লাইকোপোডিয়াম- LYCOPODIUM, চতুর্থ বর্ষ


লাইকোপোডিয়াম 
LYCOPODIUM






প্রতিশব্দ:- লাইকোপোডিয়াম ইনফ্লেক্সনাম, ক্লাব মস, মাস্কাস ব্লেডাটাস, স্ট্যাগস্ হন, ভেজিটেবল সালফার, নেকড়ের থাবা। ভারতের মাদ্রাজ দেশীয় নাম- বনদারলী।

উৎস:- ভারতবর্ষ ও ইউরোপে উৎপন্ন 'ক্লাব মস' নামক উদ্ভিদের ফুলের দন্ডের অংকুরে উৎপন্ন রেনু হইতে এই ঔষধ প্রস্তুত হয়। 

উদ্ভিদের বর্ণনা:- ইহা এক প্রকার লতাময় গাছড়া। ইহার মূল কয়েকটি শক্ত ছড়ানো আঁশ দ্বারা গঠিত যাহা দেখিতে নেকড়ে বাঘের পায়ের থাবার ন্যায় দেখায়। ডাঁটা হামাগুড়ি দিয়া সোজা এককভাবে শাখায় আরোহণ করিয়াছে। সবুজ পাতাগুলি ছোট এবং হালকা, এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। জুলাই ও আগষ্ট মাসে এই সকল গাছে বাদামী বর্ণের ফুল দেখা যায়। সাধারণতঃ এই সকল ফুল জোড়ায় জোড়ায় থাকে, প্রত্যেক ফুলের একটি দত্ত এবং ঠাসাঠাসি আঁশ থাকে। এই দণ্ড হইতে সূক্ষ্ম চ্যাপ্টা রদ্রযুক্ত অংকুর পাওয়া যায়। ইহা হইতে মলিন হলদে বর্ণের চূর্ণ গ্রহণ করা হয়। এই চূর্ণ স্বাদ গন্ধহীন, জলে ইহা সিক্ত হয় না অথচ জলের উপর ইহা ভাসিয়া থাকে।

প্রাপ্তিস্থান:- ইউরোপ, ভারতের হিমালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুদ্ধ অরণ্য ভূমি ও পার্বত্য চারণ ভূমিতে এই গাছগুলি পাওয়া যায়।
 
 প্রস্তুতের ফরমুলা- এফ-৪

 প্রুভার:- মহাত্মা হ্যানিমান ইহা প্রুভ করেন।

ধাতুর রোগী বা ধাতুপ্রকৃতি:- লাইকোপোডিয়াম একটি গভীর ক্রিয়াশীল অন্যতম প্রধান এন্টিসোরিক ও টিউবারকুলার ঔষধ। সোরা ধাতু দোষ সংশোধানার্থ অনেকগুলি ঔষধই আছে, তাহার মধ্যে কাল-কাল, লাইকো এবং সালফারই প্রধান। যে সকল লোকের দেহ ক্ষীণ ও বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, তাহাদের শরীরে এবং যাহাদের সহজেই বা ঘন ঘন ফুসফুসের ও লিভারের পীড়া হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, তাহাদের শরীরেই এই ঔষধ ভাল ক্রিয়া করে।

ক্রিয়াস্থান:- দৈহিক বিধানের উপর ইহা প্রবল জিনা করিয়া থাকে। মূত্র, পরিপাক যন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন যন্ত্র, শৈষ্মিক ঝিল্পী ও স্নায়ু মণ্ডলের উপর ইহার প্রধান ক্রিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। জননেন্দ্রিয় ও চর্মের উপরও বিশেষপে ক্রিয়া করিয়া থাকে। যকৃতের উপরই যেন সর্ব প্রথম বিশৃঙ্খলাটি বিকাশপ্রাপ্ত হয় এবং উপরে বায়ু সত্য, অজীর্ণ প্রভৃতি লক্ষণ আনীত হইয়া থাকে। লাইকোপোডিয়ান বালক, বৃদ্ধ, যুবা স্ত্রীলোক সকলের পক্ষেই উত্তম কার্যকরী। কিন্তু বালক ও বৃদ্ধদিগের পক্ষে অপেক্ষকৃত উত্তম। যাহাদের ক্ষীণদেহ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাহাদের শরীরে এবং যাহাদের সহজেই বা ফুসফুসের ও লিভারের পীড়া হওয়ার প্রবণতা দেখিতে পাওয়া যায়। তাহাদিদের শরীরেই ইহা খুব ভাল ক্রিয়া করিয়া থাকে।

