হোমিওপ্যাথির সংজ্ঞা
Definition of Homoeopathy
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি শব্দের উৎস ও অর্থ লিখ ।
রোগ নিরাময়ের প্রাকৃতিক নিয়ম ‘ Similia Similibus Curantur এর বাক্যগত অর্থ let like be cured by like অর্থাৎ সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়াই রোগ আরোগ্য সম্ভব । হোমিওপ্যাথি একটি সুসংগঠিত নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং আরোগ্যকলা । যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল সূত্র হইতেছে সুস্থাবস্থায় কোন ঔষধ স্থুল মাত্রায় সেবন করিলে মানুষের দেহে ও মনে যে সকল অসুস্থকর লক্ষণ প্রকাশ পায় , ঐ প্রকার লক্ষণ যুক্ত প্রাকৃতিক অসুস্থতায় উক্ত ঔষধের শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রা প্রয়োগে লক্ষণসমূহ অন্তর্হিত হয় । এই চিকিৎসা বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য এই যে ইহা প্ৰাকৃতিক নীতি সম্মত । প্রকৃতির আরোগ্য বিধানের শাশ্বত নিয়মের উপর ভিত্তি করিয়াই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রাকৃতিক বিধান রচিত হইয়াছে । এই তত্ত্বের মূলকথা হইল মানব দেহে সংক্রামিত দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যায় যদি শেষোক্ত রোগটি ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন হয় অথচ পূর্বতর রোগের সঙ্গে সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট হয় । নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র হইতে আমরা জানিতে পারি যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সমান ও বিপরীত ' এই তৃতীয় সূত্রের উপরই হ্যানিমানের আরোগ্যনীতি প্রতিষ্ঠিত ।
বা , হোমিওপ্যাথি কি?
যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীব রোগ লক্ষণের সদৃশ রোগ লক্ষণ সৃষ্টিকারী ঔষধ দিয়া চিকিৎসা করা হয় , আরোগ্যের আদর্শ ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে চিকিৎসকের জ্ঞাতব্য ও কর্তব্য , চিকিৎসকের চারিত্রিক গুণাবলী , রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষণ সমষ্টি সংগ্রহের পদ্ধতি ও সদৃশ লক্ষণের ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচনের নিয়মসহ শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রায় পরিবর্তনশীল শক্তিতে ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে রোগারোগ্যের কলাকৌশল সম্পর্কিত বিবরণ পাওয়া যায় , চিকিৎসকের জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য আদর্শ আরোগ্য সম্বন্ধে জানা যায় , সদৃশ লক্ষণে চিকিৎসার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় , জীবনীশক্তি , রোগ শক্তি , ঔষধ প্রয়োগ , আরোগ্যের বিঘ্নকর অবস্থা প্রভৃতি উল্লেখ আছে তাহাই হোমিওপ্যাথি । বিধিবদ্ধভাবে অনেক হোমিও মনীষী হোমিওপ্যাথির উপর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন । নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞার উল্লেখ করা হইল :
ডাঃ বোরিকের মতে সদৃশ লক্ষণ ভিত্তিতে আরোগ্য পদ্ধতিকে হোমিওপ্যাথি বলে । ডাঃ এলেনের মতে হোমিওপ্যাথি সদৃশ বিধান ভিত্তিক একটি নিয়ম ভিত্তিক চিকিৎসা শাস্ত্র ।
ডাঃ এ , ডাইট স্মিথ বলেন , হোমিওপ্যাথি একটি বিশেষ আরোগ্য বিজ্ঞান ,
ডাঃ স্যামুয়েল ফ্রেডারিক হ্যানিমান যাহার বিকাশ সাধন করিয়াছেন এবং যাহা আরোগ্যের বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ।
ডাঃ হার্বার্ট , এ , রবার্টস এর মতে আরোগ্যের যে বিজ্ঞান ও কলা প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত , তাহাকেই হোমিওপ্যাথি বলে ।
প্রশ্ন - বিজ্ঞান বলিতে কি বুঝায় ?
