তৃতীয় অধ্যায়
সোরা - Psora
প্রশ্ন- সোরা কি?
উত্তর: সোরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হইল খোসপাঁচড়া, চুলকানি ইত্যাদি চর্মরোগ, স্ক্যাবিজ, সোরিয়াসিস, কুষ্ঠ প্রভৃতি এবং চর্মরোগের জীবাণু। ডাঃ রবার্টসের মতে সোরা হিব্রু শব্দ tsoral হইতে উৎপন্ন হইয়াছে এবং পরবর্তীকালে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার মধ্য দিয়া রূপান্তরিত হইয়া psora হইয়াছে। tsoral কথার অর্থ ক্ষত, দোষ, কলুষতা বা কলঙ্ক। হ্যানিমানের মতে সোরা হইল আদি রোগ সৃষ্টিকারী বিষ। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মারাত্মক মায়াজমঘটিত চিররোগ হইল সোরা। সোরিক মায়াজম হইতে উদ্ভুত সুস্থদেহে রোগপ্রবণতা সৃষ্টিকারী মায়াজমেটিক অবস্থাকে সোরা বলে।
প্রশ্ন- দ্বান্দিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হইতে সোরার সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: জীবন্ত দেহযন্ত্র তথা প্রাণশক্তির স্বাভাবিক অনুভূতি ও কার্যকলাপে বিকৃতি সৃষ্টিকারী রোগবিষ শক্তিকে সোরা বলে।
অন্য কথায়-জীবন্ত দেহযন্ত্রের সহজাত অশরীরী জীবনীশক্তির সঙ্গে জীবনবিরোধী অশরীরী গতিশীল রোগশক্তির সংঘর্ষ বা দ্বন্দের নামই সোরা বা প্রাথমিক রোগকারণ বা রোগশক্তি। উল্লেখ্য যে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা জনক ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমান 'The Chronic Diseases' গ্রন্থে ইহাকে Itch বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
প্রশ্ন- কিভাবে সোরার উৎপত্তি হয়?
বা, সোরার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ কিভাবে হয়?
উত্তর: পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মায়াজমঘটিত চিররোগবীজ হইল সোরা। এই সোরা মানবদেহের একটি অবস্থা মাত্র। যতদিন মানুষ প্রকৃতি নির্দেশিত পথে সৎভাবে জীবনযাপন করিতেছিল, ততদিন সোরা ছিল না। মানুষ যখন প্রকৃতি নির্দেশিত পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া কুমনন, কুচিন্তা ও কুকর্ম করিতে আরম্ভ করিল তখন হইতেই সমাজে বিশৃংখলা শুরু হইল। সম্পূর্ণ ও সুস্থ স্বাভাবিক মনে যখনই বিশৃংখলা, চঞ্চলতা, অপ্রয়োজনীয় কামনার উদয় হয়, তখনই রোগ সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সোরা বিষ মানবদেহে প্রবেশ করে। সোর যে শুধু মানুষের দেহকোষে ও মনোকোষের উপর এক গভীর দাগ কাটে তা নয়, এক দুরপনেয় কলংকের মত দেহীর সমগ্র সত্তার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে। ভ্রুণের মধ্য দিয়া এই কলংক পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সোরার সঠিক উৎপত্তির তারিখ জানা নাই। যুগযুগ ধরিয়া এই সোরা মানবজাতিকে উৎপীড়ন দিয়াছে এবং বর্তমানে অবিশ্বাস্য অজস্র প্রকৃতির বিচিত্র চির ও অচির পীড়ার জনকরূপে ক্রিয়াশীল রহিয়াছে।
প্রশ্ন- সোরা সকল প্রকৃত চিররোগের মূল কারণ- আলোচনা কর।
উত্তর: হ্যানিমান তাঁহার অর্গানন গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন যে, সকল প্রকার অযৌন প্রাকৃতিক চিররোগসমূহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরস্পরের সহিত সম্পর্কযুক্ত এবং একই আদিমূল হইতে ইহাদের উৎপত্তি। এই আদি কারণকে হ্যানিমান সোরিক মায়াজম বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মনুষ্যকৃত যতকিছু অঘটন এবং মানসিক অন্যায় সংঘটিত হইয়াছে তাহার মূল কারণ এই সোরাদোষ।
হাজার হাজার বছর ধরিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্য দিয়া সংক্রমিত হইয়া সোরা বিভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া চলিয়াছে। চিররোগসমূহের আটভাগের সাতভাগেরই মূল কারণ সোরা, বাকী একভাগ সিফিলিস ও সাইকোসিস। সোরা আবির্ভাবের পরে আমাদিগকে সুশৃংখল নির্মল মনে বিশৃংখলার সৃষ্টি হইয়া অনিয়মের সূচনা করে। অর্থাৎ আমাদের পবিত্র মনকে সোরা কলুষিত, বা দূষিত করে। দূষিত মনে দূষিত চিন্তা, কল্পনা ও অভিলাষ জন্ম নেয় এবং তদনুযায়ী যে কার্য হয় তাহাও দূষিত হইতে বাধ্য। কারণ প্রথমে আমাদের মধ্যে অভিলাষ ও কল্পনার সৃষ্টি হয় এবং পরে ওই কল্পনা অনুসারে কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। সোরার বিষময় ফল শুধু যে মানুষের দেহকোষ ও মনকোষের উপর গভীর দাগ কাটে তাহা নয়, এক দুরপনেয় কলংকের মত দেহীর সমগ্র সত্বার সঙ্গে মিশিয়া থাকে। ভ্রূণের মধ্য দিয়া এই কলংক পরবর্তী বংশধরে সংক্রমিত হয়। সোরা প্রথমেই আমাদিগকে হৃদয় মন কলুষিত করিবার ফলরূপেই উক্ত কুকর্মের মানসে সিফিলিস ও সাইকোসিস তথায় আশ্রিত হয়। যেহেতু সিফিলিস ও সাইকোসিস বসবাসের উপযুক্ত ক্ষেত্রের প্রয়োজন সেহেতু প্রথমেই কুমনন দ্বারা সোরা উক্ত ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। অতঃপর সোরা নিজে নিজেই নিজের প্ররোচনায় কুকর্ম সংঘটিত করিয়া সিফিলিস ও সাইকোসিসকে আমাদের দেহে চিরস্থায়ী আসন করিয়া দেয়। উন্মত্ততা, হিস্টিরিয়া, বুদ্ধিবৃত্তির জড়তা, মৃগী, ব্রংকাইটিস, ক্যান্সার, গেঁটেবাত, পক্ষাঘাত, অর্শ, হাঁপানী, ধ্বজভঙ্গ, বন্ধ্যাত্ব, যক্ষ্মা, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ প্রভৃতি রোগের কারণ হইল সোরা। শত শত বংশ পরম্পরায় লক্ষ লক্ষ মানবদেহের মধ্য দিয়া সঞ্চালিত হইয়া প্রাচীনতম এই পীড়া নিত্যনতুন রূপ পরিগ্রহ করিয়া উপস্থিত হয়। তাই বলা যায় সোরাই সকল রোগের মূল কারণ, একমাত্র আদিরোগ প্রসবিনী সকল রোগের জননী।
প্রশ্ন- এক সোরা হইতে অসংখ্য রোগ নানা রূপে পরিদৃষ্ট হয়, ইহার কারণ কি?
বা, সোরা উপবিষের বহুমুখী প্রকাশের কারণ কি?
উত্তর: অতি পুরাতন আদি রোগবীজ সোরা যাহা আবহমান যুগ ধরিয়া লক্ষ লক্ষ নরনারীর শোনিতে বাহিত হইয়া অবিশ্বাস্যরূপে চরম সীমায় পৌছিয়াছে। মানবের জন্মার্জিত বিভিন্ন ধাপ অনুসারে পরস্পরের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য বিদ্যমান বলিয়া জীবন যাপনের মধ্যেও অসংখ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উক্ত কারণে এই সোরা উপবিষ গৌণলক্ষণ হিসাবে নানা প্রকার রোগোৎপত্তি ঘটায়। সোরার প্রাথমিক বাহ্যিক প্রতিকৃতি কতকগুলি চুলকানিযুক্ত উদ্ভেদ দ্বারা অসমলক্ষণতত্বজ্ঞ চিকিৎসকগণের অদূরদর্শিতার ফলে বাহ্যিক প্রয়োগাদির দ্বারা এই স্ফোটকগুলি দূরীভূত হইয়া গৌণ আকার ধারণ করে। মুখ্য অপেক্ষা গৌণ বিকাশ ভয়ানক ও দুরারোগ্য। মুখ্য আকৃতি এক প্রকার হইলেও গৌণ আকৃতি অসংখ্য প্রকারের। সোরা উৎপত্তির তারিখ এত পুরাতন যে কেহই তাহা নির্ধারণ করিতে পারেন নাই। অনন্তকাল হইতে এই রোগবীজ যে প্রবাহিত তাহা বলা বাহুল্য নহে। আবার মানবদেহ মাত্রই বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিশেষত্বময়, আবার সোরা দ্বারাও অভিভূত। ইহা ছাড়া জলবায়ু প্রভৃতি বাহ্যিক শক্তি ও রোগ শোক প্রভৃতির আভ্যন্তরীক আঘাত সময়ে সময়ে অনবরত মানব সমাজে বিভিন্নরূপ বিকৃতি, দোষ, বিচলতা, যন্ত্রণা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়। যেহেতু ইহা বহু পুরাতন রোগবীজ এবং যুগ যুগ ধরিয়া লক্ষ লক্ষ মানবদেহের মধ্য দিয়া পরিপুষ্টি লাভ করিয়া আসিয়াছে তাই ইহার গৌণ বিকাশের কারণে বিভিন্নমুখী বিকাশ নিদানশাস্ত্রে বিভিন্ন নামীয় রোগে, বিভিন্নরূপে দেখা দিয়াছে, অথচ এইগুলি এক আদি রোগবীজ সোরারই অসংখ্য গৌণ প্রকাশ।
প্রশ্ন- সর্বপ্রকার রোগের মূল কারণ সোরা, কিন্তু সোরা দোষনাশক ঔষধসমূহ আবিষ্কৃত হওয়ার পরও ঔষধ নির্বাচনে চিকিৎসকদের শ্রম লাঘব হয় নাই-ব্যাখ্যা কর।
বা, সোরাঘটিত স্থায়ীরোগে কিভাবে ঔষধ নির্বাচন করিবে?
