লক্ষণ হোমিওপ্যাথি গুরুত্ব - ৬ষ্ঠ অধ্যায় - ১ম বর্ষ

 ৬ষ্ঠ অধ্যায়
লক্ষণ এবং হোমিওপ্যাথিতে ইহার গুরুত্ব 
(Symptoms and its importance in Homoeopathy)




প্রশ্ন- লক্ষণ বলিতে কি বুঝায়?

উত্তর : লক্ষণ স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অবস্থার বিকৃত পরিবর্তন বা পীড়ার অস্তিত্বের প্রমাণ। ইহা এমন একটি অবস্থা যাহা রোগী স্বয়ং তাহার নিকটআত্মীয় পার্শ্ববর্তী লোকজন এবং চিকিৎসক প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। লক্ষণ শুধুমাত্র রুগ্নাবস্থার বহিঃপ্রকাশ বা রোগের নিদর্শনই নয়, প্রতিকারক সদৃশ ঔষধ নির্বাচনেরও চাবিকাঠি।




প্রশ্ন-  লক্ষণের শ্রেণী বিভাগ কর।
বা, লক্ষণ কত প্রকার ও কি কি?
বা, ব্যক্তিনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর : লক্ষণসমূহের বৈশিষ্টের উপর ভিত্তি করিয়া লক্ষণসমূহকে দুইটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায় যথা :
১) ব্যক্তিনিষ্ঠ বা আত্মমুখী লক্ষণ (Subjective Symptoms)
২) বস্তুনিষ্ঠ বা বিষয়মুখী লক্ষণ (Objective Symptoms)
(১) ব্যক্তিনিষ্ঠ লক্ষণ : যে লক্ষণগুলি রোগী নিজে শুধু উপলব্ধি করিতে পারেন, অন্য কেহ সেগুলি দেখিতে বা বুঝিতে পারে না সেগুলি ব্যক্তিনিষ্ঠ লক্ষণ বলে। যেমন-ব্যথাবেদনা, কষ্ট, পিপাসা, ক্ষুধা, উদরশূণ্যতা বোধ, মাথা বড় বোধ অনুভূতি প্রভৃতি। এই ধরনের লক্ষণ রোগ সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে আবির্ভূত হয় বলিয়া এইগুলি রোগীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের প্রারম্ভিক বিচ্যুতি প্রকাশ করে। সেইজন্য এই ধরনের লক্ষণগুলি রোগের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের ইংগিত বহন করে। রোগ সংক্রমনে ব্যক্তি মানুষের আস্তর প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করিয়া তাহার মানসিক ও ভাবাবেগের ক্ষেত্রের পরিবর্তিত অবস্থা এই লক্ষণগুলির মাধ্যমে পরিস্ফুট হইয়া উঠে। এই ধরনের লক্ষণ ছাড়া আস্তর প্রকৃতির অবস্থা জানার আমাদের আর কোন বিশ্বস্ত উপায় নাই। এইগুলির মাধ্যমে রোগীর ও রোগের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় বলিয়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় এই ধরনের লক্ষণের গুরুত্ব অনেক বেশী।
২) বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ : যে লক্ষণগুলি রোগী, চিকিৎসক বা অন্যান্য লোকজন দেখিতে ও বুঝিতে পারেন এবং যেগুলি চিকিৎসক রোগীকে ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষা করিয়া বুঝিতে পারেন সেগুলিকে বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ বলে। এইগুলিকে অনেক সময় রোগের চিহ্ন হলে বা আভ্যন্তরীন রোগের বাহ্যিক প্রকাশ। এই লক্ষণগুলি দেহকান্ডের সেই দিকেই প্রকাশিত হয় যেদিক সহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অর্থাৎ যাহা চিকিৎসক ও রোগীর আত্মীয় পরিজনেরা তাহাদের চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সহজেই বুঝিতে পারেন। যেমন- প্রদাহিত স্থান স্ফীত ও আরক্তিম হওয়া বা পূঁজ উৎপন্ন হওয়া, জ্বর, প্রলাপ, ক্ষত, চোখ রক্ত বর্ণ হওয়া, আচিল প্রভৃতি।
বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণগুলি দেহের আক্রান্ত অংশের এবং রোগের গভীরতা সম্বন্ধে বিশেষ পরিচয় প্রদান করে। ঔষধ প্রুডিং এর সময় প্রভার বা প্রাকৃতিক রোগে রোগীদের লক্ষণের পরবর্তী বিকাশের সময় এইগুলি দেখা যায়। এই লক্ষণগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যসূচক ঔষধ বা রোগীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে না। রোগ নির্ণয় ও রোগের প্রচলিত নামকরণের জন্য ইহাদের প্রয়োজন অপেক্ষাকৃত বেশী।