মানসিক লক্ষণ:-
১) রোগীর মনটি বড়ই দুর্ব্বল, ভীতিতে পরিপূর্ণ। নূতন কাজে হাত দিতে ভয় পায় কিন্তু একবার কাজ আরম্ভ করিলে অনায়াসে সে তাহা সমাধা করে।
২) নির্জনভাবে থাকিতে ভীতিজনক মনে হয়। 
৩) শান্তিপ্রিয়তা ইহার মনোলক্ষণের আর একটি দিক এবং সে জন্য পরিচিত বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ পছন্দ করিলেও ইহার রোগী বেশী লোক পছন্দ করে না।
৪) কোমল স্বভাব, সামান্য বিষয়ে অতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠে। দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর কোনও আপনজনের সহিত সাক্ষাতে বা করুণ রসের কোন গল্প বা সঙ্গীত শুনিলে সে কাঁদিয়া ফেলে।
৫) অপরদিকে যকৃতের বিশৃঙ্খলা ও কোষ্ঠবদ্ধতা দেখা দিলে ইহার মনে একটা বিষণ্ণতা, বিরক্ত ও ভীতির ভাব বৃদ্ধি পায়। স্মৃতি শক্তির অল্পতা ও হত বুদ্ধির ভারও ইহাতে বেশ লক্ষ্য করা যায়।
৬) কথা বলিতে লিখিতে, বানান ভুল হয়। বক্তব্য শব্দ যোগায় না- ২/১ টি শব্দ বাদ পড়িয়া যায় । 
৭) পীড়িত অবস্থায় রোগী নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং উত্তেজিত ভাবে আদেশ দেয়।
৮) নিদ্রা ভঙ্গের পর ইহার শিশুরা কিছুক্ষণ বিষণ্ন ও হতবাক হইয়া চাহিয়া থাকে যেন চতুর্দিকের সব কিছুই তাহার অপরিচিত। 

 চরিত্রগত লক্ষণ:-  
১) রোগী শীতকাতর, যদিও শীতকাতর তথাপি অংশ বিশেষে ঠাণ্ডাই চায়- মাথার দিকে গরম অনুভব করে। ইহা কেবল বক্ষদেশের নিম্ন অংশ সমূহে গরম চায়। উদর যন্ত্রে শৈত্যানুভূতির জন্য গরম খাদ্য অভিলাষ অর্থঃ মাথায় ঠাণ্ডা আকাঙ্খা।
২) রোগ লক্ষণ ডানদিকেই সৰ্ব্ব প্রথম দেখা দিয়া বামদিকে ধাবিত হয় বা ডান পার্শ্বেই সীমাবন্ধ থাকে ।
৩) অপিত্ত ও অজীর্ণে পেটে বায়ু সঞ্চয়, পেট ফোলা, পেট ডাকা, অম্ল- হেতু বুক জ্বালা, মুখে টক জল উঠা, টক ঢেকুর, আহারের পর তন্দ্রা ও আলস্য, কোষ্ঠ কাঠিন্য
৪) অতিরিক্ত ক্ষুধা কিম্বা অক্ষুয়া, দুই এক গ্রাস আহারের পরই পেট ফোলা, পেট দমশম হওয়া ।
৫) দেহের উর্দ্ধাংশ শীর্ণ, নিম্নাংশ ফোলা ।
৬) নাকের পাখা দুইটির উঠা পড়া, সর্দি অবস্থায় বা নিদ্রার মধ্যে বিনা সর্দিতে নাসিকা বন্ধ।
৭) প্রস্রাবের তলানি লালবর্ণ ইটের গুঁড়ার ন্যায়। কাপড়ে প্রস্রাব লাগিলে হলদে লাল মিশ্রিত রঙের ছোপ ধরে।
৮) দিন রাত্রি শুষ্ক কাশি, তৎসহ শরীরের ক্ষয় ও দুর্ব্বলতা।
৯) সারাদিন ক্রন্দন, কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করিতে পারে না।
১০) অতিরিক্ত হস্তমৈথুন কিম্বা শুক্রনাশহেতু ধ্বজভঙ্গ।
১১) সঙ্গমের সময় বা পরে জ্বালা, যোনী শুষ্ক ।
১২) প্রতিবার মলত্যাগ কালে জননেন্দ্রিয় হইতে রক্তস্রাব । 
১৩) নিমোনিয়ায় ডানদিকে আক্রান্ত ।
১৪) কোষ্ঠ কাঠিন্য, মলত্যাগে অত্যন্ত কষ্ট।
১৫) রাত্রে ঘর্ম, ঘর্ম ঠাণ্ডা, চটচটে ও টকগন্ধ যুক্ত এবং দুর্গন্ধ বিশিষ্ট। 
১৬) শিশুদের ডানদিকের হার্নিয়া । 

