প্রথম অধ্যায়
পরিচিতি
Introduction
প্রশ্ন- চিররোগবিদ্যা কাহাকে বলে?
উত্তর: চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে শাখায় চিররোগ, চিররোগের সংগঠক মায়াজম, চিররোগের উৎপত্তির কারণ, চিররোগের গতি প্রকৃতি, আরোগ্যবিধি এবং ভাবীফল বিষয়ে পূংখানুপুংখ আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয় তাহাকে চিররোগবিদ্যা বলে।
প্রশ্ন- চিররোগবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা কি?
বা, লক্ষণ সাদৃশ্যে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে চিররোগবিদ্যার জ্ঞানের প্রয়োজনীয় কি?
বা, মেটিরিয়া মেডিকার জ্ঞান থাকিলে চলে, সেক্ষেত্রে চিররোগতত্ত্বের প্রয়োজন কি?
বা, চির মায়াজম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা কি?
উত্তর: মহাত্মা ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমানের মতে চিররোগ সুচিকিৎসা ব্যতীত আদর্শ আরোগ্য সম্ভব নয়, কারণ ইহার লক্ষণসমূহ যেমন অস্পষ্ট তেমন অধিকাংশ লক্ষণই প্রায়ক্ষেত্রে সুপ্তাবস্থায় বিরাজমান। তরুণ বা অচির রোগ ঔষধ ছাড়াও আরোগ্য হইতে পারে, কিন্তু চিররোগ ঔষধ ছাড়া আরোগ্য হয় না। চিররোগের কারণ চির মায়াজম। অর্থাৎ সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস। চির মায়াজমের জ্ঞান ব্যতীত চিররোগের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অংকন করা সম্ভব নয় এবং উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচনও সম্ভব নয়। অপরদিকে মায়াজম বিষয়ে পুংখানুপুংখ জ্ঞান না থাকিলে আমাদিগকে মায়াজমেটিক ঔষধের জন্য সম্পূর্ণ মেটিরিয়া মেডিকা আয়ত্ব করিতে হইবে। কিন্তু মেটিরিয়া মেডিকার পরিধি এতই সুবৃহৎ যে উহা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ব করিয়া স্মরণ রাখা কাহারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হ্যানিমানস ক্রনিক ডিজিজেস মায়াজম সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান থাকিলে উহা আমাদিগকে একগুচ্ছ গ্রুপ ঔষধের সন্ধান দিবে। এই একগুচ্ছ সীমিত গ্রুপ ঔষধ হইতেই একজন আদর্শ হোমিও চিকিৎসক অতি সহজেই সঠিক ঔষধ নির্বাচন করিতে সক্ষম হইবেন। অন্যথায় চিররোগের সঠিক ঔষধ নির্বাচন করা অসম্ভব। চিররোগ তত্ত্বে বিভিন্ন মায়াজমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সুপ্ত ও বিকশিত অবস্থার লক্ষণাবলী বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রহিয়াছে। মায়াজমের সঠিক জ্ঞানসহ কেবলমাত্র সঠিক ঔষধ নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, সঙ্গে উহার সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও অবশ্যই জানিতে হইবে। কারণ বিভিন্ন মায়াজমের মিলনে বিভিন্ন প্রকার জটিল কঠিন চিররোগের উদ্ভব হয়। এই সকল জটিল কঠিন চিররোগের গতি প্রকৃতি ও আদর্শ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে মহাত্মা হ্যানিমান তাঁহার চিররোগ তত্ত্বে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছেন।
অতএব সংগত কারণেই মেটিরিয়া মেডিকার জ্ঞান থাকিলেও চিররোগ চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিররোগ তত্ত্বের জ্ঞান থাকা বা চিররোগ বিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
প্রশ্ন- চিররোগের প্রকৃতি আবিষ্কারের ইতিহাস বর্ণনা কর।
বা, চিররোগের প্রকৃতি আবিষ্কারে মহাত্মা হ্যানিমানের ক্রণিক মায়াজম আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক অমূল্য অবদান-আলোচনা কর।
