সিফিলিনাম - SYPHILINUM, চতুর্থ বর্ষ - মেটেরিয়া মেডিকা

সিফিলিনাম
SYPHILINUM








প্রতিশব্দ:- সিফিলিস বিষ, উপদংশের বিষ ।

উৎস:- ইহা একটি নোসোড জাতীয় ঔষধ। উপদংশের ক্ষতের বিষ হইতে ইহা পাওয়া যায়।

প্রস্তুত প্রণালী:- উপদংশের ক্ষতের বিষ হইতে এক কথায় বলিতে গেলে উপদংশের রোগ জীবাণু হইতে ইহা বিচূর্ণাকারে প্রস্তুত করা হয়। পরে হোমিও ফার্মাকোপিয়ার নিয়মানুসারে তরলীকরণ ও উচ্চক্রম প্রস্তুত হয়।

প্রস্তুতের ফরমুলা:- এফ-৮।

প্রুভার:- ডাঃ এলেন, ডাঃ কেন্ট, ডাঃ সোন, ডাঃ ওয়াইল্ড প্রমুখ চিকিৎসকবৃন্দ ইহা প্রুভ করেন।

ধাতুপ্রকৃতি:- উপদংশ বিষদুষ্ট ধাতুর রোগী। ইহা একটি প্রধান এন্টিসিফিলিটিক ঔষধ ।

ক্রিয়াস্থান:- উপদংশ বিষদুষ্ট ধাতুর পীড়ায় ইহা ক্রিয়া করিয়া থাকে। শরীরের গভীরতম উপাদান যথা- শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী, অস্থি ইত্যাদির উপর বিশেষভাবে এই ঔষধটি আধিপত্য বিস্তার করে। তরুণ সিফিলিসের ক্ষত অসদৃশ চিকিৎসায় বা বাহ্য ঔষধ প্রয়োগে চাপা দেওয়ার ফলে শরীরে যে দোষের সূচনা হয় তাহাতে এবং বংশগত সিফিলিস দোষদুষ্ট শরীরের উপর ইহার কার্যকারিতা সর্বাধিক।

ব্যবহারের পূর্বশর্ত:- মলম প্রভৃতির বাহ্য ঔষধ প্রয়োগে উপদংশ ক্ষত দমন করিবার ফলে অথবা বংশগত সিফিলিস দোষদুষ্ট যে সকল ব্যক্তি বার বার গলদেশ সংক্রান্ত প্রদাহে বা বহুবৎসর যাবত গলক্ষতে ও চর্মরোগে ভুগিতেছে, গ্লাণ্ডস্ফীতি, অস্থিবাত, ক্ষত প্রবণতা, গুহ্যদ্বারের ফাটা, ছেঁড়া অবস্থা ও যে কোনও নামের পীড়া প্রভৃতি ভোগ হওয়া সত্ত্বেও যখন কোন একটি নির্দিষ্ট ঔষধের হ্রাস-বৃদ্ধি পরিস্ফুট হয় না তখনই সিফিলিনাম ব্যবহার করার উপযুক্ত ক্ষেত্র।

দন্ত লক্ষণ:- ইহার রোগীর দাঁতগুলির মূলদেশ ক্ষয় হয়। দাঁতের কিনারাগুলি করাতের মত খাঁজকাটা, দাঁতগুলি ক্ষুদ্রাকার। জিহ্বা লেপাকৃত, দাঁত ক্ষয়প্রাপ্ত, দাঁতগুলির মধ্যে লম্বা লম্বা ফাটা ।

মানসিক লক্ষণ:- সিফিলিসের রোগী রুক্ষ্ম ও খিটখিটে মেজাজী এবং অতিশয় বিরক্তিসহ সহানুভূতি গুণ বিবর্জিত। কোন কিছু হইতেই সে আনন্দ পায় না বা কাহাকেও আনন্দিত করিতে পারে না। রাত্রিটি যতই নিকটতর হইতে থাকে ঐ বিরক্তি ও হতাশার ভারটি ততই তাহার মধ্যে বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং সন্ধ্যার দিকে সে পাগই হইয়া যাইবে এই ভীতিতে ব্যাকুল হইয়া উঠে। দীর্ঘদিন পূর্বে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যেই তাহার মনটি নিমজ্জিত থাকে, কিন্তু মুহূর্তকাল পূর্বে যাহা ঘটিয়াছে তাহা সে মনে করিতে পারে না।

স্মৃতিশক্তিহীনতায়:- সিফিলিনামের রোগীর স্মৃতি কেন্দ্রটিই সর্বপ্রথম বিশেষভাবে নিস্তেজ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। তাহার পর ধীরে ধীরে তাহার বুদ্ধি বৃত্তি ও অনুভূতি শক্তিটিও বিপর্যস্ত হইতে থাকে। প্রান্তদেশ ধৌত করিলে এবং সন্ধ্যা হইতে প্রাতঃকাল পর্যন্ত সারারাত্রি ব্যাপি হঠাৎ শয্যা ত্যাগ করিয়া কিছুক্ষণ পায়চারি করিলে মানসিক ও দৈহিক কোন রোগ যন্ত্রণার উপশম হইয়া থাকে। বিভিন্ন ধরণের ভয় ও আতংক। রাত্রিকালকে ভয় পায়। রোগ হইতে আরোগ্যলাভ করিতে পারিবে না বলিয়া নৈরাশ্য ।

স্মৃতিশক্তির অবস্থা:- স্মৃতিশক্তিহীনতা। রোগীর স্মৃতি কেন্দ্রটিই সর্বপ্রথম বিশেষভাবে নিস্তেজ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। তাহার পর ধীরে ধীরে তাহার বুদ্ধিবৃত্তি ও অনুভূতি শক্তিটিও বিপর্যস্ত হইতে থাকে। রোগী স্থান, ব্যক্তি ও বা পুস্তকের নাম মনে রাখিতে পারে না, অংক কষা কঠিন বোধ করে। বৃদ্ধকালের ক্রশমঃ বর্ধমান স্মৃতিশক্তি লোপ, স্মৃতিশক্তির হ্রাস ঘটিলেও কিন্তু রোগের পূর্ববর্তী সব কথা মনে থাকে ।

সিপিলিনাম, সরিনাম,  থুজা ও গ্রাফাইটিসের তুলনা:-

সিফিলিনাম:- সিফিলিনাম রোগীর চেহারাটি কদাকার, কুৎসিত এমনকি ঘৃণা উদ্রেককারী, তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিষয়ে সে 'সালফারের' ন্যায় উদাসীন নয় বা অপরিচ্ছন্নতায় আন্দনও পায় না। শরীরের ময়লা ও আবর্জনাদি সে পরিষ্কার করিতে চায়, কিন্তু কার্যতঃ তাহা পারে না ।