প্রশ্ন- পরিচায়ক লক্ষণ বা চরিত্রগত বলিতে কি বুঝায়?
উত্তর : চিকিৎসার জন্য আমাদের সেই ধরনের লক্ষণ সমূহেরই প্রয়োজন যেগুলি রোগের এক পূর্ণ প্রতিকৃতি আমাদের নিকট তুলিয়া ধরে। এই ধরনের লক্ষণকে রোগের পরিচায়ক লক্ষণ বলে। পরিচারক লক্ষণ বলিতে আমরা সেই সব লক্ষণ বুঝি, যেগুলি রোগের ও রোগীর বিশিষ্টতা গুলিকে অন্য রোগ ও রোগী হইতে অনন্য করিয়া তোলে। রোগীকে ব্যক্তিগত পরীক্ষার দ্বারা যে সমস্ত লক্ষণ সংগ্রহ করা যায় তন্মধ্যে যেগুলি অদ্ভূত, অসাধারণ, দৃষ্টি আকর্ষক, পার্থক্যসূচক বা বিরল প্রকৃতির সেই লক্ষণগুলিই এই শ্রেণীভূক্ত। কেন্ট বলেন- রোগের যে সমস্ত লক্ষণ সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না সেগুলি সমস্তই পরিচায়ক লক্ষণ। যেমন- উদ্ভেদ বিহীন হাম, প্রবল জ্বরে পিপাসাহীনতা, জিহ্বার শুদ্ধতা সত্ত্বেও জলপানে অনিচ্ছা, দেহে তীব্র জ্বালাবোধ থাকা সত্ত্বেও গাত্রাবরণ চাওয়া, উত্তাপে জ্বালাবোধের উপশম হওয়া প্রভৃতি । চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ধরনের লক্ষণের গুরুত্ব সমধিক।




প্রশ্ন- ব্যাপক লক্ষণ বা সর্বাঙ্গীণ লক্ষণ কাহাকে বলে?
উত্তর : যে লক্ষণগুলি রোগীর সম্বন্ধে সর্বতোভাবে প্রযোজ্য এবং যেগুলি বর্ণনা কালে রোগী 'আমি' এই শব্দটি ব্যবহার করেন সেগুলিকে ব্যাপক লক্ষণ বলে। যেমন-আমি দুর্বল, আমি বাঁচিব না, আমার মাথাটা যেন বড় হইয়া যাইতেছে। প্রভৃতি। রোগীর ব্যক্তিমানুষের পরিচয় তুলিয়া ধরে বলিয়া চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ধরনের লক্ষণের গুরুত্ব সর্বাধিক।




প্রশ্ন-  স্থানিক লক্ষণ বা আঙ্গিক লক্ষণ কাহাকে বলে?
 
উত্তর ঃ যে লক্ষণের দ্বারা ঔষধের বা রোগীর কোন একটি বা একাধিক অঙ্গের বা অংশের সংশিষ্ট লক্ষণকে বুঝায় কিন্তু সামগ্রিক ব্যক্তি সত্তাকে বুঝায় না সেগুলিকে স্থানিক বা আঙ্গিক লক্ষণ বলে। যেমন-জিহ্বার লাল ত্রিকোণ, ওষ্ঠ, কান, নাক ইত্যাদি রক্তের মত লালবর্ণ, উদ্ভেদ বিহীন চুলকানি প্রভৃতি। সকল সর্বাঙ্গীণ ও আঙ্গিক লক্ষণকে গুরুত্ব অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।  