উত্তর: অতি সুপ্রাচীন কাল হইতেই প্রাচীনপন্থী এলোপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকগণ রোগের ভোগকাল অনুসারে রোগকে ৩টি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছিলেন। যেমন ক) যে সকল রোগের ভোগ কাল প্রায় ৬ সপ্তাহ বা দেড়মাসের কম সে সকল রোগকে তরুণ রোগ, খ) যে সকল রোগের ভোগকাল ৬ সপ্তাহ বা দেড়মাসের বেশী কিন্তু দুই মাসের কম সে সকল রোগকে স্বল্প পুরাতন রোগ এবং গ) যে সকল রোগের ভোগকাল দুই মাসের বেশী সে সকল রোগকে চিররোগের শ্রেণীভুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমান প্রাচীনপন্থীগণের এই রোগের শ্রেণীকরণের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করিয়া বলিয়াছিলেন- 'ক্রনিক মায়াজম হইতে উদ্ভূত কোন রোগের ভোগকাল যদি একদিনও হয় তবুও তাহা চিররোগ।'
হোমিওপ্যাথি বিধানমতে রোগী চিকিৎসা কালে মহাত্মা ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমান তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় তিনযুগ অতীতের সুগভীর পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতায় এইরূপ সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন; যে ক্ষেত্রে সদৃশ বিধান মতে সুনির্বাচিত ঔষধ প্রয়োগ করিয়াও কাংখিত আদর্শ আরোগ্য লাভকরেন নাই। বরং দেখা গিয়াছে যে, রোগ সাময়িকভাবে নিরাময় হইয়া গেলেও কিছুকাল পরে পুনরায় পূর্বের ন্যায় এবং ভিন্নরূপে আবির্ভূত হইয়াছে। এই ঘটনায় অনুসন্ধিৎসু ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমান ইহার রহস্য উদঘাটনের জন্য সুদীর্ঘ একযুগ সময় গভীর পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও নিরলস গবেষণা করিয়া শেষ পর্যন্ত স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই সকল ক্ষেত্রে রোগীর দেহযন্ত্রে এক আদি রোগশক্তি বিদ্যমান ও ক্রিয়াশীল রহিয়াছে, যাহা রোগীর যাবতীয় রোগের উৎস এবং রোগারোগ্যের পথে প্রধান অন্তরায়; যাহার ফলে রোগীদেহে এই বিশৃংখলাবস্থার উদ্ভব হইয়াছে। মহাত্মা ডাঃ হ্যানিমান এই রোগ শক্তিকেই ক্রনিক মায়াজম নামকরণ করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, সকল চিররোগসমূহ ক্রনিক মায়াজম হইতেই উদ্ভূত।
উৎস অনুসারে ডাঃ হ্যানিমান চিররোগসমূহকে সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিস এই তিনশ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। তাঁহার মতে 'সিফিলিস ও সাইকোসিস যৌন রোগবীজ হইতে উৎপন্ন হয় এবং অবশিষ্ট সকল অযৌন রোহসমূহ সাধারণতঃ সোরা শ্রেণীভূক্ত যাহা সোরিক মায়াজম হইতে উদ্ভূত।' তিনি আরও বলিয়াছেন 'সোরার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির ত্বকের উপরে কোন চুলকানিযুক্ত উদ্ভেদের মাধ্যমে। সিফিলিসের প্রাথমিক নিদর্শন ব্যক্তির যৌনাঙ্গে কোন ক্ষতের উপস্থিতি। সাইকোসিসের প্রাথমিক নিদর্শন ডুমুরাকৃতির কোন উদ্ভেদ নির্গমন।' এই সকল চুলকানি, ক্ষত ও উদ্ভেদের বহিঃপ্রকাশকে প্রচাপিত করিলে রোগবিষ অন্তর্মুখী হইয়া নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করে। সর্বপ্রকার চিররোগ এই ত্রিদোষের এক বা একাধিকের মিলনের ফলে উদ্ভূত হয়। তবে প্রায়ই সোরাদোষের সহিত সিফিলিস ও সাইকোসিস এককভাবে বা যৌথভাবে মিলিত হয়। ফলে নানাহ প্রকার দূরারোগ্য জটিল রোগের উদ্ভব ঘটে।
অতএব বলা যায় চিররোগের প্রকৃতি আবিষ্কারে মহাত্মা ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিমানের ক্রণিক মায়াজম আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক অমূল অবদান।
প্রশ্ন- প্রাচীন বা পুরাতন রোগকে চিররোগ বলার অসুবিধ কোথায়?
