হোমিওপ্যাথিক মাত্রানীতি - ৬ষ্ঠ অধ্যায় - ১ম বর্ষ

                                                                 ৬ষ্ঠ অধ্যায়

হোমিওপ্যাথিক মাত্রানীতি

(Homoeopathic Posology)



প্রশ্ন- মাত্ৰাতত্ত্ব কাহাকে বলে?

উত্তর : গ্রীক শব্দ Posos হইতে Posulogy শব্দের উৎপত্তি। Posos অর্থ হইল কতটুকু এবং Posology অর্থ হইল মাত্রাতত্ত্ব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে শাখায় ঔষধের শক্তি ও মাত্রা এবং পরিমাণ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় তাহাকে মাত্ৰাতত্ত্ব বলে।



প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিতে মাত্ৰাতত্ত্ব বলিতে কি বুঝায় আলোচনা কর।

উত্তর : হোমিওপ্যাথি বা সদৃশ বিধান আবিষ্কারের পূর্বে তৎকালীন প্রচলিত এলোপ্যাথিক মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগে রোগ আরোগ্য হইলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ না হইয়া আরও কতকগুলি নতুন লক্ষণ দ্বারা আক্রান্ত হইত। ইহার কারণ সম্পর্কে হ্যানিমান বলেন সুস্থ দেহে ঔষধ সেবন করিলে যেমন কতকগুলি লক্ষণ প্রকাশিত হয়, রুগ্নদেহে ঔষধ সেবনে লক্ষণগুলি দূরীভূত হয়। ঔষধজনিত লক্ষণগুলি রোগলক্ষণ গুলিকে পরাজিত করে। ইহাই আরোগ্যের নিয়ম। কিন্তু বৃহৎ মাত্রায় ঔষধের লক্ষণ এত প্রবল হয় যে রোগারোগ্যের পরও উহা থাকিয়া ভীষণ ক্ষতি সাধন করে। ঔষধের এই অনিষ্টকর অবস্থা দূর করার জন্যই হ্যানিমান মাত্রানীতি আবিষ্কার করেন। ঔষধের রোগোৎপাদিকা শক্তিই তাহার আরোগ্যদায়িনী শক্তি। হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শক্তিকৃত অবস্থায় ব্যবহার করা হয় এবং ইহা জীবনীশক্তির উপর অর্থাৎ সূক্ষ্ম স্তরে ক্রিয়া করিয়া থাকে। তাই মাত্রা বৃহৎ হইলে ঔষধশক্তি রোগশক্তি দূরীভূত করার পরও জীবনীশক্তির উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়া রাখে। এবং রোগী কষ্টভোগ করে। সেজন্য ক্ষুদ্রমাত্রা ব্যবহারে রোগলক্ষণ দূরীভূত হওয়ার পর জীবনীশক্তি ঔষধশক্তি দ্বারা অধিকক্ষণ আবিষ্ট থাকে না এবং রোগীও নিরুপদ্রবে আরোগ্য লাভ করে।



প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে হ্যানিমানের মতামত কি?

বা, উপযুক্ত সূক্ষ্মমাত্রার পরিমাণ সম্পর্কে হ্যানিমানের মতামত লিখ।


উত্তর:- আরোগক্রিয়া ত্বরান্বিত ও প্রতিক্রিয়া বিহীন করার জন্য হ্যানিমান যে নির্দেশ দিয়াছেন তাহার সারমর্ম হইল এই যে, 

(১) রোগ নিরাময়ের জন্য নির্বাচিত “ঔষধটি রোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশযুক্ত হইবে। 