প্রয়োগক্ষেত্র:- অজীর্ণ, কোষ্ঠ কাঠিন্য, রক্তামশায়, লিভার পীড়া, অর্শ, ক্ষত, রক্তস্রাব, শোথ, প্রস্রাব সম্বন্ধীয় পীড়া, পাথরী পীড়া, পুংজননেন্দ্রিয় ও স্ত্রীজননেন্দ্রিয় পীড়া, ধ্বজভঙ্গ, সর্দি কাশি, ক্যাপিলারী ব্রঙ্কাইটিস, স্ফোটক, নিমোনিয়া, ক্ষয় রোগ, বুক ধড়ফড়ানি, বাত রোগ, সবিরাম ও টাইফয়েড জ্বর, তড়কা, রাত কানা, প্রভৃতি ক্ষেত্রে লাইকো ব্যবহৃত হয়।

বার্ধক্যে ও বাল্যকালে (বৃদ্ধ ও শিশুদের পীড়ায়):- লাইকোপোডিয়াম বালক, বৃদ্ধ, যুবা, স্ত্রীলোক সকলের পক্ষেই উত্তম কার্যকরী, কিন্তু বালক ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত উত্তমভাবে কার্য করে। লাইকো রোগী তাহার বয়স অপেক্ষা অধিকতর বৃদ্ধের মত দেখায়। বালকদের মস্তক বেশ পরিপুষ্ট কিন্তু দেখিতে ক্ষীণ ও দুর্ব্বল। যে সকল বালক ও বৃদ্ধ শেম্মা প্রধান ধাতুর, লিডার পীড়াগ্রস্ত, প্রস্রাবে লিথিক এসিড নির্গত হয়। মাথাটি বড়, গাত্রচর্ম শুষ্ক, রোগ ভোগ কালে খিটখিটে ও উদ্ধত, নিজেকে অপর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে, জীর্ণ শীর্ণ অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তাহাদের ক্ষেত্রেই ইহা উত্তম কার্যকরী। ইহার শিশুরা নিদ্রা ভঙ্গের পর কিছুক্ষণ বিষণ্ন ও হতবাক হইয়া চাহিয়া থাকে। যেন হতবুদ্ধির ভাব। এই ভাব কাটিয়া গেলে অনবরত পা ছোঁড়ে, মাতাকে পর্যন্ত লাথি মারে এবং মুখ না ধুইয়াই খাইবার জন্য বায়না ধরে। কিছুক্ষণ পর মনের এই ভাবটি আর থাকে না। ইহার শিশুদের উর্দ্ধাংগ বেশী শুষ্ক ও শীর্ণ। সারাদিন খুঁত খুঁত করে, কাঁদে ও বায়না ধরে। অতিশয় ক্ষুধা কিন্তু সামান্য আহার করিলে ক্ষুধার অবসান, কোষ্ঠবদ্ধ, সামান্য ঠাণ্ডায় সর্দি ও রাত্রিকালে নাসা পথ বন্ধ, দক্ষিণ পার্শ্বের ব্রঙ্কাইটিস, নিমোনিয়া বা উদরে বায়ু সঞ্চয় সহ নাকের পাখা দুইটির উঠানামা প্রভৃতির লক্ষণগুলি লাইকোর শিশু রোগীর চিত্র। বৃদ্ধদের ধ্বজভঙ্গেও ইহা উপকারী। বৃদ্ধ স্বামীর পুরুষত্বহীনতার জন্য তরুণী স্ত্রীর মনস্তুষ্টি করিতে না পারিলে উচ্চ শক্তির লাইকো সেবনে সে অভাব দূর হওয়া সম্ভব। সে জন্য বলা হয় বাল্যকালে ও বার্ধক্যে লাইকোপোডিয়ামের অনুকূল ক্রিয়া দর্শে ।