উত্তর : বিজ্ঞান হইল প্রকৃতি সম্ভৃত প্রকৃষ্ট জ্ঞান , যাহা শ্বাশত , যাহা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির শক্তির ক্রিয়া ধারায় তাহা প্রকাশিত । সেই সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ , বিশ্লেষণ ও সেই সব ঘটনার পরম্পরার সঙ্গে সম্পর্ক আবিষ্কারই হইল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি । এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া কোন বিষয় সম্পর্কে বিধিবদ্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি প্রকৃত বিজ্ঞান ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর ।
মহাত্মা হ্যানিমান সুস্থ দেহে কুইনিন সেবন করিয়া ম্যালেরিয়া হইতে দেখিলেন এবং কৌতুহল বশতঃ আরও অনেকগুলি ঔষধের স্থলমাত্রা সুস্থদেহে গ্রহণ করিয়া বুঝিতে পারিলেন যে ঔষধের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রহিয়াছে । আবার ঐ সকল ঔষধের সূক্ষ্মমাত্রা ব্যবহার করিয়া ঔষধের লক্ষণ দূরীভূত হওয়ার ঘটনাও স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিলেন । সুতরাং এই গবেষণা হইতে সকল শক্তিশালী ভেষজের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা এবং শক্তিকৃত অবস্থায় আরোগ্যকর ক্ষমতা আছে ইহা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক । ইহা গবেষণালব্ধ সত্য যে ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে , সেই ঔষধ অনুরূপ লক্ষণবিশিষ্ট প্রাকৃতিক পীড়া আরোগ্য করিতে পারে । ইহাই “ Similia Similibus Curentur ” - অর্থাৎ সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়াই আরোগ্য সাধন সম্ভব । হোমিওপ্যাথি যে বিশুদ্ধ আরোগ্য বিজ্ঞান সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । বিজ্ঞানের সাধারণ নীতিগুলির সঙ্গে হোমিওপ্যাথির বিধানসমূহ সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । বিজ্ঞানের যে নীতিগুলির সঙ্গে ইহার সামঞ্জস্য আছে সেগুলি হইল :
( চ ) আরোহনীতি ঃ কোনরূপ অনুমান বা কল্পনার আশ্রয় না নিয়া বাস্তব ঘটনাসমূহের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ ও ঘটনাসমূহের মধ্যে সম্পর্কের এক সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা যাহা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য এবং সেই সঙ্গে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
( ছ ) প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিরামহীনভাবে চলে ।
( জ ) শক্তির প্রবাহ হইল কেন্দ্র হইতে পরিধির দিকে । ভিতর হইতে বাহিরের দিকে ।
যুক্তিশাস্ত্রের আরোহনীতি ও অবরোহনীতি অণুসরণ করিয়া ঘটনা সমূহের মধ্যে কোন সাধারণ নিয়মের আবিষ্কার করা এবং তাহা পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা করিয়া তার সত্যতা ও সার্বজনীনতা যাচাই করিয়া নেওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠিত । আরোহনীতির মূল কথা হইল ঘটনা সমূহের যথাযথ পর্যবেক্ষণ , পর্যালোচনা , ঘটনাসমূহের পরস্পরের সম্পর্ক ও কারণ সম্পর্কে এবং সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা যাহা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য হইবে । অবরোহ পদ্ধতির মূল কথা হইল কোন নিয়ম যদি সাধারণভাবে এক বিশেষ শ্রেণীতে সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হয় তবে সে শ্রেণীর প্রত্যেকের বেলায়ও সে নিয়ম প্রযোজ্য হইবে । হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন ঔষধ বিভিন্ন সময়ে সুস্থ মানব দেহে প্রয়োগ করিয়া দেখা গিয়েছে যে ঐ ঔষধগুলি সর্বক্ষেত্রে একই ধরণের দৈহিক ও মানসিক লক্ষণ সৃষ্টি করে । আবার সেই ঔষধেরই সূক্ষ্মমাত্রা সেইরূপ লক্ষণযুক্ত রুগ্নমানুষে প্রয়োগ করিলে সেই লক্ষণগুলি দূরীভূত হইয়া যায় এবং রোগী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া পায় ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমান হয় যে হোমিওপ্যাথির প্রতিটি নীতি বিজ্ঞানের নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । তাই হোমিপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত নয় , ইহা এক বৈজ্ঞানিক আরোগ্য বিজ্ঞান ।
প্রশ্ন - কলাশাস্ত্র বা আর্ট কাহাকে বলে ?