সোরিনাম:- ইহার রোগী তাহার ক্লেদময় অবস্থাটির বিষয় সম্পূর্ণ সচেতন থাকে, কিন্তু ঔ অবস্থা হইতে সে কোনও মতেই পরিত্রাণ পায় না, কেননা সে অতিশয় চর্মরোগ প্রবণ। নানা জাতীয় চর্মপীড়া আরোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাহার শরীরটিতে মানচিত্রবৎ রং বেরং এর নানা অসমতল দাগ থাকিয়া যায়। মনোস্ত রে সোরিণাম রোগী সালফার বা থুজার মত কুরুচি সম্পন্ন বা কুৎসিত নয় বরং সৌন্দর্য এবং আর্সের মত পরিপাটি সহকারে সুসজ্জিত থাকিতে চায়, কিন্তু চর্মপীড়ার প্রভাব হেতু সে তাহা পারে না। শুধু বাহ্যদেশেই সোরিনাম অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা, মনোস্তরে নয় ৷

থুজা:- থুজা ও মার্ক উভয় ঔষধই সমভাবে কুৎসিত অবস্থাযুক্ত এবং তাহা ইহাদের ঘাম ও লালাস্রাবের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত থাকে। থুজা নিজের নোংরা অবস্থা বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু অবস্থা হইতে পরিত্রানের কোন উপায় থাকে না। থুজার লক্ষণসমূহ আর্সের ন্যায় ভিজা বা শুদ্ধ ঠাণ্ডায় বৃদ্ধি পায়।

গ্রাফাইটিস:- ইহারও অপরিচ্ছন্ন নোংরা অবস্থার কারণ সোরিনামের ন্যায় চর্মপীড়া। ঐ সঙ্গে অপরিচ্ছন্নতার সহিত শুষ্ক তৈলবৎ দুর্গন্ধঘর্ম এই লক্ষণটি যুক্ত হওয়ায় পরিচ্ছন্ন থাকা ইহার পক্ষে সম্ভব হয় না। গ্রাফাইটিসের মধ্যেও নানা জাতীয় চর্মপীড়ার প্রবণতা থাকে এবং সেজন্য চর্মোপরি বিচিত্র বর্ণের প্রচুর দাগও লক্ষ্য করা যায়। প্রচণ্ড কোষ্ঠবদ্ধতার জন্য অস্ত্রমধ্যে প্রচুর মল সঞ্চয়, এই অবস্থাটিও ইহার অপরিচ্ছন্নতার জন্য কম দায়ী নয়। রোগী আদৌ ঠাণ্ডা সহ্য করিতে পারে না ।

চরিত্রগত লক্ষণ:-
১) রাত্রিকালকে ভয় পায়। যাবতীয় উপসর্গ রাত্রিতে বৃদ্ধি হয়।
২) মস্তকে রেখার ন্যায় প্রসারণশীল বেদনা। ইহা রগ হইতে আড়াআড়িভাবে বিস্তুত হয় অথবা চক্ষু হইতে আরম্ভ হইয়া পশ্চাৎদিকে গমন করে।
৩) কেশপতন, মস্তকের অস্থিতে বেদনা। মস্তকের শীর্ষদেশ যেন খুলিয়া আসিতেছে।
৪) চক্ষু কনীনিকার উপর অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোস্কাসমূহের উদ্ভেদসহ পুনঃ পুনঃ আক্রমণশীল পুরাতন প্রদাহ। চক্ষু কনীনিকার অন্তঃত্বক ক্ষয় প্রাপ্ত হইতে থাকে। প্রচণ্ড আলোভীতি ও অশ্রু নিঃসরণ।
৫) দ্বিত্ব দর্শন, দৃষ্ট পদার্থের ছবি একটির নিম্নে আর একটি দৃষ্ট হয় ।
৬) কর্ণের মধ্যে অস্থিসমূহের উপদংশজাত ক্ষতাবস্থা ।
৭) নাসিকার অস্থিগুলি ক্ষতগ্রস্ত, নাসিকার পচা ঘা ।
৮) মাড়ির কিনারাস্থিত হস্তের অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কিনারাগুলি করাতের ন্যায় ফাটা ফাটা, খর্বাকৃতি। জিহ্বা প্রলেপযুক্ত, দন্তের ছাপ জিহ্বার উপর দৃষ্ট হয়। জিহ্বার উপর লম্বা লম্বা গভীর ফাটাসমূহ নামিয়া আসে। প্রচুর পরিমাণে লালা নিঃসরণ, নিদ্রাবস্থার এই লালা মুখ বিবর হইতে গড়াইয়া বাহির হইয়া আসে।
৯) মদপানের অদম্য ইচ্ছা।
১০) সংকোচন প্রভাবে সরলাস্ত্র মনে হয় যেন বদ্ধ রহিয়াছে। মলদ্বার কাটা ফাটা, গুহ্যদ্বার নিষ্ক্রমণ ।
১১) নখকুনি, নখের সমগ্র কিনারায় পাকিয়া উঠে। পায়ের আঙ্গুলের মধ্যবর্তী স্থানসমূহে রক্তবর্ণ ও হাজাভাব।
১২) প্রান্তদেশ সব সময় ধৌত করিতে হয়। সকল সময় হাত ধৌত করিতে থাকে। নিষ্ক্রিয় ক্ষত যাহা ভাল হইতে চায় না ।
১৩) স্বরলোপ, গ্রীষ্মকালে পুরাতন হাঁপানীর আবির্ভাব, সাঁই সাঁই ও ঘড়ঘড় শব্দ। শুষ্ক কঠিন কাশি, রাত্রিতে বৃদ্ধি। হৃদপিণ্ডের আধোভাগ হইতে শিখর দেশ পর্যন্ত অস্ত্র দিয়া কর্তন করার ন্যায় যন্ত্রণা ।
১৪) চর্মে ঈষৎ রক্তবর্ণ মিশ্রিত বাদামী রঙের উদ্ভেদ, তৎসহ বিরক্তিকর গন্ধ।

প্রয়োগক্ষেত্র:- উপদংশ রোগ চাপা দেওয়ায় উহার বিষক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট লক্ষণাবলী যেমন-হটকারিতা, নৈরাশ্য, বিতৃষ্ণা, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা, মূর্খতা প্রভৃতি, অগ্নিকাণ্ড, হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি বিভীষিকাপূর্ণ স্বপ্ন, দুষ্ট জাতীয় ফোঁড়া, বাগী, অস্থিক্ষয়, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, বিভিন্ন অঙ্গে ক্ষত ও পচন প্রবণতা এবং ইহা ছাড়া নিদ্রাহীনতা, শীর্ণতা ও শুষ্কতা, অস্থিপীড়া, হৃৎস্পন্দন, বাত, শ্বেত প্রদর, সিফিসিল পীড়া, বিভিন্ন স্ত্রীপীড়া, চর্মপীড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়।