পরিপাক যন্ত্রের পীড়ায় (পাকাশয়ের উপসর্গ):- পরিপাক যন্ত্রের উপরই লাইকোর প্রধান ক্রিয়া। প্রচুর ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও দুই চার গ্রাস আহার করার পর পেটটি দশম হইয়া উঠে। আহারের ২/৩ ঘন্টা পর হইতে পেটটি এরূপ বায়ুপূর্ণ হইয়া উঠে যে রোগীর ভয়ানক অস্বস্তি হয়। নিম্ন পথে বায়ু নিঃসরণ হইতেও চায় না, উদ্গারও উঠে না। চুকা ঢেকুর উঠে। পেটের কাপড়টি আলগা করিয়া দিতে হয় নতুবা পেটটি চড়চড় করে। বিকাল ৪টা হইতে ৮টা পর্যন্ত ইহার উদর লক্ষণগুলি বিশেষতঃ ক্লেশ সমূহ বৃদ্ধি পায়। অজীর্ণে টক ঢেকুর উঠে, পেট জ্বলে, পেট ফোলে এবং চুঁইলেই লাগে। পুরাতন পীড়ায় খাদ্য বস্তু সহজে হজম হয় না, তরল পানীয় ভিন্ন অন্য কোনও দ্রব্য আহার করিলেই পেটে বেদনা হয়। সময়ে সময়ে বমি হয়। ঢেকুর পূর্ণ ভাবে উত্থিত হয় না, কেবল গলা পর্যন্ত উঠে এবং গলা জ্বালা করে, মুখে জল উঠে। ইহার উদরাময়ে তরল মলের সঙ্গে কঠিন মল মিশ্রিত থাকে, পেটে বেদনা থাকে না, বৈকালে ৪টা হইতে ৮টা পর্যন্ত উদরাময়ের বৃদ্ধি। মিষ্টি দ্রব্যে রুচি বেশী। উপরের পেট অধিক ফোলা, কোষ্ঠবদ্ধ, পেটে ভুটভাট করা, পেট ডাকা, পেটের ভিতর গোঁ গোঁ শব্দ করা প্রভৃতি লক্ষণে লাইকো উপকারী। বাহ্য হইলে ইহার পেট ফোলা কমে। 

ইচ্ছা ও অনিচ্ছা:- মিষ্ট দ্রব্যের প্রতি ইহার রোগীর রুচি থাকে। খাদ্য ও পানীয় গরমই পছন্দ করে। রোগী পেটে হাত দিতে পারে না। শান্তি প্রিয়তা ইহার মনো লক্ষণের একটি দিক এবং সেজন্যই পরিচিত বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ পছন্দ করিলেও লাইকো বেশী লোক পছন্দ করে না। মাথায় ঠাণ্ডা আকঙ্খা এবং বক্ষদেশের নিম্ন অংশসমূহে গরম চায়। ইহার রোগী কোন প্রকার প্রতিবাদ সহ্য করিতে পারে না ।

লিভার পীড়ায়:- লিভার প্রদেশে নিরন্তর একটু একটু এক ঘেয়ে রকমের বেদনা। পেটের বামদিকে বায়ু জমিয়া ভুটভাট করে, মুখ টক হইয়া থাকে, আহারের একটু পরেই পেট ভার হইয়া যায় কিম্বা অত্যন্ত ক্ষুধায় ২/১ গ্রাস আহার করিলেই যেন পেট ভরিয়া যায়। কোষ্ঠবদ্ধতা ইহাতে নির্দিষ্ট হইলেও কখনও কখনও আবার উদরাময়ও হইয়া থাকে। প্রস্রাব দুধের মত সাদা ঘোলা, লাল বর্ণের তলানি পড়ে। চেলিডোনিয়াম, ব্রায়োনিয়া ও মার্কুরিয়াসও লিভার পীড়ার মহৌষধ।

কোষ্ঠবদ্ধে ও অস্ত্রক্ষতে:- লাইকোতে কোষ্ঠবদ্ধতাই বিশেষ ভাবে থাকিতে দেখা যায়। আবার কোন কোন সময় উদরাময়ও দেখা দেয়। ইহার কোষ্ঠবদ্ধতা অনেকটা নাক্স ভমিকার ন্যায় প্রথম দেখা দেয় অর্থাৎ বার বার মলত্যাগের ইচ্ছা আদৌ থাকে না। এইরূপ ২/৩ বার অতিবাহিত হইবার পর মলত্যাগের ইচ্ছা হয় এবং মলের প্রথম অংশটি শক্ত এবং শেষ অংশটি ভাঙ্গা মত বাহির হইয়া থাকে। লাইকোতে যদিও ক্ষত করিবার প্রবৃত্তি নাই এবং পাকস্থলীতে ক্ষত বা অন্ত্রে ক্ষত হওয়া ইহাতে প্রায়ই নাই তবুও অচিকিৎসা ও কুচিকিৎসার ফলে ক্ষত জন্মিয়াছে বলিয়া ধারণা হইলে এবং ইহার লক্ষণ সমূহ বিদ্যমান থাকিলে লাইকো দ্বারা আরোগ্য সুনিশ্চিত।
 