উত্তর : কলাশাস্ত্র বা আর্ট : মানব সভ্যতা নিরূপনের মাপকাঠি হইল আর্ট বা কলা । বিজ্ঞান বলিতে আমরা বুঝি কোন বিষয়ের বিধিবদ্ধ জ্ঞান । স্টুয়ার্ট ক্লোজের মতে বিজ্ঞান আমাদিগকে কোন কিছু জানিতে শিক্ষা দেয় । বিজ্ঞান হইল তত্ত্ব । সেই তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ , পরীক্ষা ও গবেষণার দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত । কলাবিদ্যা সেই তত্ত্বের প্রয়োগ । ইন্সিত ফল লাভের নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করিয়া উপকরণসমূহের যথাযথ প্রয়োগই হইল কলাবিদ্যা । প্রতিটি কলাবিদ্যার ভিত্তিমূলে থাকে বিজ্ঞান । বিজ্ঞান মূর্ত হইয়া উঠে কলাবিদ্যার মাধ্যমে বিজ্ঞান শুরু হয় দর্শনে এবং শেষ হয় কলাবিদ্যায় ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি একটি আদর্শ আরোগ্য কলা বা নিরাময় কলা - আলোচনা কর ।
প্রথমত : আরোগ্য সাধনের নিমিত্ত প্রত্যেক রোগীতে কি অনুসন্ধান করিতে হইবে সেই বিষয় ও পদ্ধতি সম্বন্ধে জ্ঞান ।
দ্বিতীয়ত : প্রত্যেক ঔষধের আরোগ্যকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে জ্ঞান ।
তৃতীয়ত ঃ ঔষধ প্রয়োগ বিধির সম্যক জ্ঞান ।
ব্যক্তিগতভাবে রোগী পরীক্ষা করিয়া কিভাবে লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করিতে হইবে এবং রোগীর ধাতু প্রকৃতি সম্বন্ধে অবহিত হইতে হইবে সে বিষয়ে হ্যানিমান অর্গাননে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন । প্রতিটি ঔষধের স্বতন্ত্র গুনাবলীর পরিচয় পাওয়ার জন্য ঔষধের গুনাগুণ পরীক্ষা করিতে হইবে । অর্গাননে সে সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ আছে । ঔষধ যেসব লক্ষণারজি সৃষ্টি করিতে পারে তার বর্ণনা আছে মেটিরিয়া মেডিকায় ।
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার সাহায্যে সংগৃহীত লক্ষণরাজির যথাযথ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করিয়া হ্যানিমানের নির্দেশিত রীতি অণুসরণে রোগীর এক সার্বিক প্রতিচ্ছবি অংকন করিতে হইবে । সুস্থদেহে ভেষজ সৃষ্ট লক্ষণসমষ্টিকেও আমরা এক একটি জীবন্ত রোগী চিত্রে রূপায়িত করিতে পারি এবং শিল্পীর কলানৈপূণ্যে এই দুই চরিত্রের সর্বাঙ্গীণ মিলন ঘটাইয়া রোগীকে পূর্বস্থাস্থ্যে ফিরাইয়া আনিতে পারি । ঔষধ নির্বাচনও তাই এক ধরনের ছবি আকা শিল্পীর তুলির টানে কতগুলি রেখা ও বিন্দু যেমন এক একটি জীবন্ত চিত্রে রূপায়িত হয় তেমনি সংগৃহিত চিহ্ন ও লক্ষণরাজি চিকিৎসকের প্রজ্ঞা ও মননশীলতায় এক প্রাণবন্ত রোগী চিত্রে পরিণত হয় যার জীবন্ত প্রতিমূর্তি আমরা মেটিরিয়া মেডিকায় পাইয়া থাকি । বিচিত্র সব চরিত্রের সব সমাবেশ সেখানে । কোমলশীলা পালসেটিলা , ক্রুদ্ধ স্ট্র্যাফিসেগ্রিয়া , দেহমনে খর্বাকৃতি ব্যারাইটা , জড়ভরত ক্যালকেরিয়া , প্রেমকাতর এসিড ফস , হতাশ অরাম প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় কোন না কোন চরিত্রে আমাদের রোগীর প্রতিচ্ছবি অবশ্যই পাওয়া যাইবে । রোগীচিত্রে ঔষধের সন্ধান পাওয়া গেলে সেই ঔষধের প্রয়োগশৈলীতে চিকিৎসককে একজন দক্ষ শিল্পী হইতে হইবে । লক্ষণরাজি সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ , ঔষধ নির্ধারণ ও মাত্রা নির্ধারণ , ঔষধের ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী অবস্থা গ্রহণ , গথ্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ , প্রতিটি পর্যায়ে চিকিৎসকের বিজ্ঞানীর মত সত্যের প্রতি নিষ্ঠা , যুক্তিশীলতা এবং সংস্কার মুক্ততা আর শিল্পীর মত সৃজনশীলতা , আন্তরিকতা ও সৌন্দর্য্যবোধ থাকা চাই । আবার হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যকলার আদর্শ হইতেছে দ্রুত আরোগ্য বিধান , বিনা কষ্টে নির্দোষ ও স্থায়ীভাবে আরোগ্য সাধন এবং এই ক , জগুলি আর্টের দ্বারাই সম্ভব । তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক আরোগ্য কলা বলা হয় ।
1 মন্তব্যসমূহ
nice post!!!
উত্তরমুছুন