উত্তর: পরম করুণাময়ের অভিলাষে রোগের মূল কারণ এবং সদৃশ
বিধানমতে উহার ঔষধসমূহ আবিষ্কৃত হইয়াছে কিন্তু তবুও চিকিৎসকগণের শ্রম লাঘব হয় নাই। কারণ রোগের নিজস্ব কোন প্রতিকৃতি নাই, তাই উহা রোগীর প্রকৃতি ধরিয়াই আত্মপ্রকাশ করে। আবার রোগের প্রচলিত নামে কোন রোগী পাওয়া যায় না যেহেতু প্রচলিত একই নামের রোগের রোগীগণ একই প্রতিচ্ছবি ধারণ করে না। অতএব প্রতিটি রোগীর বক্তিগত লক্ষণ অসুসারে ঔষধ নির্বাচন করিতে হইবে। এক্ষেত্রে রোগের প্রকৃতি সঠিকরূপে নির্ণয় না করিয়া সঠিক ঔষধ নির্বাচন ও সঠিক শক্তি সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করা সত্যিই প্রায় অসম্ভব।
রোগারোগের ক্ষেত্রে অচির রোগের প্রতিকৃতি নির্ণয় করা সহজ হইলেও চিররোগের প্রতিকৃতি নির্ণয় করা সহজ নহে। কারণ অচিররোগের লক্ষণসমূহ প্রায়ই অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ও সুষ্পষ্টরূপে নিজের বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিকশিত হয়, যাহার লক্ষণসমূহ সহজেই ইন্দ্রিয় গোচর হয় বলিয়া তাহা দ্বারা চিকিৎসক রোগচিত্র ও ভেষজচিত্র মিলাইয়া সহজে ঔষধ নির্বাচন করিতে পারেন। কিন্তু চিররোগের লক্ষণসমূহ অত্যন্ত মন্থর গতিতে বহুবৎসর যাবত পুনর্বিকশিত হয় এবং উহা অত্যন্ত জটিল আকারে থাকার ফলে উহার প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় করিতে বহু কষ্ট স্বীকার, অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসাবাদ প্রভৃতি করিতে হয় এবং সেইভাবে সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করিতে হয়। তাই চিররোগের ক্ষেত্রে ঔষধ নির্বাচনে চিকিৎসকদের শ্রম লাঘব হয় নাই।
প্রশ্ন- 'সোরা কুমননের ফল এবং সিফিলিস ও সাইকোসিস কুকার্যের ফল'-আলোচনা কর।
উত্তর : মানুষ যতদিন প্রকৃতি নির্দেশিত পথে সৎভাবে জীবনযাপন করিতেছিল এবং নির্মল দেহ মনে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথে চলিয়াছিল, ততদিন মানুষের দেহমনে ছিল অনাবিল সুখ ও আনন্দ এবং মানুষ ছিল দেহমনে সুস্থ। কিন্তু যখন থেকে মানুষ স্রষ্টার প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী লংঘন করিতে শুরু করিয়াছে তখন হইতেই স্বাচ্ছন্দ্যের হানি ঘটিতে থাকে। কুমনন, কুকর্ম, কুচিন্ত ায় মানবমন কলুষিত হইতে শুরু করে। যে হৃদয়ে শান্তি শৃংখলা ছিল, সেই হৃদয়ে অশান্তি ও বিশৃংখলা বাসা বাঁধিতে শুরু করিয়াছে। ক্রমে এই অশান্তি মানুষের মনের ভালোবাসাকে গ্রাস করিয়াছে এবং উহার পরিবর্তে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ করিয়া তুলিয়াছে, অন্যের অনিষ্ট চিন্তায় মগ্ন হইয়াছে, একে অন্যের প্রতি হিংসাবিদ্বেষ চরিতার্থ করিয়াছে। এই যে প্রথমে চিন্তা, পরে চেষ্টা এবং সর্বশেষে কার্যে পরিণত করা এ সকলই মানসিক বিশৃঙ্খলা বা কণ্ডুয়ন ব্যতীত আর কিছুই নয়। এই মানসিক বিশৃঙ্খলাই সোরার প্রথম মূর্তি। মনোস্তর হইতে ক্রমে তাহা দেহে প্রতিফলিত বা বিকশিত হইয়া দৈহিক কণ্ডুয়ন বা বাহ্য মূর্তি প্রকাশ করে।
সোরা একটি অবস্থা মাত্র যাহা আমাদের নির্মল চিত্তে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, মনকে দূষিত করে। মন অর্থে জ্ঞানশক্তি, বোধশক্তি ও ইচ্ছাশক্তি। এই তিন শক্তির সমন্বয়ে মন। দূষিত মনে দূষিত কল্পনা ও দূষিত ইচ্ছাই জন্মিয়া থাকে এবং সেই অনুসারে কাজ করিতে বাধ্য। ফলে কুকার্য করার ফলে অন্য দুইটি পীড়া মানবদেহে আশ্রয় পাইয়াছে-উহারা সিফিলিস ও সাইকোসিস। তাই বলা যায় সোরা কুমননের ফল এবং সিফিলিস ও সাইকোসিস কুকার্যের ফল।
প্রশ্ন- সোরাকে আভ্যন্তরীক একটিমাত্র ঔষধ দ্বারা নির্মূল করা যায় না কেন?:
বা, সোরাকে একটিমাত্র সোরা দোষনাশক ঔষধ দ্বারা নির্মূল করা যায় কি?
উত্তর: সোরা একটি অতি সূক্ষ্মরোগ বীজ যাহার চরিত্র অদ্ভূত, নানা প্রকার জটিল রোগ সৃষ্টি করা যার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, তাহাকে একটিমাত্র সোরা দোষনাশক' ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা নির্মূল করা অসম্ভব। মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস যেমন পুরাতন, সোরা সৃষ্টির ইতিহাসও তেমনি পুরাতন। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির প্রায় শুরু হইতেই এই পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের শোনিতে প্রবাহিত হইয়া এই সোরা একমাত্র রতিজ রোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল রোগের মূল কারণরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। মানুষের শারীরিক গঠন প্রণালী, শিক্ষাদীক্ষা, আচার ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, কাজকর্ম, বাসস্থান, জলবায়ু, আবহাওয়া ও চালচলনের তারতম্য হিসাবে বিভিন্ন শারীরিক অবস্থার মধ্য দিয়া সোরা পরিণতি প্রাপ্ত হইয়াছে এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিকৃতরূপ পরিগ্রহ করিয়া স্বীয় শক্তি বলে বিকাশ লাভকরিতেছে।
তাই এই বহুরূপী সোরাকে আভ্যন্তরীক একটিমাত্র সোরা দোষনাশক ঔষধ দ্বারা নির্মূল করা যায় না।
প্রশ্ন- সুপ্তসোরা কি? সুপ্তসোরার লক্ষণাবলী বর্ণনা দাও।
উত্তর: সুপ্তসোরা-মানবদেহে সোরা সংক্রমণের পর তাহা সমগ্র প্রাণসত্তায় ছড়াইয়া পড়ে। তারপর অনুকূল পরিস্থিতি পাইলে আত্মপ্রকাশ করে। সংক্রমণের ও আত্মপ্রকাশের মধ্যবর্তী অবস্থাকে সুপ্ত সোরা বলে।
সুপ্তসোরার লক্ষণাবলী: নিম্নে সুপ্তসোরার লক্ষণাবলীর বর্ণনা দেওয়া হইল-
১) বিনা কারণে মানসিক চাঞ্চল্য, ভয়, উদ্বেগ ও উৎসাহহীনতা।
২) অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লাভের উদগ্র ব্যাকুলতাপূর্ণ অভিলাষ।
৩) শ্রমবিমুখতা, সামান্য পরিশ্রমেই দৈহিক ও মানসিক অবসাদ।
৪) ধর্ম বিষয়ে ভণ্ডামীপূর্ণ মুখোশপরা দার্শনিক।
৫) সারা দেহে বিশেষ করিয়া হাত ও পায়ের তলায় জ্বালা, মুখমণ্ডলে তাপের আধিক্য।
৬) শীতকাতরতা, অল্পেই ঠাণ্ডা লাগে, ঠাণ্ডা অপছন্দ, অভ্যন্তর ও বাহিরে তাপ অপছন্দ।
৭) ঘুমানোর সময় মাথায় ঘাম, ঘুমের মধ্যে দাঁত কাটা ও পেশীর উল্লম্ফন।
৮) দিনরাত শুইয়া থাকিবার অভিলাষ কিন্তু ঘুমাইলে অস্থিরতা দৃষ্ট হয়।
৯) অস্বাভাবিক ক্ষুধা। দ্রব্যবিশেষের আহারে অতিরিক্ত স্পৃহা বা অনিচ্ছা। মুখে নানা প্রকার স্বাদবোধ। উদরাময় বা কোষ্ঠবদ্ধতা, কৃমির উপসর্গ।
১০) নাসারন্ধ্র, ঠোঁট ও দেহের বর্জ্যপদার্থ নির্গমন পথসমূহ লালবর্ণ ধারণ করে।
১১) গোসলে অনীহা, অপরিষ্কার ও নোংরা থাকার অভিলাষ।
১২) টক, মিষ্টি, ভাজা এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য পছন্দ।
১৩) স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে অস্বাভাবিক কামোত্তেজনা। স্ত্রীলোকদের অনিয়মিত ঋতু।
প্রশ্ন- বিকশিত সোরার লক্ষণাবলীর বর্ণনা দাও।
বা, সোরার চরিত্রগত লক্ষণাবলী কি কি?
