দ্বিতীয় অধ্যায়
হোমিওপ্যাথির সংজ্ঞা
Definition of Homoeopathy
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি শব্দের উৎস ও অর্থ লিখ ।
উত্তর : ইংরেজী Homoeopathy শব্দটি গ্রীক শব্দ homeo বা homoios এবং pathy বা pathos হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । গ্রীক ভাষায় হোমিও মানে সদৃশ, Like similary বা pathos মানে উপায় পদ্ধতি বা কষ্টভোগ- means , methodor suffering অভিধানিক অর্থে হোমিওপ্যাথির অর্থ হইল ‘সদৃশ রোগ’বা ‘ সদৃশ দুর্ভোগ ’।
রোগ নিরাময়ের প্রাকৃতিক নিয়ম ‘ Similia Similibus Curantur এর বাক্যগত অর্থ let like be cured by like অর্থাৎ সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়াই রোগ আরোগ্য সম্ভব । হোমিওপ্যাথি একটি সুসংগঠিত নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং আরোগ্যকলা । যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল সূত্র হইতেছে সুস্থাবস্থায় কোন ঔষধ স্থুল মাত্রায় সেবন করিলে মানুষের দেহে ও মনে যে সকল অসুস্থকর লক্ষণ প্রকাশ পায় , ঐ প্রকার লক্ষণ যুক্ত প্রাকৃতিক অসুস্থতায় উক্ত ঔষধের শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রা প্রয়োগে লক্ষণসমূহ অন্তর্হিত হয় । এই চিকিৎসা বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য এই যে ইহা প্ৰাকৃতিক নীতি সম্মত । প্রকৃতির আরোগ্য বিধানের শাশ্বত নিয়মের উপর ভিত্তি করিয়াই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রাকৃতিক বিধান রচিত হইয়াছে । এই তত্ত্বের মূলকথা হইল মানব দেহে সংক্রামিত দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যায় যদি শেষোক্ত রোগটি ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন হয় অথচ পূর্বতর রোগের সঙ্গে সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট হয় । নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র হইতে আমরা জানিতে পারি যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সমান ও বিপরীত ' এই তৃতীয় সূত্রের উপরই হ্যানিমানের আরোগ্যনীতি প্রতিষ্ঠিত ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথির সংজ্ঞা দাও ।
বা , হোমিওপ্যাথি কি?
উত্তর : হোমিওপ্যাথির সংজ্ঞা : হোমিওপ্যাথি এমন এক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর রোগ লক্ষণের সদৃশ রোগ লক্ষণ সৃষ্টিকারী ঔষধ দিয়া চিকিৎসা করা হয় । ঔষধ পরীক্ষণ নীতিতে সুস্থ মানব দেহে ঔষধ পরীক্ষা করিলে যে সব লক্ষণ উৎপন্ন হয় , তার সদৃশ লক্ষণের রোগীকে ঐ ঔষধে আরোগ্য করার নাম হোমিওপ্যাথি । হোমিওপ্যাথিকে পরিপূর্ণভাবে বুঝিতে হইলে ইহার সংজ্ঞা নিম্নোক্ত ভাবে দেওয়া যায়।
যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীব রোগ লক্ষণের সদৃশ রোগ লক্ষণ সৃষ্টিকারী ঔষধ দিয়া চিকিৎসা করা হয় , আরোগ্যের আদর্শ ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে চিকিৎসকের জ্ঞাতব্য ও কর্তব্য , চিকিৎসকের চারিত্রিক গুণাবলী , রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষণ সমষ্টি সংগ্রহের পদ্ধতি ও সদৃশ লক্ষণের ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচনের নিয়মসহ শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রায় পরিবর্তনশীল শক্তিতে ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে রোগারোগ্যের কলাকৌশল সম্পর্কিত বিবরণ পাওয়া যায় , চিকিৎসকের জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য আদর্শ আরোগ্য সম্বন্ধে জানা যায় , সদৃশ লক্ষণে চিকিৎসার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় , জীবনীশক্তি , রোগ শক্তি , ঔষধ প্রয়োগ , আরোগ্যের বিঘ্নকর অবস্থা প্রভৃতি উল্লেখ আছে তাহাই হোমিওপ্যাথি । বিধিবদ্ধভাবে অনেক হোমিও মনীষী হোমিওপ্যাথির উপর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন । নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞার উল্লেখ করা হইল :
ডাঃ বোরিকের মতে সদৃশ লক্ষণ ভিত্তিতে আরোগ্য পদ্ধতিকে হোমিওপ্যাথি বলে । ডাঃ এলেনের মতে হোমিওপ্যাথি সদৃশ বিধান ভিত্তিক একটি নিয়ম ভিত্তিক চিকিৎসা শাস্ত্র ।
ডাঃ এ , ডাইট স্মিথ বলেন , হোমিওপ্যাথি একটি বিশেষ আরোগ্য বিজ্ঞান ,
ডাঃ স্যামুয়েল ফ্রেডারিক হ্যানিমান যাহার বিকাশ সাধন করিয়াছেন এবং যাহা আরোগ্যের বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ।
ডাঃ হার্বার্ট , এ , রবার্টস এর মতে আরোগ্যের যে বিজ্ঞান ও কলা প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত , তাহাকেই হোমিওপ্যাথি বলে ।
প্রশ্ন - বিজ্ঞান বলিতে কি বুঝায় ?
উত্তর : বিজ্ঞান হইল প্রকৃতি সম্ভৃত প্রকৃষ্ট জ্ঞান , যাহা শ্বাশত , যাহা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির শক্তির ক্রিয়া ধারায় তাহা প্রকাশিত । সেই সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ , বিশ্লেষণ ও সেই সব ঘটনার পরম্পরার সঙ্গে সম্পর্ক আবিষ্কারই হইল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি । এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া কোন বিষয় সম্পর্কে বিধিবদ্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি প্রকৃত বিজ্ঞান ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : হোমিওপ্যাথি যে প্রকৃত বিজ্ঞান সম্মত ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । রোগের ঘটনা সম্পর্কে বিধিবদ্ধ জ্ঞান হইল রোগ বিজ্ঞান । ঔষধ সম্বন্ধে বিধিবদ্ধ জ্ঞানই হইল ভেষজ বিজ্ঞান । আর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করিয়া রোগের চিকিৎসা ও নিরাময় করার বিধিবদ্ধ জ্ঞানই হইল আরোগ্য বিজ্ঞান । হোমিওপ্যাথির তত্ত্ব ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া রচিত হইয়াছে । হোমিওপ্যাথি একটি সুসংঘটিত নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি যাহার মূল তত্ত্ব হইল সুস্থাবস্থায় কোন ঔষধ স্থূলমাত্রায় সেবন করিলে মানব দেহে ও মনে যে সকল অসুস্থকর লক্ষণ প্রকাশ পায় , ঐ প্রকার লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক অসুস্থতায় উক্ত ঔষধের শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রা প্রয়োগে রোগলক্ষণ দূরীভূত হইয়া যায় । ইহা প্রাকৃতিক নীতিসম্মত ।
মহাত্মা হ্যানিমান সুস্থ দেহে কুইনিন সেবন করিয়া ম্যালেরিয়া হইতে দেখিলেন এবং কৌতুহল বশতঃ আরও অনেকগুলি ঔষধের স্থলমাত্রা সুস্থদেহে গ্রহণ করিয়া বুঝিতে পারিলেন যে ঔষধের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রহিয়াছে । আবার ঐ সকল ঔষধের সূক্ষ্মমাত্রা ব্যবহার করিয়া ঔষধের লক্ষণ দূরীভূত হওয়ার ঘটনাও স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিলেন । সুতরাং এই গবেষণা হইতে সকল শক্তিশালী ভেষজের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা এবং শক্তিকৃত অবস্থায় আরোগ্যকর ক্ষমতা আছে ইহা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক । ইহা গবেষণালব্ধ সত্য যে ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে , সেই ঔষধ অনুরূপ লক্ষণবিশিষ্ট প্রাকৃতিক পীড়া আরোগ্য করিতে পারে । ইহাই “ Similia Similibus Curentur ” - অর্থাৎ সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়াই আরোগ্য সাধন সম্ভব । হোমিওপ্যাথি যে বিশুদ্ধ আরোগ্য বিজ্ঞান সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । বিজ্ঞানের সাধারণ নীতিগুলির সঙ্গে হোমিওপ্যাথির বিধানসমূহ সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । বিজ্ঞানের যে নীতিগুলির সঙ্গে ইহার সামঞ্জস্য আছে সেগুলি হইল :
( ক ) এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এক বিরাট শক্তিপিণ্ড বিশেষ । জীব ও জড় এই উভয় পদার্থে সেই শক্তি বিদ্যমান । ( খ ) জড় পদার্থ হইল শক্তিরই স্থূলরূপ । পদার্থ ও শক্তি আপেক্ষিক সূত্র দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ । ( গ ) পদার্থকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপে বিভাজন করা চলে , কিন্তু ধ্বংস করা চলে না । শক্তির রূপান্তর হয় ।
( ঘ ) একই পদার্থের যাহা বৃহৎ মাত্রায় কর্মক্ষমতার ক্ষতি বা ধ্বংস সাধন করে তাহাই ক্ষুদ্র মাত্রায় উদ্দীপন করে ।
( ঙ ) উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া এবং আত্মরক্ষা করার স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়াস চালানো সজীব পদার্থের স্বাভাবিক ধর্ম ।
( চ ) আরোহনীতি ঃ কোনরূপ অনুমান বা কল্পনার আশ্রয় না নিয়া বাস্তব ঘটনাসমূহের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ ও ঘটনাসমূহের মধ্যে সম্পর্কের এক সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা যাহা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য এবং সেই সঙ্গে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
( ছ ) প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিরামহীনভাবে চলে ।
( জ ) শক্তির প্রবাহ হইল কেন্দ্র হইতে পরিধির দিকে । ভিতর হইতে বাহিরের দিকে ।
যুক্তিশাস্ত্রের আরোহনীতি ও অবরোহনীতি অণুসরণ করিয়া ঘটনা সমূহের মধ্যে কোন সাধারণ নিয়মের আবিষ্কার করা এবং তাহা পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা করিয়া তার সত্যতা ও সার্বজনীনতা যাচাই করিয়া নেওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠিত । আরোহনীতির মূল কথা হইল ঘটনা সমূহের যথাযথ পর্যবেক্ষণ , পর্যালোচনা , ঘটনাসমূহের পরস্পরের সম্পর্ক ও কারণ সম্পর্কে এবং সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা যাহা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য হইবে । অবরোহ পদ্ধতির মূল কথা হইল কোন নিয়ম যদি সাধারণভাবে এক বিশেষ শ্রেণীতে সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হয় তবে সে শ্রেণীর প্রত্যেকের বেলায়ও সে নিয়ম প্রযোজ্য হইবে । হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন ঔষধ বিভিন্ন সময়ে সুস্থ মানব দেহে প্রয়োগ করিয়া দেখা গিয়েছে যে ঐ ঔষধগুলি সর্বক্ষেত্রে একই ধরণের দৈহিক ও মানসিক লক্ষণ সৃষ্টি করে । আবার সেই ঔষধেরই সূক্ষ্মমাত্রা সেইরূপ লক্ষণযুক্ত রুগ্নমানুষে প্রয়োগ করিলে সেই লক্ষণগুলি দূরীভূত হইয়া যায় এবং রোগী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া পায় ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমান হয় যে হোমিওপ্যাথির প্রতিটি নীতি বিজ্ঞানের নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । তাই হোমিপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত নয় , ইহা এক বৈজ্ঞানিক আরোগ্য বিজ্ঞান ।
প্রশ্ন - কলাশাস্ত্র বা আর্ট কাহাকে বলে ?