উপদংশ দোষদুষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে সিফিলিনাম একমাত্র উপায়:- বংশগত উপদংশ বা সিফিলিস দোষে দুষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে সিফিলিনাম প্রধান ঔষধ। সন্তান জন্মের বহু পূর্বে পৃিত শরীরে সিফিলিস দোষের আবির্ভাব হইলে তাহার সন্তানগুলি অবশ্যই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সিফিলিস ও টিউবারকুলোসিস-এই দুইটি অবস্থা যেন একটি মুদ্রার দুইটি দিক। কোনও পিতা সিফিলিস দোষটি নিজ জীবনে অর্জন করিয়া ঐ দোষের ১) প্রাথমিক অবস্থায় বা ২) দ্বিতীয় অবস্থায় বা ৩) তৃতীয় বা শেষাবস্থায় যথাক্রমে একটি করিয়া তিনটি সন্তানের জন্ম দিলে ঐ তিনটি সন্তানের শরীরেই কি বংশগত ভাবে আগত ঐ দোষের প্রভাবটি সমভাবে অর্থাৎ একই শক্তিতে ক্রিয়াশীল থাকিবে? ইহার উত্তরে এ কথাই বলিতে হয় যে, সবকয়টি সন্তানের শরীরেই ধ্বংস প্রবৃত্তিটি বর্তমান থাকে, কিন্তু ঐ ধ্বংসমুখী গতিটি প্রাথমিক দোষযুক্ত সন্তানের ক্ষেত্রে দ্রুতভাবে সম্পন্ন হয়, দ্বিতীয় অবস্থা প্রাপ্ত সন্তানের ক্ষেত্রে ঐ গতিটি প্রাথমিক অবস্থা প্রাপ্ত সন্তান অপেক্ষা সামান্য মন্থরভাবে চলিতে থাকে এবং তৃতীয় বা শেষাবস্থা প্রাপ্ত সন্তানে ঐ গতিটি সুস্পষ্ট ও অধিকতর ধীরতা লইয়া অগ্রসর হইতে দেখা যায় ।
১) প্রাথমিক প্রকৃতির দোষযুক্ত সন্তানটি সর্বদেহে ক্ষত লইয়া ভূমিষ্ট হয় এবং এক মাসের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে, না হয় ঐ অবস্থাটি বহন করিয়া চলিতে থাকে।
২) দ্বিতীয় অবস্থা প্রাপ্ত সন্তানটি এবং শরীরের নানাস্থানে, বিশেষ করিয়া গলদেশের তন্দ্রাচ্ছন্ন নিদ্রা, প্রচুর লালাস্রাব এবং শরীরের নানাস্থানে, বিশেষ করিয়া গলদেশের প্লাণ্ড, নাসিকা গ্রন্থি স্ফীতি ইত্যাদি সময়োচিত লক্ষণের মধ্য দিয়া তাহার শৈশব জীবনটি অতিবাহিত করে।
৩) তৃতীয় বা শেষ পর্যায়ভূক্ত অবস্থার যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহার সব কিছুই ‘ঢাকাচাপা’ পড়িয়া-নির্বাচনযোগ্য কোন লক্ষণই পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র শীর্ণতার প্রাধান্যতাই এই অবস্থার প্রকৃষ্ট লক্ষণ। ক্ষতের কোন নিদর্শন এখানে থাকে না। ঐ সঙ্গে শৈশবকালে নিম্নোদরে যন্ত্রণাভূতি, হৃৎস্পন্দন, অদম্য টনসিল প্রদাহ, ঠাণ্ডা লাগার সুগভীর প্রবণতা, নিরতিশয় মানসিক বিরক্তিসহ অস্থিরতা প্রভৃতি লক্ষণগুলি শিশু শরীরে অবস্থিত ক্ষয় দোষের সুষ্পষ্ট ইংগিত বহন করে। উহাদের পোষণ গতিটি অতি শৈশবাবস্থা হইতেই অস্বাভাবিক ভাবে চলিতে থাকে, কাজেই বর্ধনের অভাব বা অতি বর্ধন উভয় প্রকার অবস্থাই উহাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সিফিলিস দোষের তৃতীয় অবস্থা প্রাপ্ত মাতাপিতার সন্তানদের আভ্যন্তরীণ অসুস্থতার নিদর্শনটি শৈশবাবস্থা হইতেই মদ্যপানের অদম্য স্পৃহা ও স্বভাবগত নিদারুন কোষ্ঠবদ্ধতার মধ্য দিয়া বিকাশ লাভ করিতে থাকে এবং উচ্চশক্তির সিফিলিনামে আরোগ্য করা না হইলে ঐ অবস্থাদ্বয় আজীবন চলিতে থাকে। এই সকল শিশু অতি শৈশবাবস্থা হইতে যৌবনাবস্থার শেষ সময়ের মধ্যেই যক্ষ্মা বা শুষ্ক জাতীয় ক্ষয় পীড়া আসিবার সম্ভাবনা থাকে। তাই বলা যায় উপদংশ বা সিফিলিস দোষে দুষ্ট রোগীক্ষেত্রে ইহা একমাত্র ঔষধ । 