উত্তর: নিম্নে বিকশিত সোরার লক্ষণাবলীর বর্ণনা দেওয়া গেল।
১) সোরার প্রধান লক্ষণ হইল চুলকানি বা কণ্ডুয়ন। সোরার উদ্ভেদে অসহ্য সুখকর চুলকানি থাকে। রোগীর মাথায় মরামাস ও শুষ্ক উদ্ভেদ হয়। দেহের নানা স্থানে দাদ, চুলকানি।
২) মানসিক কণ্ডুয়নের জন্য অহেতুক মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। রোগীর সর্বদাই ভয়, আশংকা, উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ থাকে। একা থাকিতে ভয়, অন্ধকারে ভয়, ভবিষ্যৎ চিন্তা করিতে ভয়।
৩) নির্দিষ্ট সময় অন্তর রোগলক্ষণের পুনরাবর্তন।
৪) সোরা রোগী স্পর্শকাতর। আলো, গন্ধ, ঘর্ম, শব্দ, গোলমাল প্রভৃতির প্রতি রোগী অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ।
৫) সোরা শীতকাতর, শীতে রোগ বৃদ্ধি ও গরমে উপশম। সোরার প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগে।
৬) সোরার হাত পায়ে জ্বালা থাকে, মুখমণ্ডলে তাপোচ্ছাস থাকে। গাত্রচর্ম রুক্ষ্ম ও অস্বাস্থ্যকর।
৭) সোরার চুল শুষ্ক, চাকচিক্যবিহীন। ঘাম বেশী হয় না। অকালে চুল পাকে, অল্প পরিমিত স্থানে টাক পড়ে।
৮) ইহার মাথা ব্যথা বিচিত্র। তীব্র মাথাব্যথা সকালে আরম্ভ হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়িতে থাকে, সূর্যাস্তে কমিয়া যায়। সম্মুখদিকের বা পার্শ্বদেশের ব্যথা সোরা সূচিত করে।
৯) চক্ষুর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দৃষ্টিভ্রম হয়। চোখের সামনে বিন্দু বিন্দু দৃষ্ট হয়।
১০) মুখ শুষ্ক, ব্রণ হয়।
১১) অস্বাভাবিক ক্ষুধা কিন্তু দুগ্ধ পানে অনীহা। ক্ষুধার জন্য রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায়। পেটে শূন্যতাবোধ।
১২। পোড়ামাটি, চক, কয়লা, খড়িমাড়ি ইত্যাদি অখাদ্য খাইবার অভিলাষ।
১) সোরার প্রধান লক্ষণ হইল চুলকানি বা কণ্ডুয়ন। সোরার উদ্ভেদে অসহ্য সুখকর চুলকানি থাকে। রোগীর মাথায় মরামাস ও শুষ্ক উদ্ভেদ হয়। দেহের নানা স্থানে দাদ, চুলকানি।
২) মানসিক কণ্ডুয়নের জন্য অহেতুক মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। রোগীর সর্বদাই ভয়, আশংকা, উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ থাকে। একা থাকিতে ভয়, অন্ধকারে ভয়, ভবিষ্যৎ চিন্তা করিতে ভয়।
৩) নির্দিষ্ট সময় অন্তর রোগলক্ষণের পুনরাবর্তন।
৪) সোরা রোগী স্পর্শকাতর। আলো, গন্ধ, ঘর্ম, শব্দ, গোলমাল প্রভৃতির প্রতি রোগী অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ।
৫) সোরা শীতকাতর, শীতে রোগ বৃদ্ধি ও গরমে উপশম। সোরার প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগে।
৬) সোরার হাত পায়ে জ্বালা থাকে, মুখমণ্ডলে তাপোচ্ছাস থাকে। গাত্রচর্ম রুক্ষ্ম ও অস্বাস্থ্যকর।
৭) সোরার চুল শুষ্ক, চাকচিক্যবিহীন। ঘাম বেশী হয় না। অকালে চুল পাকে, অল্প পরিমিত স্থানে টাক পড়ে।
৮) ইহার মাথা ব্যথা বিচিত্র। তীব্র মাথাব্যথা সকালে আরম্ভ হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়িতে থাকে, সূর্যাস্তে কমিয়া যায়। সম্মুখদিকের বা পার্শ্বদেশের ব্যথা সোরা সূচিত করে।
৯) চক্ষুর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দৃষ্টিভ্রম হয়। চোখের সামনে বিন্দু বিন্দু দৃষ্ট হয়।
১০) মুখ শুষ্ক, ব্রণ হয়।
১১) অস্বাভাবিক ক্ষুধা কিন্তু দুগ্ধ পানে অনীহা। ক্ষুধার জন্য রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায়। পেটে শূন্যতাবোধ।
১২। পোড়ামাটি, চক, কয়লা, খড়িমাড়ি ইত্যাদি অখাদ্য খাইবার অভিলাষ।
প্রশ্ন- সোরার কণ্ডুয়নের প্রকৃতি কি?
উত্তর: সোরার কণ্ডুয়নের প্রকৃতিকে মানসিক ও দৈহিক এই দুইভাগে ভাগ করা যায়। মানসিক কণ্ডুয়ন সোরার প্রথম ও অদৃশ্য মূর্তি। মানসিক কণ্ডয়নের জন্য অহেতুক মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। অশান্তি, অস্থিরতা, ভয়, আশংকা, উৎকণ্ঠা, মৃত্যুভয়, প্রভৃতি দেখা দেয়। প্রথমাবস্থায় নিয়ম লংঘন, অন্যায় মনন, কুমনন, অসৎ কল্পনা, অসৎ চেষ্টা বা কণ্ডুয়ন। এই অসৎ প্রচেষ্টাই হইল মানসিক কণ্ডুয়ন।
দৈহিক কণ্ডুয়ন হইল সোরার বাহ্যিক মূর্তি। মানসিক অবস্থা, বাহ্যদেহে প্রতিফলিত অবস্থা অর্থাৎ সোরার এই অসৎ চিন্তা ও অসৎ মনন হইতে দৈহিক কণ্ডুয়ন সৃষ্টি। অর্থাৎ কুকার্য ও প্রকৃতি বিরুদ্ধপথে চলার ফলে শরীরস্থ ধাতু দূষিত হওয়ায় মানসিক ও বাহ্যিকভাবে আমাদের দেহের রোগপ্রবণতা আসে। বাহ্যিক কণ্ডুয়ন হইল চুলকানি, দাদ, পাঁচড়া, প্রভৃতি। ইহাই সোরা কণ্ডুয়নের প্রকৃতি।
প্রশ্ন- সোরার যথার্থ পরিচয় লাভ করা সহজতর নয় কেন?
উত্তর: পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, ব্যাপক ও মারাত্মক মায়াজমঘটিত চিরব্যাধি হইল সোরা। যথার্থ সোরার পরিচয় লাভ করা দুরুহ ব্যাপার। সোরা মানুষের মনোজগতে নিরাপদভাবে অবস্থান করে। কেহই তার নাগাল পায় না। মনোজগতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করিয়া নানা প্রকার অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে সোরা। সুস্থ স্বাভাবিক মনে যখনই বিশৃংখলা, চঞ্চলতা, অপ্রয়োজনীয় কামনার উদয় হয়, তখনই রোগ সংক্রমণের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সোরা বিষ ধীরে ধীরে সমগ্র প্রানসত্বাকে আচ্ছন্ন করে এবং আভ্যন্তরীণ সংক্রমণের কাজ সম্পূর্ণ করে। ইহাই সোরার সুপ্তাবস্থা। এক দুরপনেয় কলঙ্কের মত সোরা দেহীর সমগ্র সত্তার সঙ্গে মিশিয়া থাকে। ভ্রুণের মধ্য দিয়া এই কলঙ্ক পরবর্তী বংশধরে সংক্রামিত হয়। তাই অতি সহজে সোরাকে চেনা যায় না। কোন অনুকূল মুহূর্তে বাহ্যিক লক্ষণের মাধ্যমে সোরা আত্মপ্রকাশ করে।
প্রশ্ন- সোরা ও খোসপাঁচড়ার মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর: অনেকেই মনে করেন সোরা খোসপাঁচড়ার কারণ। বস্তুতঃ সোরা দোষের প্রকাশ হয় খোসপাঁচড়ার মাধ্যমে। সোরার প্রধান লক্ষণ হইল চুলকানি বা খোসপাঁচড়া। মানবদেহে সোরা সংক্রমণের পর তাহা সমগ্র প্রানসত্তায় ছড়াইয়া পড়ে। প্রথমে মানুষের মনে সোরা সংক্রামিত হয়। অনুকুল পরিস্থিতি পাইলে দেহে উহার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং এই প্রকাশিত অবস্থা চুলকানি ও খোসপাঁচড়া রূপে ঘটিয়া থাকে। কাহারো শরীরে খোসপাঁচড়া থাকিলে মনে করিতে হইবে যে তাহার মধ্যে সোরা দোষ আছে। তাই সোরা বলিতে খোসপাঁচড়া মনে করা ভুল।
প্রশ্ন- সোরাঘটিত স্থানীয় পীড়ার চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব?
উত্তর: সোরাঘটিত স্থানীয় পীড়ার চিকিৎসা করিতে হইলে তথা স্থানীয় লক্ষণবিশিষ্ট ক্রনিক রোগের চিকিৎসা করিতে হইলে কখনও বাহ্যিক ঔষধ প্রয়োগ করিয়া চিকিৎসা করা উচিত নয়। এই জাতীয় রোগের মূলোৎপাটন করতঃ আরোগ্য করিতে হইবে। কেননা সোরাঘটিত বা সোরা উপবিষ হইতে সৃষ্ট রোগের আভ্যন্তরীক লক্ষণগুলি হইল মুখ্য লক্ষণ, আর বাহ্যিক বা স্থানীয় লক্ষণগুলি হইল গৌণ লক্ষণ। বাহ্যিক ঔষধ প্রয়োগে বা অস্ত্র ব্যবহার করিয়া স্থানীয় লক্ষণগুলিকে দূরীভূত করা হইলে পীড়ার অন্যান্য লক্ষণগুলি চিকিৎসকের দৃষ্টিতে অগোচরেই থাকিয়া যাইবে। ইহাতে মূল আরোগ্য আরও দুঃসাধ্য হইয়া উঠিবে। অন্যদিকে আভ্যন্তরীক সোরা উপবিষের জন্য লক্ষণগুলির যেটি যে ক্ষেত্রে বিকাশ লাভ করে যেমন-আঁচিল, অর্বুদ, নালী ঘা প্রভৃতি স্থানীয় লক্ষণগুলি বাহ্যিক ঔষধ ব্যবহার না করিয়া লক্ষণের উপর ভিত্তি করিয়া সদৃশ বিধানমতে নির্বাচিত এন্টিসোরিক ঔষধ আভ্যন্তরীক প্রয়োগ করা হয়, তবে পীড়ার আভ্যন্ত রীণ ও বাহ্যিক লক্ষণ উভয়ই দূরীভূত হইবে।
প্রশ্ন- উপবিষসমূহের বাহ্যিক উচ্ছ্বাস ইহাদের আভ্যন্তরীক উচ্ছ্বাসকে বন্ধ রাখে-আলোচনা কর।
উত্তর: অধিকাংশ চিররোগের উৎপত্তির মূলে রহিয়াছে সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস এই তিনটি উপবিষ। এই তিনটি জীর্ণ উপবিষের মধ্যে আবার * সিফিলিস ও সাইকোসিস উপবিষের তুলনায় আভ্যন্তরীক সোরা উপবিষ হইতে অধিক সংখ্যক চিররোগ সৃষ্টি হয়। ইহাদের প্রাথমিক লক্ষণ ও বাহ্যিক স্থানীয় উপসর্গ (উচ্ছ্বাস) যথা- সোরার চর্ম উদ্ভেদ, উপদংশের ক্ষত, সাইকোসিসের আঁচিল প্রভৃতি দেহের বাহিরে প্রকাশ পাইবার পূর্বেই প্রত্যেক উপবিষ শরীরাভ্যন্ত রে সর্বাঙ্গে পরিব্যাপ্ত হয় এবং সমস্ত শরীর যন্ত্রকে নিজ আয়ত্বে নিয়া আসে। বাহ্যিক স্থানীয় লক্ষণটি আভ্যন্তরীক উচ্ছ্বাসটিকে সাময়িক বন্ধ রাখে। বাহ্যিক স্থানীয় লক্ষণটি প্রকাশ করিয়া জীবনীশক্তি আরোগ্যের জন্য একটি সদৃশ ঔষধ কামনা করে। এই স্থানীয় লক্ষণগুলি দূরীভূত করিলে আভ্যন্তরীক চিররোগবীজটির মারাত্মক আকারে পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ফলে নাম না জানা ও নামহীন বিবিধ চিররোগের সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন- কি কি উদ্দীপক কারণে অন্তর্নিহিত সোরার সাময়িক স্ফুরণ ঘটে?
