এপিলেন্সী বা মৃগী, তৃতীয় অধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ

 এপিলেন্সী বা মৃগী
Epilepsy





প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগী রোগের সংজ্ঞা লিখ।

উত্তর: ইহা স্নায়ুমন্ডলের একটি রোগ। হঠাৎ চেতনাশক্তি লোপ পাইয়া রোগী পড়িয়া গেলে এবং তাহার সাথে হাত পা সর্বশরীরের মাংসপেশী সজোরে সংকোচন হইয়া আক্ষেপ বা খিচুনী ভাব দেখা দিলে এই জাতীয় পীড়াকে এপিলেন্সী বা মৃগী রোগ বলে।



প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগীরোগের শ্রেণীবিভাগ কর।

উত্তর: শ্রেণীবিভাগ- এই পীড়াকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

যথা-

১) পেটিটমাল বা লঘু মৃগী রোগ।

২) গ্রান্ড মাল বা গুরু মৃগী রোগ।

৩) 'জ্যাকসোনিয়ান এপিলেন্সী-ব্রেণের কার্টিকাল এরিয়ার নির্দিষ্ট অংশের পীড়া।

৪) জেনারেল এপিলেন্সী-রোগীর সম্পূর্ণ অজ্ঞানাবস্থা।




প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগী রোগের কারণ তত্ত্ব লিখ।


উত্তর: কারণতত্ত্ব- একাধিক কারণে এই রোগ লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

১) অতিরিক্ত শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় সেবা, হস্ত মৈথুন এবং নেশাজনিত কারণ।

২) চর্মপীড়া বা কোন উদ্ভেদ বসিয়া গিয়া এই রোগ সৃষ্টি হইতে পারে।

৩) উপদংশ, সংক্রামক রোগ, ক্রিমিরোগ হইতেও ইহা সৃষ্টি হইতে পারে।

৪) চিন্তা, শোক, দুঃখ, ক্রোধ হেতু প্রকোপিত বায়ু, কফ ও পিত্ত হৃদযন্ত্রস্থিত ধমনীসমূহে বাধার সৃষ্টি করিয়া স্মৃতিশক্তি নষ্ট হইয়া এই রোগ সৃষ্টি হইতে পারে।

৫) হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা, প্রবল মানসিক আবেগসমূহ।

৬) মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে হঠাৎ প্রবল অবসাদের সৃষ্টি হইয়া তাহাদের নিয়মিত কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হইয়া এই রোগ দেখা দিতে পারে।

৭) বংশগত কারণে, পিতামাতার এই রোগ থাকিলে সন্তানদের মধ্যেও দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৮) মস্তিষ্কের রক্তহীনতা, মস্তিষ্ক মধ্যে অর্বুদ, রক্তস্রাব, থ্রম্বোসিস, প্রভৃতির চাপ, ঋতুর গোলযোগ, হস্তমৈথুনের কুফল, বালকদের দন্তোদাম, ক্রিমি, ভয় ও শোক প্রভৃতি কারণে।



প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগী রোগের লক্ষণাবলী বা উপসর্গ বা ক্লিনিক্যাল ফিচার লিখ।

উত্তর: লক্ষণাবলী:

১) মাথায় বেদনা, চক্ষুর সম্মুখে বিদ্যুৎবৎ আলোক দর্শন, হৃদস্পন্দন ও মাথাঘোরা, কানে ভোঁ ভোঁ করা, অস্থিরতা, মাথায় ভারবোধ, মুখে রক্তহীনতা, হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি তালুর দিকে আকৃষ্ট হওয়া প্রভৃতি সৃষ্টি হইয়া পীড়া হঠাৎ আক্রমণ করে।

২) কোনরূপ পূর্বলক্ষণ ছাড়াই রোগী হঠাৎ চীৎকার করিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়ে এবং খেঁচুনী, বা আক্ষেপ দেখা দেয়। মুর্ছিত হইয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাঁতে দাঁত লাগিয়া যায়, চোখ মুখ বিকৃত হয়। মুখে ফেনা উঠে, হাত শক্তভাবে মুঠা করা থাকে।