মস্তিষ্ক বা শিরঃপীড়ার লক্ষণ:- ইহার রোগীর স্নায়ুকেন্দ্রটি এত বেশী বিপর্যস্ত হয় যে, রোগী প্রায়ই স্নায়ুশূলে কষ্ট পায়। ঐ জাতীয় যন্ত্রণা সাধারণতঃ মাথাতেই অধিক বিকাশ লাভ করে এবং নিদ্রাহীনতার একটি বিশেষ কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ইহার শিরঃপীড়ার প্রকৃতি এই যে, তাহার মাথার অর্ধাংশে বা সমগ্র কপালে সীমাবদ্ধ থাকে এবং সন্ধ্যাকাল হইতে আরম্ভ হইয়া রাত্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এরূপ ভীষণ আকার ধারণ করে যে, রোগী পাগলের মত প্রলাপ বকিতে বকিতে অনিদ্রার মধ্য দিয়া সমস্ত রাত্রিটি অতিবাহিত করে। ইহার নিদ্রাহীনতার বৈশিষ্ট্য এই যে, স্নায়বিক জাতীয় যে কোন যন্ত্রণার পূর্বাভাসরূপে উহা আবির্ভূত হয়। যেমন- রোগীর দাঁত ব্যথার অভ্যাস থাকিলে প্রথমে নিদ্রাহীনতা, তারপর দাঁত ব্যথার সূত্রপাত, শিরঃশূল থাকিলে অগ্রে নিদ্রাহীনতা, তারপর শিরঃপীড়া আরম্ভ হয়।
এই নিদ্রাহীনতার ব্যাখ্যা করিতে গেলে বলিতে হয় নিদ্রাহীনতা মার্ক ও ল্যাকেসিসেও আছে, তবে মার্ক ও ল্যাকেসিসের নিদ্রা স্বপ্নময় ও অগভীর। আর সিফিলিনামের নিদ্রাটি গভীর, কিন্তু তাহা হঠাৎ ভাঙ্গিয়া যায় এবং রোগী তখন বেশ কয়েক ঘণ্টা যাবত জাগিয়া পায়চারি করে, পুনরায় ঘুমাইয়া পড়ে এবং পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলিতে থাকে। এইভাবে ২/৩ বার নিদ্রাভঙ্গের মধ্য দিয়া সারারাত্রি অতিবাহিত হয় এবং বিষণ্ণ ও অতৃপ্ত মন লইয়া ক্লান্ত দেহে শয্যাত্যাগ করে। গভীর নিদ্রাহীনতাই ইহার রোগী অধিক কামনা করে। প্রবল সিফিলিস দোষদুষ্ট রোগীর প্রলাপ অথবা উন্মাদ অবস্থা, এমনকি টাইফয়েড জনিত মস্তি ষ্কের বিশৃঙ্খল অবস্থা আসিবার পূর্বাভাসরূপে সর্বপ্রথমেই পূর্বোক্ত নিদ্রাহীনতা সুনিশ্চিতভাবে আবির্ভূত হয়। অতএব ঐরূপ নিদ্রাহীনতা লক্ষণ কিছুদিন চলিতে থাকিলে সন্দেহ করিতে হয় যে সে ব্যক্তির শরীর সিফিলিস দোষে দুষ্ট। সেই সঙ্গে সিফিলিটিক রক্তোচ্ছ্বাস, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ঘর্ম, জিহ্বা প্রভৃতি লক্ষণগুলিও বর্তমান থাকা চাই। ইহার রোগী মাত্রই প্রান্তদেশসমূহ ধৌত করিতে চায় ৷

শিশুদের শীর্ণতা ও শুষ্কতায়:- টিউবারকুলার দোষের প্রবণতা বা বিকশিত অবস্থা বিশিষ্ট পরিচয় জ্ঞাপক শীর্ণতা অথবা সার্বদৈহিক দুর্বলতা সিফিলিনামের ধাতুযুক্ত রোগীতে, বিশেষ করিয়া শিশু রোগীতে এরূপ প্রবলাকারে বর্তমান থাকে যে, ঐ সকল শিশু অবিরত শুকাইতে শুকাইতে একেবারে অস্থিচর্মসার হইয়া উঠে। ইহার কারণ মাতাপিতার শরীরে অর্জিত সিফিলিস দোষ, যাহা পুত্রকন্যাকে টিউবারকুলোসিসে পরিণত করে। এই সকল শিশুর জিহ্বার অবস্থা, লালাস্রাব, ঘর্মাধিক্য বিশেষ করিয়া রাত্রিকালীন বৃদ্ধি-এই লক্ষণগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করিলে সহজেই বুঝিতে পারা যায়। বংশগত সিফিলিস দোষটি টিউবারকুলার দোষে রূপান্তরিত হইয়া উহাদের শরীরে বিরাজ করিতে থাকে। ঐ প্রকার শীর্ণতা কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই যে টিউবারকুলার দোষজ, তাহা মনে করা ভুল। কেননা সোরা বা সাইকোসিস দোষের প্রাধান্যতা হেতুও ঐ প্রকার শীর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। কাজেই এক্ষেত্রে স্মরণ রাখিতে হয় সোরা দোষযুক্ত শিশু অস্থির, সাইকোটিক দোষযুক্ত শিশু উদরাময়ের প্রবণতাযুক্ত এবং সিফিলিস দোষযুক্ত শিশু আক্ষেপ প্রবণ ।
সিফিলিনাম শুধুই যে দৈহিক শুষ্কতা আনয়ন করে তাহা নয়, মনটিকেও ইহা অতি মাত্রায় দুর্বল করিয়া তোলে, সেজন্য ইহার শিশুরোগী ভালভাবে পড়াশোনা করিতে পারে না। কোন কিছুই মনে রাখিতে পারে না, স্থূলবুদ্ধি, বোকামী ও উদাসীনতাই স্মরণযোগ্য মানসিক পরিচয়। সিফিলিনামের শীর্ণতার সহিত সুগভীর মানসিক অবসাদ বর্তমান থাকে। কাজেই পুষ্টিকর খাদ্যবস্তু আহার করা সত্ত্বেও যে সকল রোগী শৈশবাবস্থা হইতে চিন্তাশূন্যভাবে এবং নিষ্ক্রিয়তা ও অবসাদের মধ্য দিয়া ক্রমাগত শীর্ণ ও শুষ্ক হইতে হইতে একেবারে অস্থিচর্মসার হইয়া পড়ে, তাহাদের শরীরে বংশগত সিফিলিস দোষটি অবশ্যই। বর্তমান আছে ইহা বুঝিতে হইবে। আহারে অরুচি না থাকিলেও খাইবার প্রবৃত্তি সিফিলিস দোষের ধর্ম- সাইকোসিস ক্ষুধার অবস্থা ঠিক উহার বিপরীত।

থুজা, এসিড নাইট্রিক ও গ্রাফাইটিসের তুলনা:

সিফিলিনাম:- সিফিলিনামের এই অবস্থাটি অতিশয় ভয়ঙ্কর দুর্দমনীয়, যন্ত্রণাপূর্ণ এবং নিদারুন ক্ষতযুক্ত। সংকোচন প্রভাবে সরলাস্ত্র মনে হয় যেন বন্ধ রহিয়াছে। মলদ্বার ফাটা ফাটা, গুহ্যদ্বার নিষ্ক্রমণ। বংশগত সিফিলিস দুষ্ট ব্যক্তির বারবার গলদেশ সংক্রান্ত প্রদাহ, চর্মপীড়া, গ্ল্যাণ্ডস্ফীতি অস্থিবাত, ক্ষত প্রবণতা এবং গুহ্যদ্বারের ফাটা ছেঁড়া অবস্থা।

থুজা:- ইহার গুহ্যদ্বারের ফাটা ছেঁড়া অবস্থা ও গনোরিয়া স্রাব পর্যায়ক্রমে আসা যাওয়া করে। ঐ স্রাবটি আরম্ভ হইলে গুহ্যদ্বারের ঐ অবস্থাটির অবসান ঘটে। উপরন্তু ইহার গুহ্যদ্বারের ফাটলের সহচর রূপে নানা রঙ বেরঙ এর ও নানা জাতীয় মাংসবৃদ্ধি যথা- আঁচিল, ডুমুরফুলি, অর্শবলী ইত্যাদি আসিয়া রোগীর অবস্থাটিকে ভয়ানক জটিল করিয়া তোলে। ইহা ছাড়া গুহ্যদ্বারে এত অস্বাভাবিক টাটানি থাকে যে, চলাফেরা করার সময় রোগী খুবই কষ্টবোধ করে, এমনকি শয়নাবস্থাতেও পা দুইটি যথাসম্ভব ফাঁক করিয়া রাখিতে বাধ্য হয়। গরম প্রয়োগ আরামদায়ক এবং ঠাণ্ডা জলে ও ভিজা ঠাণ্ডা সমস্ত লক্ষণের বৃদ্ধি ।