উত্তর: অতিভোজন বা স্বল্পাহার, অত্যধিক দৈহিক সংবেদন, শীত, অতিরিক্ত উত্তাপ, অনাচার, দৈহিক ও মানসিক উদ্বেগ এই সকল উত্তেজক কারণে অন্তর্নিহিত সোরার সাময়িক স্ফুরণ ঘটে। সাধারণতঃ অচির রোগসমূহ সোরা বা আদি রোগবীজের ক্ষণস্থায়ী উচ্ছ্বাস মাত্র।
প্রশ্ন- সোরার প্রাথমিক লক্ষণ কি?
উত্তর: ত্বকের উপরে চুলকানিযুক্ত উদ্ভেদের বহিঃপ্রকাশই সোরার প্রাথমিক লক্ষণ যাহা চুলকাইবার পরে আক্রান্ত স্থানে অত্যন্ত জ্বালা ও সড়সড় করে এবং অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাইবার উদগ্র বাসনা বা মানসিক চঞ্চলতা দেখা দেয়।
প্রশ্ন- 'সোরা' শব্দটি ব্যবহারের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : হ্যানিমান সোরা কথাটি প্রচলন করেন নাই, তিনি এই কথাটি নির্বাচন করেন এবং এক বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন। তখনকার দিনে বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগকে সাধারণভাবে সোরা বলিয়া অভিহিত করা হইত। চিকিৎসক সমাজে প্রচলিত সহজবোধ্য এই পরিভাষাটি ব্যবহার করিয়া হ্যানিমান চিকিৎসক সমাজের সঙ্গে তাহার নিজের একাত্মতা প্রকাশ করিয়াছেন। কেননা তৎকালীন সোরা নামধারী ব্যাধিসমূহের ন্যায় হ্যানিমানের সোরা শ্রেণীভূক্ত ব্যাধিগুলির প্রাথমিক প্রকাশস্থল হইল গাত্রচর্ম ও দেহের বহিরঙ্গ এবং প্রথম অবস্থায় ইহাদের অসহ্য জ্বালা ও চুলকানি থাকে।
প্রশ্ন- সোরার ক্রিয়াফল লিখ।
উত্তর: সোরার ক্রিয়া ধ্বংসাত্মক। সোরা প্রাণসত্তাকে নিষ্ঠুরভাবে ক্ষতবিক্ষত করে। দেহকে বিকৃত করে, মনকে আশংকায় পরিপূর্ণ করে, বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্প্রভ করে এবং বিবেককে বিহ্বল করিয়া দেয়। সোরা দেহযন্ত্রের ক্রিয়াগত বৈলক্ষণ্য সৃষ্টি করিয়া অচির রোগের উৎপত্তি ঘটায়। সোরা মানুষের মনোজগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া নানা প্রকার অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে। সোরা সকল প্রকার চিররোগের জনক। সোরার বিষময় ফল অতি গভীর ও ব্যাপক। শুধু দেহকোষ ও মনকোষের উপর যে গভীর দাগ কাটে তাহা নয়, এক দুরপনেয় কলঙ্কের মত দেহীর সমগ্র সত্বার সঙ্গে মিশিয়া ভ্রূণের মধ্য দিয়া এই কলঙ্ক পরবর্তী বংশধরে সংক্রমিত হয়।
প্রশ্ন- সোরার প্রথম প্রকাশ মনে-ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: মনটিকে বিপথগামী করাই সোরার প্রথম পরিচয়। এজন্য সোরাদুষ্ট ব্যক্তির মনটি অন্তর্মুখী না হইয়া বহির্মুখী। মানব মনকে একেবারে পঙ্গু ও অকেজো করিয়া দিয়া চিন্তা স্রোতটি রুদ্ধ করিয়া নানা প্রকার দুশ্চিন্তার মধ্যে নিমগ্ন করাই সোরার ধর্ম। সৎ চিন্তা স্রোতটি রুদ্ধ হইয়া অসামঞ্জস্য নানা প্রকার কাল্পনিক চিন্তায় সোরাদুষ্ট মন সর্বদাই বিভোর। একা একা নির্জনে বসিয়া থাকা, ধর্ম বিষয়ে ভণ্ডামিপূর্ণ দার্শনিকতার ভান, চারিদিকে নীতিভঙ্গ অথচ নীতিবাদের অভিনয়, মনুষ্যত্ববোধের একান্ত অভাব সোরাদুষ্ট মনের আর একটি পরিচয়। স্বার্থপরতায় সে পরিপূর্ণ। শ্রমবিমুখতা ও অবসাদ সোরাদোষের আর একটি নিদর্শন। নানাপ্রকার ভয়, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, হতাশা, মৃত্যুভয় ইত্যাদি ভাবগুলি যতই দেখা দিতে থাকে, সোরা রোগী ততই অস্থির ও চঞ্চল হইয়া উঠে। বিনা কারণে মেজাজের পুনঃ পুনঃ পরিবর্তন, রুক্ষ মেজাজ। সোরা রোগীর কর্মধারা নাটকীয়ভাবেই আরম্ভ, নাটকীয়ভাবে শেষ। মোটকথা সোরার প্রথম প্রকাশ মনে, এই মনোলক্ষণের পরিচয় কোথায় আরম্ভ করিতে হয়, কোথায় শেষ করিতে হয়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।
প্রশ্ন- ক্রনিক মায়াজম বা সোরা মতবাদের প্রসার লাভের অন্তরায়সমূহ কি কি?
উত্তর: খ্যাতনামা ডাঃ এলেন তাঁহার লিখিত গ্রন্থের ভূমিকায় ক্রনিক মায়াজম বা সোরা মতবাদ প্রসার লাভের অন্তরায়ের দুটি কারণের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। উহারা হইল-
১) প্রথম বিঘ্ন হইতেছে এই যে, কেহ কেহ রোগের কারণকে জড়ীয় বা স্থূল কারণ বলিয়া মনে করেন।
২) দ্বিতীয় বিঘ্ন হইতেছে এই যে, অর্গাননের ১৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধিকাংশ হোমিওপ্যাথ শুধুমাত্র লক্ষণসমষ্টির উপর হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বলিয়া মনে করেন। লক্ষণসমষ্টির মূলে কি ধরনের মায়াজম ক্রিয়া করিতেছে তাহা জানা প্রয়োজন মনে করেন না। ঐ সমস্ত লক্ষণসমষ্টির দ্বারা নির্বাচিত ঔষধটির ভিতর ও লক্ষণসমষ্টির মূলে ক্রিয়াশীল মায়াজমসমূহ (সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস) এর লক্ষণসমষ্টিও বর্তমান থাকা আবশ্যক।
প্রশ্ন- সোরা রোগপ্রবণতা সৃষ্টি করে-ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং মারাত্মক মায়াজম ঘটিত চিরব্যাধি হইল সোরা। যুগযুগ ধরিয়া এই সোরা মানব সমাজে অজস্র রকমের বিচিত্র চির ও অচির পীড়ার জনকরূপে ক্রিয়াশীল রহিয়াছে। যাবতীয় চির ও অচির রোগ আক্রমণের প্রবণতার মূলে রহিয়াছে চিরমায়াজম সোরা। সোরার প্রথম পরিচয় মানব মনে। অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাইবার ব্যাকুলতাপূর্ণ কামনা বা মানসিক চঞ্চলতাই সোরার আদি বা প্রাথমিক চিত্র। পবিত্র মনে সোরার সুপ্তাবস্থা ভীতি, আশংকা, স্বার্থপরতা, শ্রমবিমুখতা, অবসাদ, রুক্ষ্ম মেজাজ, পরশ্রীকাতরতা, ভণ্ডামি এবং যাবতীয় নোংরামি স্বভাব সৃষ্টি করে। নীতিভঙ্গের সূচনা মনোমধ্যে অংকুরিত হইয়া দেহে আসিয়া তাহা পল্লবিত ও কুসুমিত হয়। নানাপ্রকার ব্যাধি, সিফিলিস ও 'সাইকোসিস মায়াজমের আক্রমনের একটা প্রবণতা এভাবেই সোরাবীজ অংকুরিত হওয়ার মধ্যেই সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির দৈহিক সংবেদন, অতিভোজন, অল্প ভোজন, অমিতাচার, অতিরিক্ত শীত তাপ, শারীরিক ও মানসিক উদ্বেগের ফলে অন্তর্নিহিত সোরার স্ফুরণ ঘটে। চুলকানি, দাদ, চর্মপীড়া আকারে সোরার প্রকাশ ঘটে বাহ্যদেহে। আর এই উদ্ভেদ যদি অসদৃশ উপায়ে মলম প্রভৃতি দ্বারা চাপা দিয়া অন্তর্মুখী করা হয় তবে মনটিই সরাসরি আক্রান্ত হয়। মনটিকে বিপথগামী করিয়া মনকে পঙ্গু ও বিপথগামী করে, দূষিত সংসর্গের আকাংখা জাগ্রত করে এবং এই আকাংখা চরিতার্থ হইলেই ধীরে ধীরে সিফিলিস ও সাইকোসিস দোষ আসিয়া নাম না জানা অসংখ্য আভ্যন্তরীণ রোগ সৃষ্টি হয়। তাই বলা যায় সোরা রোগপ্রবণতা সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন- সোরার মানসিক লক্ষণ লিখ।
উত্তর: নিম্নে সোরার মানসিক লক্ষণাবলীর বর্ণনা দেওয়া হইল-
১) সোরার মন ভীতিপূর্ণ, আশংকাপরায়ন, স্বার্থপরায়ন, অপরিচ্ছন্ন, চঞ্চল ও পরিবর্তনশীল।
২) অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লাভের উদগ্র ব্যাকুলতাপূর্ণ অভিলাষ।
৩) ধর্ম বিষয়ে ভণ্ডামিপূর্ণ দার্শনিকতার ভান। যেন এক 'মুখোশপরা দার্শনিক'।
৪) মনুষ্যত্ববোধ ও মমতাবোধের একান্ত অভাব। স্বার্থপরতাতে সে পরিপূর্ণ।
৫) রোগী শ্রমবিমুখ, অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, অতি অল্পেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত হইয়া পড়ে।