(২) ঔষধটি শক্তিকৃত অবস্থায় ক্ষুদ্রমাত্রা প্রয়োগ করিতে হইবে, 

(৩) ঔষধটি নির্দিষ্ট সময়ান্তরে পরিবর্তিত শক্তিতে পুনঃ প্রয়োগ করিতে হইবে। 

(৪) ঔষধের ক্রিয়া চলাকালীন ঔষধের পুনঃ প্রয়োগ করা চলিবে না। এখানে মাত্রা সম্পর্কে হ্যানিমানের অভিমত এই যে শক্তিকৃত অবস্থায় ক্ষুদ্রমাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ। দীর্ঘকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হ্যানিমান আবিষ্কার করিলেন যে ঔষধের পরিমাণের সঙ্গে ঔষধের ক্রিয়া ক্ষমতার এক নিবিড় সম্পর্ক রহিয়াছে। ঔষধের ক্রিয়ার গুনগত উৎকর্ষ প্রদত্ত ঔষধের পরিমাণ দ্বারা। নিয়ন্ত্রিত হয়। ঔষধের পরিমান যত কম তার কার্যকরী শক্তি তত বেশী। আরোগ্য ক্রিয়াই চিকিৎসকের উদ্দেশ্য। চিকিৎসার দ্বারা রোগীর মধ্যে পরিবর্তন একমাত্র কাম্য। তদুপরি ঔষধের মাত্রা এমন পরিমানে দিতে হইবে যাহাতে প্রাকৃতিক রোগের শক্তির চেয়ে ঔষধের কৃত্রিম রোগের শক্তি ন্যূনতম বা কিঞ্চিৎ বেশী হয়। আরোগ্যমূলক পরিবর্তনের জন্য এইটুকুই দরকার। প্রয়োগের পরে ঔষধজনিত বৃদ্ধি ঐ পরিমানেই ঘটে এবং ইহা আবশ্যকীয় বটে। ন্যূনতম পরিমাণের ঔষধের বৃদ্ধি হয় মৃদু এবং পরিমান স্বল্প বিধায় ঐ বৃদ্ধি হয় ক্ষণকাল স্থায়ী। ফলে জীবনীশক্তি অবিলম্বে মুক্তি পায়। মাত্রার লঘুত্বের দরুনই সুখকর আরোগ্য সাধিত হয়। মাত্রাধিক্য ও গুরুতর পরিমাণের কারণে ঔষধ জনিত এমন অতিবৃদ্ধি ঘটিতে পারে যাহাতে জীবনীশক্তি তথা রোগীর অবস্থা শোচনীয় হইয়া পড়ে বা মৃত্যুও ঘটিতে পারে। অতএব মাত্রা নিয়ন্ত্রক আবশ্যক। রোগ নিধনে সক্ষম হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অত্যধিক মাত্রার ভীষণ আঘাত রোগের সাথে সাথে জীবনীশক্তিরও পঞ্চত্ব প্রাপ্তির অশংকা থাকে। তাই মাত্রা নিয়ন্ত্রনের প্রতি কড়া নজর রাখা উচিত। প্রত্যেকটি পৃথক ঔষধের মাত্রা কি হওয়া উচিত উহা নির্ভর করে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা ও রোগীর সংবেদনশীলতার উপর। রোগীর সংবেদনশীলতা, গ্রহনক্ষমতা, বয়স ভেদে, স্বাস্থ্য ভেদে, অভ্যাস ভেদে, খাদ্য ভেদে, পরিবেশ ভেদে, শিক্ষা ও মননশীলতা ভেদে, নারী ও পুরুষ ভেদে বিভিন্ন প্রকার ও পরিমানে দেখা যায়। আবার রোগের তরুণ ও চির প্রকৃতি এবং অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করিতে হয়। সর্বাবস্থাতেই মনে রাখিতে হইবে ঔষধের মাত্রা ও শক্তি এমন না হয় যাহাতে ঔষধ প্রবলতর হয়।




প্রশ্ন-  কখন একই পরিমানের মাত্রার ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়?

উত্তর : রোগীতে ঔষধ প্রয়োগ করার পর যদি লক্ষণসমূহ কেন্দ্র হইতে পরিধির দিকে, ঊর্ধ্বাংগ হইতে নিম্নাংগের দিকে এবং সর্বশেষ লক্ষণ হইতে প্রাথমিক লক্ষণের দিকে আরোগ্যের গতি ধারা অনুযায়ী স্বচ্ছন্দভাবে ও অপেক্ষাকৃত বিনাকষ্টে আরোগ্য হইতে থাকে, তখন ঔষধকে একই পরিমানের পরিবর্তিত সূক্ষ্মমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রয়োগ করিতে হইবে।



প্রশ্ন-  কখন ঔষধের মাত্রাকে আরও সূক্ষ্ম করিতে হয়?

উত্তর : ঔষধ নির্বাচন সঠিক হইলে যদি রোগীর লক্ষণ সমূহ আরোগ্যের ধারা অনুসারে বিলীন হইতে থাকে অথচ রোগীর জীবনীশক্তির দুর্বলতা অনুসারে অসাধ্য রোগীদের মধ্যে অতি অনুভূতিশীলতার অথবা প্রতিক্রিয়া অভাবে রোগলক্ষণের আকাংখিত সময় পর্যন্ত উন্নতি না দেখা যায় ও অনাকাংখিত বৃদ্ধি হয় অথবা অচির রোগের প্রথমাবস্থায় কোন কোন সময় ঔষধজ বৃদ্ধি দেখা দেয়, অথবা চিররোগের আরোগ্যের শেষ অবস্থায় রোগশক্তি স্বল্প অবশিষ্ট থাকে, তখন রোগ শক্তি অপেক্ষা ঔষধের শক্তি ও মাত্রা অত্যন্ত অধিক হওয়ার কারনে ঔষধজনিত বৃদ্ধি দেখা দিলে ঔষধকে আরও সূক্ষ পরিমানের পরিবর্তিত মাত্রায় অধিক সময় অন্তর প্রয়োগ করিতে হইবে। যখন রোগলক্ষণগুলির আকাংখিত সময় পর্যন্ত উন্নতি না পাওয়া যায়। এবং অনাকাংখিত বৃদ্ধি হয় বা চিররোগের আরোগ্যের শেষ অবস্থায় ঔষধ বৃদ্ধি দেখা দিলে ঔষধের পরবর্তী মাত্রাটির প্রভাবেই অবশিষ্ট রোগশক্তি বিদূরিত হইয়াছে কিনা, যদি তাহা না হয় তবে পুনর্বার সূক্ষ্মতর মাত্রার ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে ।

 


প্রশ্ন- কখন ঔষধের মাত্রাকে অপেক্ষাকৃত স্কুল করিতে হয়?

উত্তর : জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা কম থাকার কারণে যদি রোগীর ভিতরে কোন যান্ত্রিক পরিবর্তন না ঘটে বা এমন কোন পরিবর্তন ঘটে যাহা সহজে আরোগ্য হইতে চায় না অথবা যদি ঔষধটি ধীর ক্রিয় হয় তখন সুনির্বাচিত ঔষধের স্বাভাবিক পরিমাণে পরিবর্তিত সূক্ষ্মতম মাত্রা প্রয়োগ করার পরও আকাংখিত উন্নতি পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় ঔষধকে পরিবর্তিত সূক্ষ্মতম মাত্রায় প্রয়োগ করার সাধারণ সময়ের নিয়ম অপেক্ষা আরও ঘনঘন ও কিছুটা বেশী পরিমানে প্রয়োগ করিতে হয়।



সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