এসিড নাইট্রিক:- ইহার মলদ্বারের ফাটার বিশেষ করিয়া ভগন্দরের বৈশিষ্ট্য এই যে, মলত্যাগের পর দীর্ঘ সময় যাবত জ্বালা ও প্রচণ্ড যন্ত্রণা চলিতে থাকে। মলত্যাগকালে রোগী অনুভব করে তাহার মলদ্বারের ভিতর যেন কতকগুলি সূঁচালবস্তু লাগিয়া রহিয়াছে এবং সামান্য নড়াচড়াতেই গুহ্যদ্বারে ভীষণ জ্বালা ও কাটিয়া ফেলাবৎ যন্ত্রণার আবির্ভাব হয়। এ যন্ত্রণা ঠাণ্ডা জলে বৃদ্ধি পায় এবং উত্তাপে ও গরম প্রলেপে উপশমিত হয়। তবে সামান্যতম স্পর্শে ইহার যন্ত্রণাদি নিরতিশয় বৃদ্ধি পায় বলিয়াই মলদ্বারে গরম প্রয়োগ সত্ত্বেও রোগী বলিতে থাকে কোনও কিছুতেই তাহার উপশম আসিতেছে না। সুতরাং এক্ষেত্রে বুঝিতে হইবে ঐ বৃদ্ধির কারণ উত্তাপ প্রয়োগ নয়। স্পর্শই তাহার অস্বস্তির কারণ। দূর হইতে তাপ প্রয়োগ করাই সে পছন্দ করে এবং কার্যত তাহাতেই উপশম পায় ।

গ্রাফাইটিস:- এই ঔষধটির মলদ্বারে স্থানীয় লক্ষণ অপেক্ষা রোগীর ব্যক্তিগত লক্ষণের মূল্যই অধিক। মোটাসোটা শরীর ও চর্মোপরি রং বেরঙয়ের বিচিত্র ছাপ ও কদাকার চর্মপীড়া হইতে আঠাল স্রাব, রক্তোচ্ছাসসহ শীতকারতা ইত্যাদিই ইহার মূল্যবান প্রয়োগ প্রদর্শক লক্ষণ । ঐ সঙ্গে আম জড়ান মোটা লম্বা ল্যাড়যুক্ত কোষ্ঠবদ্ধতাও ইহার বৈশিষ্ট্যজনক লক্ষণ ।

সিফিলিনামের দন্তলক্ষণ এবং অরামমেট, এসিড ফ্লোর ও কেলি আয়োডের সহিত তুলনা:-

সিফিলিনাম:- অস্থিসমূহে পচন ও ক্ষত উৎপাদনে, এমনকি মেরুদণ্ডের অস্থিতে ক্ষত আনয়নে সিফিলিনামের শক্তি অসীম। দাঁতের উপরই ইহার অস্থিক্ষয়ের প্রথম ক্রিয়া সূচিত হইতে দেখা যায়, কাজেই সেগুলি অপরিপুষ্ট, অসম আঁকাবাঁকাভাবে শ্রেণীবদ্ধ, করাতের মত দাঁড়াযুক্ত এবং অগ্রভাগগুলি পরস্পর সংলগ্ন অথচ নিচের অংশগুলি অনেকখানি ফাঁকযুক্ত হইতে দেখা যায়। বাল্যকাল হইতেই সিফিলিনামের ধাতুযুক্ত শিশু রোগীর শরীরে বংশগতভাবে প্রাপ্ত সিফিলিস দোষের নিদর্শনটি দাঁত ও মাড়ির অসুস্থতার মধ্য দিয়াই সুপরিস্ফুট থাকে। ঐ সঙ্গে উহাদের চোখের অবস্থাটির দিকে নজর দিলেই লক্ষ্য করা যায় যে, সামান্যতম ঠাণ্ডার সংস্পর্শেই উহাদের চোখ দুইটি সহজেই প্রদাহান্বিত হয়, এই প্রকার অবস্থায় বংশগত ইতিহাস পাওয়া না গেলেও ধারণা হয়, বংশগত সিফিলিস দোষটিই সুনিশ্চিতভাবে উহাদের শরীরে ক্রিয়াশীল আছে।

অরামমেট:- মনের উপর ক্রিয়া ঝংকার উৎপন্ন করিতেই ইহার মূল শক্তিটুকু যেন ব্যয়িত হইয়াছে এবং অবশিষ্ট শক্তিটুকু শরীরে অন্য কোনও স্থান অপেক্ষা শীর্ণতা ও অস্থিক্ষয় আনয়ন করিতেই যেন নিঃশেষিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। নাসিকার অস্থিই ইহার দ্বারা বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়। তাহা ছাড়া স্ত্রীলোকের জরায়ুযন্ত্রের কাঠিন্যতা যুক্ত ক্ষত আনয়ন করিয়া ইহা জরায়ু তন্ত্রসমূহকে ক্যান্সারপ্রবণ করিয়া তোলে। তবে ইহার বৈশিষ্ট্য এই যে, অস্বাভাবিক মানসিক বিষণ্ণতা না থাকিলে অরাম প্রয়োগ করা চলে না। অরাম সিফিলিনামের অনুপূরক। 

এসিড ফ্লোর:- বেদনাযুক্ত ক্ষত উৎপাদন করাই ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য। অস্থিসমূহের শ্লৈষ্মিক আবরণ অর্থাৎ যে বস্তুর দ্বারা অস্থিগুলি আচ্ছাদিত থাকে, তাহার উপরেই ইহার ক্রিয়া প্রাধান্যতা লক্ষ্য করা যায়। ইহার পরবর্তী ক্রিয়াস্থান দন্তরাজি। এজন্য ইহার রোগীর দাঁতগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত ও ক্ষতযুক্ত হইতে দেখা যায় এবং ঐ স্থান হইতে দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পাতলা স্রাব নিঃসরিত হইতে থাকে। নখের উপরও ইহার ক্রিয়া উপেক্ষার বিষয় নয়। কেননা নখগুলি ভঙ্গুর প্রবণ ও ঢেউ খেলান উঁচুনীচু আকার ধারণ করে এবং সাদা সাদা দাগে পূর্ণ হইয়া উঠে। তাহা ছাড়া নখগুলির ভিতর কোনও কিছু প্রবিষ্ট হইয়া যেন খোঁচা মারিতেছে, এই প্রকার অনুভূতি থাকায় ইহার রোগী সর্বদাই সেগুলি খুঁটিতে থাকে। এসিড ফ্লোরের রোগী পরিশ্রমে কোন সময়ই ক্লান্ত হয় না, সে সর্বদাই ঠাণ্ডা অভিলাষ করে, কখনই গরম চায় না এবং কাপড়খানি খুব আঁটিয়া পরা পছন্দ করে। জানুর লম্বা অস্থির ক্ষত ও লক্ষণ সাদৃশ্যে ইহার দ্বারা আরোগ্য হয় ।