উত্তর : কলাশাস্ত্র বা আর্ট : মানব সভ্যতা নিরূপনের মাপকাঠি হইল আর্ট বা কলা । বিজ্ঞান বলিতে আমরা বুঝি কোন বিষয়ের বিধিবদ্ধ জ্ঞান । স্টুয়ার্ট ক্লোজের মতে বিজ্ঞান আমাদিগকে কোন কিছু জানিতে শিক্ষা দেয় । বিজ্ঞান হইল তত্ত্ব । সেই তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ , পরীক্ষা ও গবেষণার দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত । কলাবিদ্যা সেই তত্ত্বের প্রয়োগ । ইন্সিত ফল লাভের নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করিয়া উপকরণসমূহের যথাযথ প্রয়োগই হইল কলাবিদ্যা । প্রতিটি কলাবিদ্যার ভিত্তিমূলে থাকে বিজ্ঞান । বিজ্ঞান মূর্ত হইয়া উঠে কলাবিদ্যার মাধ্যমে বিজ্ঞান শুরু হয় দর্শনে এবং শেষ হয় কলাবিদ্যায় ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি একটি আদর্শ আরোগ্য কলা বা নিরাময় কলা - আলোচনা কর ।
উত্তর : হোমিওপ্যাথি একটি বিশুদ্ধ চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং আদর্শ আরোগ্য কলা । হোমিওপ্যাথি তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক দিয়া আলোচনা করিতে গেলে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান না কলাবিদ্যা । জবাবে আমরা এক কথায় বলিতে পারি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োগ কলা । ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দর্শন , বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যার সার্থক সমন্বয়ে যে শাস্ত্র গড়িয়া উঠে তাহাই আদর্শ প্রযুক্তি বিদ্যা । হোমিওপ্যাথির নীতি যেমন স্থির ইহার প্রয়োগ পদ্ধতিও তেমনি স্থির ও সুনির্দিষ্ট । হ্যানিমান ঔষধের প্রয়োগ প্রণালীকে তিন ভাগে ভাগ করিয়াছেন ।
প্রথমত : আরোগ্য সাধনের নিমিত্ত প্রত্যেক রোগীতে কি অনুসন্ধান করিতে হইবে সেই বিষয় ও পদ্ধতি সম্বন্ধে জ্ঞান ।
দ্বিতীয়ত : প্রত্যেক ঔষধের আরোগ্যকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে জ্ঞান ।
তৃতীয়ত ঃ ঔষধ প্রয়োগ বিধির সম্যক জ্ঞান ।
ব্যক্তিগতভাবে রোগী পরীক্ষা করিয়া কিভাবে লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করিতে হইবে এবং রোগীর ধাতু প্রকৃতি সম্বন্ধে অবহিত হইতে হইবে সে বিষয়ে হ্যানিমান অর্গাননে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন । প্রতিটি ঔষধের স্বতন্ত্র গুনাবলীর পরিচয় পাওয়ার জন্য ঔষধের গুনাগুণ পরীক্ষা করিতে হইবে । অর্গাননে সে সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ আছে । ঔষধ যেসব লক্ষণারজি সৃষ্টি করিতে পারে তার বর্ণনা আছে মেটিরিয়া মেডিকায় ।
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার সাহায্যে সংগৃহীত লক্ষণরাজির যথাযথ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করিয়া হ্যানিমানের নির্দেশিত রীতি অণুসরণে রোগীর এক সার্বিক প্রতিচ্ছবি অংকন করিতে হইবে । সুস্থদেহে ভেষজ সৃষ্ট লক্ষণসমষ্টিকেও আমরা এক একটি জীবন্ত রোগী চিত্রে রূপায়িত করিতে পারি এবং শিল্পীর কলানৈপূণ্যে এই দুই চরিত্রের সর্বাঙ্গীণ মিলন ঘটাইয়া রোগীকে পূর্বস্থাস্থ্যে ফিরাইয়া আনিতে পারি । ঔষধ নির্বাচনও তাই এক ধরনের ছবি আকা শিল্পীর তুলির টানে কতগুলি রেখা ও বিন্দু যেমন এক একটি জীবন্ত চিত্রে রূপায়িত হয় তেমনি সংগৃহিত চিহ্ন ও লক্ষণরাজি চিকিৎসকের প্রজ্ঞা ও মননশীলতায় এক প্রাণবন্ত রোগী চিত্রে পরিণত হয় যার জীবন্ত প্রতিমূর্তি আমরা মেটিরিয়া মেডিকায় পাইয়া থাকি । বিচিত্র সব চরিত্রের সব সমাবেশ সেখানে । কোমলশীলা পালসেটিলা , ক্রুদ্ধ স্ট্র্যাফিসেগ্রিয়া , দেহমনে খর্বাকৃতি ব্যারাইটা , জড়ভরত ক্যালকেরিয়া , প্রেমকাতর এসিড ফস , হতাশ অরাম প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় কোন না কোন চরিত্রে আমাদের রোগীর প্রতিচ্ছবি অবশ্যই পাওয়া যাইবে । রোগীচিত্রে ঔষধের সন্ধান পাওয়া গেলে সেই ঔষধের প্রয়োগশৈলীতে চিকিৎসককে একজন দক্ষ শিল্পী হইতে হইবে । লক্ষণরাজি সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ , ঔষধ নির্ধারণ ও মাত্রা নির্ধারণ , ঔষধের ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী অবস্থা গ্রহণ , গথ্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ , প্রতিটি পর্যায়ে চিকিৎসকের বিজ্ঞানীর মত সত্যের প্রতি নিষ্ঠা , যুক্তিশীলতা এবং সংস্কার মুক্ততা আর শিল্পীর মত সৃজনশীলতা , আন্তরিকতা ও সৌন্দর্য্যবোধ থাকা চাই । আবার হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যকলার আদর্শ হইতেছে দ্রুত আরোগ্য বিধান , বিনা কষ্টে নির্দোষ ও স্থায়ীভাবে আরোগ্য সাধন এবং এই ক , জগুলি আর্টের দ্বারাই সম্ভব । তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক আরোগ্য কলা বলা হয় ।
প্রশ্ন - হোমিওপ্যাথি একটি লাক্ষণিক চিকিৎসা বিজ্ঞান - আলোচনা কর ।
উত্তর : হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ নির্বাচনের একটিমাত্র পথ আছে , তাহা হইল রোগ লক্ষণের সদৃশ লক্ষণযুক্ত একটি ঔষধ নির্বাচন করা । লক্ষণসমষ্টি হইল ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র পথপ্রদর্শক । সম্পূর্ণ মানুষই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার লক্ষ্য । যে সমস্ত চিহ্ন ও লক্ষণের মাধ্যমে আমরা পীড়িত দেহের অবস্থা জানিতে পারি তাহাদের সমষ্টিগতরূপকে আমরা লক্ষণসমষ্টি বলিয়া অভিহিত করি । চিকিৎসার নিমিত্ত লক্ষণসমষ্টিই কার্যত রোগ । লক্ষণসমষ্টি নিজেই এক পূর্ণাঙ্গ লক্ষণ , যাহা রোগীরই লক্ষণ , রোগীর চিত্র , সেইদিক হইতে বিচার করিলে লক্ষণসমষ্টিকে রোগীর জীবন্ত প্যাথলজি বলা চলে । সেই মূর্তির মধ্যে একাধারে থাকে রোগের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত কতগুলি চিহ্ন ও লক্ষণ যা রোগের প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমাদিগকে পরিচয় করাইয়া দেয় । প্রতিটি ঔষধ সুস্থদেহে কতগুলি লক্ষণসৃষ্টি করে।এই সমস্ত লক্ষণের মাধ্যমেই আমরা ঔষধের প্রকৃত পরিচয় জানিতে পারি । যে সমস্ত চিহ্ন ও লক্ষণের দ্বারা আমরা কোন ঔষধের রোগ উৎপাদিকা শক্তি তথা আরোগ্যদায়ীনি শক্তির পরিচয় পাই তাহাদের সমষ্টিগত রূপই হইল লক্ষণসমষ্টি । লক্ষণসমষ্টি রোগের প্রতিচ্ছবি , আবার লক্ষণসমষ্টি ঔষধের প্রতিচ্ছবি । লক্ষণসমষ্টি রোগীর ও ঔষধের স্বাতন্ত্র্য দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রকাশ করে । লক্ষণসমষ্টি রোগের সূচনা হইতে পরিনাম পর্যন্ত এমন এক কাহিনী যার মধ্যে রোগের বিনাশের পথ নির্দেশ থাকে । তাই বলা যায় হোমিওপ্যাথি একটি লাক্ষণিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ।
প্রশ্ন — হোমিওপ্যাথি প্রাকৃতিক নীতি ভিত্তিক একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি বা হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য ( সদৃশ বিধাণ ) প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে সংঘটিত হয় ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : আরোগ্য বিধানের জন্য আমাদের নিকট একটি পথই খোলা আছে , উহার ভিত্তি হইল প্রকৃতিকে নির্ভুলভাবে অনুসরণ করা অর্থাৎ প্রকৃতির ক্রিয়াধারার পর্যবেক্ষণ , সতর্ক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে হোমিওপ্যাথি রীতি বলা হয় । প্রাকৃতিক নিয়মের উপর ভিত্তি করিয়াই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র রচিত । প্রাকৃতিক নিয়ম বলিতে আমরা বুঝি সেই সব চিরন্তন বিধান যেগুলি দ্বারা কোন প্রাকৃতিক ঘটনার সামগ্রিক গতিদ্বারা প্রকাশ করা হয় । মানুষের দেহে রোগের সংক্রমণ ও বিকাশের সময় তাহার স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন হয় । কতকগুলি চিহ্ন ও লক্ষণ এই রোগাবস্থার এক সামগ্রিক চিত্র আমাদের নিকট তুলে ধরে । ঔষধ প্রয়োগে এই অবস্থার পরিবর্তন হয় , রোগী আরোগ্য লাভ করে । রোগলক্ষণ সমূহ অন্তর্হিত হয় । এখানে দেখা যায় রোগ ও ঔষধের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কোন শাশ্বত সম্পর্ক রহিয়াছে যাহার উপর আরোগ্য ক্রিয়া নির্ভরশীল । সেই সম্পর্কটি কি ? ঔষধ কেন রোগ আরোগ্য করে ? অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে , ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে , ঠিক যেমন প্রাকৃতিক রোগ শক্তি সুস্থদেহে রোগের সংক্রমণ ঘটায় । সুস্থদেহে ঔষধ প্রয়োগ করিলে মানবের সমস্ত প্রাণ সত্তার অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটায় যাহার প্রতিফলন হয় উৎপন্ন লক্ষণসমূহের এক সামগ্রিক রূপে । রোগাবস্থায় প্রদত্ত ঔষধ এই লক্ষণসমষ্টি দূর করিয়া রোগীকে সুস্থবস্থায় ফিরাইয়া আনে । কাজেই সুস্থদেহে ঔষধ প্রয়োগ জনিত লক্ষণ সমষ্টির জ্ঞান আমাদের রুগ্নাবস্থায় ঔষধের প্রয়োগ ক্ষেত্রকে সুনির্দিষ্ট করিয়া দেয় । রোগ ও ঔষধ সদৃশ । প্রশ্ন জাগে সদৃশ নীতিতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে রোগ আরোগ্য হয় কেন ? হোমিওপ্যাথির আরোগ্য নীতি নিউটনের গতি বিষয়ক ততীয় নীতির উপর প্রতিষ্টিত । এই নীতিটি হইল প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে । কাজেই যে ঔষধ যে রোগ উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে ঔষধের সেই রোগ দূর করার ক্ষমতাও আছে । সদৃশ মতে ঔষধ প্রয়োগের ফলে ঔষধের প্রাথমিক ক্রিয়া হইল রোগীতে যে লক্ষণসমূহ বর্তমান তদ্রুপ সক্ষণ উৎপাদন করা । লক্ষণসমূহের সাদৃশ্য হেতু সেই সব লক্ষণসমূহ প্রাকৃতিক রোগ দ্বারা অধিকৃত স্থানসমূহেই প্রকাশিত হয় এবং তেমনি ভাবে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে । দুই সমভাবাপন্ন শক্তি তখন একই সময়ে একই ভূমিতে ক্রিয়াশীল থাকে । এর পর শুরু হয় ঔষধের গৌণ ক্রিয়া যাহা প্রাথমিক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া । ঔষধের শক্তি প্রাকৃতিক রোগ শক্তি অপেক্ষা প্রবলতর কিন্তু ক্ষুদ্রমাত্রায় প্রদত্ত হয় বলিয়া স্বল্পকাল স্থায়ী । অতএব ঔষধের প্রবলতর শক্তিতে রোগের দুর্বলতর শক্তি বিলীন হইয়া যায় । ফলে রোগ শক্তির কোন অস্তিত্ব থাকে না । ঔষধের ক্রিয়াকাল শেষ হইলে তাহার সৃষ্ট লক্ষণসমূহও তিরোহিত হয় । ইহাই সদৃশ বিধান বা হোমিওপ্যাথি । তাই বলা যায় হোমিওপ্যাথি প্রাকৃতিক নীতি ভিত্তিক একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি ।
প্রশ্ন — চিকিৎসকের প্রধান উদ্দেশ্য বা ব্রত কি ?
উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান অর্গানন প্রথম সূত্রেই বলেন , রোগীকে পূর্ব স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনা তথা রোগীর আরোগ্য সাধনই চিকিৎসকের মহৎ ও একমাত্র উদ্দেশ্য । রোগীকে নীরোগ করাই চিকিৎসকের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য । রোগ কাতর মানুষ চিকিৎসকের নিকট আসে সাহায্যের জন্য , রোগ যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাওয়ার জন্য । প্রথমতঃ রোগীর কষ্টের বিধান করা প্রয়োজন । চিকিৎসাবৃত্তি এক মহান ব্রত । রোগীকে সম্পূর্ণ নীরোগ করিতে হইবে , শুধুমাত্র দুই একটি কষ্টকর রোগলক্ষণ দূর করিলে চলিবে না । অর্থাৎ যে পর্যন্ত রোগী তাহার যে স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়াছে উহা ফিরিয়া পায় সে পর্যন্ত বুঝিতে হইবে যে রোগী নীরোগ হয় নাই । অনেক সময় তীব্র কোন যন্ত্রণা লাঘব হইলেই আমরা মনে করি “ রোগ সারিয়াছে ” কিন্তু সার্বিকভাবে রোগী সুস্থ হইয়াছে কিনা উহা দেখি না । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কোন রোগীর হয়ত জ্বর হইয়াছে । কিন্তু জ্বরগ্রস্ত রোগীর শুধু গাত্রোত্তাপ নিরসণই চিকিৎসকের উদ্দেশ্য হইতে পারে না । জ্বর নিরসণের পর যদি রোগীর স্বাভাবিক অনুভূতি না থাকে , মুখ বিস্বাদ থাকে , কোষ্ঠ অপরিস্কার থাকে বা তরল ভেদ হয় , মাথা ঘোরা ; কানে ভোঁ ভোঁ করা প্রভৃতি থাকে , ক্ষুধা না থাকে , ঘুম না থাকে তাহা হইলে জ্বর সারিলেও রোগী এই ক্ষেত্রে নীরোগ হয় নাই । এইরূপ অসার চিকিৎসা প্রতারণার শামিল । এইরূপ ব্যর্থ চিকিৎসা পেশাদারী মাত্র । হ্যানিমান চিকিৎসকগণকে পেশাদারী না হইয়া মিশনারী রূপে চিকিৎসার মহানব্রত সাধনে উদ্বুদ্ধ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন । এই ক্ষেত্রে ঔষধ প্রয়োগের পর জ্বর উপশমের সাথে সাথে আরোগ্যপ্রাপ্ত রোগীর মনের প্রফুলতা বৃদ্ধি পাইলে , রোগীর ক্ষুধা বৃদ্ধি পাইলে , কোষ্ঠ পরিস্কার ও সুনিদ্রা হইলে অর্থাৎ পূর্বের স্বাভাবিক সুস্থাবস্থায় ফিরিয়া আসিলে চিকিৎসকের দায়িত্ব সম্পন্ন হইয়াছে এবং আদর্শ আরোগ্য সাধিত হইয়াছে বুঝিতে হইবে । অতএব রোগীর অসুস্থতা সার্বিকভাবে দূরীভুত করিয়া স্বাস্থ্যের পুণঃপ্রবর্তণ করাই চিকিৎসকের মহৎ এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ।
প্রশ্ন - আরোগ্য কলার বিজ্ঞ চিকিৎসকের আবশ্যকীয় গুণাবলী কি কি ?
উত্তর : চিকিৎসার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করিবার পূর্বে চিকিৎসকের কি কি বিষয়ে গুণ ও জ্ঞান থাকিতে হইবে তাহা নিম্নে আলোচিত হইল :
১ ) রোগ সম্বন্ধে জ্ঞান ঃ চিকিৎসককে অবশ্যই রোগ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে হইবে । কারণ হোমিপ্যাথিক চিকিৎসা লক্ষণভিত্তিক । প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে রোগের
পরিচয় জ্ঞাপক কি কি লক্ষণ রহিয়াছে যাহাতে রোগের প্রকৃতি বুঝা যায় এবং যেগুলি তাহাকে বিদূরিত করিতে হইবে তাহা জানিতে হইবে । চিকিৎসক যদি লক্ষণসমষ্টি সঠিকভাবে সংগ্রহ করিতে না পারেন তবে ঔষধ নির্বাচন ও চিকিৎসা করা তাহার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয় । লক্ষণাবলীই পীড়ার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ । অতএব প্রকৃত বিবেক সম্পন্ন চিকিৎসা কলাবিদের প্রথম গুণ হইল প্রত্যেক ব্যক্তিগত রোগী ক্ষেত্রে প্রকাশিত লক্ষণাবলী সঠিক ভাবে অনুধাবন করা এবং ঐ লক্ষণগুলি ঔষধ প্রয়োগে দূরীভূত করা ।
২ ) ঔষধের আরোগ্যকারী শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান : প্রতিটি ঔষধের আরোগ্যদায়িনী ক্ষমতা সম্বন্ধে চিকিৎসকের বিশেষ জ্ঞান থাকা দরকার । হ্যানিমানের মতে প্রাকৃতিক কারণে যেমন রোগের সৃষ্টি হয় , তেমনি ঔষধও মানব দেহে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে । ঔষধের এই রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতার মধ্যেই তাহার আরোগ্যদায়িনী ক্ষমতা নিহিত আছে । সুস্থ মানব দেহে ঔষধ প্রয়োগের ফলে যে লক্ষণ সমষ্টি প্রকাশিত হয় তাহার মাধ্যমে প্রতিটি ঔষধের রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা তথা আরোগ্যদায়িনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় । কাজেই ঔষধের শক্তি সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা প্রত্যেক চিকিৎসকের অবশ্য কর্তব্য ।
৩ ) ঔষধ প্রয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞান : ঔষধ প্রয়োগে রোগ আরোগ্য হয় । আরোগ্য বিধান যদি স্থায়ী ও সুনিশ্চিত করিতে হয় তবে ঔষধ ও রোগের মধ্যে এক সুনিবিড় সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য । আমরা যদি লক্ষণসমষ্টিতে রোগের প্রকৃতি অনুধাবন করিতে পারি এবং যদি জানি কোন ঔষধে ঐ ধরনের রোগ সৃষ্টি করার সামর্থ আছে তবে আমরা নিশ্চিত যে , সেই ঔষধই সূক্ষ্মমাত্রায় ঐ রোগ আরোগ্য করিতে সম্পূর্ণ সক্ষম । সঠিকভাবে নির্বাচিত ঔষধটির প্রস্তুত প্রণালী , প্রয়োগ বিধি , উপযুক্ত মাত্রা , পুনঃপ্রয়োগ বিধি প্রভৃতি সম্পর্কে চিকিৎসকের জ্ঞান থাকা আবশ্যক ।
৪ ) আরোগ্যের বিঘ্ন দূর করার জ্ঞান : সদৃশ মতে নির্বাচিত ঔষধ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও রোগ আরোগ্য না হইলে আরোগ্যের পথে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা সমূহ এবং সেগুলি দূর করিবার উপায় জানিতে হইবে । এই বাধাসমূহ দূর করিতে না পারিলে রোগলক্ষণ সমূলে বিনষ্ট হইবে না ।
ইহা ছাড়া রোগের গতিধারা , অবস্থা পরিণতি এবং সেই অনুযায়ী ঔষধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করার নিমিত্ত মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবস্থান , তাহাদের ক্রিয়া ও পরস্পরের সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয় ।
প্রশ্ন - আদর্শ আরোগ্য বলিতে কি বুঝ ?
