৎসা প্রথার ভয়াবহ পরিণামের কথা উপলব্ধি করিয়া সখেদে ঘোষণা করিলেন , “ আমি এমন সব ঔষধ প্রয়োগ করছি যেগুলি সম্পর্কে আমি খুব কম জানি । এমন দেহে প্রয়োগ করছি যার অন্তর্নিহিত ক্রিয়া ধারা সম্বন্ধে বলতে গেলে আমি কিছুই জানিনা । অতএব মানুষের চিকিৎসার নামে তার বৃহত্তর অনিষ্ট সাধন করা থেকে অব্যাহতি পেতে হলে এই চিকিৎসা বৃত্তি পরিত্যাগ করা ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর রেই । আমি বিশ্বাস করি আমি যে সমস্ত রোগের চিকিৎসা করছি সেগুলি বিনা চিকিৎসায় থাকলে বর্তমান অবস্থা থেকে ভাল থাকত । চিকিৎসাবৃত্তির মাধ্যমে মানব সেবার যে স্বপ্ন তিনি আশৈশব দেখিয়া আসিয়াছেন , সেই বৃত্তির সাফল্যের শীর্ষস্থানে আরোহণ করিয়া তিনি ইহা পরিত্যাগ করেন । 




প্রশ্ন - সিঙ্কোনা বার্কের উপর কালেন সাহেবের মন্তব্যে হ্যানিমানের মনের প্রতিক্রিয়া কি ? 

উত্তর : ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমান তখন উইলিয়াম কালনের মেটিরিয়া মেডিকা গ্রন্থখানি অনুবাদ করিতেছিলে । তিনি সেখানে লক্ষ্য করিলেন যে , সিঙ্কোনা কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত সেই ঔষধটিই বৃহৎ মাত্রায় প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বরের সৃষ্টি হয় বলিয়া উল্লেখ আছে । তাহার মনে চকিতে এক নতুন সম্ভাবনার কথা উদয় হইল । হ্যানিমান নিজেকে প্রশ্ন করিলেন , তবে কি সদৃশমতে চিকিৎসার দ্বারা রোগ আরোগ্য সম্ভব ? তিনি পরীক্ষা করার জন্য কম্পিত হৃদয়ে সিঙ্কোনা সেবন করিলেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধরণের কম্পজ্বর তাঁহাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিল । অতঃপর তিনি সিঙ্কোনার সূত্রমাত্রা সেবন করিয়া রুদ্ধশ্বাসে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন । ধীরে ধীরে যাদুমন্ত্রের মত সমস্ত কষ্টকর উপসর্গ অন্তর্নিহিত হইয়া গেল । ইহা হইতে তাহার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্ম নিল যে , যে ভেষজ রোগ সৃষ্টি করিতে পারে , সেই ভেষজই সেই সেই ধরণের রোগ আরোগ্য করিতে পারে । 




প্রশ্ন -  শুধুমাত্র সিঙ্কোনা পরীক্ষা করিয়াই কি হ্যানিমান ক্ষান্ত হন ? 

উত্তর : শুধুমাত্র সিঙ্কোনা পরীক্ষা করিয়াই হ্যানিমান ক্ষান্ত হয় নাই । সিঙ্কোনা পরীক্ষার পর বিভিন্ন ঔষধ নিয়া তিনি পরীক্ষা - নীরিক্ষা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা শুরু করেন । একোনাইট স্থুলমাত্রায় প্রয়োগ করিয়া দেখা গেল প্রদাহ যুক্ত জ্বরের সূচনা হয় । তার সঙ্গে থাকে পিপাসা , অস্থিরতা আর মৃত্যুভীতি । আবার এমন অবস্থায় একোনাইট সূক্ষ্মযাত্রায় প্রয়োগ করা হইলে সমস্ত উপসর্গ বিলীন হইয়া যায় । এমনিভাবে নাক্স , পালসেটিলা , বেলোডানা প্রভৃতি ঔষধ পরীক্ষায় একই সত্যের সন্ধান পাওয়া গেল ভেষজের রোগোৎপাদিকা শক্তিই তাহার আরোগ্যদায়িকা শক্তি । দীর্ঘ ৬ বৎসর যাবত অবিরাম পরীক্ষা , গবেষণা , সংস্কার , মুক্ত যুক্তি , বিরামহীন অনুসন্ধান , বিশ্বস্ত পর্যবেক্ষণের পর হ্যানিমান সেই মহান সত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হইলেন । 




প্রশ্ন - ঔষধ যেরূপ কৃত্রিমরোগ সৃষ্টি করিতে পারে , সেইরূপ প্রাকৃতিক রোগ আরোগ্য করিতে পারে - কিভাবে হ্যানিমান ইহা বুঝিলেন ? 