কেলি আয়োড:- সিফিলিস দোষ শরীরে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী, অস্থি, গ্ল্যাণ্ড, বিশেষতঃ লিক্ষ্যটিক গ্ল্যাণ্ড ইত্যাদি যেভাবে আক্রান্ত হয়, ইহার অনুরূপভাবে ঠিক • সেগুলিকে আক্রমণ করে। নাসারন্ধ্রে মামড়ি উৎপাদন এবং আক্রান্ত স্থান হইতে দুর্গন্ধ সবুজ বর্ণের পূজ নিঃসরণে ইহার শক্তি সীমাহীন। স্পর্শকাতরতাও ইহাতে এত বেশী বর্তমান থাকে যে, আক্রান্ত স্থানের দৃঢ় দেশেও ইহার রোগী স্পর্শ সহ্য করিতে পারে না। ইহার নাসিকা কেলি বাই এর মত চ্যাপ্টা এবং অগ্রভাগটি লালবর্ণযুক্ত। গরম খাদ্য অভিলাষ করিলেও ইহার রোগী বাহ্যদেশে মুক্ত বাতাস পছন্দ করে এবং তাহাতেই উপশম পায় ।

চক্ষুপীড়ায় লক্ষণ:- উপদংশ দুষ্ট পিতামাতা হইতেই ইহার চক্ষুপীড়া দেখা দেয়। ইহার চক্ষুপীড়ার তীব্রতা রাত্র ২টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত অধিক থাকে। সামান্য ঠাণ্ডার সংস্পর্শে রোগীর চোখ দুইটি প্রদাহান্বিত হয়। নবজাত শিশুর চক্ষুর প্রদাহের জন্য চক্ষুর পাতা ফুলিয়া উঠে, চক্ষুদ্বয় জুড়িয়া যায়, ইহাতে প্রচুর পূঁজ বাহির হয়, ঠাণ্ডা পানিতে ধুইলে চক্ষু যন্ত্রণার উপশম, রাত্রিকালে সর্বাধিক যন্ত্রণার বৃদ্ধি ইহার লক্ষণ ।

সদ্যোজাত শিশুর চক্ষু উপসর্গে লক্ষণ:- সদ্যোজাত শিশুর চক্ষু উঠা, চোখের পাতা ফুলিয়া উঠে এবং ঘুমের সময় জুড়িয়া যায়। রাত্রে ভয়ানক ব্যথা হয় বিশেষতঃ ২টা ইহতে ৩টা পর্যন্ত ব্যথা বাড়ে। চক্ষু হইতে প্রচুর পূঁজ বাহির হয়। উক্ত উপসর্গে সিফিলিনাম উপযোগী।

হৃৎস্পন্দনে ও হৃদপীড়ায় লক্ষণ:- হৃদপিণ্ডে কাটিয়া ফেলার মত বেদনা। ঐ বেদনা উপর হইতে নিচের দিকে নামে। সিফিলিনামের দ্রুত হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও বর্শাবিদ্ধ একটি উর্ধগামী বেদনা থাকে এবং প্রধানত রাত্রিকালেই ইহা অধিক বৃদ্ধি পায়। হৃদকপাটগুলিকে আক্রমণ করিয়া হৃৎযন্ত্রের কাঠিন্যতা আনয়ন করিয়াই সিফিলিনামের শেষ লক্ষ্য। মার্ক ও সিফিলিস দোষযুক্ত অন্যান্য ঔষধের মত ইহারও বক্ষ ও শ্বাসযন্ত্র আক্রমণের বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই কারণেই ডাঃ ডানহাম বলিয়াছেন, সিফিলিসই সম্ভাব্য টিউবারকুলোসিস অর্থাৎ সিফিলিসের মধ্যেই যক্ষ্মা ও ক্ষয়ের বীজ সুপ্তাকারে অবস্থান করে। অধিকন্তু সিফিলিস দোষজ অধিকাংশ ঔষধের ন্যায় সিফিলিনাম রোগীও যে কোন রোগে বিশেষ করিয়া হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত রোগে ডান পার্শ্বে শুইতে পারে না। ইহার কাশি শুষ্ক এবং তাহা ডানপার্শ্বে শয়নের বৃদ্ধি পায় ।

বাত রোগে লক্ষণ:- সিফিলিনামের বাত প্রধানত সন্ধিস্থলেই প্রকাশ পায়। এই অবস্থায় হাতটি পাশাপাশি ভাবে উপরে তুলিতে চেষ্টা করিলে রোগ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়। অথচ সমকোণাকৃতি ভাবে হাতটি উপরে তুলিতে বিশেষ কষ্ট হয় না। কাজেই রোগী যদি জোরপূর্বক তাহার আক্রান্ত হাতটি ঝুলাইয়া থাকা অবস্থা হইতে একবার উপরের দিকে তুলিবার চেষ্টা করে তবে সমগ্র হাতটি সাময়িকভাবে পক্ষাঘাত অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া অনৈচ্ছিকভাবে নিচের দিকে পড়িয়া যায়। ডান স্কন্ধের পাখনায় টাটানিযুক্ত বেদনা, চেলিডোনিয়াম ও লাইকোপোডিয়াম দুইটি ঔষধেও বর্তমান থাকিতে দেখা যায় ।

কোষ্ঠবদ্ধতায় লক্ষণ:- প্রবল কোষ্ঠবদ্ধতা। সরলান্ত্রে অবরুদ্ধবোধ, রোগী মলদ্বারে আঙ্গুল দিয়া মল টানিয়া আনে, ইহা ছাড়া মল বাহির হয় না। প্লাম্বাম মেটেও উক্তরূপ অবস্থা হয়। তবে উহার রোগী মনে করে যেন মলদ্বারের পশ্চাতে কেহ রশি দিয়া বাঁধিয়া টানিতেছে। যদি কোষ্ঠবদ্ধতায় সিফিলিনামের রোগী ডুস নেয় বা পিচকারী দেয় তবে মল নিঃসরণের সময় কলিক বেদনা হয়। সরলাস্ত্র বাহির হইয়া পড়ে। যদি বংশগত সিফিলিসের ইতিহাস বর্তমান থাকে তবে সিফিলিনাম ব্যবহারে আরোগ্য হয়।