উত্তরঃ চিকিৎসকের কাজ হইল রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করিয়া তোলা । শুধু তার দুই একটি কষ্টকর উপসর্গ দূর করা নয় । যেমন কোন রোগীর জ্বর হইল , ঔষধ প্রয়োগের পর গায়ের উত্তাপ নাই কিন্তু মুখে বিস্বাদ , কানে ভোঁ ভোঁ করা , মাথা ঘোরা , ক্ষুধাহীনতা , বমি ভাব , কোষ্ঠবদ্ধতা , নিদ্রাহীনতা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিল । এখানে বলা হয় জ্বর সারিয়াছে কিন্তু তা নয় । আসলে জ্বরকে ধামা চাপা দেওয়া হইয়াছে মাত্র । ইহাকে আরোগ্য বলা চলে না । চিকিৎসক যদি ঔষধ প্রয়োগ করিয়া রোগীর মানসিক প্রফুলতা বৃদ্ধি করিতে পারিতেন , রোগীর কোষ্ঠ পরিস্কার হইত , ক্ষুধা বৃদ্ধি হইত , সুনিদ্রা হইত এবং পূর্বের ন্যায় রোগী সুস্থবোধ করিতেন তবেই রোগী আরোগ্য লাভ করিয়াছে বলা যাইত । অতএব রোগীর যাবতীয় অসুস্থতা দূরীভূত করিয়া তাহার স্বাস্থ্যের পুনঃসংস্থাপনকে আরোগ্য বলা হয় । আর সে আরোগ্য বিধান কার্যটি যদি ( ১ ) অতি অল্প সময়ের মধ্যে
( ২ ) রোগীকে কোন রূপ জ্বালা যন্ত্রণা না দিয়া
( ৩ ) স্থায়ীভাবে অর্থাৎ পীড়ার পুনরাক্রমণ বিধানে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার করিতে পারা যায় তাহাকে আদর্শ আরোগ্য বা যথার্থ আরোগ্য বলা হয় ।
প্রশ্ন - আদর্শ আরোগ্য কিভাবে সম্পাদিত হয় ?
উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমানের অভ্রান্ত উপলব্ধি ও বিশুদ্ধ পরীক্ষার ফলেই আমরা আদর্শ আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম অবগত হইয়াছি । রোগলক্ষণের সাথে ঔষধ লক্ষণ মিলাইয়া রোগ নিরাময় হয় । রোগীর দেহ ও মনে প্রকাশিত বিকৃত লক্ষণসমষ্টির দ্বারা অংকিত রোগের প্রতিচ্ছবির সদৃশ চিত্রবিশিষ্ট সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষিত শক্তিকৃত একবারে একটিমাত্র ক্ষুদ্রতম মাত্রার ঔষধ প্রয়োগে আদর্শ আরোগ্য সম্পাদিত হয় ।
প্রশ্ন - সম্পূর্ণ আরোগ্যের লক্ষণাবলী কি কি ?
উত্তর : সম্পূর্ণ আরোগ্যের লক্ষণাবলী নিম্নরূপ
১ ) রোগীর দেহমনে অসুস্থকর লক্ষণাবলী সর্বতোভাবে দূরীভূত হইয়া গিয়াছে ।
২ ) পুনরায় অসুস্থকর লক্ষণাবলী ফিরিয়া আসে নাই ! রোগী দেহে রোগশক্তি বিন্দুমাত্রও বিদ্যমান থাকে না ।
৩ ) রোগী পূর্বস্বাস্থ্যে ফিরিয়া গিয়াছে ।
৪ ) আরোগ্যের পর রোগী সম্পূর্ণ স্বস্তিবোধ করে ।
প্রশ্ন - কিভাবে হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য প্রাকৃতিক আরোগ্যের সদৃশ হয় ?
উত্তর : আরোগ্যের ক্ষেত্রে সদৃশ ও বিসদৃশ এই দুইটি পদ্ধতি বিদ্যমান । বিসদৃশ পদ্ধতিতে রোগ আরোগ্য হইতে পারে না । কারণ দুইটি ভিন্ন প্রাকৃতিক পীড়া একে অন্যকে দমন করিতে পারে না । সুতরাং ঔষধ দ্বারা বিসদৃশ পদ্ধতিতে রোগ দূর করা যায় না । অন্যদিকে সদৃশনীতিতেই প্রকৃত আরোগ্য সাধিত হয় । প্রকৃতির মধ্যে দেখা যায় দুইটি সদৃশ ব্যাধি একে অন্যকে বিতাড়িত করে । কৃত্রিম রোগ সৃষ্টিকারী ঔষধ দ্বারা সদৃশনীতিতে চিকিৎসা করাই প্রাকৃতিক নিয়ম । তাই বলা হয় হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য প্রাকৃতিক আরোগ্যের সদৃশ ।
প্রশ্ন - আরোগ্য আরোগ্যের ধারার বর্ণনা দাও । বা , আদর্শ আরোগ্যের ধারা ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : রোগের আক্রমণ ঘটিলে প্রথম জীবনীশক্তিই আক্রান্ত হয় । পরে বিভিন্ন অঙ্গে উহার লক্ষণ প্রকাশ পায় । এই অবস্থায় ভিতরের চিকিৎসাই প্রথম করিতে হয় । এবং বাহিরের চিকিৎসা পরে করিতে হয় । কারণ আরোগ্য কেন্দ্র হইতে পরিধির দিকে , ভিতর হইতে বাহিরের দিকে , উপর হইতে নিচের দিকে , মাথা হইতে কম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দিকে অগ্রসর হয় । আবার যে লক্ষণ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় , সেই লক্ষণ সর্বশেষে অদৃশ্য হইবে । চিররোগের আরোগ্যের অগ্রগতি বা ক্রমবৃদ্ধি বাহির হইতে কেন্দ্রের দিকে চলে । সকল প্রাচীন পীড়া প্রথম বাহির হইতে কেন্দ্রের দিকে চলে । যে অনুপাতে বিকাশ , আরোগ্য সেই অনুপাতেই হইবে । ইহাই আদর্শ আরোগ্যের ধারা ।
প্রশ্ন - হ্যানিমান আরোগ্যের কি প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করিলেন ?
উত্তর : আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম এই যে , জীবদেহের মধ্যে অদৃশ ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন দুইটি পীড়ার মধ্যে যদি একটি অপরটি অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হয় এবং উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিন্তু দৃশ্যত অত্যধিক সদৃশ হয় তাহা হইলে শক্তিশালী পীড়াটি দুর্বলতর পীড়াটিকে চিরকালের জন্য ধ্বংস করিয়া দেয় । প্রশ্ন -২.১৭ । এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পার্থক্য কি ? উত্তর : আরোগ্য বিধানের জন্য আমাদের নিকট দুইটি পথ মাত্র খোলা আছে । একটির ভিত্তি হইল প্রকৃতিকে নির্ভুলভাবে অনুসরণ করা অর্থাৎ ক্রিয়া ধারার পর্যবেক্ষণ , সতর্ক নীরিক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে হোমিওপ্যাথি রীতি বলা হয় । আর একটি উহার বিপরীত , এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি । নিম্নে হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির পার্থক্য বর্ণণা করা হইল ।
১ ) নীতি : হোমিওপ্যাথি সদৃশনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত । এলোপ্যাথিতে এইরূপ কোন নির্দিষ্ট নীতি নাই । হোমিওপ্যাথিতে এমন ঔষধ প্রয়োগ করা হয় যাহা সুস্থ মানবদেহে রোগলক্ষণের সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করিতে পারে । অন্য দিকে এলোপ্যাথিতে এমন ঔষধের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয় যেগুলি সুস্থ দেহে এমন রোগ সৃষ্টি করে । যার সঙ্গে রুগ্ন ব্যক্তির রোগ লক্ষণের কোন সাদৃশ্য থাকে না । এলোপ্যাথিতে বিপরীত পদ্ধতির নীতিরই প্রাধান্য । হোমিওপ্যাথির নীতি শ্বাশত , দেশ কাল ও পাত্র ভেদে তার পরিবর্তন হয় না । কিন্তু এলোপ্যাথিতে নীতির স্থিরতা নেই । যে ঔষধ অভ্রান্ত ও আমোঘ বলিয়া প্রয়োগ করা হয় কিছুদিন পর তাহা ভ্রান্ত ও ক্ষতিকারক বলিয়া পরিত্যক্ত হয় ।
২ ) লক্ষ্য : হোমিওপ্যাথির উদ্দেশ্য হইল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কষ্টবিহীন ভাবে ও নির্দোষ উপায়ে স্থায়ীভাবে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনঃরুদ্ধার করুণ । এলোপ্যাথির উদ্দেশ্য হইল যে কোন প্রকারে রোগীর কষ্টকর উপসর্গসমূহকে দূর করা বা সাময়িক উপশম দেওয়া ।
৩ ) দৃষ্টিভঙ্গি : হোমিওপ্যাথিতে মানুষকে এক অখণ্ড , জীবন্ত চৈতন্যময় সত্তা • বলিয়া বিবেচনা করা হয় । মানুষ যখন পীড়িত হয় , তাহার কোন বিশেষ অঙ্গ পীড়িত হয় না । এলোপ্যাথিতে যে অঙ্গে রোগের প্রকাশ ঘটে সেই অঙ্গের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই চিকিৎসা করা হয় । যে যন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয় তাহার সংস্কার বা প্রয়োজন বোধে তাহা বাদ দিয়া দেওয়ার কথাও চিন্তা করা হয় ।
৪ ) চিকিৎসা ঃ হোমিওপ্যাথিতে রোগ হইল দেহীর এক বিশেষ অবস্থা । রোগীর অবস্থার গুণগত পরিবর্তন সাধনই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উদ্দেশ্য । এলোপ্যাথিতে রোগীর মানসিক লক্ষণের মূল্য নাই । রোগের নাম নির্ণয় এলোপ্যাথিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রোগের নাম অনুসারে সব রোগীকে একই ঔষধ প্রয়োগ করা হয় ।
৫ ) রোগ নির্ণয় ও ঔষধ নির্বাচন সম্বন্ধে নীতি : হোমিওপ্যাথিতে রোগীর ও ঔষধের স্বতন্ত্র বিশিষ্টতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং রোগ নির্ণয়ে ও ঔষধ নির্বাচনে স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসরণ করা হয় । এই জন্য হোমিওপ্যাথিতে রোগের কোন বিশেষ নাম নাই এবং তার জন্য বিশেষ ঔষধও নাই । বিভিন্ন রোগে ঔষধ যেমন ব্যবহৃত হইতে পারে , তেমনি বিভিন্ন রোগেও একই ঔষধ ব্যবহৃত হইতে পারে ।
৬ ) ঔষধ : হোমিওপ্যাথিতে ঔষধের রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতাকেই আরোগ্যদায়িনী ক্ষমতা বলিয়া মনে করা হয় । প্রতিটি সুস্থ মানবদেহে প্রয়োগ করিয়া মানুষের দেহ ও মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় তাহা ভালভাবে অনুধাবণ করা হয় । এলোপ্যাথিতে ব্যবহৃত ঔষধ সমূহ সাধারণতঃ ইতর প্রাণীর উপর পরীক্ষা করিয়া রোগীর উপর তাহা প্রয়োগ করা হয় , প্রয়োগ ক্ষতিকারক বলিয়া প্রমাণিত হইলে তাহা বর্জিত হয় । হোমিওপ্যাথিতে সমস্ত কষ্টকর উপসর্গের জন্য একসময় একটি মাত্র ঔষধ ক্ষুদ্রমাত্রায় ব্যবহার করা হয় । মিশ্রিত বা পর্যায়ক্রমিক ঔষধ ব্যবহার হোমিওপ্যাথিতে নিষিদ্ধ । এলোপ্যাথিতে সাধারণতঃ বিভিন্ন ঔষধের মিশ্রণ বা একসঙ্গে একাধিক ঔষধের ব্যবহার বহুল প্রচলিত । বিভিন্ন কষ্টকর উপসর্গের জন্য বিভিন্ন ঔষধ স্থুল মাত্রায় ঘন ঘন প্রয়োগ করা হয় ।
৭ ) জীবানুবাদ ঃ হোমিওপ্যাথ জীবাণুবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয় । কোন ঔষধ দ্বারা রোগ জীবাণু ধ্বংস করা গেলেও মানুষ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ নাও করিতে পারে । হোমিওপ্যাথি মনে করে মানুষের প্রাণ সত্তার দুর্বলতার জন্যই মানুষের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা জন্মায় । অথচ এলোপ্যাথিতে রোগ জীবাণু ধ্বংস করাই রোগ নিরাময়ের প্রধান উপায় বলিয়া মনে করা হয় ।
রোগ সম্বন্ধে হোমিও মতবাদ
( Conception of disease from the Homoeopathic point of view )
প্রশ্ন - রোগ বলিতে কি বুঝায় বা রোগ সম্পর্কে হোমিওপ্যাথিতে কিরূপ ধারণা পোষণ করা হয় ?
উত্তর : জীবনীশক্তির বিকৃত অবস্থাজনিত সৃষ্ট লক্ষণকেই রোগ বলা হয় । অদৃশ্য জীবনীশক্তি মানবদেহে অতি সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থিত । জীবনীশক্তির এই গতি ভিতর হইতে বাহিরের দিকে । কোন ব্যক্তি পীড়িত হইলে আমাদের প্রথম বুঝিতে হইবে জীবনীশক্তির বিপর্যস্ত অবস্থা । রোগশক্তির বিরুদ্ধে সব সময় জীবনীশক্তি যুদ্ধ করিয়া আসিতেছে এবং রোগশক্তিকে প্রতিহত করিয়া জীবন ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখিতেছে । যদি রোগশক্তিটি জীবনীশক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী হয় তবে জীবনীশক্তির সুশৃংঙ্খল কর্মকাণ্ডে বিপর্যয় ঘটিলে সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে জানাইয়া দেয় । প্রাকৃতিক রোগশক্তি সূক্ষ্ম ও অজড় । এই অজড় রোগশক্তির প্রভাবেই অজড় জীবনীশক্তি বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে লক্ষণ সমষ্টির সাহায্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রকাশ করে । যাহার ফলে মানবের দেহ ও মনের বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হয় । অনুভূতির বিকৃতি ঘটে ও বিশৃঙ্খল ক্রিয়াকলাপ দেখা দেয় । এই সকল বিকৃত অনুভূতি , বিশৃঙ্খল ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ জীবনীশক্তির বিকৃত অবস্থাজনিত যে সকল লক্ষণ মানবদেহে প্রকাশিত হয় ঐ লক্ষণসমষ্টিকেই হোমিওপ্যাথি রোগ বলা হয় । রোগ সম্পর্কে হোমিওপ্যাথিতে যে ধারণা পোষণ করা হয় তাহা হইল এই যে প্রাকৃতিক রোগ শক্তি সূক্ষ্ম ও অজড় ।
প্রশ্ন - রোগ চিকিৎসায় লক্ষণসমষ্টির প্রয়োজনীয়তা কি ?