উত্তর : ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে উইলিয়াম কালেনের বিখ্যাত মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদের সময় হ্যানিম্যান  লক্ষ্য করিলেন যে , যে সিঙ্কোনা কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয় , সেই ঔষধই বৃহত্যাত্রায় প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বরের সৃষ্টি হয় । হ্যানিমান নিজ সুস্থদেহে সিঙ্কোনা প্রয়োগ দ্বারা কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা লক্ষ্য করেন এবং সূক্ষ্ম মাত্রায় সিঙ্কোনা সেবন করিয়া ঐ কৃত্রিম রোগ দূরীভূত হওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করেন । ইহার পর একে একে একোনাইট , বেলেডোনা পালসেটিলা , নাক্স ভমিকা প্রভৃতি ঔষধগুলি নিজদেহে প্রয়োগ করিয়া এই মহা সত্যের সন্ধান পাইলেন যে , সুস্থদেহে পরীক্ষিত ভেষজ যে যে রোগলক্ষণ উৎপন্ন করে , উক্ত লক্ষণ বিশিষ্ট কোন পীড়ায় ঐ ঔষধসমূহ প্রয়োগ দ্বারা লক্ষণাদি তিরোহিত হয় । ইহা হইতে তিনি বুঝিলেন যে , ঔষধ যেইরূপ কৃত্রিম বোপ সৃষ্টি করিতে পারে , ঠিক সেইরূপ প্রাকৃতিক বোগও আরোগ্য করিতে পারে । 




প্রশ্ন -  প্রাচীনপন্থীদের কি কি অভিজ্ঞতা হ্যানিমানকে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত করিয়াছিল ?

উত্তর : হোমিওপ্যাথি হইল সদৃশনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পদ্ধতি । আরোগ্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে সদৃশনীতি বিধান অতি প্রাচীন । প্রতি যুগেই এমন ইংগিত সুস্পষ্ট ছিল যে সদৃশ মতে চিকিৎসা দ্বারা রোগ নিরাময় সম্ভব । খৃষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে দার্শনিক এরিষ্টল ঘোষণা করিয়াছিলেন যে রোগের সাদৃশ্য ও ঔষধের সাদৃশ্যের পরস্পর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল হইল পরস্পরের বিনাশ । এলোপ্যাথিক চিকিৎসার আদিগুরু হিপোক্রেটিস ( ৪৬০ খৃঃ পূঃ ) সদৃশমতে চিকিৎসার নীতি সমর্থন করিয়া গিয়াছেন । তিনি বলিয়াছেন , যে ঔষধ যে রোগ উৎপন্ন করিতে পারে , সেই ঔষধ সেই রোগ আরোগ্যও করিতে রে । ইংরেজ চিকিৎসা শাস্ত্রবিদ সিডেনহামের উপদেশ হইল — হয় প্রকৃতিকে অনুসরণ করিয়া প্রকৃতি নির্দিষ্ট পথে রোগ নিরাময় কর নতুবা রোগ শত্রুকে সরাসরি কোন ঔষধ প্রয়োগে নির্মূল কর । সেলসাস , প্যারাসেলসাস , ষ্টল , হল , ষ্টুয়ার্ক প্রভৃতি চিন্তানায়কদের বক্তব্যেও সদৃশনীতির যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় । কিন্তু এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে কোন বিধিবদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি গড়িয়া উঠে নাই । প্রচীনপন্থীদের উক্ত অভিজ্ঞতাই হ্যানিমানকে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত করিয়াছিল । 



প্রশ্ন -  কিভাবে হ্যানিমান হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করেন ? 
বা , হ্যানিমান কিভাবে বিশ্বজনীন আরোগ্যনীতিতে উপনীত হইলেন ? 
বা , হ্যানিমান কর্তৃক চিরন্তন হোমিওপ্যাথির জন্ম সম্পর্কে যাহা জান লিখ । 
বা , হ্যানিমান কর্তৃক চিরন্তন আরোগ্যনীতি ‘ সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার ’ আবিষ্কারের কাহিনী সংক্ষেপে লিখ । 