স্ত্রীরোগে লক্ষণ:- প্রচুর পরিমানে হাজনশীল শ্বেতপ্রদর স্রাব, সিফিলিস দোষের পরিচয় জ্ঞাপক লক্ষণ। ঐ অবস্থাটি সিফিলিনাম স্ত্রীরোগীতে যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। রাত্রিকালেই উহা বৃদ্ধি পায় এবং যে স্থানের উপর দিয়া ঐ স্রাবটি প্রবাহিত হয় সেখানে টাটানি ব্যথা ও চুলকানির উদয় হয়। ঋতুস্রাবের মতই ইহার প্রদর স্রাবও প্রচুর শ্লেষ্মা পূঁজ মিশ্রিত ও দুর্গন্ধযুক্ত। গোড়ালি পর্যন্ত গড়াইয়া পড়া প্রচুর শ্বেতপ্রদর স্রাব এই লক্ষণটি এলুমিনা ও সিফিলিনাম উভয়েরই প্রসিদ্ধ লক্ষণ। তবে এলুমিনার ন্যায় খড়িমাটি, কাঠকয়লা প্রভৃতি অদ্ভূত বস্তু খাইবার অভিলাষ এবং আলুর প্রতি বিতৃষ্ণাসহ কোষ্ঠবদ্ধতা সিফিলিনামে মোটেই লক্ষ্য করা যায় না।

জ্বর রোগে লক্ষণ:- সিফিলিনামের জ্বর লক্ষণও প্রায় মার্কসলের মত। কিন্তু মার্কসল প্রকৃত জ্বরাবস্থায় প্রয়োজন হইতে পারে, আর সিফিলিনাম ঔষধটি সালফার ও সোরিনামের ন্যায় শুধু দুইটি ঔষধের মধ্যবর্তী অবস্থা ব্যতীত অন্য কোন সময়েই প্রয়োগযোগ্য নয়। পুরাতন জাতীয় জ্বরে ইহা শুধু রোগীর ধাতুগত ও বংশগত লক্ষণ সাদৃশ্যেই প্রয়োগ করিতে হয়-জ্বরের চরিত্রগত ২/৪টি নির্দিষ্ট লক্ষণের কোন মূল্যই সিফিলিনামের নাই। সিফিলিস দোষের সংস্পর্শযুক্ত জ্বরে সর্বদাই যথাসম্ভব সতর্কতার সহিত সালফার প্রয়োগ করিতে হয়। কেননা সিফিলিস দোষজ রোগীর লক্ষণাদি বৃদ্ধি করিতে সালফার অসীম শক্তিশালী, উপরন্তু ঐ দোষজ রোগীকে আরোগ্য না করিয়া সালফার শুধুই রোগ লক্ষণাদির বৃদ্ধি সাধন করে। কাজেই সিফিলিস দোষদুষ্ট রোগীর চিকিৎসা কালে মধ্যপথে যেখানে আর একটি ঔষধ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আসে, সেখানে সালফারের পরিবর্তে অপর কোনও একটি ঔষধের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। যাহা হোক সিফিলিনামের জ্বরাবস্থায় দুইটি গোপন সংকেতের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়-১) পুরুষ রোগীর মাথায় অদ্ভূত ও অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক স্নায়ুশূল ও ২) স্ত্রীরোগীর ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে নিদারুণ দুর্গন্ধযুক্ত গাঢ় শ্বেতপ্রদর স্রাব। এই অবস্থাদ্বয় জ্বরের আনুষঙ্গিক লক্ষণ রূপে প্রায়ই বর্তমান থাকে এবং সিফিলিনাম প্রয়োগ না করা পর্যন্ত এই দুইটি অবস্থা ও জ্বর কোনটিই আরোগ্য হইতে চায় না ।

চর্মপীড়ায় প্রধানতঃ তিনটি অবস্থা বর্তমান থাকে-
১) পচন,
২) স্রাবের প্রচুরতা ও মামড়ি সঞ্চয় এবং
৩) আরোগ্য বিমুখতা ।
দুর্গন্ধভাবও ইহার চরিত্রগত লক্ষণ তবে সর্বক্ষেত্রে উহা পাওয়া যায় না। ক্ষতস্থানের মূলদেশে চর্বিবৎ থলথলে পূজপূর্ণ থাকে এবং স্রাব যাহা নির্গত হয়। তাহা চটচটে । স্পর্শ কাতরতাযুক্ত যন্ত্রণাও ঐ সঙ্গে বর্তমান থাকে।
সোরা দোষজ চর্মপীড়া:- এই দোষজ চর্মপীড়া বিস্তারশীল সর্বশরীরেই উহা
বিকশিত হয়, যতক্ষণ অন্য কোনও দোষের সর্দি উহার সংমিশ্রণ না ঘটে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব চরিত্রগত শুষ্কতা ও রসশূন্যতা লইয়া উদ্ভেদগুলি শরীরে বিরাজ করে। এই দোষজ চর্মপীড়াগুলি যদিও সম্পূর্ণ শুষ্ক, তথাপি শত চেষ্টাতেও সেগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না, কেননা ঐগুলিতে অবশ্যই আঁইশ সদৃশ ছোট ছোট চটা ও ময়লা জমে। সোরা দোষজ চর্মপীড়া প্রায় ক্ষেত্রেই পচন প্রবৃত্তি শূন্য, কাজেই তাহাতে কোন গন্ধ থাকে না, সর্বোপরি সোরা দোযজ চর্মপীড়া সম্পূর্ণ গঠনমুখী, কেননা ঐগুলি নির্মলভাবে আরোগ্য হইলে রোগী সোরাশূন্য স্বাস্থ্যবান হইয়া উঠে।

সাইকোসিস দোষজ চর্মপীড়া:- এই দোষজ চর্মপীড়া ব্যথা বেদনায় পরিপূর্ণ। তবে যে স্নায়ুর যতটুকু অংশের উপর উহা পরিস্ফুট থাকে, শুধু ততটুকু স্থানে প্রায়ই অবিরাম প্রকৃতির একটা বেদনা চলিতে থাকে, কিন্তু স্নায়ুটির বাকী অংশে কোনও প্রকার বেদনাই থাকে না। সাইকোসিস দোষজ বেদনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাপনে ও উত্তাপ প্রয়োগে উপশমিত হয়। ক্ষত প্রবৃত্তি সিফিলিস দোষের একটি বৈশিষ্ট্যজনক লক্ষণ। সেজন্য সাইকোসিস দোষের প্রাধান্যযুক্ত কোনও রোগীতে ক্ষত লক্ষণ বিকাশ লাভ করিলে বুঝিতে হইবে যে শরীরে নিশ্চয়ই সিফিলিস দোষের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। সাইকোসিস দোষের অগঠন বা কুগঠনের প্রকৃতি এই যে, তাহা বাহ্য দেশে সুস্পষ্ট স্ফীতির মধ্য দিয়া সুদীর্ঘদিন এমনকি মৃত্যুকাল পর্যন্ত ক্ষত লক্ষণ না আনিয়া বিকশিত থাকিতে পারে। অপর পক্ষে সিফিলিস দোষের শেষ পরিণতি বা লক্ষ্যস্থল সুনিশ্চিত ক্ষত উৎপাদন।