৩) মুর্ছিত হওয়ার আগে চীৎকার করিয়া উঠা লক্ষণটি অনেক সময় দেখা যায়। 

৪) অচেতন হইয়া পড়িয়া গোঁ গোঁ শব্দ করিতে থাকে, প্রথমে চক্ষু ঘুরিতে থাকে, পরে চক্ষু স্থির হয়, চক্ষু তারকা ঊর্ধে উঠিয়া যায়, চক্ষু তারকা প্রসারিত হয়।

৫) মুখ পাণ্ডুবর্ণ পরে রক্তবর্ণ ধারণ করে। 

৬) সর্বাঙ্গে আক্ষেপভাব দেখা দেয়, গ্রীবা শক্ত ও বাঁকা হয়, হাতের আঙ্গুলগুলি কুঞ্চিত হয়, বুক ধড়ফড় করে, ঠাণ্ডা ঘাম নির্গত হয়।

৭) অনেক সময় অসাড়ে পায়খানা প্রস্রাব নির্গত হয়।

৮) জিহ্বায় কামড় পড়ে। 

৯) উপসর্গসমূহ প্রশমিত হইলে রোগী ঘুমাইয়া পড়ে এবং ঘুম ভাঙ্গার পর সুস্থ রোধ করে।




প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগী রোগের ফিটের স্তর বা অবস্থা বর্ণনা কর।

উত্তর: ফিটের অবস্থা- মৃগীর ফিটের নিম্নলিখিত অবস্থাগুলি দেখা যায়।
১) টনিক স্প্যাজম- ক্ষণিকের জন্য সারা দেহ, মুখ, কাঁধ ও চক্ষু হইতে আরম্ভ হইয়া সর্বদেহের কাঠিন্য ও আড়ষ্ট ভাব উপস্থিত হয়, ঘাড় পিছনদিকে ঘুরিয়া যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়, মাথা পশ্চাৎ দিকে বাঁকিয়া সর্বশরীর ধনুকের ন্যায় আকৃতি ধারণ করে। চক্ষু উপরের দিকে উঠে। অতি দ্রুত এই অবস্থা সংঘটিত হয়।

২) ক্রোনিক স্প্যাজম- টনিক স্প্যাজমের কয়েক সেকেণ্ড মধ্যেই ক্লোনিক স্প্যাজম অর্থাৎ মাংসপেশীর নাচন শুরু হয়। সাথে সাথে সমগ্র পেশীচক্রে খিচুনী আরম্ভ হয়। চক্ষু গোলক ঘুরিতে থাকে, হাত পা জোরে ছড়াইতে থাকে, মুখ দিয়া ফেনা নির্গত হয়। অসাড়ে পায়খানা প্রস্রাব নিঃসরণ হয়। এই অবস্থা ২/৩ মিনিট
থাকে।

৩) কোমা বা অজ্ঞান অবস্থা- ক্রমে খিঁচুনীর প্রাবল্য কমিয়া আসে, হাত পা শিথিল হইয়া যায়, দীর্ঘ ঘড়ঘড়ি শ্বাসের পর শ্বাস সহজ হয়, রোগী অজ্ঞান হইয়া ঘুমাইয়া পড়ে।

৪) স্টেটাস এপিলেপ্টিকাস- বিরলক্ষেত্রে ক্লোনিক স্প্যাজমের বিরাম না হইয়া পুনঃ পুনঃ ফিট হইয়া রোগীর নাড়ীর গতি ও দেহের তাপ বৃদ্ধি পায়।

৫) পোস্ট এপিলেপ্টিক- ফিট ও কোমার অবসানে রোগী জাগিয়া উঠে, শিরঃপীড়া, বমন, অবসন্নতা দেখা দেয়, বই খাতা ছেঁড়া, কাপড় খুলিয়া ফেলা, অসংলগ্ন কার্য করা, উন্মাদের মত আচরণ করিতে থাকে।

৬) প্যারালাইসিস- অনেকের কথা জড়াইয়া যায়, দৃষ্টি শক্তি কমিয়া যাইতে থাকে, অঙ্গ বিশেষের কম জোর হইতে পারে।