উত্তর : সত্য জ্ঞানের গাণিতিক যথার্থতা অন্বেষণের আকাঙ্খা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে বহুলাংশে সাহায্য করিয়াছে ঠিকই কিন্তু চিকিৎসা কলাকে তাচ্ছিল্যের সাথে পরিত্যাগ করিয়াছে এবং এটাকে পরস্পরাগত মতবাদ , পূর্বতন বিধি , দৈবঘটন । ও আকস্মিক পর্যবেক্ষণ প্রভৃতির অনুগ্রহের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে । স্যামুয়েল হ্যানিমান হইলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম প্রকৃত চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিসর ও বিষয়বস্তুর সংকেত নির্দেশ করেন । হ্যানিমান ছিলেন একজন প্রথিতযশা এলোপ্যাথিক চিকিৎসক । বার বার তিনি প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনুমান নির্ভর ব্যক্তিগত মত ভিত্তিক অবস্থা , ইহার অসম্পূর্ণতা ও অনির্ভরশীল অবস্থা , ভ্রান্ত , ক্ষতিকর ও অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী উপলব্ধি করেন । এই কারণে তিনি এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাইয়া ফেলেন এবং রসায়ন বিদ্যা বিষয়ক গবেষণা ও অনুবাদ কার্যে বিশেষ ভাবে আত্মনিয়োগ করেন । ১৭৯০ খৃষ্টাব্দ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় কাল । বৃক্ষ হইতে আপেল পতন যেমন নিউটনের জীবনে বিস্ময়কর আবিষ্কারের ইঙ্গিত বহন করিয়া আনিয়াছিল , তেমনি এক সাধারণ ঘটনা হ্যানিমানের জীবনে নতুন এক সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করিয়া দিল । হ্যানিমান তখন উইলিয়াম কালেন সাহেবের বিখ্যাত মেটিরিয়া মেডিকা জার্মাণ ভাষায় অনুবাদ করিতেছিলেন । সেখানে তিনি লক্ষ্য করিলেন যে , যে সিঙ্কোনা কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয় সেই ঔষধটাই বৃহৎ মাত্রায় প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বরের সৃষ্টি হয় বলিয়া উলেখ আছে । তাঁহার মানস্পটে এক একে ভিড় করিল আর্যাবর্তের মুনিঝষিগণ আর প্রতীচ্যের এরিষ্টটল , হিপোক্রেটিস , সিডেনহাম , সেলসাস , ষ্টল ও হলের সদৃশমতে চিকিৎসার নীতির সমর্থনে অংশ । তিনি কম্পিত হৃদয়ে অধিক মাত্রায় সিঙ্কোনা সেবন করিলেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বিশেষ ধরণের কম্পজ্বর তাঁহাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিল । তিনি বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেলেন । অতঃপর তিনি সিঙ্কোনার সূক্ষ্মমাত্রা সেবন করিয়া ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন । ধীরে ধীরে নাটকীয় ভাবে সমস্ত কষ্টকর উপসর্গ অন্তর্হিত হইয়া গেল । হ্যানিমান অভিভূত হইয়া পড়িলেন । হ্যানিমান অবশেষে তাঁহার পরীক্ষার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেন , “ সবিরাম জ্বরের ঔষধ হিসেবে পেরুভিয়ান বার্ক বা সিঙ্কোনা কাজ করে , কারণ সুস্থ মানুষের শরীরে উহা সবিরাম জ্বরের সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করিতে পারে । ” তারপর বিভিন্ন ঔষধ নিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা শুরু হইল । একোনাইট স্থুল মাত্রায় প্রয়োগ করিয়া দেখা গেল প্রদাহ যুক্ত জ্বরের সূচনা হয় , তার