টিউবারকুলার দোষজ:- চর্মপীড়া ইহা নিরতিশয় ধ্বংসমুখী। শুধু তাহাই নয়, যে সকল অংশ বা যন্ত্র সর্ব সময়ের জন্য মানবদেহের কার্যাদি সম্পাদন করিয়া চলে; সেই সকল যন্ত্রেই এই দোষজ চর্মপীড়া বিকাশ লাভ করে এবং ঐ সকল যন্ত্রের তন্তুসমূহের পরস্পর সংশ্লিষ্টতার বিলোপ সাধন করে। কাজেই সেই অংশ বা যন্ত্রগুলি মেরামতের কোন সম্ভাবনা থাকে না।
উপরোক্ত চারি প্রকার চর্মপীড়া চাপা পড়ার কুফলটি সকল রোগীতে কিন্তু একই রূপ লইয়া পরিস্ফুট হয় না। সোরা দুষ্ট রোগীর চর্মপীড়া চাপা পড়িলে অবিলম্বে মনটিই সরাসরি আক্রান্ত হয়। সাইকোসিস দোষজ চর্মপীড়া চাপা দিলে প্রথমতঃ স্নায়ুকেন্দ্রে এবং তাহার পর হৃত্যন্ত্র; যকৃত ও প্রজননযন্ত্র আক্রান্ত হয়। সিফিলিস দোষদুষ্ট রোগীর চর্মপীড়া চাপা পড়িয়া স্নায়ুকেন্দ্রের বৃদ্ধির পথটি সর্বপ্রথম অবরুদ্ধ হইয়া যায় এবং তাহার পর বিষণ্ণতা, নিরোৎসাহ ও বুদ্ধির স্থূলত্ব দেখা দেয়। আর টিউবারকুলার দোষজ সকল রোগীর চর্মপীড়া চাপা পড়ার প্রভাবটি ব্যক্তিগত অবস্থার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল-কেননা ঐ দোষটি প্রবণতাকারে চলিতে থাকা কালে চর্মপীড়া চাপা পড়িলে গভীরতম পেশী সমূহে ধ্বংসমুখী ক্ষত লক্ষণ বিকাশ লাভ করে, এবং সর্বসম্পূর্ণ ক্ষয়াবস্থায় ঐ প্রকার চাপা দেওয়া হেতু ঐ ধ্বংস কার্যটি অধিকতর দ্রুত গতিতে সুসম্পন্ন হইতে দেখা যায়।

প্রান্তদেশে কার্যকারিতা:- প্রান্তদেশ বলিতে, হস্ত, মস্ত ক ও বাহ্যিক অংগ বুঝাইয়া থাকে। প্রান্তদেশ ধৌত করিলে এবং সন্ধ্যা হইতে প্রাতঃকাল পর্যন্ত সারারাত্রি ব্যাপিয়া হঠাৎ শয্যাত্যাগ করিয়া কিছুক্ষণ পায়চারি করিলে মানসিক ও দৈহিক কোন রোগ যন্ত্রণার উপশম হইয়া থাকে। শয্যার উত্তাপে সিফিলিস দোষজ রোগীর যন্ত্রণা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। মস্তকে রেখার ন্যায় সম্প্রসারণশীল বেদনা, ইহা রগ হইতে আড়াআড়িভাবে বিস্তুতি হয় অথবা চক্ষু হইতে আরম্ভ হইয়া পশ্চাৎদিকে গমন করে। কেশ পতন, মস্তকের অস্থিতে বেদনা, মস্তকের শীর্ষদেশে মনে হয় যেন খুলিয়া আসিতেছে। কর্ণের মধ্যে অস্থিসমূহের ক্ষতাবস্থা। মাড়ির কিনারাস্থিত দন্তের অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কিনারাগুলি করাতের ন্যায় ফাটা ফাটা, খর্বাকৃতি। জিহ্বা প্রলেপযুক্ত, দন্তের ছাপযুক্ত। নখকুনি ও নখের সমগ্র কিনারা পাকিয়া উঠে। পায়ের আঙ্গুলের মধ্যবর্তী স্থানসমূহের রক্তবর্ণ ও হাজাভাব। সকল সময় হাত ধৌত করিতে থাকে। নিষ্ক্রিয় ক্ষত যাহা ভাল হইতে চায় না। চর্মে ঈষৎ রক্তবর্ণ মিশ্রিত বাদামী বর্ণের উদ্ভেদ। একটা কথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সিফিলিনামের রোগী মাত্রই বার বার প্রান্তদেশসমূহ ধৌত করিতে চায়।

বৃদ্ধি বা উপচয়:- সূর্যাস্ত হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত, অত্যধিক ঠাণ্ডা ও গরমে একটি পূর্ণিমা বাদ দিয়া আর একটি পূর্ণিমায়, ঝড় বিদ্যুৎপূর্ণ ভিজা আবহাওয়ায়, শীতকালে, সমুদ্র তীরে বা সমুদ্র ভ্রমণে, জিহ্বা বাহির করার সময়, দুই হাত পাশাপাশিভাবে উপরে তুলিলে, সঞ্চালনে, স্পর্শে ও ডান পার্শ্বে শয়নে।

উপশম:- দিবাভাগে, পাহাড় পর্বত অঞ্চলে, নড়িয়া চড়িয়া বসিলে বা শুইলে, অবিরত ধীর সঞ্চালনে ও চলিয়া বেড়াইলে, ঠাণ্ডা বা গরম জলে স্নানে এবং গরম প্রয়োগে ।

সম্বন্ধযুক্ত ঔষধ:- চক্ষুরোগে আর্জেন্ট নাইট, মার্কসল, শিরঃপীড়ায়- পালসেটিলা, কেলি বাই, দন্তপীড়ায়- মেজেরিয়া, ক্রিয়োজোট, কোষ্ঠবদ্ধতায়- সাইলিসিয়া, নাসিকার পীড়ায়- এসিড নাইট্রিক, প্রদরস্রাবে এলো।

অনুপূরক ঔষধগুলি:- মার্কসল, কেলি হাইড্রো, নাইট্রিক এসিড, অরাম মেট, এলুমিনা।

ক্রিয়ানাশক ঔষধ:- নাক্স ভমিকা।

শক্তি বা ক্রম:- ২০০ হইতে উচ্চ শক্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