প্রশ্ন- অসাধারণ লক্ষণ কাহাকে বলে?
উত্তর : যে সব লক্ষণ রোগের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অপেক্ষা ব্যতিক্রমধর্মী বা যাহা অদ্ভূত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসূচক, সুস্পষ্ট, যেখানে একটিমাত্র লক্ষণ একটিমাত্র ঔষধকে নির্দেশ করে এই জাতীয় লক্ষণকে অসাধারণ লক্ষণ বলে। যেমন-জলপানের ইচ্ছাসহ পিপাসাহীনতা (আর্স, ক্যালাডি), বুক ধড়-ফড়ানিতে তাড়াতাড়ি হাঁটিলে উপশম (আর্জ নাইট) প্রভৃতি।




প্রশ্ন-  সাধারণ লক্ষণ কাহাকে বলে?
উত্তর : যে সকল লক্ষণ প্রায় সকল ঔষধে দেখা যায় বা কোন নির্দিষ্ট রোগের সকল রোগীর মধ্যে দেখা যায়, যাহা অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও বৈশিষ্ট্যহীন সে সকল লক্ষণকে সাধারণ লক্ষণ বলে। যেমন- রক্ত আমাশয়, আঁচিল, শিরঃপীড়া প্রভৃতি।




প্রশ্ন-  আনুষঙ্গিক বা সহযোগী লক্ষণ কাহাকে বলে?
উত্তর : যে লক্ষণগুলিকে আপাত দৃষ্টিতে মূলরোগের সঙ্গে সামঞ্জসাবিহীন বলিয়া মনে হয়, কিন্তু যেগুলি রোগের মূল লক্ষণের সঙ্গে উপস্থিত ও অন্তর্হিত হয় সেগুলিকে আনুষঙ্গিক বা সহযোগী লক্ষণ বলে। এই সকল লক্ষণ সাধারণতঃ মূলরোগের সঙ্গে দেখা যায় না, মূল রোগের প্রকাশ স্থান ভিন্ন দেহের অন্যস্থানে ইহাদেরকে দেখা যায়। এই সকল লক্ষণের মাধ্যমে রোগীর ও ঔষধের প্রকৃতির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া সহজ হয় বলিয়া চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই সব লক্ষণের গুরুত্ব অনেক বেশী । এই লক্ষণগুলিই অন্যান্য লক্ষণ হইতে রোগীর পার্থক্য আপন করে।




প্রশ্ন- অতিরিক্ত লক্ষণ কাহাকে বলে?
উত্তর : ঔষধ প্রয়োগ করার পর যদি রোগীতে এমন কিছু লক্ষণ পাওয়া যায় যেগুলি পূর্বে রোগীতে ছিল না অথচ ঐগুলি ঔষধেরই লক্ষণ (কেননা সুস্থ শরীরে ঔষধ পরীক্ষার সময় ঐ ঔষধে ঐরূপ লক্ষণ পাওয়া গিয়াছে) তবে সেই সকল লক্ষণকে অতিরিক্ত লক্ষণ বলে। রোগ লক্ষণের স্বল্পতাহেতু সম্পূর্ণ সাদৃশ্যযুক্ত ঔষধ যখন নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তখন অধিক সাদৃশ্যযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়। ফলে ঔষধের কিছু লক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়ে।



প্রশ্ন- আকস্মিক লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর : অনেক সময় রোগীতে এমন কিছু লক্ষণ পাওয়া যায় যেগুলির সহিত মূল পীড়ার কোন সংগতি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। এগুলি সাধারণতঃ রোগীর আহারজনিত হইয়া থাকে। অনেক সময় ঔষধের বিশুদ্ধতার অভাবেও এইসব লক্ষণ দেখা দেয়। ঔষধ গ্রহণের পর রোগী যদি অন্য কোন প্রকার ঔষধ বা উত্তেজক দ্রব্য সেবন করে তখনও এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই সকল লক্ষণকে আকস্মিক লক্ষণ বলা হয়।