৬) রোগীর অন্তরে স্বার্থপরতা, বাহিরে নাটকীয় উদারতা, সব সময় যে গোপনে অন্যের ক্ষতিসাধন করিবার চিন্তা করে।
৭) অত্যন্ত খিটখিটে মেজাজ, রুক্ষ ও কর্কশ, মতের অমিল হইলে রাগিয়া যায়।
৮) গোসলে অনিচ্ছা, শৃংখলাবোধের অভাব, পরিচ্ছন্নতায় অনীহা, সব সময় নোংরামী স্বভাব।
৯) রোগীর কর্মধারা নাটকীয়ভাবেই আরম্ভ হয় ও নাটকের ন্যায়ই শেষ হয়।
১০) নানাভাবে, নানা চিন্তায় রোগী কত কল্পনা করে, কত কি ভাঙে গড়ে যেন ভাব প্রবণতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন- সোরার ধাতুগত লক্ষণসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর: নিম্নে সোরার ধাতুগত লক্ষণসমূহ উল্লেখ করা হইল।
১) মানসিক কণ্ডুয়নের জন্য অহেতুক মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। রোগী সর্বদা ভীতিপূর্ণ, মায়ামমতা, মনুষ্যত্ব ও শৃঙ্খলাহীন, আশংকা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ, স্বার্থপরায়ন, শ্রমবিমুখ ও অবসাদগ্রস্ত।
২) রোগীর মেজাজ খিটখিটে, রুক্ষ ও কর্কশ-সামান্য মতের অমিল হইলেই রাগিয়া যায়।
৩) রোগীর অন্তরে স্বার্থপরতা কিন্তু বাহিরে নাটকীয় উদারতা। পরশ্রীকাতর, অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, গোপনে সর্বক্ষণ অন্যের ক্ষতিকরার চিন্তা।
৪) সোরার অস্বাভাবিক ক্ষুধা, খাইলেই ক্ষুধা। খাদ্যে অরুচি। ভাজা, অস্ত্র, গুরুপাক দ্রব্য, মাংস, আবার কিছু অস্বাভাবিক দ্রব্য যেমন- কয়লা, পোড়ামাটি, চক, পেন্সিল প্রভৃতি খাইতে ইচ্ছা করে।
৫) দুর্দমনীয় খোসপাঁচড়া ও চুলকানি। অসহ্য সুখকর চুলকানি। মাথায় মরামাস ও শুষ্ক উদ্ভেদ।
৬) রোগী শীতকাতর, অতি অল্পেই শীতলাগে। হাত ও পায়ের তলায় জ্বালা করে ও ঘাম হয়।
৭) রোগীর নাসিকা, ওষ্ঠ, অধর ও দেহের বর্জ্য নির্গমনের ছিদ্রপথগুলি লালবর্ণ ধারণ করে।
৮) ঘর্ম, প্রস্রাব, ঋতুস্রাব প্রভৃতি অস্বাভাবিক হইলে রোগী আরাম বোধ করে।
৯) গাত্রচর্ম শুষ্ক, রুক্ষ ও অস্বাস্থ্যকর।
১০) সোরার মাথাব্যথা বিচিত্র। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তীব্র মাথাব্যথা শুরু হয়, বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়িতে থাকে, সূর্যাস্তে কমিয়া যায়।
১১) দাঁতে, মাড়িতে ও দাঁতের গোড়ায় ময়লা জমে।
১২) দিবারাত্র শুইয়া থাকার অভিলাষ কিন্তু ঘুমাইলে অস্থির লাগে। মাথায় ঘাম হয়।
১৩) চোখের ক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, দৃষ্টিভ্রম হয়। চোখে নানা রঙের দৃশ্য দেখে।
১৪) রোগী অপরিষ্কার, নোংরা স্বভাবের, গরমের দিনেও গোসল করিতে চায় না।
১৫) সোরার চুল শুষ্ক, চাকচিক্যহীন। ঘামবেশী হয় না। অকালে চুলপাকে, অল্প পরিমিত স্থানে টাক পড়ে।
১৬) নির্দিষ্ট সময় অন্তর রোগলক্ষণের পুনরাবর্তন।
উল্লেখ্য যে, সোরা অত্যন্ত ব্যাপকভাবে রোগীর স্নায়ুকেন্দ্রের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া বিকাশ লাভ করিলেও মূলতঃ রোগীর যন্ত্রগত কোন পরিবর্তন ঘটাইতে পারে না।
প্রশ্ন- সোরার চিকিৎসা পদ্ধতি লিখ।
উত্তর: সোরাগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসায় সুপ্ত অথবা বিকশিত যে কোন অবস্থাতেই রোগীর বংশগত, ব্যক্তিগত এবং অতীত ইতিহাস পুংখানুপুংখরূপে সংগ্রহ করিয়া লক্ষণসমষ্টির সামগ্রিক চিত্র দ্বারা এইরূপ একটি ঔষধ নির্বাচন করিতে হইবে যাহা এন্টিসোরিক এবং রোগীর ধাতুগত পরিবর্তন ঘটাইতে সক্ষম। সদৃশ এন্টিসোরিক ঔষধ প্রয়োগ করিবার পরে রোগীর ইতিপূর্বে চাপাপড়া কোন রোগলক্ষণ থাকিলে তাহা পুনরায় ফিরিয়া আসিবে এবং রোগী পূর্বাপেক্ষা অধিকতর কষ্ট পাইবে। যেমন হাঁপানী রোগলক্ষণ আরোগ্যের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করিবার পরে চর্মরোগ পুনরায় ফিরিয়া আসে এবং অত্যন্ত কষ্ট দেয়। হোমিওপ্যাথি মতে, এই অবস্থায় সাধারণতঃ কোন নূতন ঔষধের প্রয়োজন হয় না। বরং একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া ধৈর্যধারণ করিলে কিছুদিন পরে এই সকল লক্ষণাবলী প্রাকৃতিক নিয়মেই নিজ হইতে বিদূরিত হইবে।
পূর্বের চাপাপড়া লক্ষণ পুনরাবির্ভূত হইয়া' যদি দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকে এবং রোগীর আভ্যন্তরীন রোগলক্ষণসমূহ ক্রমশঃ দূরীভূত হইতে থাকে তাহা হইলে পূর্বে প্রয়োগকৃত ঔষধ অপেক্ষাকৃত উচ্চশক্তিতে পুনরায় প্রয়োগ করিতে হইবে। অবশ্য চাপা দেওয়া লক্ষণসমূহ প্রকাশ পাইবার পরেও যদি রোগী সামগ্রিকরূপে সুস্থতা অনুভব না করে তাহা হইলে পুনরায় রোগীলিপি প্রস্তুত করিয়া যতটা সম্ভব যথোপযুক্ত নূতন সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করিয়া রোগীকে প্রয়োগ করিতে হইবে।
এই ধরনের চিকিৎসা চলাকালীন রোগীর যদি কোন তরুণ রোগ দেখা দেয় তাহা হইলে এন্টিসোরিক ঔষুধ দ্বারা চিকিৎসা আপাততঃ বন্ধ রাখিয়া তার পরিবর্তে সাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ননমায়াজমেটিক ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে। তরুণ রোগ আরোগ্য হইলে পুনরায় পূর্বের ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে।
উল্লেখ্য যে, রোগীর ধাতুগত লক্ষণ সংগ্রহ না করিয়া শুধু স্থানীয় লক্ষণ সংগ্রহ করিয়া উহার সাদৃশ্যে ঔষধ নির্বাচন ও প্রয়োগ করিলে রোগীর রোগলক্ষণের কষ্টকর উপসর্গসমূহ সাময়িক উপশম হইবে কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইবে না। ফলে একই রোগ বারু বার দেখা দিবে অথবা রোগের পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর ঘটিবে অর্থাৎ একরোগ হইতে অন্যরোগ দেখা দিবে।
অতএব, শুধু লক্ষণসমূহের সদৃশ হইলেই হইবে না, সোরার চরিত্রগত লক্ষণসমূহও উক্ত ঔষধের সদৃশ হইতে হইবে। উহা ব্যতীত রোগ আরোগ্যের আশা করা অরণ্যে রোদনমাত্র আর কিছুই নহে।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর মস্তকের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর মস্তকের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) হজমশক্তির দুর্বলতার জন্য মস্তকে নানা প্রকার রোগ-বিশেষ করিয়া মাথাঘোরা ও মাথাব্যথা সোরাদুষ্ট রোগীতে বিশেষরূপে বিকশিত হইতে, দেখা যায়।
খ) এই সকল রোগলক্ষণ সঞ্চালনে, প্রত্যুষে এবং সূর্যের তাপবৃদ্ধির সাথে সাথে, চলাফেরায়, শয়নে বা উপবেশন হইতে উঠিলে, উর্ধদিকে তাকাইলে বৃদ্ধি পায় এবং এ সকল লক্ষণের বিপরীত পরিস্থিতিতে হ্রাস পায়।
গ) রোগীর কেশগুচ্ছ লাবণ্যহীন, উস্কোখুস্কো ও শুষ্ক। কেশগুচ্ছ চিরুনী সিক্ত না করিয়া পরিপাটি করা যায় না।
ঘ) মাথায় তেমন ঘাম হয় না।
ঙ) মস্তকে জ্বালাকর ও যন্ত্রণাকর নানাহ প্রকার রক্তশূণ্য উদ্ভেদ বা চর্মরোগ যাহা মুক্ত বায়ুতে ও সন্ধ্যায় উপশম হয়।
চ) অকালে কেশ পাকিয়া যায় এবং অল্প পরিসর স্থানে টাক পড়ে।
ছ) কোনপ্রকার রোগভোগের পরে বা কোন প্রকার রোগে কেশ পতন ঘটে।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর চক্ষু ও দৃষ্টিশক্তির লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: সোরার রোগীর চক্ষুর লক্ষণাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হইল।