সঙ্গে থাকে পিপাসা , আস্থরতা ও মৃত্যুভীতি । আবার এইরূপ অবস্থায় একোনাইট সূক্ষ্মমাত্রায় প্রয়োগ করা হইলে সমস্ত উপসর্গ বিলীন হইয়া যায় । এমনিভাবে নাক্সভমিকা , বেলেডোনা , পালসেটিলা প্রভৃতি ঔষধ পরীক্ষায় একই সত্যের সন্ধান পাওয়া গেল । ভেষজের রোগোৎপাদিকা শক্তিই তার আরোগ্যদায়িনী শক্তি । যে ভেষজ যে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে , সেই ভেষজই ধরণের রোগ আরোগ্য করিতে পারে । দীর্ঘ ৬ বৎসর ধরিয়া সত্যের সন্ধানে এই অনলস সাধনা চলে । বিশুদ্ধ চিত্তা , সংস্কারমুক্ত যুক্তি , বিরামহীন অনুসন্ধান , বিশ্বস্ত পর্যবেক্ষণ আর পুংখানুপুংখ পরীক্ষার পর হ্যানিমান সেই মহাসত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হইলেন । ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে স্যামুয়েল হ্যানিমান উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন , “ রোগারোগ্যের শ্বাশ্বত পথের সন্ধান আমি পেয়েছি । যে সত্য সুদীর্ঘকাল রহস্যের তিমিরাবরণে আচ্ছন্ন ছিল আমি তা উদ্গাটন করিয়াছি । সে পথ প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতার পথ । প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করে নির্মল আরোগ্য বিধান সম্ভব নয় । আদর্শ আরোগ্য বিধানের নিমিত্ত প্রকৃতির নির্দিষ্ট একটি মাত্র পথ আছে । তা হলো Similia Similibus Curantur- সমঃ সমং সময়তি অর্থাৎ যে ভেষজ সুস্থ দেহে যে ধরণের রোগ সৃষ্টি করিতে সক্ষম সেই ধরণের রোগ সেই ভেষজই আরোগ্য করিতে সক্ষম । মৃদু , দ্রুত ও স্থায়ীভাবে আরোগ্য প্রদানের জন্য রোগের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমন একটি ঔষধ নির্ধারণ করিতে হইবে যাহা যে রোগ নিরাময় করিতে হইবে সেই রোগের সদৃশ একটি রোগ নিজেই উৎপাদন করিতে পারে । নির্মল আরোগ্য বিধানের ইহাই একমাত্র পথ । হ্যানিমানের বহু পূর্বেই হিপোক্রেটিস উলেখ করিয়াছিলেন যে অসদৃশ ও সদৃশ উভয় পদ্ধতিতেই রোগী আরোগ্য লাভ করে । সিডেনহাম , সেলসাস , প্যারাসেলসাস , ষ্টল , হল ষ্টুয়ার্ক প্রভৃতি নিায়কদের বক্তব্যেও সদৃশ নীতির যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় । কিন্তু আরোগ্যের একমাত্র নিয়ম হিসাবে ইহাকে কেউই উল্লেখ করেন নাই । একমাত্র হ্যানিমান তাহা উল্লেখ করেন এবং পরীক্ষা ও প্রয়োগের মাধ্যমে তাহা প্রমাণও করেন । হ্যানিমান এবং নব , চিকিৎসা পদ্ধতির নামকরণ করেন ‘ হোমিওপ্যাথি ' । ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে হোমিওপ্যাথির আবিষ্কার হইলেও তখন পর্যন্ত ইহাকে হোমিওপ্যাথি বলিয়া
[6:50 PM, 8/11/2022] Dr. Mohi Uddin: আখ্যায়িত করেন নাই । ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে হাফল্যান্ডের জার্নালে এক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যাহার শিরোনাম ছিল “ On a new principle for Ascertaining the curative properties of Drugs ” ইহাতেই তিনি এই সদৃশ নীতির আরোগ্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতিকে হোমিওপ্যাথি " নামে অভিহিত করেন । ১৮১০ খৃষ্টাব্দে অর্গাননের ১ ম সংস্করণেও তিনি “ হোমিওপ্যাথি ” নাম ব্যবহার করেন । 