প্রশ্ন-  প্যাথলজিক্যাল বা নিদানগত লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর ঃ দেহ যন্ত্রের ক্রিয়া ধারায় বিশৃংঙ্খলার দরুন দেহাঙ্গের কাঠামোগত পরিবর্তন, অনুভূতির পরিবর্তন প্রভৃতি দেখা যায়। এইগুলিকে নিদানগত লক্ষণ বলা হয়। রোগ কোন স্তরে পৌঁছিয়াছে এই লক্ষণ তাহা জানিতে সাহায্য করে। শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়েও এই সমস্ত লক্ষণ ইংগিত দিয়া থাকে। যেমন-কৃষ্ণবর্ণের রক্তস্রাব, দড়ির মত লম্বা ও আঠার মত শেপ্না, স্ফোটক হইতে ঘন সাদা পূঁজ স্রাব প্রভৃতি ।




প্রশ্ন-  ধাতুগত লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর : যে লক্ষণগুলি রোগীর বিশেষ ধাতু প্রকৃতির পরিচয় দেয় সেগুলিকে ধাতুগত লক্ষণ বলা হয়। চিররোগের ক্ষেত্রে এ ধরনের লক্ষণের গুরুত্ব অনেক বেশী। যাহাদের আপাত দৃষ্টিতে বিশেষ কোন রোগ আছে বলিয়া মনে হয় না অথচ সামান্য কারণেই অসুস্থ হইয়া পড়ে কিংবা কোন সময়েই ঠিক সুস্থবোধ করেনা এই ধরনের লক্ষণ তাহাদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- প্রায় সর্দি কাশিতে ভোগা, আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তনেই অসুস্থবোধ করা প্রভৃতি ।




প্রশ্ন- মানসিক লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর : যে সকল লক্ষণ দ্বারা রোগীর মনোবৃত্তি অর্থাৎ মানসিক অবস্থা এবং আচরণের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় উহাদিগকে মানসিক লক্ষণ বলে। অন্য কথায় যাহা কিছু রোগীর মনের ভাব, অবস্থা, আকাংখা, অনীহা, ভয়ভীতি, ভালবাসা, আবেগ প্রভৃতি প্রকাশ করে সেইসকল লক্ষণকে মানসিক লক্ষণ বলে ।
 



প্রশ্ন- অদ্ভূত লক্ষণ বলিতে কি বুঝ?

উত্তর : যে সকল লক্ষণ দ্বারা রোগের কোন অদ্ভূত নিদর্শন প্রকাশ পায় উহাদিগকে অদ্ভুত লক্ষণ বলে। যেমন পক্ষাঘাত রোগীর পক্ষাঘাত অংশে তাপমাত্রা বেশী কিন্তু অন্য স্থানে কম। ইহা একটি অদ্ভুত লক্ষণ। কারণ পক্ষাঘাত অংশে শৈত্যভাব থাকাই স্বাভাবিক অথচ এই ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রম।




প্রশ্ন-  আরোগ্যপ্রাপ্ত বা ক্লিনিক্যাল লক্ষণ কাহাকে বলে?

উত্তর : চিকিৎসাধীন কোন রোগীকে কোন কোন অবস্থার জন্য কোন ঔষ ব্যবস্থা করিলে সেই ঔষধের পরীক্ষা লব্ধ লক্ষণে নাই এমন কোন সুস্পষ্ট লক্ষণ যদি অন্তর্হিত হইতে দেখা যায় তাহা হইলে উহা সেই ঔষধের ক্রিয়ায় দূরীভূত হইয়াছে বলিয়া অবধারিত হয়। এই লক্ষণকে আরোগ্যপ্রাপ্ত লক্ষণ বলে




প্রশ্ন- পরীক্ষালব্ধ ব. প্যাথজিনিটিক লক্ষণ বাহাকে বলে?

উত্তর : সুস্থদেহে ঔষধ পরীক্ষা করিয়া অথবা ঔষধের বিষক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া যে লক্ষণপ্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাকে পরীক্ষালব্ধ বা প্যাথজিনিটিক লক্ষণ বলে ।