ক) রোগীর নানাপ্রকার কার্যগত বিশৃংখলাপূর্ণ চক্ষুরোগ দেখা দেয়।
খ) দৃষ্টি বিভ্রম-চক্ষুর সম্মুখে নানাবর্ণের দৃশ্য বা গুচ্ছবদ্ধ বিন্দু দেখে।
গ) অদূরবদ্ধ দৃষ্টি, দূরবদ্ধ দৃষ্টি বা রাত্রি অন্ধতা প্রকাশ পায়।
ঘ) চক্ষুর ব্যথা ভোরে শুরু হইয়া সূর্যাবর্তরূপে বৃদ্ধি পায় এবং সন্ধ্যায় উপশম হয়।
চ) টিউবারকুলার দোষের কারণে চক্ষুর পাতা আরক্তিম বর্ণের দেখায়।
ছ) প্রদাহজনিত উপসর্গ, অত্যধিক চক্ষুঘর্ষণ করিতে ইচ্ছা হয়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর কর্ণের লক্ষণাবলীর বর্ণনা দাও।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর কর্ণের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) সোরার রোগীর কর্ণ দৃশ্যত ছোট এবং স্বাভাবিক।
খ) কর্ণগহ্বর সর্বদাই শুষ্ক ও শল্কাবৃত এবং উহা অনরবত সৃষ্টি হয় ও পড়িয়া যায়।
গ) কর্ণে সকল প্রকার শব্দ অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর।
ঘ) কর্ণে কদাচিৎ ফোড়া হয়।
ঙ) স্নায়বিক কারণে শ্রবণ সংক্রান্ত গোলযোগ সৃষ্টি হয়।
চ) কানে সর্বদা চুলকানি থাকে, কানের ভিতর অপরিষ্কার থাকে।
ছ) কর্ণে কার্যগত বিশৃঙ্খলা ব্যতীত যন্ত্রগত কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না অর্থাৎ যান্ত্রিক সমস্যা না থাকিলেও কর্ণের যে সকল রোগ দৃষ্ট হয় তার সবই সোরিক জানিতে হইবে।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর নাসিকার লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: সোরার রোগীর নাসিকার লক্ষণাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হইল।
ক) সোরাগ্রস্ত রোগীর নাসিকা স্বাভাবিক, সকলপ্রকার গন্ধেই স্পর্শকাতর হইয়া উঠে। সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ কোনটাই সহ্য করিতে পারে না।'
খ) কখনও কখনও সুগন্ধ-দুর্গন্ধ উভয়টিতেই রোগী বেহুঁশ হইয়া পড়ে।
গ) কখনও আবার সুগন্ধ-দুর্গন্ধ উভয়টিতেই রোগীর ঘুম ভাঙিয়া যায়।
ঘ) রান্নার, রংএর, উদ্ভিদের, ফুলের ও সুগন্ধিদ্রব্যের গন্ধে বমির উদ্রেক, বমন, শিরঃপীড়া, শিরোঘূর্ণন, খাদ্যদ্রব্যে অনিচ্ছা প্রভৃতি উপসর্গ সৃষ্টি হয়।
ঙ) নাসিকার অভ্যন্তরে যন্ত্রণাজনক ব্রণের উৎপত্তি হয়।
চ) সোরায় সাধারণ সর্দি আছে যাহা সহজে আরোগ্য হয়।
ছ) তবে, রোগীর নাসিকায় ক্ষত বা ঘা হওয়া সোরা ও সিফিলিস দোষের সংমিশ্রণজাত সংকেত বহন করে।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর মুখমণ্ডলের লক্ষণাবলী লিখ।
উত্তরঃ নিম্নে সোরার রোগীর মুখমণ্ডলের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) সোরার রোগীর মুখমণ্ডল দেখিতে অনেকটা উল্টানো পিরামিডের ন্যায়।
খ) মুখমণ্ডলে ঘাম হয় না, সমস্ত মুখমণ্ডল শুষ্ক।
গ) ঠোঁট দুইটি নীলাভ, শুষ্ক ও জুরাবস্থায় উজ্জ্বল লালবর্ণের হইতে দেখা যায়। তবে ওষ্ঠদ্বয় হইতে রক্ত বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছে মনে হইলে তাহা টিউবারকুলার।
ঘ) মুখমণ্ডলে ফুস্কুড়ি, ব্রণ দেখা দেয় এবং অপরিষ্কার।
ঙ) সমস্ত মুখমণ্ডলে তাপোচ্ছাস হয়।
চ) সোরা ও সিফিলিস দোষের সংমিশ্রনে টিউবারকুলার দোষের সৃষ্টি হইলে মুখমণ্ডলে প্রচুর ঘর্ম দৃষ্ট হয়।
ছ) মেয়েদের ঋতুস্রাব প্রথমবার শুরু হইবার পূর্বে মুখমণ্ডলে তাপোচ্ছাস দেখা দেয়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর মুখগহ্বরের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তরঃ নিম্নে সোরার রোগীর মুখগহ্বরের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল-
ক) সোরার রোগীর দন্তমাড়ি, দন্তগোড়া ও জিহ্বায় ময়লা জমে।
খ) মাড়িতে ও জিহ্বায় জ্বালা করে।
গ) সোরিকে শিশুদের জাড়ি ঘা বা জিহ্বায় দধির ন্যায় সাদা ক্ষত আছে। মুখের মধ্যে সাধারণ প্রদাহও আছে। কিন্তু মুখের মধ্যে যে কোন স্থানে প্রকৃত ক্ষত থাকিলে উহা সিফিলিটিক বা টিউবারকুলার।
ঘ) মুখে নানা প্রকার স্বাদ-টক, মিষ্ট, বিস্বাদ বা তিক্ত। এমনকি কখনও কখনও ভুক্ত খাদ্য-পানীয়ের অবিকল স্বাদযুক্ত ঢেকুর উঠে।
ঙ) হরিদ্রাবর্ণের জিহ্বার সহিত তিক্তাস্বাদ নিশ্চিত সোরিক। আবার যে জিনিষের স্বাদ, সে স্বাদের স্থলে অন্য স্বাদবোধ দেখা যায়। যেমন রুটির স্বাদ তিক্ত, জলের স্বাদ অস্বাভাবিক ইত্যাদি।
চ) কখনও কখনও সকল খাদ্যদ্রব্যেই পোড়া আস্বাদ বোধ হয়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর পাকাশয় ও অস্ত্রের লক্ষণাবলী লিখ।
বা, সোরার রোগীর উদর সম্বন্ধীয় লক্ষণাবলী লিখ।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর উদর তথা পাকাশয় ও অস্ত্রের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) সোরার রোগীর ক্ষুধা প্রচুর। পেট ভরিয়া খাওয়া সত্বেও ক্ষুধাবোধ করে। তাহা ছাড়া যাহা সহজে হজম হয় না, সে সকল খাদ্য জুরাবস্থায় বেশ আকাংখা করে।
খ) ক্ষুধার তাড়নায় মধ্যরাতে ঘুম হইতে জাগিয়া খাবার খাইতে চায়।
গ) দুপুর বেলা ও মধ্যরাতে পেটে অত্যন্ত শূণ্যতাবোধ করে, সেই সাথে কাহারো গরম বা ঠাণ্ডা অনুভূত হইয়া থাকে।
ঘ) সুসিদ্ধ খাদ্যদ্রব্যে বিতৃষ্ণা, ভাজা ও অল্পসিদ্ধ দ্রব্যসমূহ এবং অত্যধিক মশলাযুক্ত খাদ্যদ্রব্য যেমন মাংস, ঘি, মাখনযুক্ত খাদ্যে অভিরুচি থাকে কিন্তু তাহা খাইলে পাকাশয়ে সহ্য হয় না। দুগ্ধ পানে অনিচ্ছা, তাহাও সহ্য হয় না।
ঙ) উদর সংক্রান্ত লক্ষণ আহারের পরেই বৃদ্ধি পায়।
চ) সোরা গরম খাদ্য পছন্দ করে।
ছ) স্ত্রীলোকেরা গর্ভাবস্থায় নানা প্রকার অস্বাভাবিক দ্রব্য যেমন- মাটি, খড়িমাটি, পোড়ামাটি, কাঠ কয়লা, পেনসিল, চক, শ্লেটভাঙা প্রভৃতি খাইতে ইচ্ছা করে।
জ) পাকস্থলীতে শূণ্যতাবোধ। ভোর বেলায় উদরাময়। অত্যন্ত কোষ্ঠবদ্ধতা। কোষ্ঠবদ্ধতা ও উদরাময় পর্যায়ক্রমে দেখা যায়। পাকস্থলীতে ব্যথা হয় প্রভৃতি।
ঝ) যাবতীয় যন্ত্রণা আহারের পর বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর ক্ষুধার লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর ক্ষুধার লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) অত্যধিক বা অস্বাভাবিক ক্ষুধা সোরার একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। অসময়ে ক্ষুধা, আহারের নির্দিষ্ট সময়ের এক বা দুইঘন্টা পূর্বে ক্ষুধা, আহারের অব্যাবহিত পরে ক্ষুধা, পেট ভরিয়া খাওয়া সত্বেও রোগী ক্ষুধা বোধ করে।
খ) ক্ষুধার তাড়নায় মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায় এবং খাবার খাইতে চায়।
গ) দুপুর বেলা ও মধ্যরাত্রিতে পেটে অত্যন্ত শূণ্যতাবোধ করে। সে সঙ্গে কাহারো কাহারো গরম বা শীতবোধও হইয়া থাকে।
ঘ) সুসিদ্ধ খাদ্য খাইতে চায় না। ভাজা বা অল্পসিদ্ধ খাদ্যদ্রব্যসমূহ এবং অত্যধিক মশলাযুক্ত খাদ্যদ্রব্য যথা-মাংস, ঘি, মাখনযুক্ত খাদ্যাদিতে বিশেষ অভিরুচি থাকে কিন্তু তাহা খাইলে সহ্য হয় না।
ঙ) সোরিকে প্রায়ই তিক্ত ও টক উদ্দ্গার উঠা, সদ্য আহার করা খাদ্যের স্বাদ, বুক জ্বালা, বমি ভাব, গলাজ্বালা, ইত্যাদি লক্ষণ আছে।
চ) চা, কফি, ধুমপান ও অন্যান্য উত্তেজক খাদ্যে তীব্র আসক্তি। উষ্ণ খাদ্য ও গরম পানীয়ে আকাংখা।