উত্তর : চিকিৎসার জন্য লক্ষণসমষ্টিই হইল রোগ । যতক্ষণ রোগ আরোগ্যযোগ্য অবস্থায় থাকে ততক্ষণ রোগ লক্ষণের স্বকীয় , বিশিষ্টতা বর্তমান থাকে । যখন রোগ থাকে না তখন লক্ষণসমষ্টিও থাকে না । আভ্যন্তরীন রোগের পরিচয় জানিবার একমাত্র বিশ্বস্ত উপায় হইল লক্ষণসমষ্টি । লক্ষণের মাধ্যমেই রোগের পরিচয় থাকে । আর হোমিওপ্যাথি একটি লাক্ষণিক চিকিৎসা বিজ্ঞান । ঔষধ নির্বাচনে তথা সদৃশ বিধানের চিকিৎসা লক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য অপরিসীম । লক্ষণ ঠিকভাবে চিহ্নিত না হইলে চিকিৎসা কর্ম ব্যর্থ হইয়া যায় । হোমিওপ্যাথিতে রোগলক্ষণ শুধু রোগের চিহ্ন নহে , কার্যত রোগ । সেই জন্যই রোগলক্ষণের ব্যঞ্জনা এত বাগক ও গভীর ।
প্রশ্ন - রোগের প্রকৃত এবং একমাত্র বোধগম্য প্রতিচ্ছবি কিভাবে গঠিত হয়।
উত্তর : হ্যামিমানের মতে রোগ হইলে তাহার লক্ষণ থাকিবেই এবং সেই লক্ষণ অবশ্যই বোধগম্য হইবে । রোগলক্ষণ অবশ্যই মানুষের ইন্দ্রিয় দ্বারা সহজেই বোধগম্য হয় । ব্যাক্তিগত রোগী ক্ষেত্রে আমরা রোগীর দেহ মনের কতিপয় বিকৃতি পরিবর্তন লক্ষ্য করি । রোগ অজড় উহা দেখা যায় না । কিন্তু রোগলক্ষণ আমরা প্রত্যক্ষ করি । রোগলক্ষণ হইল রুগ্ন প্রকৃতির নিজের অবস্থা জানানোর এবং সাহায্য প্রার্থনা করার স্বাভাবিক ভাষা । রোগীর স্বাস্থ্য বিকৃতিজনিত লক্ষণসমষ্টি রোগী নিজে অনুভব করেন , রোগীর আত্মীয় স্বজন এবং সেবাকারীরা পর্যবেক্ষণ করেন এবং চিকিৎসকের নিকট বর্ণনা দেন । আর চিকিৎসক স্বয়ং পর্যবেক্ষণ করিয়া রোগীর ও তাহার আত্মীয় স্বজনদের বর্ণনার সাথে সামগ্রিকভাবে লক্ষণসমূহকে তুলিয়া ধরেন । এইসব প্রত্যক্ষ লক্ষণসমষ্টির দ্বারাই রোগের প্রতিকৃতি গঠিত হয় ।
প্রশ্ন - ব্যক্তিনিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠু লক্ষণ বলিতে কি বুঝায় ?
উত্তর ঃ রোগলক্ষণ দুই প্রকার । ব্যক্তিনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ । ব্যক্তিনিষ্ঠ লক্ষণ ঃ রোগের যেসব লক্ষণ কেবল রোগী নিজে অনুভব করিতে পারে এবং রোগী না বলিলে চিকিৎসক বা অন্য কেহই তাহা বুঝিতে পারে না উহাদিগকে ব্যক্তিনিষ্ঠ লক্ষণ বলে । যেমন - ক্ষুধা , পিপাসা , মাথাব্যথা প্রভৃতি । বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণঃ রোগের যে সকল লক্ষণ রোগী না বলিলেও চিকিৎসক তাহার জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ও যান্ত্রিক পরীক্ষার দ্বারা জানিতে পারেন উহাদিগকে বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ বলে । যেমন - কাশি , জ্বর , প্রভৃতি ।
প্রশ্ন - রোগ সম্বন্ধে প্রাচীনপন্থীদের ধারণা ও হোমিওপ্যাথিক নীতির মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা কর ।
উত্তর : রোগ সম্বন্ধে প্রাচীন পন্থীদের ধারণা ও হোমিওপ্যাথিক নীতির মধ্যে পার্থক্য অনেক । প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকগণ ডাঃ গ্যালেনের আবিষ্কৃত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা অর্থাৎ বিসদৃশ মতে চিকিৎসা করিয়া সাময়িক উপশমের দ্বারা মানুষের বিশ্বাস লাভের চেষ্টা করেন । প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকেরা রোগকে স্থূলবস্তু ভাবিয়া স্থুল ঔষধ প্রয়োগে উপশম দিতে চেষ্টা করেন । তাঁহারা দেহের যেকোন অংশ বিশেষের প্রকাশিত বিকৃতিকে বা কোন অঙ্গের লক্ষণকে রোগ বলিয়া আখ্যায়িত করেন । কিন্তু হোমিওপ্যাথি নীতি উহার সম্পূর্ণ ভিন্ন । হোমিওপ্যাথিতে জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খল অবস্থায় দেহের বিভিন্ন অংশে প্রকাশিত লক্ষণসমঠিকে রোগ বলে । রোগ কোন অংশ বিশেষের বিকৃতি নয় , দেহীর প্রাণসত্তার বিকৃত অবস্থা তথা বিভিন্ন অঙ্গে প্রকাশিত জীবণীশক্তির অসুস্থাবস্থার লক্ষণাবলীই রোগ । রোগ কোন জড় বস্তু নয় । ইহা অজড় এবং অতীন্দ্রিয় !
প্রশ্ন - প্রবণতা কাহাকে বলে ? সুস্থ প্রবণতা ও রোগ প্রবণতা কি ?
উত্তর : উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া প্রকৃতিপ্রদত্ত ধর্ম । এই ধর্ম মানব দেহে এক বিশেষ অবস্থা হিসেবে বিদ্যমান থাকে । এই অবস্থাকে প্রবণতা বলে । আভ্যন্তরীক ও বাহ্যিক প্রভাব সমূহের প্রতি দেহীর প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি প্রধানতঃ প্রবণতার উপর নির্ভর করে । প্রবণতা বলিতে তাই আমরা বুঝি কোন কিছুর প্রতি অভাব , চাহিদা বা ক্ষুধা সূচিত করে । অভাববোধ হইতেই বাঞ্ছিত দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে , দুর্বলতা জন্মে । কাজেই সেই আকাঙ্খিত দ্রব্য গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পাইলে প্রাণসত্তা তাহাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে এবং আত্মসাৎ করিয়া পরিতৃপ্ত হয় । জীবনের ইহাই স্বাভাবিক ধর্ম ও সুস্থতার লক্ষণ । ইহারই নাম সুস্থ প্রবণতা । যখন এই স্বাভাবিক গ্রহণ ক্ষমতার বিকৃতি ঘটে তখনই দেহীর রোগ ঘটে , কষ্ট ভোগ হয় । এই বিকৃত প্রবণতাকে রোগপ্রবণতা বলে ।
প্রশ্ন - জীবনী শক্তি কি ?
উত্তর : হ্যানিমান তাহার অর্গানন গ্রন্থে জীবনীশক্তির প্রথম উল্লেখ করেন এবং তাহার প্রবর্তিত হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রটি ঐ শক্তির উপরই সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত । এই পরা প্রকৃতি বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রত্যেক অনুপরমাণুর মধ্যে ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত থাকিয়া যেখানে যেরূণ কার্যের প্রয়োজনীয়তা আছে , তাহা সম্পাদন করিয়া থাকে । এই শক্তি যেমন জড় দেহে আছে , তেমনি উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহেও আছে । ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে জীবণীশক্তি সম্বন্ধে সর্বপ্রথম ধারণা প্রকাশ পায় । হ্যানিমান তাহার বর্ণনায় জীবণীশক্তিকে Spiritual বলিয়াছেন । যে অদৃশ্য শক্তি মানব শরীরে স্বাধীন ভাবে থাকিয়া মানব দেহকে সঞ্জীবিত রাখে , দেহের পুষ্টি ও ক্ষয় পূরণে সাহায্য করে থাকে । যে শক্তির প্রভাবে আমরা কথা বলি , সাড়া দিই অনুভব করি , জন্ম দিই , সে শক্তিকে মহাত্মা হ্যামিমান জীবনীশক্তি নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন । মানব দেহের প্রতি অঙ্গে প্রতি কোষে এই শক্তি সমান ভাবে পরিব্যপ্ত থাকিয়া দেহের প্রতিটি যন্ত্রকে স্বীয় কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত রাখে । এই শক্তি এক দিকে দেহ কান্ডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্রিয়া সমূহের সংহতি ও সামঞ্জস্য বিধান করে । আবার অন্য দিকে বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে আন্তঃপ্রকৃতিকে মানাইয়া নিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রয়োগ চালায় এবং সযত্নে দেহ তন্ত্রে সাম্যাবস্থা বজায় রাখে ।
প্রশ্ন - রোগ প্রতিরোধ বা স্বাস্থ্য রক্ষায় জীবনীশক্তির বর্ণনা কর । বা , মানুষের সুস্থাবস্থায় জীবনীশক্তির কাজ কি ?
উত্তর : প্রথমতঃ জীবনীশক্তি বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রত্যেক অনুপরমানুর মধ্যে ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত থাকিয়া যেখানে যেরূপ কার্যের প্রয়োজন তাহা সম্পাদন করিয়া থাকে । মানুষ দেহ মন ও প্রাণের সমন্বয়ে গড়া এক অখন্ড চৈতন্যময় সত্ত্বা । মানুষ যখন সুস্থ থাকে তখন সামগ্রিক ভাবেই সুস্থ থাকে । অসুস্থ হইলে গোটা মানুষটিই অসুস্থ হইয়া পড়ে । সুস্থাবস্থায় মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ প্রাণক্রিয়া সাধিত হয় তাহার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে এক অতীন্দ্রিয় শক্তির ছন্দোময় প্রকাশের মধ্য দিয়ে । দেহের অভ্যন্তরস্থ আত্মার জাগরণ , উদ্বোধন , উন্নয়ণ , বিকাশ জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য । জীবনীশক্তি সজীব সুস্থ দেহকে এমন চমৎকারভাবে পরিচালিত করে যাহাতে মানুষের মন মানুষের অস্তিত্বের উচ্চত ! মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে দেহকে নিযুক্ত রাখিতে পারে । জীবনীশক্তির প্রবাহ প্রাণকেন্দ্র হইতে প্রতিকোষে , প্রতি কলায় , প্রতি অঙ্গে ভিতর হইতে বাহিরের দিকে বহিয়া চলে । সুস্থাবস্থায় জীবনীশক্তি দেহের বৃদ্ধি , পুষ্টি ও ক্ষয় পূরণে সহায়তা করে । এই জীবনীশক্তির প্রভাবে আমরা কথা বলি , সাড়া দিই , অনুভব করি , জন্মদান করি । মানবদেহের প্রতি অঙ্গে , প্রতি কোষে এই শক্তি সমান ভাবে পরিব্যপ্ত থাকিয়া দেহের প্রতিটি যন্ত্রকে স্বীয় কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত রাখে ।
দ্বিতীয়তঃ রোগশক্তির বিরুদ্ধে দেহস্থ জীবনীশক্তি প্রতিরোধ চালাইয়া জীবদেহ তাহা বাহিরে প্রকাশ করিয়া দেয় । সুস্থ রাখে এবং রোগাৎপাদিকা শক্তি দ্বারা যদি একান্তই আক্রান্ত হইয়া পড়ে তবে তাহা বাহিরে প্রকাশ করিয়া দেয়।
প্রশ্ন - রোগ আরোগ্যের ক্ষেত্রে জীবনীশক্তির ক্রিয়া বর্ণনা কর । বা , অসুস্থ অবস্থায় জীবনী শক্তির কাজ কি ?
উত্তর : জীবনীশক্তি অতিশয় সূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় । রোগ শক্তি সূক্ষ্ম ভাবে জীবনীশক্তিকে আক্রমন করে । অর্থাৎ জীবনীশক্তি যখন দেহমধ্যে সুশৃঙ্খলার সহিত রাজত্ব করিতে থাকে তখন অলক্ষ্যে সূণ্ন রোগশক্তি হঠাৎ তাহাকে আক্রমন করিয়া নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে । ফলে দেহ অসুস্থ হইয়া পড়ে । এই অবস্থায় সূক্ষ্ম জীবনীশক্তির সহিত সূক্ষ্ম রোগশক্তির যুদ্ধ ঘটে । জীবনীশক্তি সবল থাকিলে রোগশক্তিকে পরাজিত করিয়া স্বীয় রাজ্য হইতে বহিষ্কৃত করে , কিন্তু জীবনীশক্তি দুর্বল হইলে রোগশক্তি জীবনীশক্তির উপর আধিপত্য বিস্তার করে । তখন সূক্ষ্ম জীবনীশক্তির সাহায্যার্থে সূক্ষ্ম ' ভেষজ শক্তি ' সমলক্ষণে প্রদত্ত হইলে প্রদত্ত ভেষজ শক্তি রোগ শক্তির স্থান অধিকার করে এবং প্রবল ভাবে জীবনীশক্তিকে আক্রমন করে ফলে জীবনীশক্তি রোগশক্তির কবল হইতে মুক্ত হইয়া আর এক প্রবলতর শক্তির সহিত যুদ্ধে নিরত হইতে বাধ্য হয় । ভেষজশক্তি রোগশক্তির ন্যায় প্রবল হইলেও মাত্রার সূক্ষ্মতা হেতু উহার ক্রিয়া বেশীক্ষণ থাকে না , সহসাই জীবনীশক্তির নিকট পরাভুত ও বিলীন হয় । ফলে জীবনীশক্তি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয় । ইহার দ্বারাই অসুস্থবস্থায় জীবনীশক্তির ক্রিয়াকলাপের পরিচয় পাওয়া যায় ।
প্রশ্ন - জড়দেহ ও মনের সহিত অজড় জীবনীশক্তির সম্পর্ক কি ?
উত্তর : আমাদের জড়দেহের অন্তঃস্থলে যে অতীন্দ্রিয় শক্তি কাজ করে উহাই জীবনীশক্তি । এই জীবনীশক্তির অভাবে জীবদেহ মৃত । জীবনীশক্তি যখন থাকে তখনই জড় দেহ সঞ্চালিত হয় , ইচ্ছা শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং জীবদেহকে আকাংখিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পথে লইয়া যায় । হ্যানিমানের মতে জড় দেহ জীবনীশক্তি ও মন এই তিনের সমন্বয়ে প্রত্যেক মানুষের চৈতন্যময় সত্ত্বা । জীবনীশক্তি ছাড়া জড় দেহের অনুভব করার কাজ করার বা আত্মরক্ষা করার কোন সামর্থ নাই । এই জীবনীশক্তির প্রভাবে জড়দেহ সজীব থাকে , জীবনের সত্ত্বাই জীবনীশক্তি । জীবনীশক্তি ছাড়া জড়দেহ কোন ক্রিয়া করিতে পারে না । জড়দেহের অভ্যন্তরস্থ প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন হাত , পা , চক্ষু , আবার ফুসফুস যকৃত , হৃৎপিণ্ড এবং মন প্রত্যেকটিই জীবনী শক্তির সুনিয়ন্ত্রিত পরিচালনায় পরিচালিত হইয়া স্বীয়কর্ম সম্পাদন করিতেছে ।
প্রশ্ন - রোগে কে আক্রান্ত হয় ? দেহ না জীবনীশক্তি ?
বা , আক্রান্ত জীবনীশক্তি কিরূপে বাহ্যিকভাবে প্রত্যক্ষনীয় রোগ উৎপাদন করে এবং কিভাবেই বা সেই রোগ নিরসিত হইয় । স্বাস্থ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ?