শোথে লক্ষণ:- লিভার পীড়াগ্রস্ত ব্যাক্তিবর্গের শোথ রোগে লাইকো উপকারী। কোনও শোথ রোগে পায়ে অধিক ফোলা থাকিলে ও সেই ফোলার উপর ঘা থাকিলে ইহা আরও বেশী উপকারী। লাইকোতে রোগীর উপরার্ধ যেমন হাত, মুখ, বুক, গলা ইত্যাদি শুষ্ক শীর্ণ এবং নিম্নার্ধে যেমন- পেট, পাছা, পা ইত্যাদি খুব ভারী বোধ ও অত্যন্ত ফোলা ফোলা দেখায়। হৃৎপিণ্ডের পীড়া জনিত শোথে ইহা আর্সেনিক প্রভৃতি অন্যান্য ঔষধ অপেক্ষাও অনেক সময় অধিক উপকার করে। পেরিকার্ডিয়াম ও পুরার শোথেও লাইকো উপকারী।

প্রস্রাব সম্পর্কীয় লক্ষণ:- শিশুদের মূত্রকৃচ্ছ্রতায় লাইকো ভাল ঔষধ। প্রস্রাবে অতিশয় যন্ত্রণা, প্রস্রাব ত্যাগ কালীন শিশুরা যন্ত্রনায় ছটফট করে, কোথায়ও পা ছোঁড়ে। প্রস্রাব থামিয়া থামিয়া হয়, বেগ অনেক বেশী আসে, কিন্তু বসিয়া থাকিতে হয়, প্রস্রাব বাহির হয় না। প্রস্রাব হইতে এক প্রকার বালুকাবৎ পদার্থ বাজারে জমে। ছেলেদের এই রোগ হইলে লাইকো উপকারী। প্রস্রাবের সহিত যদি প্রচুর পরিমাণে লিথিক এসিড ডিপজিট থাকে এবং সেই জন্য প্রস্রাব করিতে জ্বালা করে, প্রস্রাবের পূর্বে শিশু ভয়ানক কাঁদে কিম্বা বেদনার যাতনায় ঘুম ভাঙ্গিয়া হাত পা ছোঁড়ে, প্রস্রাবে লাল বর্ণের ইটের গুঁড়ার ন্যায় লালবর্ণ তলানি পড়ে তবে ইহা উপকারী।

পাথরী লক্ষণ:- পিত্ত পাথরীতে প্রবল পিত্তশূল, লিভার স্থানে টাটানি বেদনা। মূত্র পাথরীতে ডানদিকের কিডনীর দিক হইতে বেদনা প্রথমে আরম্ভ হইয়া সেই বেদনা প্রস্রাব দ্বারা পর্যন্ত ক্রমশঃ পরিচালিত হইলে কিম্বা আরও নিম্নদিকে এমনকি পায়ে পর্যন্ত পরিচালিত হইলেও লাইকো উপযোগী। আবার উক্ত লক্ষণে বেদনা বামদিক হইতে উৎপত্তি। হইলেও ইহাতে উপকার হয়।

জননেন্দ্রিয়ের দুর্বলতা বা পুংজননেন্দ্রিয় পীড়ায় (ধ্বজভঙ্গ) লক্ষণ:- পুংজননেন্দ্রির উপর মানসিক ও শারীরিক শৈথিল্যই লাইকোপোডিয়ামের ক্রিয়া। লিঙ্গের উত্তেজনা ও সঙ্গম প্রবৃত্তি নষ্ট হইয়া যায়। এই অবস্থাটি প্রায়ই পৌড়াবস্থায় দেখা যায় এবং ইহার কারণ যৌবনের প্রারম্ভে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অতিরিক্ত ক্ষয়। পুংজননেন্দ্রিয়ের মধ্যে ভিতরে অনেক সময় ছোট ছোট উপমাংস জন্মাইয়া মূত্র স্রাবটি রোধ করিবার উপক্রম করে, সে অবস্থাতেও যদি লাইকোর সহিত রোগীর ব্যক্তিগত লক্ষণের সাদৃশ্য থাকে, তবে ইহাতে বিশেষ উপকার হয়। ধ্বজভঙ্গে ইহা একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। যে সকল যুবক অল্প বয়সে হস্তমৈথুন হেতু বা অস্বাভাবিক উপায়ে ইন্দ্রিয় চালনা করিয়া মেরুদণ্ডে, মস্তিষ্কে ও লিঙ্গে অত্যধিক দুর্ব্বলতা বোধ করে, তাহাদের পক্ষে লাইকো উত্তম। অতিরিক্ত স্ত্রী সহবাস জন্য অত্যধিক ধাতুক্ষয়ে যাহাদের লিঙ্গ শিথিল, ক্ষুদ্র ও বক্র হইয়া গিয়াছে, কিন্তু সঙ্গমের ইচ্ছা প্রবল আছে অথচ শক্তি থাকে না তাহাদের পক্ষে এই ঔষধ অধিকতর ফলপ্রদ। অতিরিক্ত স্বপ্নদোষ ও অসাড়ে শুক্রক্ষয় হইয়া ক্রমশঃ পুরুষত্বহীনতা উপস্থিত হইলে, লিঙ্গ সৰ্ব্বদাই শীতল বোধ হইলে ইহা উপকারী। বৃদ্ধদের ধ্বজভঙ্গেও ইহা খুব উপকারী। বৃদ্ধ স্বামীর পুরুষত্বহীনতা জন্য তরুণী স্ত্রীর মন সন্তুষ্টি করিতে না পারিলে উচ্চ শক্তির লাইকো সেবন করিতে দিলে সে অভাব দূর হওয়া সম্ভব । 