ছ) স্ত্রীলোকদের গর্ভাবস্থায় নানাপ্রকার অস্বাভাবিক দ্রব্যসামগ্রী যথা মাটি, খড়িমাটি, পোড়ামাটি, কয়লা, চকপেন্সিল ইত্যাদি খাইতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দুগ্ধপানে এবং অত্যধিক সুগন্ধিযুক্ত খাদ্যদ্রব্যে অনীহা থাকে।
প্রশ্ন- খাদ্য দ্রব্যে ও পানীয়ে সোরার ইচ্ছা অনিচ্ছা লিখ।
উত্তর: নিম্নে সোৱার রোগীর খাদ্যদ্রব্যে ইচ্ছা অনিচ্ছা বর্ণনা করা হইল।
ক) ভাজা বা অল্পসিদ্ধ খাদ্যদ্রব্য, অত্যধিক মশলাযুক্ত খাদ্য যথা- মাংস, ঘি মাখনযুক্ত খাদ্যে বিশেষ অভিরুচি থাকে অথচ তাহা সহ্য হয় না।
খ) মিষ্টি দ্রব্যে আসক্তি আছে তবে জ্বর ভোগকালীন বা লিভার পীড়ায় মিষ্টিতে অনিচ্ছা থাকে, টক ফল ও অম্ল খাইতে চায়।
গ) উষ্ণ খাদ্য ও গরম পানীয়ে আকাংখা আছে।
ঘ) চা, কফি, ধুমপান ও অন্যান্য উত্তেজক খাদ্যে তীব্র আসক্তি।
ঙ) গর্ভবতী স্ত্রীলোকেরা মাটি, খড়িমাটি, পোড়ামাটি, কয়লা, চকপেন্সিল ইত্যাদি খাইতে ইচ্ছা করে।
চ) দুগ্ধ পানে এবং অত্যধিক সুগন্ধিযুক্ত খাদ্য দ্রব্যে অনীহা থাকে।
প্রশ্ন- সোরার বক্ষস্থল ও শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) যন্ত্র হইতে যন্ত্রান্তরে রোগলক্ষণের বার বার আসা যাওয়া সোরার রোগীর প্রকৃত পরিচয় বহন করে।
খ) অসদৃশ বিধান মতে চিকিৎসার ফলে রোগলক্ষণ চাপা পড়া যন্ত্র হইতে যন্ত্রান্তরে রোগলক্ষণের আসাযাওয়ার অন্যতম কারণ সোরার পরিচয় বহন করে।
গ) হাম, মিলমিলে প্রভৃতি চর্মোদ্ভেদ জাতীয় রোগ প্রচাপনের ফলে ফুসফুস আক্রান্ত হইয়া একটি কষ্টদায়ক শুষ্ক আক্ষেপযুক্ত কাশি উপস্থিত হয়। তাহাতে শ্লেষ্মা বিশেষ উঠে না। কখনও সামান্য পরিমাণে উঠিলেও উহা স্বাদহীন।
ঘ) কখনও কখনও চাপাপড়া রোগলক্ষণের কুফলরূপে বা ফুসফুসের কোনও প্রকার যন্ত্রগত দোষ থাকা সত্বেও ফুসফুস হইতে রক্ত উঠা সোরা দোষের কারণেই ঘটিয়া থাকে।
ঙ) সামান্য ঠাণ্ডায় স্বরভঙ্গ সোরার লক্ষণ। কিন্তু কয়েক বৎসর যাবত যদি সামান্য ঠাণ্ডাতেই স্বরভঙ্গ থাকে, স্বর কর্কশ ও গভীর হয় গলাবেদনা থাকে তবে তাহা টিউবারকুলার।
চ) সোরা রোগীর বক্ষ পরীক্ষায় কোন অস্বাভাবিক লক্ষণ পাওয়া যায় না। কারণ সোরার সহিত অন্য কোন দোষের মিশ্রণ না হইলে সোরা এককভাবে আকারগত কোন পরিবর্তন আনিতে পারে না।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর হৃদপিণ্ডের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর। বা, সোরা দোষগ্রস্ত ব্যক্তির হার্টের গোলযোগ সম্পর্কে লিখ।
উত্তর: নিম্নে সোরার রোগীর হার্ট বা হৃদপিণ্ডের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) সোরার রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু চাপাইয়া দিলে সোরাদুষ্ট মনে একটি প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে হৃদপিণ্ডের নানা রকম রোগলক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-হৃদপিণ্ডের দুর্বলতা, শূণ্যতা, পূর্ণতা বা চাপবোধ, ক্ষতবোধ, অত্যধিক রক্তোচ্ছাসের অনুভূতি প্রভৃতি। সোরায় হৃদপিণ্ডের ক্রিয়াগত লক্ষণ দৃষ্ট হয় এবং ফলে উপরোক্ত লক্ষণ সৃষ্টি হয়।
খ) হৃদপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন ও হাতুড়ি মারার ন্যায় আঘাত অনুভূত হয়।
গ) সোরার হজমের ব্যতিক্রম, বায়ু জমা ও জরায়ুর উত্তেজনার জন্য হৃদপিণ্ডের কম্পন, হাতুড়ি মারার ন্যায় অনুভূতি প্রভৃতি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
ঘ) হৃদপিণ্ডের উপসর্গের সহিত ভয় ও দুশ্চিন্তা প্রধান আনুষঙ্গিক লক্ষণরূপে বর্তমান থাকে। হৃদপিণ্ডের চারিপাশে বন্ধনী থাকার অনুভূতি। হৃদপিণ্ডের উপসর্গের সহিত উদ্বেগ ও মৃত্যুভয় থাকে।
ঙ) মানসিক উদ্বেগ, হৃদপিণ্ডে বেদনা ও স্নায়বিক বেদনা, সূচীবিদ্ধবৎ ও কাটিয়া ফেলার ন্যায় বেদনা দেখা দেয়। তবে এইসব উপসর্গ সবই ক্রিয়াগত, যন্ত্রগত পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত নয়।
চ) সোরিক রোগীর হৃদপিণ্ডের উপসর্গ বিশ্রামে বিশেষতঃ শয়নে ও উদগারে উপশম এবং নড়াচড়া করিলে, প্রাতঃকালে, পানাহারের পরে, সন্ধ্যাবেলায়, রাত্রে নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে ও চিৎ হইয়া শয়নে বৃদ্ধি পায়।
ছ) রোগী হৃদপিণ্ডের উপসর্গে মনে করে যে, এইবার বুঝি তাহার মৃত্যু হইবে। সোরিক রোগীর মন হৃদপিণ্ডের উপর পড়িয়া থাকে। কিন্তু আশার কথা হৃদপিণ্ড সংক্রান্ত ব্যাধিতে সোরা রোগীর মৃত্যু হয় না।
জ) সোরা বা সিউডো সোরায় শ্বাসকষ্ট খুবই কষ্টকর। শোথ লক্ষণও ইহাতে দৃষ্ট হয়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর মলদ্বারের বা মলের লক্ষণাবলীর বর্ণনা দাও।
উত্তর: সোরার রোগীর মলদ্বারের লক্ষণাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হইল।
ক) অতিভোজনজনিত উদরাময় ও অজীর্ণ সোরাদুষ্ট রোগীতে প্রায়ই দেখা যায়। উদরাময় সাধারণতঃ জলবৎ অথবা উহার সহিত অজীর্ণ খাদ্যবস্তু দেখা 'যায়। প্রায়ই দুর্গন্ধযুক্ত থাকে এবং উহার সহিত শূল ব্যথা থাকে।
খ) সাধারণতঃ প্রাতঃকালেই উদরাময়ের বৃদ্ধি দেখা যায়। উদরাময় ও আমাশয় শেষরাত্রি হইতে প্রাতঃকাল পর্যন্ত বৃদ্ধি হয় এবং মলত্যাগের বেগে ছুটিয়া যাইতে বাধ্য হয়।
গ) উদরাময়ের সময় নানা প্রকার ব্যথার অনুভব যাহা তাপে ও সামান্য 'চাপে উপশম হয়। ব্যথায় তলপেট অনেক সময় দপদপ করিতে থাকে।
ঘ) দুর্গন্ধযুক্ত যন্ত্রণাহীন উদরাময়ও দেখা যায়। উষ্ণপানীয় পানে ও গরমে থাকিলে উপশম হয়। ঠাণ্ডা দ্রব্য পান করিলে, ভয়, দুঃখ ও দুঃসংবাদে উদরাময় দেখা দেয়।
ঙ) সীম, আলু, ঠাণ্ডা দুধ ইত্যাদি পানাহারের ফলে পেটে গড়গড় করিয়া উদরাময় প্রকাশ পায়।
চ) কোষ্ঠবদ্ধে-অনেকদিন পর্যন্ত মলত্যাগের কোন ইচ্ছা হয় না, মল শুষ্ক যেন দগ্ধ, শক্ত, নির্গত হইতে চায় না। কোষ্ঠবদ্ধের সাথে শিরঃপীড়া, পর্যায়ক্রমে উদরাময়, ক্ষুধাহীনতা দেখা দেয়। ভেড়ার নাদির ন্যায় গোলাকার মল।
ছ) সোরায় সূতার ন্যায় কৃমি ও গুহ্যদ্বারে সুড়সুড়ি অনুভূতি আছে।
প্রশ্ন- সোরার প্রস্রাব ও মূত্রযন্ত্রের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: নিম্নে সোরা রোগীর প্রস্রাব ও মূত্রযন্ত্রের লক্ষণাবলী বর্ণনা করা হইল।
ক) সামান্য ঠাণ্ডা লাগিলেই বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রস্রাব বন্ধ হইয়া যায়।
খ) হাসিলে, কাশিলে বা হাঁচিলে অসাড়ে প্রস্রাব নিঃসরণ এবং জ্বালাযুক্ত প্রস্রাব সোরাদুষ্ট রোগীতে প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যান্ত্রিক কোনও পরিবর্তনজনিত এগুলি সংঘটিত হয় না।
গ) জ্বরে ভুগিবার পর সাদা ফসফেট জাতীয় মরিচা রঙের ন্যায় প্রস্রাব প্রায়ই দেখা যায়।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর পুংজননেন্দ্রিয়ের লক্ষণাবলীর বর্ণনা দাও
উত্তর: সোরার রোগীর পুংজননেন্দ্রিয়ের লক্ষণাবলী নিম্নে বর্ণনা করা হইল।
ক) পুরুষদের স্বপ্নঘোরে অসাড়ে বীর্যপাত এবং তাহা দীর্ঘদিন ধরিয়া চলিলে হজমশক্তির দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তির অল্পতা, কর্মে নিরোৎসাহ, মনে বিষণ্ণতা প্রভৃতি লক্ষণ আসিয়া দেখা দেয়।