উত্তর : সার্বভৌম শক্তির আধার জীবনীশক্তির মানুষের দেহ রাজ্যের অধিপতি , ইহার নিয়ন্ত্রণেই দেহের সকল কার্য পরিচালিত হয় । এই জীবনীশক্তি বোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় । অতীন্দ্রিয় জীবনীশক্তি অজড় অশুভ প্রাকৃতিক রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হইয়া বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং অসুস্থ হইয়া পড়ে । জীবনীশক্তির অসুস্থাবস্থা সমগ্র জড়দেহের বিভিন্ন অঙ্গে একসাথেই বিকশিত হয় এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গের বিকৃতাবস্থা লক্ষণসমষ্টি আকারে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় । এই প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টি হইল রোগলক্ষণ । এখন যে কোন উপায়ে রোগ লক্ষণগুলি বিদূরীত করিতে পারিলেই রোগী পূর্বস্বাস্থ্যে নীত হয় এবং আরোগ্য সাধিত হয় । যেহেতু দেহের বাহিরের পরিবর্তনসমূহ অদৃশ্য আভ্যন্তরীক পরিবর্তনের দৃশ্যমান বাহ্যিক আকৃতি , তাই চিকিৎসা দ্বারা অর্থাৎ আভ্যন্তরীক চিকিৎসা দ্বারা বাহ্যিক লক্ষণ সকল সম্পূর্ণ দূরীভূত হইলে সে সাথে আভ্যন্তরীক যে গোলযোগ হেতু উহারা উৎপাদিত হইয়াছিল , তাহাও দূরীভূত হইয়াছে বুঝিব । একমাত্র সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন সূক্ষ্ম মাত্রার ঔষধ প্রয়োগে সদৃশনীতির সাহায্যে জীবনীশক্তির আভ্যন্তরীক বিশৃংঙ্খলা দূর করা সম্ভব , যাহা দূর হইলে বাহ্যিক লক্ষণসমূহও অন্তর্হিত হয় এবং জীবনীশক্তি এককালেই সুশৃংখল অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং রোগীর স্বাস্থ্য এককালেই পুনঃস্থাপিত হয় । প্রাকৃতিক নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসায় প্রকাশিত রোগলক্ষণ দূরীভূত হইলে রোগ আর থাকে না , জীবনীশক্তিও বিকৃতিমুক্ত হয় এবং সমগ্র যান্ত্রিক দেহের স্বাস্থ্য পুণঃস্থাপিত হয় ।
প্রশ্ন - রোগ কি দেহী এবং জীবনীশক্তি হইতে পৃথক বস্তু ?
বা , জীবনীশক্তি , দেহ ও রোগ ইহাদের পরস্পরের সহিত কি সম্বন্ধ ? রোগকে শরীরের অভ্যন্তরের লুকায়িত কোন স্থুল পদার্থ বলিয়া ধারণা করা উচিত কি না ?
উত্তর : রোগ কোন জড়দেহধারী পদার্থ নয় যে উহা দেহের মধ্যে বাসা বাঁধিবে । রোগ হইল প্রাকৃতিক এক অশুভ শক্তি , ইহা অজড় , অশরীরি অতীন্দ্রিয় । রোগ বলিতে আমরা বুঝি জীবনীশক্তির বিশৃংখলাজনিত বাহ্যিক প্রকাশ । জীবনীশক্তি প্রাকৃতিক রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হইলে বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয় । যাহার জীবনীশক্তির প্রতিরোধঅবস্থা দুর্বল বা প্রাকৃতিক রোগ গ্রহণের প্রবণতা আছে তাহার জীবনী শক্তিই রোগশক্তির প্রভাবে অসুস্থ হয় । রোগশক্তির প্রভাবে এই অসুস্থতা হেতু দেহ মনে বিকৃত অবস্থার সৃষ্টি করে । এই বিকৃত অবস্থা রোগলক্ষণ নামে পরিচিত । কিন্তু মূল রোগ নয় । জীবনীশক্তির দুর্বলতাই রোগের কারণ । দেহের বিভিন্ন অঙ্গে প্রকাশিত রোগলক্ষণসমষ্টিকে আমরা রোগ বলি । রোগ লক্ষণসমষ্টি দূর হইলে রোগ যদি পৃথক কিছু হইত তাহা হইলে দেহের মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যাইত । জড় বস্তু কোন কাজ করিতে পারে না । এই জড়ের পশ্চাতে কারণ রূপে সূক্ষ্ম জীবনীশক্তির বিকৃতি আছে । সূক্ষ্ম শক্তিই সকল কার্যের মূল । রোগোৎপাদন বিষয়েও জীবনীশক্তির বিশৃংখলাই কারণ । বিকৃত জীবনীশক্তিই স্বীয় আক্রান্ত বা বিকৃত অবস্থা সূচনা করে বলিয়াই বাহ্যিক লক্ষণাদি বা স্থুল বিকৃতাদি প্রকাশ পায় । হোমিওপ্যাথি মতে ভাইরাস , ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি রোগের কারণ নয় বরং রোগের ফল । পীড়া দেহ বা জীবনীশক্তি হইতেও পৃথক কোন বস্তু নয় । জীবনীশক্তির বিশৃংখলা দেখা দিলেই দেহ ও মনে অস্বাভাবিক লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং ঐ লক্ষণসমষ্টিকেই রোগ বলা হয় । আর দেহী বা মানুষ হইল দেহ , মন ও প্রাণের সমন্বয়ে গড়া এক অখন্ড চৈতন্যময় সত্ত্বা । এক অংশকে অন্য অংশ হইতে পৃথক করা যায় না । এর কোন অংশে কোন বিশৃংখলা দেখা দিলে সমগ্র সত্বায় তার প্রতিফলন ঘটে ।
প্রশ্ন - জীবনীশক্তি , রোগশক্তি ও ঔষধশক্তির মধ্যে পার্থক্য কি ?
উত্তর : জীবনীশক্তি , রোগশক্তি ও ঔষধ শক্তি সদৃশনীতির চিকিৎসকের একমাত্র হাতিয়ার । এই তিনের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান । অতিন্দ্রিয় জীবনীশক্তি আমাদের স্কুল দেহের ধারক , পালক ও নিয়ামক । জীবনীশক্তি ছাড়া দেহের কোন ক্রিয়া সম্পাদন হয় না । জড়দেহ অনুভব করিতে পারে না । অতএব মানুষের জীবদ্দশায় দেহ ও জীবনীশক্তি অবিচ্ছিন্ন । জীবনীশক্তি প্রতিনিয়ত আমাদের সুস্থ দেহে অবস্থান করিয়া প্রাকৃতিক রোগশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত । জীবনীশক্তি যখন দেহমধ্যে সুশৃংখলভাবে রাজত্ব করিতে থাকে , তখন অলক্ষ্যে সূক্ষ্ম রোগশক্তি হঠাৎ তাহাকে আক্রমন করিয়া নানারুপ বিশৃংখলা সৃষ্টি করে । রোগশক্তি জীবনীশক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী হইলেও জীবনীশক্তিকে রোগশক্তির নিকট আবিষ্ট হইতে হয় । ফলে জীবনীশক্তি বিশৃংখলা প্রাপ্ত হয় এবং সেজন্য এই বিশৃংখলাগ্রস্ত অবস্থার কথা জীবনীশক্তি দেহে নানা প্রকার কষ্টজনক অনুভূতি ও নানা প্রকার অবৈধ প্রক্রিয়া উৎপাদন করিয়া লক্ষণসমষ্টির মাধ্যমে বাহিরে প্রকাশ করে । জীবনীশক্তির বিশৃংখলার ফলে দেহ ও মনে যে সকল অস্বাভাবিক লক্ষণাবলী পরিদৃষ্ট হয় তাহাই রোগলক্ষণ বা রোগ । রোগ শক্তি সূক্ষ্ম , তাই সূক্ষ্ম রোগ শক্তির মাধ্যমে সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি আক্রান্ত হয় । রোগশক্তি দেহীকে আক্রমন করে দেহকে নয় । জীবনীশক্তি সবল হইলে রোগশক্তি পরাজিত হইয়া স্বীয় রাজ্য হইতে বহিষ্কৃত হয় , আর জীবনীশক্তি দুর্বল হইলে রোগশক্তি জীবনীশক্তির উপর আধিপত্য বিস্তার করে । অসুস্থ জীবনীশক্তি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে লক্ষণসমষ্টি সৃষ্টির মাধ্যমে সাহায্যের ভাষা প্রকাশ করে । অসুস্থ জীবনীশক্তি নিরাময়ের জন্য ঔষধ শক্তি প্রার্থনা করে । সূক্ষ্ম জীবনীশক্তির সাহায্যার্থে সূক্ষ্ম ঔষধশক্তি যদি সমলক্ষণ প্রদত্ত হয় তাহা প্রদত্ত ভেষজশক্তি রোগশক্তির স্থান দখল করে ও প্রবল ভাবে জীবনীশক্তিকে অক্রমন করে । রোগশক্তি হইতে ঔষধশক্তি কিছু শক্তিশালী হইলেই রোগ শক্তিকে ঔষধশক্তি আবিষ্ট করিয়া ফেলে । ফলে জীবনীশক্তি রোগশক্তির কবল হইতে মুক্তিলাভ করিয়া আর এক প্রবলতর শক্তির সহিত যুদ্ধে নিরত হয় । ঔষধ শক্তি রোগশক্তির ন্যায় প্রবল হইলেও মাত্রার সূক্ষ্মতা হেতু সহসা জীবনীশক্তি নিকট পরাভূত ও বিলীন হয় । সুতরাং জীবনীশক্তি প্রথমত রোগশক্তি পরে ভেষজশক্তির কবল হইতে মুক্তি লাভ করিয়া পূর্ববৎ দেহমধ্যে সুশৃংখলার সহিত রাজত্ব করিতে থাকে । রোগোৎপাদিকা শক্তি সুস্থ অবস্থাকে পরিবর্তন করিয়া অসুস্থ করে , কিন্তু ঔষধশক্তি সুস্থকে অসুস্থ করিতে পারে এবং অসুস্থকে সুস্থ করিতে পারে । সুতরাং ঔষধ শক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর , তাহাতে সন্দেহ নাই । মূলতঃ রোগশক্তি , ঔষধশক্তি ও জীবনীশক্তি এই তিন শক্তির ক্রিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত ।
প্রশ্ন - সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি স্কুল রোগ শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় কি ? এবং স্থূল ঔষধের দ্বারা নিরাময় হয় কি ?
উত্তর ঃ জীবনীশক্তি সূক্ষ্ম ও অতিন্দ্রিয় । এই সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি সুস্থাবস্থায় থাকিলে ইন্দ্রয়াদির কার্য অবাধে পরিচালিত হয় । প্রকৃত রোগের উৎপত্তি সূক্ষ্মশক্তি দ্বারাই হইয়া থাকে । তাই যে রোগোৎপাদক সূক্ষ্ম শক্তি দ্বারা আমাদের জীবনীশক্তি বিকৃত হয় আবার ঔষধের সূক্ষ্ম শক্তি দ্বারাই তাহা পুনরায় স্বাস্থ্য লাভ করে । সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি স্থূল রোগশক্তি দ্বারা কখনও আক্রান্ত হইতে পারে না বা স্থূল ঔষধের দ্বারাও নিরাময় হইতে পারে না । সূক্ষ্মশক্তি দ্বারাই সূক্ষ্ম প্রভাবিত হয় । জড়বস্তু দ্বারা অজড় শক্তিকে আঘাত করিলে কোন কাজ হয় না । রোগশক্তি যদি স্থুল হইত বা অজড় দেহ ধারী কোন জীব হইত তাহা হইলে বনে জঙ্গলে লুক্কায়িত ব্যাধিকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া সবংশে নিপাত করা সম্ভবপর হইত । সূক্ষ্ম জীবনীশক্তিকে এই সূক্ষ্ম রোগশক্তি অভৌতিকভাবে আবিষ্ট করে এবং দেহে রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে । এই বিকৃত লক্ষণসমষ্টি দূর না হওয়া পর্যন্ত রুগ্ন মানুষ সুস্থ হইতে পারে না । একমাত্র প্রতিকারক সাদৃশ্য লক্ষণসম্পন্ন ঔষধ শক্তির দ্বারাই জীবনীশক্তির বিশৃংখল অবস্থার দূরীকরণ সম্ভব । দেহমন প্রাণ সমন্বয়ে যে জীবনীশক্তির ক্রিয়া পরিচালিত , প্রয়োগকৃত ঔষধের শক্তি সর্বদেহ ব্যাপিয়া বিস্তৃত স্নায়ুসমূহ দ্বারা অনুভূত হইয়া জীবনীশক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে ও তাহাকে রোগ মুক্ত করে । ঔষধ তাহার জড় অংশ দ্বারা মানব স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে না , প্রভাব বিস্তার তাহার অভ্যন্তরস্থ সূক্ষ্ম তেজোময়ী শক্তি দ্বারা । রোগের শ্রেণী বিভাগ
প্রশ্ন -২.৩২ । রোগের শ্রেণীবিভাগ কর ।
বা , অচির রোগ ও চিররোগ বলিতে কি বুঝ ?
উত্তর : হ্যানিমান রোগকে দুইভাগে ভাগ করিয়াছেন ( ১ ) অচির রোগ ও ( ২ ) চির রোগ ।
অচির রোগ বা তরুণ রোগ বা অস্থায়ী রোগ : এই রোগ হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হয় , দ্রুত জীবনীশক্তি পরিবর্তন সাধন করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই হয় রোগীর জীবননাশ করে , না হয় সমূলে পীড়া দূরীভূত করে । এই সকল রোগের কোন স্থিতিশীলতা নাই । ঔষধ ছাড়াও তরুণ রোগ আরোগ্য হয় , যদিও সময় কিছুটা অধিক লাগিতে পারে । তাহাদের ভোগকাল অল্পদিন । ইহারা বিকৃত জীবনীশক্তির চঞ্চল প্রক্রিয়া মাত্র । জীবনীশক্তির এই আক্রমন ভীষণ হইতে পারে কিন্তু তত গভীর নয় । এই বিকৃতি ঔষধের সাহায্যে দূরীভূত করা সহজ এবং বিনা ঔষধেও ইহা আপনি দূরীভূত হয় । যেমন - ওলাউঠা , হাম , উদারময় , বসন্ত , প্রভৃতি ।
চিররোগ বা প্রাচীন পীড়া বা স্থায়ী রোগ :
যে সকল পীড়ার আরম্ভ প্রায়ই জানিতে পারা যায় না , অতি অল্পে অকিঞ্চিৎকর তেজে অলক্ষিত ভাবে আরম্ভ হইয়া বহুদিন ধরিয়া জীবনীশক্তির বিকৃতি ঘটায় এবং দেহকে অন্তঃসারশূণ্য করিয়া এইরূপ অবস্থায় আনিয়া ফেলে যে প্রকৃত ঔষধ ব্যতীত প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত স্বীয় বৃথা চেষ্টায় , জীবনীশক্তি ইহার হাত হইতে পরিত্রাণ পায় না । স্বীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে চিররোগ জীবনীশক্তিকে নষ্ট করিতে থাকে এবং ঔষধ ছাড়া কখনও পীড়া নিরাময় হয় না । এই রোগ ক্রমশঃ বর্ধিত হইয়া রোগীর মৃত্যু ঘটায় । এই শ্রেণীর রোগ সমূহ জীর্ণ উপবিষ জাতীয় সংক্রমণ হইতে সৃষ্ট , ইহাদের নাম চির রোগ । প্রমেহ , উপদংশ প্রভৃতি চিররোগ ।
প্রশ্ন:- চিররোগ সম্পর্কে হোমিওপ্যাথিক ও অহোমিওপ্যাথিক মতাদর্শের পার্থ ক্য নিম্নে আলোচনা কর।
উত্তর:- চিররোগ সম্পর্কে হোমিপ্যাথিক ও অহোমিওপ্যাথিক মতাদর্শের পার্থক্য আলোচনা।
প্রশ্ন- চিররোগ ও অচিররোগের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তর : অর্চির রোগ বা তরুণ রোগের বৈশিষ্ট্য :
এই জাতীয় রোগ হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হয়। দ্রুত জীবনীশক্তির পরিবর্তন সাধন করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই হয় রোগীর জীবন নাশ করে, না হয় সমূলে পীড়া দুরীভূত হয়। এই সকল রোগের কোন স্থিতিশীলতা নাই । পীড়ার ভোগকাল নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রোগের বিকাশ ও পরিণতি। ঔষধ ছাড়াও তরুণ রোগ আরোগ্য হইতে পারে। পথ্য নিয়ন্ত্রণ, রোগের কারণ নিবারণ, স্বাস্থ্যকর স্থানে বসবাস এবং উপযুক্ত পরিচর্যার দ্বারা রোগ নিরাময় হয়। অচিররোগ বিকৃত জীবনীশক্তির চঞ্চল প্রক্রিয়া মাত্র। জীবনীশক্তির এই বিকৃতি ভীষণ হইতে পারে কিন্তু তত গভীর নয় ।
চিররোগ বা স্থায়ী রোগের বৈশিষ্ট্য :
এই সকল পীড়ার আরম্ভ প্রায়ই জানিতে পারা যায় না। অলক্ষিতভাবে, অকিঞ্চিৎকর তেজে আরম্ভ হইয়া বহুদিন জীবনীশক্তির বিকৃতি ঘটায় এবং দেহকে অন্তসারশূন্য করিয়া এইরূপ অবস্থায় আনিয়া ফেলে যে, প্রকৃত ঔষধ ব্যতীত জীবনীশক্তি ইহার হাত হইতে পরিত্রাণ পায় না। পীড়ার কারণ অদৃশ্য, পীড়ার ভোগকালের কোন সময়সীমা নাই। আজীবন চিররোগে রোগী ভূগিতে পারে। এই রোগ ক্রমশঃ বর্ধিত হইয়া রোগীর মৃত্যু ঘটায়। বিনা চিকিৎসায় এই রোগ আরোগ্য হয় না।
প্রশ্ন- হ্যানিমান কথিত অচিররোগকে তরুণপীড়া বা নতুন ব্যাধি এবং চিররোগকে প্রাচীন পীড়া বলা ভ্রমাত্মক কেন?