প্রশ্ন- চিহ্ন ও লক্ষণের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর • চিকিৎসকের নিকট যখন রোগী নিজে রোগ সম্পর্কে বা কষ্টকর উপসর্গ সম্বন্ধে বর্ণনা দেন তখন রোগীর বর্ণিত কষ্টকর উপসর্গ গুলিকে লক্ষণ বলা হয়। অপর দিকে চিকিৎসক রোগী পর্যবেক্ষণ করিয়া এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা রোগ সম্পর্কে যাহা জানিতে পারেন তাহা সবই চিহ্ন। সুতরাং লক্ষণ হইল রোগ সম্পর্কে রোগীর নিজের বর্ণনা আর চিহ্ন হইল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকের ধারনা। অনেক সময় লক্ষণও চিহ্ন হইতে পারে। যেমন একজন রোগী বলিল আমার বমির সহিত রক্ত বাহির হয়। এখানে রক্তি বমি একটি লক্ষণ। আবার যদি রোগী চিকিৎসকের সামনে রক্ত বমি করে বা চিকিৎসককে রক্তবমি আনিয়া দেখা তাহা হইলে এখানে বক্তি বমি চিহ্ন।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় লক্ষণের গুরুত্ব বা মূল্য কি?

বা, চিকিৎসকের নিকট লক্ষণের গুরুত্ব কি?

উত্তর : রোগের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় পরীক্ষাধীণ রোগীর কোন লক্ষণ সমষ্টির মধ্যে। জীবনীশক্তির বিকৃত অবস্থার ফলে দেহে ও মনের পূর্ব স্বাস্থ্য হইতে যে কোন প্রকার বিচ্যুতির নিদর্শনই রোগ লক্ষণ। জীবনীশক্তির কি এ অবস্থার ফলে দেহে ও মনে কতিপয় যন্ত্রনা ও কষ্টকর উপসর্গের আবির্ভাব । এই উপসর্গগুলি মিলিতভাবে আক্রান্ত দেহীর এক ব্যথিত চিত্র বাহিরে তুলিয়া ধরে। এই যন্ত্রনা ও কষ্টকর উপসর্গ গুলিকেই রোগ লক্ষণ বলা হয়। হ্যানিমানের মতে রোগ হইলে তাহার লক্ষণ থাকিবেই এবং সেই লক্ষণ অবশ্যই, বোধগম্য হইবে। রোগের নান দিয়া চিকিৎসকের কোন লাভ হইবে না, রোগীতে কি কি লক্ষণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই চিকিৎসকের বিবেচ্য বিষয়। একই রোগে দেখা যায় বিভিন্ন রোগীতে বিভিন্ন প্রকার রোগ লক্ষণ দেখা দিয়াছে। ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের জন্যই এমন হয়। লক্ষ বিভিন্নতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রোগীতে ভিন্ন ভিন্ন ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। তাই রোগের নাম না করিয়া রোগীর লক্ষণ সমষ্টির দ্বারাই রোগের পরিচয় পাওয়া যায় এবং এই কারণে লক্ষণ সমষ্টি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নিকট এত গুরুত্বপূর্ণ।

রোগলক্ষণ রুগ্ন প্রকৃতির নিজের অবস্থা জানানোর এবং সাহায্য প্রার্থনা করার স্বাভাবিক ভাষা। সেইজন্য প্রাণসত্তা রোগের প্রকাশ এমন ভাবে করে যে রোগী নিজে, তাহার আত্মীয় স্বজন এবং চিকিৎসকও তাহা উপলব্ধি করিতে পারেন। তাই রোগীর নিজের ব্যক্ত লক্ষণ, সেবাকারী ও আত্মীয় স্বজন কর্তৃক দৃষ্ট লক্ষণ এবং চিকিৎসকের উপলব্ধি ও লক্ষ্যণীয় লক্ষণ সকল প্রকার লক্ষণ মিলিত ভাবেই রোগীর লক্ষণ সমষ্টির সৃষ্টি করে। কেবল এই সকল লক্ষণ সমষ্টি দ্বারাই আমরা রোগের আকৃতি অংকন করিতে পারি। সংস্কারমুক্ত ও নিরপেক্ষ ভাবে যদি চিকিৎসক রোগীর সঠিক লক্ষণ সমষ্টি লাভ করিতে না পারেন তাহা হইলে রোগের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাইবে না। তাই প্রতিটি ব্যক্তিগত রোগীর ক্ষেত্রে বন্ধমূল ধারনার বশবর্তী না হইয়া রোগীর দেহ ও মনের স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন অর্থাৎ পরিদৃশ্যমান রোগ লক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই চিকিৎসকের কল্পনা করা উচিত নয়। পরিদৃশ্যমান লক্ষণসমষ্টির মধ্যেই পীড়ার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। সেজন্যই হোমিওপ্যাথিতে লক্ষণের মূল্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম।