প্রশ্ন - হ্যানিমান কি হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা ? 

উত্তর : হ্যানিমান নিজেকে কখনও হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা বলিয়া দাবী করেন নাই । সদৃশনীতি অনুযায়ী চিকিৎসা প্রথা অতি প্রাচীন কাল হইতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত ছিল । কিন্তু দেশেই এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি গড়িয়া উঠে নাই । দার্শনিক এরিষ্টটল , এলোপ্যাথিক চিকিৎসার জনক হিপোক্রেটিস , ইংরেজ চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ সিডেনহাম এবং সেলসাস , প্যারাসেলসাস , ষ্টল , হল প্রভৃতি চিন্তানায়কদের বক্তব্যেও সদৃশনীতির যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় । এই বিষয়ে কোন দ্বিমত নাই যে , হ্যানিমানই সর্ব প্রথম যিনি সদৃশনীতির উপর ভিত্তি করিয়া পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন , যা প্রচলিত সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি হইতে নীতি ও প্রয়োগ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । তিনি নিঃসন্দেহে প্রচলিত হোমিওপ্যাথির জনক । ডাঃ মরগ্যানের ভাষায় বলা যায় “ রোগারোগ্যের জন্য এক শ্বাশ্বত বিধানের অস্তিত্বের আবিষ্কার এবং শক্তিকরণের মাধ্যমে ভেষজের অন্তর্নিহিত শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়ে আরোগ্য সাধনের নিমিত্ত তার সর্বোত্তম প্রয়োগ কৌশল আবিষ্কারের অমর গৌরব ও সম্মান একমাত্র হ্যানিমানের প্রাপ্য । 



প্রশ্ন - হ্যানিমান কিভাবে ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন ? 

উত্তর : ভেষজকে আমরা তখনই ঔষধরূপে ব্যবহার করিতে পারি যখন ইহা সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষিত হইয়াছে । কিভাবে হ্যানিমান ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন সে সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা আছে । ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমান উইলিয়াম কালেনের মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদ করিতেছিলেন । কালেন সাহেবের মেটিরিয়া মেডিকায় মন্তব্য ছিল , যে সিনো কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয় , সেই সিঙ্কোনাই বৃহৎ মাত্রার প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বর সৃষ্টি হয় । কালেন সাহেবের এই মন্ত বো হ্যানিমান সন্তুষ্ট হইতে ন । পারিয়া নিজের উপর কয়েকবার পরীক্ষা চালাইলেন । সিঙ্কোনা কম্পজ্বর সারে কেন এই প্রশ্নে হ্যানিমানের কৌতুহলী মন অস্থির হইয়া উঠে । ইহার কারণ জানার জন্য তিনি নিজ সুস্থদেহে সিঙ্কোনা পরীক্ষা - নিরীক্ষা করিবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তিনি স্থূল মাত্রায় সিঙ্কোনা সেবন করিলেন । ইহার ফলে তাঁহার দেহ ও মনে কম্পজুরের যাবতীয় লক্ষণ প্রকাশ পায় । এই আক্রমণ অতিক্রান্ত হওয়ার কিছুকাল পরে তিনি পুনরায় সিঙ্কোনা গ্রহণ করেন । তাহাতে ঐ একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয় । হ্যানিমান সিঙ্কোনাকে কম্পজ্বরের নিরসনের উত্তম অস্ত্র হিসেবেই জানিতেন । কিন্তু এখন দেখিলেন সেই সিঙ্কোনা তাঁহার সুস্থ দেহে কম্পজ্বরের আক্রমণ চালাইয়া প্রাকৃতিক কম্পজ্বরের অনুরূপ সদৃশ লক্ষণাবলী উৎপাদনে সক্ষম । তাই তিনি পরিচিত কতিপয় ঔষধ দ্বারা সুস্থ মানব দেহের উপর গভীর পরীক্ষা শুরু করিলেন এবং স্বতন্ত্র ভাবে পরীক্ষিত কতিপয় ঔষধের মধ্যে এই ক্রিয়ানীতি লক্ষ্য করিয়া মুগ্ধ হইলেন । একোনাইট স্থূল মাত্রায় প্রয়োগ করিয়া দেখিতে পাইলেন প্রদাহযুক্ত জ্বরের সূচনা হয় , তার সঙ্গে থাকে পিপাসা , অস্থিরতা ও মৃত্যুভীতি । আবার এইরূপ অবস্থায় একোনাইট সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ করা হইলে সমস্ত উপসর্গ বিলীন হইয়া যায় । এমনিভাবে নাক্স ভমিকা , পালসেটিলা , বেলেডোনা প্রভৃতি ঔষধ পরীক্ষায় একই সত্যের সন্ধান পাওয়া গেল যে ভেষজের রোগোৎপাদিকা শক্তিই তার আরোগ্যদায়িনী শক্তি । যে ভেষজ যে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে সেই ভেষজই সেই ধরণের রোগ আরোগ্য করিতে পারে । সুতরাং তিনি দেখিলেন যে , রোগ আরোগ্য করিতে হইলে , ঔষধের রোগাৎপাদন ক্ষমতা জানা দরকার এবং তাহা একমাত্র ভেষজ পরীক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব । এই ভাবে হ্যানিমান ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন । 



প্রশ্ন -  হ্যানিমানের রোগী পরীক্ষা পদ্ধতি বা নীতি কেমন ছিল ? 