উত্তর ঃ আমরা সাধারণতঃ তরুণ পীড়া বলিতে যাহা বুঝি, হ্যানিমান কথিত অস্থায়ী বা অচিররোগ ঠিক তাহা নয়। নতুন কোন রোগ হইলে সাধারণতঃ তরুণরোগ এবং অনেকদিন ভোগ করিলেই তাহা পুরাতন রোগ হয় এই ধারণা আমাদের সকলেরই। কিন্তু হ্যানিমান কথিত তরুণ রোগ অর্থাৎ অস্থায়ী বা অচিররোগ এক বৎসর পরও অচিররোগ বলিয়া আখ্যায়িত হইবে। অচিররোগসমূহ হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হয়, ইহাদের স্থিতিশীলতা নাই। ঔষধ দ্বারাও এই রোগ দূর করা যায়। আবার ঔষধ ছাড়াও জীবনীশক্তি এই রোগ দূরীভূত করিতে পারে।
অপর কোন রোগী ২/১ মাসের বেশীদিন ভূগিলেই তাহার প্রাচীন পীড়া বলিয়া মনে হয়। বস্তুতঃ অচির রোগবীজ হইতে অচিররোগসমূহ ও চিররোগবীজ হইতে চিররোগসমূহ উৎপন্ন হয়। চিররোগবীজ হইতে পীড়া হইলে প্রথমদিন হইতেই তাহার নাম চিররোগ বা ক্রণিক ডিজিজ। অনেকেই ক্রনিক ডিজিজকে প্রাচীন পীড়া বলিয়া উল্লেখ করেন। কিন্তু তাহা হ্যানিমানের মত সঠিকভাবে ব্যক্ত করিতে পারে না। ক্রনিক ডিজিজেজকে প্রাচীন পীড়া বা পুরাতন পীড়া বলিলে সাধারণ লোকে পূর্ব হইতে অনেকদিন কোনও রোগ রোগীকে কষ্ট দিতেছে ইহাই বুঝিতে হইবে। সেজন্যই ইহাকে প্রাচীন পীড়া বলা উচিত নয়। ক্রনিক ডিজিজ বা চিররোগ বলিলে ভবিষ্যতেও আজীবন তাহা ভোগ করিতে হইবে, প্রধানতঃ ইহাই বুঝায়। শুধু বহুদিন ভোগ করা হইয়াছে বুঝায় না।
স্থায়ী রোগ বা চিররোগ একদিনের হইলেও উহাকে চিররোগ বলিয়া অভিহিত করা হয়। এলোপ্যাথির ন্যায় ভোগকাল ধরিয়া চির ও অচির রোগের বিভাগ হ্যানিমান করেন নাই। বিনা ঔষধে আরোগ্য হয় কিনা ইহাই একমাত্র না হইলেও প্রধান বিচার্য বিষয়। প্রমেহ বা উপদংশ একদিনের হইলেও বিনা ঔষধে নির্মূল হয় না বলিয়া ইহা চিররোগ। আবার ম্যালেরিয়াগ্রস্ত রোগীকে বিনা ঔষধে ফেলিয়া রাখিলেও রোগ আরোগ্য হয় বলিয়া এক বৎসর স্থায়ী হইলেও উহা অচিররোগ।
প্রশ্ন- অচির বা তরুণ রোগবীজ কি? তরুণ রোগবীজের কারণজনিত কয়েকটি রোগের নাম লিখ।
উত্তর ঃ মহাত্মা হ্যানিমান অচির রোগসমূহের উৎপত্তির ব্যাপারে কারণ হিসাবে বা বীজরূপে মায়াজন কথাটি ব্যবহার করিয়াছেন। অচির রোগের কারণ হইল অচির বা তরুন রোগবীজ। তরুণ রোগবীজ বা মায়াজমকে অনেকেই জীবাণু অর্থে ব্যবহার করেন। তাঁহারা বলেন মহাত্মা হ্যানিমানই জীবাণুতত্ত্বের জনক। কচ কর্তৃক টিউবারকুলার ব্যাসিলাস আবিষ্কারের ৬০ বৎসর পূর্বে জীবাণুর সংক্রমণে যে রোগ সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে মহাত্মা হ্যানিমান তথ্যের সন্ধান দেন। 'মায়াজম' শব্দের অর্থ পুতিবাস্প, উপবিষ, কলুষ, মালেরিয়া বিষ, প্রভৃতি। তবে হ্যানিমান মায়াজমকে যাবতীয় পীড়ার কারণ আখ্যা দিয়াছেন। তরুণ রোগ তরুণ মায়াজমের অশুভ প্রভাবে সৃষ্টি হয় । ইহা প্রাকৃতিক রোগসৃষ্টিকারী দানব। তরুণ রোগবীজের কারণজনিত কয়েকটি বিশেষ রোগ হইতেছে বসন্ত, হুপিংকাশি, প্লেগ প্রভৃতি। এই রোগসমূহ তরুণ উপবিষ দ্বারা সৃষ্ট।
প্রশ্ন- অচির রোগ বাস্তবিক পক্ষে ঘোরা বা আদিরোগ বীজের ক্ষণস্থায়ী উচ্ছ্বাস মাত্র আলোচনা কর ।
উত্তর : অচির রোগ সমূহ মানুষের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে। এই অচির রোগ সমূহের উত্তেজক নাম হিসাবে নাম করা যায় অতি ভোজন বা স্বল্পাহার, অত্যধিক দৈহিক সংবেদন 'শীত' অতিরিক্ত চাপ, অনাচার, দৈহিক ও মানসিক উদ্বেগ প্রভৃতি। অচির রোগের প্রধান কারণ হিসাবে আমরা অচির রোগবীজের নাম করিতে পারি। এই অচির রোগ বীজ অর্থাৎ মায়াজম যাহার অর্থ উপবিষ, কলুষ পুতিবাষ্প প্রভৃতি। বাস্তবপক্ষে অচির রোগসমূহ সুপ্ত সোরার ক্ষণস্থায়ী উচ্ছাস মাত্র। যদি অচির রোগসমূহ অতীব ভীষণ প্রকৃতির না হয় এবং শীঘ্রই উহাদের দমন করা যায় তবে সত্বরই সোরা তাহার সুপ্ত অবস্থা পুনরায় প্রাপ্ত হয়। সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস ইহারা তিনটি উপবিষ। এই উপবিষ হইতে উদ্ভূত পীড়াকে চিররোগ বলা হয়। তাই ইহাও বলা যায় অচিররোগ বাস্তবিক পক্ষে সোরা তথা চিররোগের সাময়িক উচ্ছাস। এই উপবিষ হইতে উদ্ভুত পীড়াসমূহকে যদি অব্যাহত গতিতে চলিতে ও বিকাশ লাভের সুযোগ দেওয়া হয় এবং সুচিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিকারক ঔষধ ব্যবহৃত না হয় তাহা হইলে উহা ক্রমশঃ বাড়িতে থাকে এবং রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতি প্রাপ্ত হয়।
প্রশ্ন- প্রকৃত চিররোগ কাহাকে বলে?
উত্তর : স্থায়ী উপবিষ হইতে যে রোগের সৃষ্টি হয় তাহাকেই প্রকৃত চিররোগ বলে। প্রকৃত চিররোগ রোগীর অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে বর্ধিত হইয়া চিরজীবনই রোগীকে যন্ত্রণা প্রদান করে এবং পরিশেষে রোগীর প্রাণনাশ করিয়া থাকে। জীবনীশক্তি এই পীড়াকে বাধা দিয়া ব্যর্থ হয় এবং আমৃত্যু জীবনীশক্তি নিরাশভাবে রোগের প্রসারতা সহ্য করিয়া থাকে। মূলতঃ সোরা আদি রোগবীজ, প্রমেহবীজ ও উপদংশবীজ এই তিন প্রকার হইল চিররোগের মূল কারণ। ক্যানসার, উন্মত্ততা, অর্বুদ, হাঁপানি, সিফিলিস প্রভৃতি চিররোগের উদাহরণ।
প্রশ্ন- চিররোগের কারণ সমূহ কি কি?
উত্তর : সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস এই তিনটি উপবিষ চিরোরোপের প্রধান কারণ। এই তিনটি উপবিষ হইতে উদ্ভুত যাবতীয় পীড়াকেই চিররোগ বলা হয়। চিররোগের কারণ উল্লেখ করিতে গিয়া হ্যানিমান উহাকে ক্রনিক মায়াজম বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। প্রথম অচিররোগের ক্ষেত্রে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন, পরে চিররোগর ক্ষেত্রেও তিনি মায়াজম শব্দটি ব্যবহার করেন। মায়াজম বা দূষিত বাষ্প অশুভ প্রভাবের ফল। চিরকাল উহা দেহে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মূর্তিতে থাকে এবং ইহাকে আরোগ্য করিতে হইলে জীবনীশক্তি একার শক্তিতে সম্ভব হয়না, অন্য কোন পৃথক শক্তির দরকার হয়।
প্রশ্ন- মায়াজম কি?
উত্তর : তৎকালীন সময়ে হ্যানিমান অন্যকোন উপযুক্ত শব্দ না পাওয়ায় পীড়ার কারণকে মায়াজম বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। হ্যানিমানের মতে যাবতীয় রোগ মায়াজমের অশুভ প্রভাবে সৃষ্টি হয়। 'মায়াজম' শব্দের অর্থ হইল উপবিষ, কলুষ, পুতিবাস্প ম্যালেরিয়া বিষ প্রভৃতি। যাবতীয় রোগের কারণই হইল এই মায়াজম। ইহা প্রাকৃতিক রোগ সৃষ্টিকারী দানব।
প্রশ্ন- মায়াজম অর্জিত না বংশানুক্রমিক?
উত্তর : হ্যানিমানের মতে মায়াজম বা অশুভ প্রভাবের ফলে চিররোগ সৃষ্টি হয়। লক্ষ্যনীয় যে আদি রোগ সোরা মায়াজম আদিকাল হইতে মানব সমাজে বংশানুক্রমে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে। অপরদিকে দূষিত সঙ্গমের মাধ্যমে সাইকোসিস ও সিফিলিস মায়াজম অর্জিত হয়। এই দিক দিয়া চিন্তা করিলে মারাজনকে আমরা অর্জিত এবং বংশানুক্রমিক উভয়ই বলিতে পারি।
প্রশ্ন- চিররোগ সম্বন্ধে প্রাচীনপন্থীদের মতামত কি?
উত্তর : সাধারণভাবে মনে করা হয়, যে রোগে রোগী বহুদিন যাবত ভোগ করে তাহাকেই চিররোগ বলে। চির বা প্রাচীন বলিলেই মনে করা হয় অনেক দিনের রোগ এবং অল্প দিন ভুগিলে মনে করা হয় নূতন রোগ। প্রাচীনপন্থী ভিন্ন মতাবলম্বী। চিকিৎসকগণও পীড়ার ভোগকাল অনুসারে রোগের শ্রেণী বিভাগ করিয়া থাকেন। তাঁহারা সময় কালের ব্যবধানে পীড়াকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেন। (১) ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভোগ করা নতুন রোগ, (২) ছয় সপ্তাহের অধিক ভোগ করা রোগকে স্বল্প পুরাতন এবং (৩) তিনমাস, পাঁচমাস বা তাহারও অধিককাল ভোগ করা রোগ রোগকে প্রাচীন বা চিররোগ বলা হয় । রোগের কারণ সম্পর্কে প্রাচীনপন্থীদের ধারণা সীমিত বিধায় তাঁহারা রোগ ভোগের সময়কালের ব্যবধানে তরুণ ও প্রাচীন বলিয়া আখ্যায়িত করেন।
প্রশ্ন- সোরা বলিতে কি বুঝায়?
উত্তর : সোরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হইল খোসপাঁচড়া, চুলকানি ইত্যাদি চর্ম রোগ, স্ক্যাবিজ, সোরিয়াসিস, কুষ্ঠ ইত্যাদি এবং চর্মরোগের জীবাণু। ডাঃ রবার্টসের মতে সোরা, হিব্রু শব্দ tsorat হইতে উৎপন্ন হইয়াছে এবং পরবর্তী কালে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার মধ্য দিয়া রূপান্তরিত হইয়া psora হইয়াছে। Tsorat কথার অর্থ ক্ষত, দোষ, কলুষতা বা কলঙ্ক। হ্যানিনানের মতে সোরা হইল মানুষের আদি রোগ। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মারাত্মক মায়াজম ঘটিত চির ব্যাধি হইল সোরা। মনুষ্য সমাজে সোরা অসংখ্য রোগের, আকর এক সহস্রশীর্ষ দানব। চিররোগ সমূহের আটভাগের সাত ভাগের মূল কারণ হইল সোরা।
প্রশ্ন- সোরার উৎপত্তি কিভাবে হইয়াছে?
উত্তর : পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মায়াদমঘটিত চিররোগ হইল সোরা। হাজার হাজার বছর ধরিয়া কোটি কোটি মানুষের মধ্য দিয়া সংক্রামিত হইয়া সোরা বিভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া চলিতেছে। এই সোৱা মানবদেহের একটি অবস্থামাত্র। যতদিন মানুষ প্রাকৃতিক নির্দেশিত পথে সৎভাবে জীবনযাপন করিতেছিল, ততদিন সোরা দোষ ছিল না। যখনই মানুষ প্রকৃতি নির্দেশিত পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া কুমনন, কুচিন্তা ও কুকর্ম করিতে আরম্ভ করিল তখন হইতেই মানবসমাজে বিশৃংখলা শুরু হইল সম্পূর্ণ ও সুস্থ স্বাভাবিক মনে যখনই বিশৃংখলা, চঞ্চলতা, অপ্রয়োজনীয় কামনার উদয় হয়, তখনই রোগ সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সোরাবিষ মানব দেহে প্রবেশ করে। সংক্রমনের পর ধীরে ধীরে সমগ্র প্রাণসত্বাকে আছন্ন করে এবং আভ্যন্তরীণ সংক্রমণকার্য সম্পূর্ণ করে। সোরার বিষময় ফল অতি গভীর ও ব্যাপক। শুধু যে মানুষের দেহ কোষ ও মনকোষের উপর এক গভীর দাগ কাটে তা নয়, এক দুরূপণের কলংকের মত দেহীর সমগ্র সত্তার সঙ্গে মিশিয়া থাকে। ভ্রুণের মধ্য দিয়া এই কলংক পরবর্তী বংশধরে সংক্রমিত হয়। সোরার সঠিক উৎপত্তির তারিখ জানা যায় নাই। যুগ যুগ ধরিয়া এই সোরা মানবজাতিকে উৎপীড়ন দিয়াছে, বিকৃত করিয়াছে এবং বর্তমানে অবিশ্বাস্য অজস্র প্রকারের বিচিত্র চির ও অচির পীড়ার জনকরূপে ক্রিয়াশীল রহিয়াছে ।
প্রশ্ন- সুপ্ত সোরার লক্ষণাবলী কি কি?