বা, প্রাচীন রোগ ও চিররোগের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর: আজকাল অনেকেই প্রাচীনরোগকে চিররোগ বলিয়া আখ্যায়িত করেন, যাহা প্রাচীনপন্থী এলোপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ করিয়াছিলেন। প্রাচীনপন্থী এলোপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও যে সকল রোগের ভোগকাল দুই মাসের বেশী সে সকল রোগকে চিররোগের শ্রেণীভূক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু মহাত্মা ডাঃ হ্যানিমান দ্বিমত পোষণ করিয়া বলিয়াছিলেন- 'ক্রনিক মায়াজম হইতে উদ্ভূত কোন রোগের ভোগকাল যদি একদিনও হয় তবুও তাহা চিররোগ।'
মূলতঃ ব্যাধির স্থায়িত্ব বা প্রাচীনত্বের উপর চিররোগের সংজ্ঞা নির্ভর করে না। যে সকল ব্যাধি আপনা হইতে আরোগ্য হওয়ার কোন প্রবণতা থাকে না, চির উপবিষ হইতে যে সকল রোগের উদ্ভব, যতই দিন যাইতে থাকে, ততই নানা নামে ভিন্নরূপে প্রকাশিত হইয়া থাকে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা ভিন্ন রোগীকে সারাজীবন কষ্ট দিতে থাকে, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তস্করের ন্যায় মানবের জীবনীশক্তিকে বিকৃত করিয়া দেহমনকে এমনভাবে বিপর্যস্ত করে, প্রকৃত ঔষধ ছাড়া উন্নত জীবনযাপন প্রণালীর দ্বারা উহা হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না, এই ভয়াবহ ব্যাধির নামই চিররোগ বা স্থায়ী রোগ। চিররোগের বীজ হইতেই উহা উৎপন্ন হয়। কারণ ব্যাধির স্থায়িত্ব বা প্রাচীন এর সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ নাই।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরিয়া নানা প্রকার ব্যাধিতে ভুগিলেই এবং আপনা হইতে আরোগ্য হইবার প্রবণতা না থাকিলেই তাহাকে চিররোগ বলা যায় না। কারণ দীর্ঘদিন ধরিয়া দূষিত আবহাওয়ায় বসবাস, মাদকদ্রব্য ও অনিষ্টকর খাদ্য গ্রহণ, অসংযত আচরণে লিপ্ত থাকা, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, দৈহিক ও মানসিক অতিরিক্ত পরিশ্রম, মানসিক দুশ্চিন্তায় অতিবাহিত করা প্রভৃতি কারণে মানুষ দীর্ঘকাল ভুগিতে পারে। কিন্তু এই প্রকার ব্যাধিগ্রস্তের শরীরে যদি কোন চিররোগ বিষ লুকায়িত না থাকে তাহা হইলে উন্নততর জীবন যাপন প্রণালী অবলম্বন করিয়া স্বকৃত ব্যাধির কারণ দূর করিতে পারিলে পুনরায় স্বাস্থ্য লাভকরা যায়। ইহাদিগকে পুরাতন বা প্রাচীন পীড়া বলা যায়।
তাই প্রাচীন রোগ কখনই চিররোগ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত চির মায়াজম দ্বারা রোগী আক্রান্ত না হয়। প্রাচীন রোগ ও চিররোগকে এক করিয়া ভাবার কোন উপায় নাই।
0 মন্তব্যসমূহ