উত্তর : প্রত্যেকটি রোগীকে ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষা দ্বারা রোগ লক্ষণসমূহ অনুসন্ধান , পর্যবেক্ষণ , স্বরূপ অনুধাবন ও যথাযথ লিপিবদ্ধ করণের নীতি হ্যানিমান গ্রহণ করিতেন । একটি রোগীকে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করিয়া যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ করিতে হ্যানিমান দেড়ঘন্টা সময় ব্যয় করিতেন । এই উদ্দেশ্যে ১৬ টি নম্বর দেওয়া রেজিষ্টার খাতা থাকিত । প্যারিসে যখন তিনি অবস্থান করিতেন তখন পরীক্ষিত সমস্ত রোগীর বিবরণ এই রেজিষ্টার খাতায় তিনি লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন । ৭/৮ বৎসর পূর্বের রোগীও যদি পুনরায় চিকিৎসার জন্য হ্যানিমানের নিকট আসিত তখন এই সকল রেজিষ্টার খাতায় রোগীদের নাম পাওয়া যাইত । খুব সহজে নাম বাহির করিবার জন্য বর্ণনানুক্রমিক সূচিপত্র থাকিত । যে সকল শয্যাগত রোগীদেরকে হ্যানিমান তাঁহাদের বাড়ি গিয়া দেখিতেন তাহাদের লক্ষণ ও ঔষধের নাম ঘরে আসিয়া লিখিয়া রাখিতেন । জটিল ও শয্যাগত রোগীর ক্ষেত্রেও রোগী বিবরণী না লিখিয়া এবং মেটিরিয়া মেডিকা আলোচনা না করিয়া ঔষধ দিতেন না । রোগী পরীক্ষার ব্যাপারে কোন সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করিতেন না । রোগলক্ষণ সংগ্রহ করার সময় তিনি ধাতুগত লক্ষণ , মানসিক লক্ষণ , বংশগত লক্ষণ , এবং অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষণসমূহও লিপিবদ্ধ করিতেন । মিশ্রিত ঔষধ বা পর্যায়ক্রমে ঔষধ প্রয়োগ তিনি কখনই করেন নাই । বৃহস্পতিবার এবং রবিবার তিনি চেম্বার বন্ধ রাখিতেন । 



প্রশ্ন - হ্যানিমানের শেষ জীবন কিভাবে কাটে ? 
বা , হ্যানিম্যানের বার্ধক্যের সুখময় কাল ও শান্তিময় পরিসমাপ্তির বিবরণ দাও । বা , হ্যানিমান কতসালে মৃত্যুবরণ করেন ? মৃত্যুকালে তিনি কি বলিয়াছিলেন ? 

উত্তর : হ্যানিমানের শেষ জীবন অনেকটা শান্তিতেই কাটিয়াছিল । প্যারিসে তিনি ৮ বৎসর কাল অবস্থান করেন । তাঁহার দ্বিতীয় স্ত্রীর অগাধ সম্পদ ছিল । শেষ জীবনে তিনি তাঁহার অর্থ ও সেবা যত্ন লাভ করেন । তাঁহার স্ত্রী মৃত্যুকাল পর্যন্ত বিশ্বস্ততা ও ভালবাসার সহিত তাহাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেন । প্রায় শতাধিক ঔষধ নিজের উপর পরীক্ষা করিয়া এবং সারাজীবন বহু দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়া মানবজাতির পরম বন্ধু হোমিওপ্যাথির জনক যশ ও সম্মানের উচ্চতর শিখরে উন্নীত হইয়াছিলেন । এই মহামানব ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দের ২ রা জুলাই ভোর ৫ টায় প্যারিসে নিজের ঘরে ‘ রুইদ্য মিলান , নং -১ ' স্থানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দের ১১ ই জুলাই প্যারিসের মন্ট মার্টরী সমাধিক্ষেত্রে ৮ নং কবরে তাঁহাকে সমাহিত করা হয় । মৃত্যুকালে হ্যানিমান মৃদুস্বরে বলিয়াছেন , ' আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই ।


সমাপ্ত









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