চর্মপীড়ায় লক্ষণ:- চর্মে ক্ষত জন্মানোর প্রবণতা। চামড়ার নীচে ফোঁড়া, গরম প্রয়োগে বৃদ্ধি। জল বসন্তের মত পীড়কী, গরমে বৃদ্ধি। অত্যন্ত চুলকানি, পূজযুক্ত ফাটা ফাটা উদ্ভেদ, খোঁস। পুরাতন একজিমা, তৎসহ মূত্রযন্ত্র, পাকাশয় এবং যকৃত ক্রিয়ার বিকৃতি। চর্ম মোটা ও স্ফীত হইয়া পড়ে। বাদামী বর্ণ দাগ ও পীড়কা, মুখের বামদিকে ও নাসিকায় অধিক, হাতের তালু শুষ্ক ও কুঞ্চিত। চুল অকালে পাকিয়া যায়। সোরায়সিস । পায়ে ও বগলে আঠা আঠা দুর্গন্ধযুক্ত ধর্ম।

ফুসফুসের লক্ষণ:- সুড়সুড়ি যুক্ত কাশি, শ্বাস কৃচ্ছ্রতা, বক্ষে টানপড়া, সংকোচক বেদনা। যখন ফুসফুসের যকৃতের মত নিরেট অবস্থা এতদূর বিস্তৃত হয় যে রোগী অতি কষ্টে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস লইতে থাকে এবং নাকের পাখনা পাখার মত নড়িতে থাকে তখন লাইকো উপযোগী। নিমোনিয়া আরোগ্যের পর যদি বিরক্তিকর শুষ্ক কাশি বর্তমান থাকে অথবা বুকে সাঁই সাঁই শব্দ ও শ্বাস কষ্ট থাকে, তবে লাইকো উপযোগী
নেট্রাম সালফ- আর্দ্র ঋতুতে শ্বাসকষ্ট। শেম্মা ক্ষরণযুক্ত হাঁপানী, বুকের মধ্যে ঘড় ঘড় শব্দ । কাশির সহিত দড়ির ন্যায় সবুজাভ শেখা উঠে; বুকের মধ্যে খালি বোধ। নিমোনিয়ায় সহজ আরোগ্য ক্রিয়া বিলম্বিত হইলে ইহা উপযোগী। বাম বক্ষস্থলের নিম্নাংশে বেদনা।

হস্তপদাদি বা প্রান্তদেশে লক্ষণ:- অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অবশতা এবং টানিয়া ধরা, ছিড়িয়া ফেলার মত বেদনা। বিশেষতঃ রাত্রিকালে। স্কন্ধ ও কনুই সন্ধিতে ছিন্নকর বেদনা। এক পা গরম অপর পা ঠাণ্ডা। প্রচুর পদ ঘর্ম । গোড়ালিতে বেদনা, যেন পাথরের নুড়ির উপর দিয়া চলিতেছে। পদতলে বেদনাযুক্ত কড়া। হাত পায়ের আঙ্গুল সংকুচিত। বেদনাযুক্ত পার্শ্ব চাপিয়া শুইতে - পারে না। হাত পা অবশ হইয়া যায়, রাত্রে শায়িত অবস্থায় পায়ের ডিম ও আঙ্গুলে খিল ধরে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গে টানিয়া ধরা ও ঝাকি মারা।