প্রশ্ন- লক্ষণের মান বা গ্রেড অনুসারে লক্ষণের শ্রেণীবিভাগ কর।

উত্তরঃ লক্ষণের মান বা গ্রেড অনুসারে লক্ষণকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।

ক) প্রথম শ্রেণী : ঔষধের পরীক্ষাকালীন যদি অধিকাংশ পরীক্ষক তাহারে ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কোন লক্ষণ বর্ণনা করে, তবে তাহা প্রথম শ্রেণীর ব্যাপক লক্ষণ। যেমন এটি নাক্স ভমিকা সেবনে অধিকাংশ পরীক্ষকের পুনঃ পুনঃ মলত্যাগ লক্ষণ দেখা দেয় তবে তাহা আঙ্গিকের প্রথম শ্রেণীর লক্ষণ। এইরূপ এপিস, আয়োডিন প্রভৃতি ঔষধের শ্বাসরোধ লক্ষণটি অধিকাংশ পরীক্ষকের উচ্চ কক্ষে অতিশয় অসুস্থবোধ অনুভূত হয় তবে এই লক্ষণটি সাধারণ পর্যায়ের প্রথম শ্রেণীতে স্থান পাইবে।

খ) দ্বিতীয় শ্ৰেণী : যে সকল লক্ষণ অধিকাংশ পরীক্ষক দ্বারা না হইয়া কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক পরীক্ষক দ্বারা সমর্থিত, উহারা দ্বিতীয় শ্রেণীর লক্ষণ।

গ) তৃতীয় শ্রেণী : শুধুমাত্র দুই একজন পরীক্ষক দ্বারা যদি কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় কিন্তু পুনরায় পরীক্ষা দ্বারা আর সমর্থিত হয় নাই, কিন্তু প্রবলভাবে প্রকাশিত হওয়ায় উহাদিগকে তৃতীয় শ্রেণীর লক্ষণ হিসাবে স্থান দেওয়া হইয়াছে। ভেষজ পরীক্ষার সময় কোন লক্ষণ প্রকাশিত না হইলেও যদি ব্যক্তিক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ কর্তৃক আরোগ্য সাধনের দ্বারা প্রমাণিত হয় তবে তাহাও তৃতীয় শ্রেণীর লক্ষণ।

প্রশ্ন-  কোন কোন লক্ষণগুলি ঔষধ নির্বাচনের জন্য সর্বাপেক্ষা অধিক সাহায্য করিয়া থাকে এবং কেন?

উত্তর : যে সকল লক্ষণ অতি সুস্পষ্ট অসাধারণ, বিস্ময়কর, অদ্ভুত, বিশেষ পরিচায়ক, বিশেষত্বপূর্ণ, একক ও পার্থক্য নির্ণয়শীল সেই সকল লক্ষণের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিতে হইবে। কারণ এই প্রকারের লক্ষণগুলিই আমাদের ঔষধ নির্বাচনের জন্য অধিকতর সাহায্য করিয়া থাকে। এই ঔষধগুলি এক ঔষধের সাথে অন্য ঔষধের পার্থক্য নির্ণয় করিয়া দেয়।
যে সকল লক্ষণ অতি সাধারণ ও নির্দিষ্ট যেমন-ক্ষুধামন্দা, মাথা ধরা, অস্থিরতা, নিদ্রয়, দুর্বলতা, অস্বচ্ছন্দতা প্রভৃতি ইহাদের মধ্য হইতে কোন প্রকার অসাধারণ লক্ষণ না পাওয়া পর্যন্ত কেবল মাত্র ইহাদের দ্বারা কোন ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। কারণ এই সকল সাধারণ লক্ষণ প্রায় প্রত্যেক ব্যাধির ও প্রত্যেক ঔষধের সাধারণ লক্ষণরূপে দেখিতে পাওয়া যায়। কাজেই এই লক্ষণগুলি উপর বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।




সমাপ্ত







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