প্রশ্ন- এপিলেন্সী ও হিস্টিরিয়ার মধ্যে পার্থক্য দেখাও।

উত্তর: এপিলেন্সী ও হিস্টিরিয়ার মধ্যে পার্থক্য- হিস্টিরিয়ার প্রতি আক্রমণ প্রায়ই এপিলেন্সী অপেক্ষা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এপিলেন্সী ঘুমের মধ্যেও আক্রমণ হয় কিন্তু হিস্টিরিয়ায় ঘুমের মধ্যে কোন আক্রমণ হয় না। হিস্টিরিয়ার রোগী আত্মরক্ষা করিবার কোন চেষ্টা না করিয়া হঠাৎ অসহায়ভাবে যেখানে সেখানে জ্ঞানহারা হইয়া পড়িয়া গিয়া আহত হয় না, কিন্তু এপিলেন্সীতে আহত হয়। ক্রোনিক স্প্যাজম, নানা ভঙ্গীতে হাত পা ছোঁড়া ও ফিট হইবার পরে চীৎকার করা হিস্টিরিয়ার বৈশিষ্ট্য। হিস্টিরিয়ার রোগী বাধা পাইলে বল প্রকাশ করে এবং আপন জিহ্বা দংশন করে না বরং অপরকে কামড় দিতে পারে। অসাড়ে পায়খানা প্রস্রাব ত্যাগ করে না। এপিলেন্সীর রোগী অনেক সময় নিজ জিহ্বা দংশন করে এবং অসাড়ে পায়খানা প্রস্রাব ত্যাগ করে।





প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগীরোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস লিখ।

উত্তর: রোগ নির্ণয়-
১) হঠাৎ বেহুঁশ বা অজ্ঞান হওয়া।
২) চক্ষু তারকা অসমান হওয়া, চক্ষু তারকা ঊর্ধে উঠিয়া যাওয়া। 
৩) মুখ দিয়া ফেনা বাহির হওয়া।
৪) ব্লাড প্রেসার বেশী থাকা।
৫) মুখমণ্ডল ও অন্যান্য অঙ্গের স্পন্দন ও আক্ষেপ, আক্ষেপকালে মুখ বিকৃত হওয়া।
৬) হাতের আঙ্গুল মুষ্ঠিবদ্ধ হওয়া।




প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগীরোগের ভাবীফল লিখ।

উত্তর: ভাবীফল- আক্রমণের সংখ্যা ও গুরুত্বের উপর পীড়ার নিরাময় নির্ভর করে, যত অল্প বয়সে পীড়া আরম্ভ হয়, স্টেটাস এপিলেপ্টিকাস অবস্থায় মৃত্যুর সম্ভাবনা তত বেশী। ফিট কম বা বন্ধ হইলেও শিশুকালের রোগীরা প্রায় জড়বুদ্ধি প্রাপ্ত হয়। যৌবনে পীড়া আরম্ভ হইলে ভাবী উপর্গের মধ্যে ম্যানিয়া, বাতিকগ্রস্তভাব অধিক দেখা যায়। পেটিটমাল বয়োবৃদ্ধি হইলে আরোগ্য হয়। গ্রান্ড মাল আরোগ্য সন্দেহজনক।



প্রশ্ন- এপিলেন্সী বা মৃগী রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং পথ্য লিখ এবং এই পীড়ায় ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ লিখ।

উত্তর: চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা- রোগীর ফিট হইলে নরম বিছানায় শয়ন করানো উচিত। দেহের কোনস্থানে যাহাতে কোন প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে দৃষ্টি রাখা দরকার। এই পীড়ায় কনভালশনের সময় দাঁতি লাগে, তাহাতে জিভ কাটিয়া যাইবার সম্ভাবনা বেশী। সেজন্য জ্ঞান না আসা পর্যন্ত দাঁতের দুই পাটির মধ্যে শক্ত কর্ক রাখা উচিত। আক্রমণের সময় বার বার এমিল নাইট মাদার ৫/৭ ফোঁটা রুমালে ঢালিয়া নাকের কাছে ধরিলে খেঁচুনির উপকার হয়। মুক্ত বাতাসে বেড়ানো ভাল। মানসিক চিন্তা, মানসিক পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত থাকা উচিত নয়। স্ত্রী সহবাস বর্জনীয়।