কাশি ও ব্রঙ্কাইটিসে লক্ষণ:- ব্রঙ্কাইটিস পীড়ায় যখন ডানদিকের ফুসফুস অধিক আক্রান্ত হয় এবং বক্ষ পরীক্ষায় সর্দির শব্দ ঘড়ঘড়ে পাওয়া যায়, প্রচুর পরিমাণে হরিদ্রা রঙের গয়ার উঠে তাহার সহিত জ্বর থাকে ও সেই জ্বর বৈকালে ৪টা হইতে ৯টার মধ্যে বৃদ্ধি হয়, তখন লাইকোতে উপকার হয়। এক প্রকার শুষ্ক কাশি দিনরাতে চলিতে থাকে, কাশিয়া কাশিয়া পেটে বেদনা হয়, কাশিতে গলা সুড়সুড় করে, কখনও কিছুমাত্র গয়ার উঠে না, আবার কখনও দিন রাত্রিতে প্রচুর পরিমাণে হরিদ্রা রঙের সবুজাভ, পুঁজের মত কিম্বা রক্তের ছিট মিশ্রিত গয়ার উঠে। সন্ধ্যার পর বা ঠাণ্ডা দ্রব্য পান করিলে কাশির বৃদ্ধি হয়। হাঁপানী কাশিতেও ইহা অনেক সময় উপযোগী। হাঁপানীর সহিত ইহাতে পেট ফোলা থাকে এবং বৈকালে ৪টা হইতে ৮টার মধ্যে হাঁপানীর টান বাড়ে। 

নিমোনিয়ায় লক্ষণ:- নিমোনিয়ায় ২য় অবস্থায় যখন ফুসফুসে বাতাস থাকিবার গর্তগুলি এক প্রকার চটচটে ঘন রসে পূর্ণ হইয়া  যায়, ফুসফুস নিরেট হয়, ফুসফুসের ভিতর বাতাস থাকে না, সে জন্য ষ্টেথোস্কোপ দ্বারা বক্ষঃ পরীক্ষা করিলেও ফুসফুসে বায়ু যাতায়াতের শব্দ পাওয়া যায় না এই অবস্থায় রোগীর অবস্থা ক্রমশঃ মন্দ হইতে থাকিলে ইহা ব্যবহারে রোগী আরোগ্য প্রাপ্ত হয়। ইহাই রোগের তৃতীয়াবস্থা এ অবস্থায় উক্ত ২য় অবস্থার কতক রস শোষণ ও কতক কাশির সহিত নির্গত হয়। লাইকোর রোগী। চিৎ হইয়া শুইলে প্রত্যেকবার নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় নাসিকার ডগার দুই পার্শ্বে । ফুলিয়া উঠে। কোন রোগীতে যদি এই লক্ষণ সহ সর্দি বেশ সরল, গয়ার প্রচুর। পরিমাণে উঠিতেছে কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট দূর হয় নাই, রোগেরও উপশম নাই কিম্বা রোগী কাশিয়া কাশিয়া গয়ার আদৌ তুলিতে পারিতেছে না, সর্দিও শ্রীঘ্র শোষণ হইতেছে না, কোন ঔষধে কিছুমাত্র ফল হইতেছে না তখন ৩০ বা ২০০ শক্তির ২/১ মাত্রা লাইকো প্রয়োগ করিয়া ২/১ দিন অপেক্ষা করিলে আশাতীত উপকার দর্শিবে। লাইকোতে সময়ে সময়ে গয়ার লোনা স্বাদ আবার কখনও কখনও অত্যন্ত দুর্গন্ধ হয়। রোগের বৃদ্ধি বৈকালে ৪টা হইতে ৮টা।

বাত পীড়ায়:- পুরাতন বাতে লাইকোপোডিয়াম অনেক সময়েই প্রয়োজনে আসে। প্রায়ই ডান অঙ্গে ইহা প্রকাশ পায়। বর্ষায় ইহার বৃদ্ধি এবং মৃদু সঞ্চালনে ও তাপে উপশমিত হইয়া থাকে। শয্যাতাপে যাতনায় উপশম পাওয়া যায়। ইহা ছাড়া ছোট ছোট ছেলেদের ও বৃদ্ধদের রাত্রে শয়নের পর নিদ্রাকর্ষনের ঠিক পূৰ্ব্বেই পা দুটিতে একপ্রকার স্নায়বিক অস্বস্তিকর আবির্ভাব হয়। সে জন্য অনেকক্ষণ ধরিয়া পা গুলিকে নাড়িতে হয়- নাড়ার মধ্যেই নিদ্রাকর্ষণ হয়। আবার অনেক সময় হস্ত পদ বিশেষতঃ দক্ষিণ হস্ত বা দক্ষিণ পদ যেন অসাড় হইয়া যায়, যেন সাময়িক পক্ষাঘাতসম অনুভব হয়, আবার চলিয়া যায়। প্রত্যেকবার নড়াচড়ায় রোগীর কোমর ব্যথা হইলে ব্রায়োতে উপকার না হইলে লাইকো ব্যবহার্য।