উত্তর: মানবদেহে সোৱা দোষ সংক্রমনের তাহা সমগ্র প্রাণ সভায় ছড়াইয়া পড়ে। তারপর অনুকূল পরিস্থিতে পাইলে আত্মপ্রকাশ করে। সংক্রমনের ও আত্মপ্রকাশের মধ্যবর্তী অবস্থাকে সুপ্ত সোরা বলে।
(১) মানসিক লক্ষণ : সোরার রোগী মনের দিক হইতে সজাগ ও তৎপর। এরা দ্রুত কথা বলে, দ্রুত চলাফেরা করে, দ্রুত কাজ করে । কিন্তু সহজেই দেহ মন ক্লান্ত হইয়া পড়ে। সোরার অত্যন্ত মানসিক উৎকণ্ঠা থাকে, এই উৎকণ্ঠা প্রায় ভয়, আশংকা উদ্বেগ ও চাঞ্চল্যে পর্যবসিত হয়। অন্ধকারের ভয়, ভূতের ভয়, কাজে অসাকল্যের ভয়, মৃত্যুর ভয় প্রভৃতি। মেজাজ দ্রুত পরিবর্তনশীল হয়, সহসা রাগিয়া যায়। ইহার রোগীর বিমর্ষতা ও উৎসাহহীনতা দেখা দেয়। কোন বিষয়ে মনোনিবেশ করিতে অসমর্থ। মানসিক অস্থিরতায় ছটফট করে, নিদ্রা সুখকর হয় না।
(২) দৈহিক লক্ষণ : অস্বাভাবিক ক্ষুধা, আবার কখনো ক্ষুধাহীনতা। দ্রব্য বিশেষের প্রতি আগ্রহ বা অনীহা। মুখে স্বাদের বিকৃতি। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে অস্বাভাবিক কামোত্তেজনা। সহজেই ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা, প্রায়ই শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, রাত্রিকালে শীত ও বসন্তকালে উপসর্গের বৃদ্ধি ।
(৩) অস্বাস্থ্যকর চর্ম, সামান্য কাটিয়া গেলেও ঘা হয়, হাতের চামড়া ও ওষ্ঠ ফাটা, প্রায়ই ফোঁড়া ও আঙ্গুল হাঁড়া হওয়া, অসহ্য চুলকানি, চুলকানির পর জ্বালা, একদৈশিক মাথাব্যাথা, মাথা হইতে চুল উঠিয়া যাওয়া, চুলের শুষ্কতা প্রভৃতি সুপ্ত সোরার লক্ষণ।
প্রশ্ন- সোরার চারিত্রিক লক্ষণাবলী (বিকশিত সোরার লক্ষণ) লিখ।
উত্তর : বিকশিত সোরার বহু ব্যাপক লক্ষণ আছে। তন্মধ্যে, প্রধান প্রধান লক্ষণাবলী নিম্নে উল্লেখ করা গেল। সোরার আত্মমুখী লক্ষণই বেশী প্রকট। মনে হয় যেন জাতীয় অনুভূতি সোরার প্রধান পরিচায়ক লক্ষণ ।
(১) দৈহিক ও মানসিক কণ্ডুয়ন সোরার প্রধান লক্ষণ হইল চুলকানি বা কণ্ডুয়ন। সোরার উদ্ভেদে অসহ্য চুলকানি থাকে। চুলকাইলে প্রথমে বেশ আরাম লাগে, পরে জ্বালা শুরু হয়। সোরার উদ্ভেদে সাধারণতঃ পুঁজ হয় না, এক প্রকার দুর্গন্ধযুক্ত রস নির্গত হয়। এগুলি শুকাইয়া গেলে শুষ্ক আইশের মত উঠে। রোগীর মাথায় মরামাস ও শুষ্ক উদ্ভেদ হয়। দেহের সর্বত্র খোস, চুলকানি প্রভৃতি নানা প্রকার উদ্ভেদ নির্গত হয়। মানসিক কন্ডুয়নের জন্য অহেতুক মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কিছুতে মনে শান্তি পায় না, কোথাও স্থির থাকিতে পারে না । সেই জন্য সোরার রোগী সর্বদা চলাফেরা করে, কোন কিছুতে ঠেস দিয়া দাঁড়ায়। রোগীর সর্বদা ভয়, আশংকা, উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। একা থাকার ভয়, মৃত্যুভয় বিশেষ করিয়া হার্টফেল করিয়া মৃত্যুর ভয়।
২) নির্দিষ্ট সময় অন্তর রোগলক্ষণের পুনরাবর্তন সোরার এক বিশেষ লক্ষণ । ৩) সোরা নিজ দেহের কোন গঠনগত পরিবর্তন আনে না, কিন্তু যান্ত্রিক বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি করে।
৪) সোরার রোগী স্পর্শকাতর। আলো, গন্ধ, বর্ণ, শব্দ, গোলমাল প্রভৃতির প্রতি সোরা অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ।
(৫) সোরা শীত কাতর। শীতে রোগ বৃদ্ধি ও গরমে উপশন। সোরার প্রায় ঠান্ডা লাগে। সোরার মাথা ব্যাথায় এমন মারাত্মক শীতভাব যে তাহা আসল রোগ মাথা ব্যথা হইতে বেশী কষ্টকর মনে হয়। চুপচাপ হইয়া থাকার ইচ্ছা এবং তাহাতে উপশম বোধ সোরার বিশেষ পরিচায়ক লক্ষণ ।
(৬) সোরার হাতে পায়ে জ্বালা থাকে, মুখমন্ডলে তাপোচ্ছাস থাকে, গাত্রচর্ম শুষ্ক রুক্ষ ও অস্বাস্থ্যকর।
(৭) সোরার মস্তক আকারে ও আকৃতিতে স্বাভাবিক, চুল ও চাকচিক্য বিহীন। ঘাম বেশী হয়না। চুল না ভিজাইয়া আচঁড়ানো যায় না। অকালে চুল পাকে, অল্প পরিমিত স্থানে টাক পড়ে।
(৮) সোরার মাথাব্যাথা বিচিত্র। তীব্র, তীক্ষ্ণ মাথাব্যথা সকালে আরম্ভ হয়। বেলা বাড়ার সাথে বাড়িতে থাকে, সূর্যাস্তে কমিয়া থাকে। মাথার সম্মুখভাগের মাথাব্যথা বা পার্শ্বদেশের মাথাব্যথা সোরা সূচিত করে।
(৯) সোরা চোখের ক্রিয়ার বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি করে। দৃষ্টিভ্রম হয়। চোখের সামনে বিন্দু বিন্দু দেখা যায়। মুখমণ্ডল অনেকটা উল্টানো পিরামিডের মত। মুখ শুষ্ক, ব্রণ হয়, ঘাড়ের গ্রন্থি ফোলে।
(১০) সোরার কাশি শুষ্ক ও কষ্টদায়ক, দমকা। সোরার ক্ষুধা অদ্ভুত। অস্বাভাবিক ক্ষুধা। খাইলেও ক্ষুধা। খাদ্যে অরুচি। সোরা নরম খাদ্য পছন্দ করে। ভাজা অম্ল, মিষ্টি, গুরুপাক দ্রব্য, মাংস প্রভৃতি গুরুপাক দ্রব্য খাইতে চায় এবং তাহাতেই রোগের বৃদ্ধি ।
প্রশ্ন- সোরার কণ্ডুয়নের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
উত্তর : সোরার কণ্ডুয়নের প্রাকৃতিকে মানসিক ও দৈহিক এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। মানসিক কন্তুয়ন সোরার প্রথম ও অদৃশ্য মূর্তি এবং দৈহিক কণ্ডুয়ন সোরার বাহ্যিক মূর্তি। সর্বপ্রথমে নিয়ম লংঘন, অসৎ ও অন্যায় মনন, তাহার পরে অসৎ ও অন্যায় কল্পনা ও চেষ্টা বা কণ্ডুয়ন এবং সর্বশেষে এই মানসিক অবস্থা হইতে বাহ্য দেহে প্রতিবিম্বিত বা প্রতিফলিত অবস্থা অর্থাৎ দৈহিক কণ্ডুয়ন সোরার এই অসৎ চিন্তা ও অসৎ মনন এবং মানসিক ও বাহ্যিক কণ্ডুয়নের ফলে শরীরস্থ ধাতু দূষিত হওয়ায় মানসিক ও বাহ্যিকভাবে আমাদের দেহে রোগপ্রবণতা আসে। ইহাই সোরার কণ্ডুয়নের প্রকৃতি ।
প্রশ্ন- সোরা বা খোস পাঁচড়ার মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর : সোরা দোষ বলিলে ইহার অর্থ অনেকেই বুঝিতে পারে না। তাহারা মনে করে সোরা অর্থ খোস পাঁচড়া বা কোন চর্মপীড়া। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাহা নয় । সোরা চর্মপীড়ার কারণ। সোরা দোষের প্রকাশ ঘটে খোস পাঁচড়ার মাধ্যমে। কাহারও শরীরে খোস পাঁচড়া থাকিলে মনে করিতে হইবে যে তাহার সোরা দোষ আছে। যাহার সোরা দোষ না নাই তাহার খোস পাঁচড়া হইতে পারে না। কাজেই সোরা বলিতে খোস পাঁচড়া মনে করা ভুল।
প্রশ্ন- সোরা সকল প্রকৃত চিররোগের কারণ ব্যাখ্যা কর।
বা, সিফিলিটিক ও সাইকোটিক রোগ ব্যতীত সকল প্রকৃত চিররোগের জননী সোরা-ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : সিফিলিস ও সাইকোসিস উভয়েই যৌনব্যাধি। যৌনব্যাধি ছাড়াও বিচিত্র ও বিভিন্ন লক্ষণ সমন্বিত অযৌন ব্যাধিসমূহ চির বা অচির ব্যাধিরূপে মানবজাতিকে বিশেষ পীড়া দেয়। সুদীর্ঘ গবেষণার পর হ্যানিমান এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিলেন যে, সমস্ত রকম অযৌন প্রাকৃতিক চিররোগসমূহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং একই আদিমূল হইতে ইহাদের উৎপত্তি। এই আদি কারণকে হ্যানিমান সোরিক মায়াজম এবং ইহা হইতে উৎপন্ন যাবতীয় পাঁড়াকে তিনি সাধারণভাবে সোরা বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মনুষ্যকৃত যত কিছু অঘটন এবং মানসিক ও দৈহিক অন্যায় সংঘটিত হইয়াছে তাহার মূল কারণ এই সোৱা দোষ। অতএব সোরাই একমাত্র আদি রোগ প্রসবিনী সকল রোগের জননী । হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্য দিয়া সংক্রামিত হইয়া সোরা বিভিন্নরূপে আত্ম প্রকাশ করিয়া চলিয়াছে। যুগ যুগ ধরিয়া এই সোরা মা জাতিকে উৎপীড়ন করিয়াছে, বিকৃতি জন্মাইয়াছে এবং বর্তমানে অবিশ্বাস্য রকমের অজস্র প্রকার বিচিত্র চির ও অচির পীড়ার জনকরূপে ক্রিয়াশীল রহিয়াছে। মনুষ্য সমাজে সোরা অসংখ্য রোগের আকর এক সহস্র শীর্ষ দানব। চিররোগ সমূহের আট ভাগের সাতভাগেরই মূল কারণ সোরা, বাকি এক ভাগ সিফিলিস ও সাইকোসিস ৷ এমন কি সিফিলিস ও সাইকোসিস নামক এই দুইটি চিররোগবীজেরও উৎপত্তি সোরা হইতে। সোরা। থাকিলে কোন রোগই থাকিত না। সাধারণ প্রকারের চর্মপীড়ারূপে ইহার আবির্ভাব হওয়ার ফলে ব্যাপক আকারে অন্য মানুষের মধ্যে এইগুলি সংক্রমনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। উপদংশ ও প্রমেহ বিষের সংশ্রবে না আসিলে সংক্রমনের বিশেষ ভয় থাকে না, কিন্তু কোন প্রকারে একবার স্পর্শমাত্রই এই আদি রোগবীজ ইহার সংক্রমণন কার্য সম্পন্ন করে। আদি রোগবীজ সোরা খোসপাঁচড়ার স্ফোটক দ্বারা অংকুরিত হয়। কুচিকিৎসা দ্বারা চাপা দিলে রোগ অন্তর্মুখী হয় এবং বিপত্তির সূচনা ঘটে। সোরার কাজ ধ্বংসাত্মক, প্রাণসত্তাকে সোরা নিষ্ঠুরভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে। দেহকে বিকৃত করে, মনকে আশংকায় পূর্ণ করে, বৃদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্প্রভ করে। সোরার বিষময় ফল শুধু যে মানুষের দেহকোষ ও মনকোষের উপর এক গভীর দাগ কাটে তা নয় এক দূরপনেয় কলঙ্কের মত দেহীর সমগ্র সত্তার সঙ্গে মিলিয়া থাকে। ভ্রূণের মধ্য দিয়া এই কলঙ্ক পরবর্তী বংশধরে সংক্রামিত হয়। আজকাল যে অসংখ্য প্রকার বিচিত্র কঠিন ব্যাধিসমূহ দেখা দেয় তাহার মূল সোরা। উন্মত্ততা, হিষ্টিরিয়া, বিষণ্নতা, বুদ্ধিবৃত্তির জড়তা, মৃগী, তড়কা, ব্রঙ্কাইটিস, মেরু দত্ত সংক্রান্ত রোগ, অস্থির ক্ষত, ক্যানসার, গেঁটেবাত, পক্ষাঘাত, অর্শ, পাকস্থলীর পীড়া, হাঁপানী, রজঃরোধ, বধিরতা আধকপালে মাথাব্যথা, ছানি, অন্ধত্ব, ইন্দ্রিয়াদির অকর্মণ্যতা, ধ্বজভঙ্গ, বন্ধাত্ব, শোথ ন্যাবা, যক্ষ্মা, নীলরোগ, নানা প্রকার চর্মরোগ, সহস্রপ্রকার মাথাবেদনা প্রভৃতি রোগের মূল কারণ হইল সোরা। শত শত বংশ পরম্পরায় লক্ষ লক্ষ মানব দেহের মণ্য দিয়া সঞ্চালিত হইয়া প্রাচীনতম এই সংক্রামক ব্যাধি নিত্যনূতন রূপ পরিগ্রহ করিয়া উপস্থিত হয়। এই গুলিকে স্বতন্ত্র রোগ বলিলে ভুল হইবে। এই সমস্ত পীড়া একই মূল রোগের বিভিন্ন অভিব্যক্তি ।
সোরা ব্যতীত যে উপদংশ ও প্রমেহও হইতে পারে না সে সম্বন্ধে বলা যায় যে আভ্যন্তরীক আদি রোগবীজ পোষণ না করিলে মানুষ কখনও এইরূপ আত্মমর্যাদা বিস্মৃত হইয়া উপদংশ, প্রমেহ প্রভৃতি কুৎসিত রোগের উৎপত্তিস্থল গণিকা নিকেতনে প্রবেশ করিতে পারে না। আদি রোগবীজই ভয়ংকর অভ্যন্তরীন আক্রমনে লোকের মানসিক সাত্ত্বিক ভাব নষ্ট করে। তাহারই ফলে মানব নীচ প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়া নানাভাবে নিজের ও পরের অহিতকর কার্যে লিপ্ত ও রোগগ্রস্ত হইয়া পাপের ফল ভোগ করে। তাই বলা যায় নোরাই একমাত্র আদি রোগ প্রসবিনী সকল রোগের
প্রশ্ন- সোরার এবার্থ পরিচয় লাভ করা সহজতর নয় কেন?