খ) দীর্ঘকাল অন্য যে কোন প্রকার রোগ ভোগের পর প্রজনন যন্ত্রে কোনও প্রকার লক্ষণ, বিশেষ করিয়া দুর্বলতা দেখা দিলে তাহা সোরিক বলিয়া জানিতে হইবে।
প্রশ্ন- সোরার স্ত্রী-জননেন্দ্রিয়ের লক্ষণাবলী বর্ণনা দাও।
বা, সোরার রোগিনীর ঋতুস্রাব সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলার বর্ণনা দাও।
উত্তর: সোরার স্ত্রী-জননেন্দ্রিয়ের বা ঋতুস্রাব সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা নিম্নে বর্ণনা করা হইল।
ক) স্ত্রীলোকদের মাসিক ঋতুস্রাব সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যগত বিশৃঙ্খলা সোরার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কোন যন্ত্রগত বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয় না। উল্লেখ্য যে মাসিক ঋতুস্রাবের এই সকল পরিবর্তনের সহিত কোন প্রকার জ্বালাপোড়া, হাজাভাব ও ক্ষতকর লক্ষণ বিদ্যমান থাকে না।
খ) সিউডো সোরা দোষের জন্য স্রাব বিবর্ণ, জলবৎ এবং দীর্ঘকাল যাবত চলিতে থাকিলে যুবতীদের রক্তহীনতা দেখা দেয়।
গ) সোরার ঋতুকালীন বেদনা থাকিলেও আক্ষেপিক ও শূলব্যথার মত থাকে না।
ঘ) সোরার স্রাবে ক্লট থাকিলেও উহা ক্ষুদ্র ধরণের।
প্রশ্ন- সোরার লিউকোরিয়া বা শ্বেতপ্রদরের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর : নিম্নে সোরার লিউকোরিয়া বা শ্বেতপ্রদরের লক্ষণ বর্ণনা করা হইল। সোরার লিউকোরিয়ার স্রাব শ্বেতাভ এলবুমেনের বা ডিমের শ্বেতাংশের ন্যায়, গন্ধশূণ্য, সাধারণতঃ মৃদু প্রকৃতির, স্বল্প পরিমাণ এবং অবসাদক নহে।
প্রশ্ন- সোরার চর্মরোগের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: চর্মের উপর সোরার প্রভাব নানাভাবে বিকশিত হইয়া থাকে। ইহার রোগীর চর্ম অপরিচ্ছন্ন, শুষ্ক, খসখসে, উদ্ভেদপূর্ণ বা অনেক সময় উদ্ভেদশূণ্যও হইতে দেখা যায়। চুলকানিযুক্ত উদ্ভেদ থাকিলে উহাতে কোন রস বা পুঁজ না হওয়াই সোরার বৈশিষ্ট্য। জ্বালার অনুভূতি, দেহের বর্ণ বিশিষ্ট উদ্ভেদ, মৎস্যের আইশের ন্যায় উদ্ভেদ এবং পুনঃ পুনঃ চর্মরোগের আক্রমণ প্রবণতা, যাহা বংশগতভাবে সোরাদুষ্ট দেহেই প্রবাহিত হইতে দেখা যায়। চর্মরোগ চাপা পড়িয়া অন্য কোন রোগের আবির্ভাব সোরা দোষের পরিচয় বহন করে।
সোরার মামড়ী বা কভুত্বক পাতলা, সরু এবং ক্ষুদ্র। আর্টিকেরিয়া বা আমবাতে চুলকানির জন্য প্রধানঃ ইহা সোরিক এবং ইহার মূলে টিউবারকুলার দোষের অবস্থিতি থাকে।
উল্লেখ্য-মনোরাজ্যে সোরার ক্রিয়াকলাপের ফল স্বরূপ খোসপাঁচড়া প্রভৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রকৃত পক্ষে এই উদ্ভেদসমূহ স্বয়ং সোরা নহে।
প্রশ্ন- সোরার শিশুর মানসিক লক্ষণাবলী বর্ণনা কর। বা, সোরা শিশুর ভয়ের লক্ষণাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর: সোরার শিশুদের মধ্যে নানা প্রকার ভয়ের মানসিক লক্ষণ বা চঞ্চলতা বিদ্যমান থাকে। যেমন-
ক) শিশু একাকী থাকিতে ভয় পায়। একাকী বিদ্যালয়ে যাইতে ভয় লাগে।
খ) শিশু অন্ধকারে ভয় পায়।
গ) অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখিলে ভয় পায়।
ঘ) নানা প্রকার কাল্পনিক বস্তুর ভয় বা জীবজন্তুর ভয় পায়। যেমন-বাঘ, ভালুক, কালকুকুর, কাল ষাঁড় প্রভৃতি।
ঙ) ঠিক সময়ে স্কুলে যাইতে পারিবে না বা পড়াশোনায় উন্নতি করিতে পারিবে না বলিয়া ভয়।
এইভাবে অবিরত ভয়ে ভয়ে থাকিয়া শেষ পর্যন্ত শিশু অবসন্ন হইয়া পড়ে ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির ভাব রুদ্ধ হইয়া পরে।
প্রশ্ন- সোরার রোগীর স্বপ্নের প্রকৃতি লিখ।
উত্তর: সোরার রোগী বাহিরে প্রস্রাব করিতেছে বা মলত্যাগ করিতেছে কিংবা গান গাহিতেছে এইরূপ স্বপ্ন দেখে।
প্রশ্ন- আজকাল সোরার আদি বা প্রাথমিক রূপ নজরে পড়ে না কেন?
উত্তর: আজকাল সোরার আদি বা প্রাথমিক রূপ নজরে পড়ে না। কারণ বহুযুগ পূর্বে আদি সোরাদোষে আক্রান্ত পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকারী হিসাবে বর্তমান মনুষ্য সমাজ গঠিত। সুতরাং প্রাথমিক সোরার পরবর্তী বা পরিণতির পূর্ণরূপটিই বর্তমান মনুষ্যসমাজে, মনুষ্যদেহে প্রতিফলিত। তবে সোরাশূণ্য ব্যক্তি এ জগতে এক প্রকার বিরল।
প্রশ্ন- সোরার রোগলক্ষণ সমূহের হ্রাস-বৃদ্ধি লিখ।
উত্তর : সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে, বিশ্রাম করিলে, ঘুমাইলে ও চুপচাপ করিয়া থাকিলে সোরার রোগলক্ষণ হ্রাস পায় এবং সূর্য উদয় হইবার সাথে সাথে, সঞ্চালনে, প্রভাতকালে ও যে কোন প্রকার উত্তাপে সোরার রোগ লক্ষণ বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন- সোরা দোষ হইতে উৎপন্ন কয়েকটি রোগের নাম লিখ
উত্তর: সাধারণতঃ নিম্নলিখিত রোগগুলি সোরা দোষ হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে।
উদরাময়, পেটফাঁপা, অম্লাজীর্ণ, চুলকানিযুক্ত চর্মপীড়া, চক্ষু ও নাসিকা হইতে কেবলই জলস্রাব ও তৎসমুদয়ে জ্বালা, প্রদাহ ও জ্বালাযুক্ত স্বরভঙ্গ, মেরুমজ্জা ও মস্তিষ্কের অস্থায়ী প্রদাহ ও জ্বালা, স্তন প্রদাহ, স্বরভঙ্গ, হৃদযন্ত্রের প্রদাহ, বিসূচিকা, কোষ্ঠবদ্ধতা, নানা যন্ত্রের শুধু কার্যগত বিশৃঙ্খলা, শোথ, প্রভৃতি সোরা দোষ হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে।
প্রশ্ন- এন্টিসোরিক ঔষধ কাহাকে বলে? দশটি এন্টিসোরিক ঔষধের নাম উল্লেখ কর।
উত্তর: যে সকল ঔষধ সুস্থ দেহে প্রয়োগ করিলে সোরার রোগলক্ষণসমূহের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করিতে পারে এবং কোন অসুস্থ ব্যক্তির দেহের সোরিক দোষ থাকিলে তাহাও নির্দোষ, রূপে আরোগ্য করিতে পারে উহাদিগকে এন্টিসোরিক ঔষধ বলে। যেমন-সালফার, সিপিয়া, সোরিনাম, সাইলিসিয়া, আর্সেনিক, আর্সেনিক আয়োড, আয়োডিন, নেট্রাম মিউর, ল্যাকেসিস, হিপার সাল্ফ প্রভৃতি।
প্রশ্ন- অর্জিত দোষ কাহাকে বলে?
উত্তর: যখন দুষ্ট প্রবৃত্তিজাত নিজ কুকর্মের ফলরূপে গনোরিয়া ও সিফিলিস বা উহাদের কোনও একটি রোগের আক্রমণ ঘটে, তখন সোরার প্রভাবে অথবা অসমলক্ষণ চিকিৎসার প্রভাবে চাপা দেওয়া হইলে উক্ত রোগসমূহ বা কোন একটি রোগ আর রোগাবস্থায় না থাকিয়া দোষের আকার পরিগ্রহ করে। তখন তাহাকে অর্জিত দোষ বলে।
প্রশ্ন- প্রাপ্ত দোষ কাহাকে বলে?
উত্তর: স্বীয় জীবনে গনোরিয়া ও সিফিলিস সোরার প্রভাবে বা অসমলক্ষণ চিকিৎসার প্রভাবে অর্জিত না হইয়াই পূর্বপুরুষের মধ্যে কাহারও দ্বারা অর্জিত হইয়া বংশ পরম্পরায় স্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হইয়া পুত্র' পৌত্রদিগের দেহে সঞ্চারিত হওয়াকে প্রাপ্ত দোষ বলে। অর্থাৎ স্বীয় জীবনে অর্জন নহে, অথবা স্বীয় জীবনে দোষের আকারে পরিবর্তন হওয়াও নহে। পরন্তু রোগ অর্জন ও দোষের আকারে প্রাপ্তি, উভয় ব্যাপারটিই পূর্বপুরুষে সংঘটিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। নতুনা উহাকে প্রাপ্ত দোবের শ্রেণীতে পরিগণিত করা যাইবে না।
প্রশ্ন- লব্ধ দোষ কাহাকে বলে?
উত্তর: বংশানুক্রমিক রূপে ব্যতীত টিকা দেওয়া প্রথা হইতে এবং পারদজাতীয় ভেষজ দ্বারা চিকিৎসিত হওয়ার ফলে পর্যায়ক্রমে সাইকোসিস পারদবিষ (সিফিলিসেরই সমজাতীয়) আকারে সংক্রমিত হওয়া দোষকে লব্ধ দোষ বলে।
0 মন্তব্যসমূহ