কেশের পীড়ায় (কেশ পতনে):- অল্প বয়সে চুল পাকে, মাথার মাঝখানে টাক পড়ে, কিন্তু অন্যখানের চুল বাড়ে ও ঘন হয়, পেটের কোনও অসুখ হইয়া ক্রমশঃ চুল উঠিয়া মাথায় ন্যাড়া হইয়া যায়। প্রসবের পর চুল উঠিয়া যায় দেখিতে পাইলে লাইকো ব্যবহার্য ।
 
তড়কায় লক্ষণ:- লাইকোর ফিটের সময় শিশুর মুখ রক্তহীন বা হরিদ্রাভ মুখ ও কপালের মাংস কুঞ্চিত ও রেখাপূর্ণ। রোগী জিহ্বা একবার বাহির করিতেছে আবার ঢুকাইয়া লইতেছে। মুখের পেশী সকলের আকুঞ্চনের সহিত কম্পন, মুখের কোন পর্যায়ক্রমে একবার যেন আকুঞ্চিত হইতেছে। পরক্ষণেই উহা যেন শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, নাসিকা পুট বা পক্ষ পর্যায় ক্রমে একবার আকুঞ্চিত হইতেছে পরক্ষণেই বাড়িতেছে, চক্ষু একবার আংশিক ভাবে খোলে, পরক্ষণেই মোড়ে। তড়কা ছাড়া অন্য রোগেও বিশেষতঃ টাইফয়েড জ্বরেও এই লক্ষণটি থাকিলে লাইকোপোডিয়াম অব্যর্থ ।

রাতকানায় লক্ষণ:- লাইকো রাতকানার একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। রাত্রিতে রোগী কিছুই দেখিতে পায় না। বিশেষতঃ সন্ধ্যা হইতে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত কিছুই না দেখিলেও ৮টার পরে দেখিতে পাইলে ইহাতে অব্যর্থ ফল ফলিয়া থাকে ।

বৃদ্ধি— আঁটিয়া কাপড় পড়িলে, উত্তাপে, নিদ্রাভঙ্গের পর ঠাণ্ডা বাতাসে, শব্দে, দেহ সঞ্চালনে, ডানদিকে, বিকাল ৪টা হইতে ৮টার মধ্যে, আহারে, টুপি পড়িলে ।

উপশম— গরম খাদ্য ও পানীয়ে, সঞ্চালনে, ঢেকুর উঠিলে, কাপড় খুলিলে বিছনার গরমে, শৈত্যে।

 সম্বন্ধযুক্ত ঔষধ- নাক্স ভমিকা, ক্যাল-কার্ব, সালফার ও ল্যাকেসিস চারিটি ঔষধের পর ইহার উত্তম ক্রিয়া প্রদর্শিত হয় । ইহা একটি দীর্ঘ ক্রিয় ঔষধ তাই প্রথম মাত্রায় একটু উপকার হইলে ২য় মাত্রা ব্যবহারে সাবধান হওয়া উচিত। কোনও পীড়া আয়োডিয়ামে কিছু উপকার হইতে তাহার পর লাইকো ব্যবহার্য।
 
পরবর্তী ঔষধ- নাক্স, বেলেডোনা, পালসেটিলা, ফসফোরাস, সিপিয়া। 

অনুপূরক ঔষধ- ক্যালকেরিয়া ও সালফারের পর লাইকো সুন্দর কাজ করে। আয়োডিয়াম, চেলিডোনিয়াম, ল্যাকেসিস, ম্যাডোরিনাম।

ক্রিয়ানাশক ঔষধ- কস্টিকাম, ক্যাক্ষর, ক্যামোমিলা, একোনাইট, পালসেটিলা, গ্রাফাইটিস।

ক্রিয়াস্থিতিকাল- ৪০ হইতে ৫০ দিন 
 
ক্রম বা শক্তি- ৩ হইতে ১০০০ বা তাহারও অধিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