পথ্য- নিয়মিত ও পরিমিত ভোজন এবং ধীরে ধীরে আহার করা কর্তব্য। সর্ব প্রকার মাদকদ্রব্য বর্জনীয়। মাছ মাংস অপথ্য। শুধুমাত্র নিরামিষ শাক সবজি, ডাল ভাত, পাকা ফল, ময়দা, আটা, মানকচু মোচা ডুমুর প্রভৃতি ব্যবস্থেয়। সাধারণ স্বাস্থোন্নতির জন্য পুষ্টিকর। আহার ও বায়ু পরিবর্তন বিধেয়।
ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ:-

১) কুপ্রাম মেট- অত্যন্ত খেঁচুনি, মুখমণ্ডল নীলবর্ণ। দাঁত কপাটি লাগা, মুখ দিয়া ফেনা উঠা, সর্বাঙ্গ শক্ত। ফিটের পূর্বে গা বমি বমি, মুখ দিয়া শ্লেষ্মা নির্গত, তলপেট ফুলিয়া যায়, হাত পা বাঁকিয়া শরীরের দিকে আসে, সুড়সুড় করে, ডানহাতে ছিঁড়িয়া ফেলার ন্যায় বেদনা। ইহাতে ফিট দীর্ঘ স্থায়ী হয় এবং ফিটের পূর্বে নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়ে। অসাড়ে প্রস্রাব করে, শরীর কাঁপে।

২) সাইকিউটা- আক্ষেপ হইয়া সমস্ত শরীর পিছন দিকে ধনুকের মত বাঁকিয়া
যায়, সারা শরীর শক্ত হইয়া যায়, চক্ষু স্থির হয়, পা হইতে মাথা পর্যন্ত ঝাঁকি দিয়া উঠে। মুখাবয়ব নীলাভ হয় এবং মুখে ফেনা কাটে। সামান্য স্পর্শে, গোলমাল কিংরা ঝাঁকি লাগিলেই আবার আক্ষেপ হয়। ঝাঁকুনি আরম্ভ হইলে রোগীর চোয়াল আটকাইয়া যায়, জিহ্বা কাটিয়া যায়।

৩) বিউফোরানা- হস্তমৈথুনজনিত রোগ। পুরাতন মৃগী রোগের পক্ষে উপকারী। অতিরিক্ত শুক্রক্ষরণ হেতু পীড়ার উৎপত্তি, রাত্রে আক্রমণ বেশী হয়, রোগী কয়েক ঘন্টা অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া থাকে। অসাড়ে প্রস্রাব করে। ঊর্ধ অপেক্ষা নিম্নাঙ্গ অধিক আক্ষিপ্ত।

৪) এবসিন্থিয়াম- মৃদু প্রকৃতির মৃগী, প্রায়ই কম্পনসহ রোগাক্রমণ। বিকৃত মুখমণ্ডল। খেঁচুনি, দাঁত কপাটি লাগা, ঠোঁট ও জিড় কামড়ানো। মুখ দিয়া ফেনা উঠে। আক্রমণের পূর্বে স্নায়বিক কম্পন। হঠাৎ তীব্র বমি, প্রলাপ, সংজ্ঞালোপ, নিদ্রাহীনতা। মাথাঘোরে, রোগী পিছন দিকে পড়িয়া যায়।

৫) ট্যারেন্টুলা- রোগীর ঘন ঘন ফিট। রক্তহীনতা সহ পীড়া, তাণ্ডব রোগ, মেরুদণ্ডের উপদাহ, অতিশয় অস্থিরতা অনবরত নড়াচড়া করে, মাথায় তীব্র বেদনা, মনে হয় সুই ফুটাইতেছে। পায়ের দুর্বলতা, পায়ের আড়ষ্টভাব।

ইহা ছাড়া লক্ষণানুযায়ী হায়োসিয়ামস, কষ্টিকাম, ক্যানাবিস ইন্ডিকা, আর্টিমিসিয়া ভালগ, স্ট্র্যামোনিয়াম, স্ট্যানাম, প্লাম্বাম, এসিড হাইড্রো, হায়োসিয়ামস, আর্জেন্টনাইট, কস্টিকাম, বেলেডোনা প্রভৃতি ঔষধও ব্যবহৃত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