উত্তর : পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মারাত্মক মায়াজম ঘটিত চির ব্যাধি হইল সোরা। হাজার হাজার বছর দিয়া কোটি কোটি মানুষের মধ্য দিয়া সংক্রমিত হইয়া সোরা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া চলিতেছে। যুগযুগ ধরিয়া এই সোৱা মানব জাতিকে উৎপীড়ন দিয়াছে, বিকৃত করিয়াছে এবং বর্তমানে অবিশ্বাস্য রকমের অজস্র প্রকারের বিচিত্র চির চির পীড়ার জনকরূপে ক্রিয়াশীল রহিয়াছে। যথার্থ সোরা পরিচয় লাভ করা দুরুহ। সোরা মানুষের মনোজগতে নিরাপদে অবস্থান করে, কেউ তাহার নাগাল পায় না। মনোজগতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করিয়া, নানা প্রকার অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করে সোরা। যাবতীয় আত্মমুখী লক্ষণ, বিশেষ করিয়া মনে হয় যেন' এইরূপ অনুভূতিসমূহের উৎসও হইল সোরা। সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে যখনই বিশৃংখলা, চঞ্চলতা অপ্রয়োজনীয় কামনার উদয় হয় তখনই রোগ সংক্রমনের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং নোরা বিষ মানবদেহে প্রবেশ করে। সংক্রমনের পর সোরা বিষ মানবদেহে ধীরে ধীরে সমগ্র প্রাণসত্তাকে আছন্ন করে এবং আভ্যন্তরীণ সংক্রমণের কার্য সম্পূর্ণ করে। ইহাই সোরার সুপ্তাবস্থা। সোরার বিষময় ফল অতি গভীর ও ব্যাপক। শুধু যে মানুষের দেহকোষের ও মনোকোষের উপর এক গভীর দাগ কাটে তাহা নয়, এক দুরপনের কলংকের মত দেহীর সমগ্র সত্তার সঙ্গে মিশিয়া থাকে। বংশগত বৈচিত্রের সঙ্গে এই ব্যাধি বিষ বংশ পরম্পরায় চলিতে থাকে। তাই অতি সহজেই এই সোরাকে চিনা যায়। কোন অনুকূল মূহুর্তে বাহ্যিক লক্ষণের মাধ্যমে সোরা আত্মপ্রকাশ করে।
প্রশ্ন- সাইকোসিস বলিতে কি বুঝায়?
উত্তর : কুচিকিৎসায় গনোরিয়া স্রাব প্রচাপিত হইলে সাইকোসিসের সৃষ্টি হয়। ইহা একটি যৌন রোগ। কুকার্যের ফলশ্রুতি হিসাবে ইহার প্রথম উদ্ভব। সঙ্গমেন্দ্রিয়ের চারিপাশে ডুমুর বা ফুলকপির ন্যায় উপমাংস বা আঁচিল প্ৰকাশ পাওয়াই সাইকোসিসের প্রধান লক্ষণ। মূত্রনালীতে প্রদাহ ও প্রস্রাবে জ্বালা হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে লিঙ্গাগ্রে এবং স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে যোনীর উপর ও তাহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই সকল উদ্ভেদ দেখা দেয়। সাইকোসিস শরীরের অস্ত্র ও সন্ধিপথে প্রভাব বিস্তার করে বলিয়া তাহা মূত্রনালী, শ্বাসনালী, বৃহদন্ত্র, সরলার ও সন্ধিস্থলে স্বাভাবিক ক্রিয়ার বাধাদান করে। ফলে গেটেবাত, প্রস্রাবে কষ্ট, হাঁপানি প্রভৃতি নানাবিধ নিদারুন যন্ত্রনাদায়ক উপসর্গে রোগীর প্রানান্ত হইবার উপক্রম হয়। ডুমুরাকৃতি অর্বুদ সাইকোসিসের প্রধান নিদর্শণ এবং ইহা মুখগহবর, জিহবা, তালু, ওষ্ঠ প্রভৃতিতে সাদা বর্ণের ছিত্রাল, স্পর্শকাতর সামান্য উঁচু সমতল উপবৃদ্ধি এবং বগল, ঘাড়, মস্তক প্রভৃতি স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডুমুরাকৃতি অর্বুদ বা আঁচিল দেখা দেয়।
প্রশ্ন :- সাইকোসিসের বিশেষত্ব বা সাইকোসিসের চারিত্রিক লক্ষণ বর্ণনা কার।
উত্তর : কোনও দেহে সাইকোসিস দোষ দুষ্ট হইলে ঐ দেহে যে সোরাদোষ বিদ্যমান তাহা অবশ্যই মনে রাখিতে হইবে। নিম্নে সাইরকাসিসের লক্ষণসমূহ বর্ণিত হইল।
১) মানসিক লক্ষণ মনোস্তরে সাইকোসিসের ক্রিয়া অত্যন্ত মারাত্মক। রোগী হিংসুক, সন্দিগ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ খিটখিটে ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। কাহাকেও বিশ্বাস করে না। সব কিছুই গোপন রাখা প্রবৃত্তি, কোন বিষয়ে বন্ধুমুল ধারণা। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা! আত্মীয় স্বজনের নাম, লোকের নাম ঠিকানা মনে রাখিতে পারে না।
২) দৈহিক লক্ষণ : সাইকোসিসের রোগী হয় গরম নতুবা ঠান্ডা খাদ্য পছন্দ করে। সাধারণতঃ গরম খাদ্যই পছন্দ। মাংস ভক্ষণে রোগ লক্ষণের বৃদ্ধি । বননেন্দ্রিয় ও বস্তিপ্রদেশের উপর ইহার ক্রিয়া বেশী তাই সেখানকার টিসুতে প্রদাহ না, বাত হয় ও ক্ষত ভাব থাকে। অন্ডকোষের প্রদাহ, প্রষ্টেট গ্লান্ড, জরায়ু ও বিশ্বকোষের পীড়ার মূলে সাইকোটিক বিষ থাকে। সাধারণতঃ সাইকোসিসে সিফিলিসের মত ক্ষত থাকে না। তবে প্রাব থাকে। সেই স্রাব ঝাঁঝাল, হাজাকারক এবং একরকম আসটে গন্ধযুক্ত ।
৩) সার্বদৈহিক লক্ষণ : সাইকোসিসের সমস্ত উপসর্গ বিশ্রামে, ঠান্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ার বৃদ্ধি। নড়াচড়ায় উপশম। সাইকোসিসে প্রচন্ড বেদনা থাকে, ফাটিয়া যাওয়া বা ছিঁড়িয়া যাওয়ার ন্যায় বেদনা। যন্ত্রনায় ছটফট করে, এপাশ ওপাশ করে।
৪) সাইকোসিসের প্রধান পরিচায়ক লক্ষণ হইল দেহকলার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি । ফলে আঁচিল অর্বুদ অর্শ ইত্যাদি দেখা দেয়। চর্মের উপর পুরু প্রলেপ পড়ে, নাভি বড় হয়। নখপুরু হয় । তাহাতে ভাঁজ ও খাঁজ থাকে।
৫) দেহের বিভিন্ন অঙ্গে বাত দেখা দেয়।
৬) দেহের আভ্যন্তরীণ যন্ত্রসমূহ যেমন হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, কিডনী, লিভার, প্রভৃতি আক্রান্ত হয়।
৭) সাইকোসিসের দেহে অতিরিক্ত চুল থাকে। ছোট বৃত্তাকার স্থান হইতে চুল উঠিয়া যায়। মাথা ঘামে, তবে সিফিলিসের ন্যায় ঘামে চুলে জট পাকেনা ।
৮) মাথার শীর্ষদেশে বা অগ্রভাগে বেদনা। শুইয়া থাকিলে শিরঃপীড়ার বৃদ্ধি । রাত্রিকালে শিরঃপীড়ার লক্ষণ অনেকটা সিফিলিসের ন্যায় ।
৯) দেহের বিভিন্ন অংগে তীব্র বেদনা। সমস্ত বেদনা বিশেষ করিয়া উদবের বেদনা কলিক ও আপেক্ষিক প্রকৃতির খাদ্যদ্রব্য গ্রহণে বেদনা বাড়ে। উপুড় হইয়া শুইলে, সামনের দিকে ঝুঁকিলে ও চাপে বেদনার উপশম ।
প্রশ্ন- সিফিলিস কি? বা, সিফিলিস দোষ কাহাকে বলে?
উত্তর : সোরার অনেক পরে সিফিলিসের আবির্ভাব, তাই মানসিক স্তর হইতে দৈহিক স্তরে ইহার ক্রিয়া বেশী। সিফিলিস একটি যৌন চিররোগ। উপদংশ রোগ চাপা দিলে সিফিলিন বিষের সৃষ্টি হয়। উপদংশিক ক্ষতরূপে ইহা প্রকাশ করে। দুষ্ট লোক সহ সঙ্গম দ্বারা চর্মের কোন পাতলা অংশে বিষ-সংস্পর্শ হেতু সিফিলিস সুস্থ দেহে সংক্রমিত হয়।
প্রশ্ন- সিফিলিসের বিশেষত্ত্ব বা সিফিলিসের পরিচায়ক লক্ষণ বা প্রধান নিদর্শন বর্ণনা কর।
উত্তর : ১) মানসিক লক্ষণ : সিফিলিসের মনের অবস্থা শোচনীয়, মর্নের ক্রিয়ার জড়ত্ব। বুদ্ধিবৃত্তি নিষ্প্রভ, রোগী নির্বোধ, বিমর্ষ ও সন্দিগ্ধ চিত্ত। একা থাকিতে চায়। জীবনের প্রতি ঘৃণা। আত্মহত্যার ইচ্ছা, নিজের দুঃখ কারো কাছে ব্যক্ত করেনা। কথার মাঝে খেই হারাইয়া ফেলে।
২) দৈহিক লক্ষণ ঃ এই সকল রোগীর মাথা বৃহৎ আকারের, শিশুদের ব্রহ্মরন্ধ্রে অনেকটা ফাঁক থাকে। সিফিলিসের চুল সিজ, তৈলাক্ত ও আঠাশ, মাথা হইতে থোকা থোকা চুল পড়ে। টাক মাথার ঘামে চুল ভিজিয়া যায়। নাখায় মামড়ি পড়ে। সিফিলিস শীতল খাদ্য চায়। গরম খাদ্য পছন্দ করে না।
৩) সার্বদৈহিক লক্ষণ : সমস্ত রোগ লক্ষণ রাত্রিতে বৃদ্ধি। সিফিলিস রোগীর নিকট রাত্রি ভয়াবহ, কষ্টকর, উৎপীড়ক, উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ। বিছানায় ছটফট করে। মল মূত্র, প্রভৃতি স্বাভাবিক স্রাবে উপসর্গের বৃদ্ধি কিন্তু ব্যাধিগত স্রাবে উপশম ।
৪) ক্ষত লক্ষণ : ক্ষত অগভীর নানা প্রকারের ক্ষত, কার্বংকল, দুষ্টফোঁড়া, বাগী, অস্থিক্ষয়, দন্তক্ষয় চক্ষুর স্বচ্ছত্বকে ঘা, নাসিকা ও জিহ্বায় ঘা প্রভৃতি। যৌনাঙ্গে ফুস্কুড়ির মত উদ্ভেদের ও ক্ষতের আবির্ভাব সিফিলিস লক্ষণের প্রথম পর্যায় ।
৫) বিকৃতি : দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ও স্বাদ শক্তির বিকৃতি। অস্থি, দাঁত ইত্যাদির বিকৃতি ও ক্ষয়, নখ কাগজের মত পাতলা ও ভঙ্গুর হয়। দেহের হাঁড়ের কাঠামোর পরিবর্তন হয়।
৬) দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব : সিফিলিসের সকল স্রাব দুর্গন্ধযুক্ত। অতিরিক্ত দুর্গন্ধযুক্ত ধর্ম। সিফিলিসের ক্ষত হইতে দুর্গন্ধযুক্ত পূঁজ নির্গত হয় ।
৭) উভেদ ফোস্কার ন্যায়, তাম্রবর্ণের বা বাদামীবর্ণের উদ্ভেদে চুলকানী থাকেনা। পূঁজ হয়, ঘা হয়। ৮) ইহার শিরঃপীড়া রাত্রে আসে, মাথার পিছন দিকে ব্যাথা শুরু হয়। এক পার্শ্বের মাথাব্যথা, মাথাব্যথার সঙ্গে দেনের শীতলতা।
প্রশ্ন- সিফিলিস উপবিষ ও সিফিলিস রোগের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর : সাধারণ মানুষের নিকট উপদংশ বা সিফিলিস যেভাবে পরিচিত, হ্যানিমানের আবিষ্কৃত সিফিলিস দোষ তাহা নয়। সিফিলিস রোগটি মানুষের কুকার্যের ফল। দুষিত সংগমের মাধ্যমে এই কুৎসিত রোগ সৃষ্টি হয়। ইহাতে লিঙ্গের মুখে ও বাহিরে প্রদাহ ও ক্ষত হয়। কোন ব্যক্তির সিফিলিস ক্ষত হওয়া মাত্র তথাকথিত চিকিৎসার নামে ইনজেকশান দ্বারা প্রচাপিত করিলে সিফিলিস নামক উপবিষের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ইহা শরীর যন্ত্রের অবস্থা বিকৃত করিয়া ফেলে এবং মানুষকে অনেকগুলি রোগের অধীন করে। প্রকৃত পক্ষে সিফিলিস দোষ ও সিফিলিস রোগ ভিন্ন জিনিষ।
প্রশ্ন- বিসদৃশ নীতিতে আরোগ্য সাধন হয় কি?
বা, অসমলক্ষণ সম্পন্ন রোগ বা ঔষধ অধিকতর শক্তি সম্পন্ন হইলেও কোন রোগকে আরোগ্য করিতে পারে না কেন, বুঝাইয়া দাও ।
উত্তর : হ্যানিমানের মতে যদি কোন ঔষধ রোগের সদৃশতম লক্ষণসমষ্টি উৎপাদন করিতে পারে এবং রোগের শক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী হয় তবেই তাহা রোগ দূর করিতে পারে। ইহার সমর্থনে তিনি বলেন যে, অসমলক্ষণে কিছুতেই রোগ আরোগ্য হয় না। অসমলক্ষণে তিন প্রকারের অবস্থা সৃষ্টি হইতে পারে।
১) যদি একই মানবশরীরে দুইটি বিসদৃশ প্রাকৃতিক রোগ উপস্থিত হয় এবং যদি প্রথম, রোগটি দ্বিতীয়টি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী বা সমানও হয় তবে বিসদৃশ লক্ষণসম্পন্ন নবাগত পীড়াটি শরীরে প্রবেশই করিতে পারে না। এই ক্ষেত্রে বিসদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় কোন উপকারই হয় না। ২) প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রথম রোগটি যদি দ্বিতীয়টি অপেক্ষা দুর্বলতর হয়, তবে দ্বিতীয়টি যতক্ষন থাকে, প্রথমটিকে দমন করিয়া স্থগিত রাখে মাত্র, আরোগ্য করিতে পারে না।
৩) প্রাকৃতিক অবস্থায় বিসদৃশ লক্ষণবিশিষ্ট হইলে, দ্বিতীয় রোগটি কোন দিন শরীরে থাকিয়া প্রথমটির সহিত রোগী দেহের আপন আপন প্রিয় অংশে নিজ নিজ লক্ষণ প্রকাশ করিতে থাকে। কেহই কাহাকে নিরাময় করিতে পারে না। যদি বহুদিন বিসদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট তীব্র ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয় তবে ঔষধজ কৃত্রিম রোগ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক রোগের সহিত যোগ হইয়া নূতন নূতন লক্ষণ উৎপাদন করে। তাই বিসদৃশ চিকিৎসায় রোগ নিরাময় হয় না বরং রোগী নানারূপ অজ্ঞাত জটিল পীড়ায় আক্রান্ত হইয়া পড়ে।
সমাপ্ত
1 মন্তব্যসমূহ
nice post!!!
উত্তরমুছুন