হোমিওপ্যাথির মূলনীতি - নিয়মনীতি - ১ম বর্ষ - পঞ্চম অধ্যায়

 পঞ্চম অধ্যায়
হোমিওপ্যাথির মূলনীতি
(Basic Principles of Homoeopathy)



প্রশ্ন-৫.১। বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি কি? আলোচনা কর। 
অথবা, আরোগ্যের বিশ্বজনীন নিয়ম “সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার আলোচনা কর।
অথবা, সদৃশনীতি অনুসারে আরোগ্য সম্পাদনের প্রক্রিয়া বর্ণনা কর। 
অথবা, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বা সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধ কি প্রক্রিয়ায় আরোগ্য সাধন করে ?

উত্তর : বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি হইল “Similia Similibus Curentur" অর্থাৎ সদৃশ বিধানে আরোগ্য সাধন। সংস্কৃতে বলা হয় “সমঃ সম সময়তি" এবং ইংরেজীতে বলা হয় “Let like be cured by like"। আরোগ্যের জন্য রোগ ও ঔষধ সদৃশ হইতে হইবে। সুস্থ মানবদেহে কোন ঔষধ প্রয়োগ করিলে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় সে সমস্ত লক্ষণবিশিষ্ট কোন রোগীতে সেই ঔষধ প্রয়োগ করিলে রোগী আরোগ্য লাভ করে। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে এই সদৃশনীতিতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে কেন এবং কিভাবেই বা আরোগ্য সম্পাদিত হয়। হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য নীতি নিউটনের গতি বিষয়ক তৃতীয় সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নীতিটি হইল : প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সুস্থ জীবনীশক্তি যদি রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহা হইলে জীবনীশক্তির বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং লক্ষণাকারে ইহা দেহের বিভিন্ন অংগে প্রকাশ পায়, ইহার নাম রোগ। আবার সদৃশবিধান মতে সুস্থ দেহে রোগাৎপাদিকা শক্তি সঞ্জীব সত্তার সংস্পর্শে আসিয়া প্রাকৃতিক রোগের অনুরূপ অথচ প্রবলতর এক কৃত্রিম রোগ সৃষ্টি করে। যেহেতু সদৃশ বিধান মতে প্রয়োগকৃত ঔষধের শক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী, তাই ঔষধ দ্বারা সৃষ্ট লক্ষণারাজিও প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ অপেক্ষা প্রবলতর হইবে। সজীব দেহে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম রোগ একসাথে দুইটি রোগের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যে প্রবলতর সদৃশ রোগলক্ষণ সৃষ্টি হয় তাহাতে পূর্বতন প্রাকৃতিক রোগের দুর্বলতর লক্ষণগুলি বিলীন হইয়া যায়। দুর্বলতর রোগলক্ষণসমূহ বিলীন










প্রশ্ন:- এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর:- ঔষধের প্রকৃতি, নীতি, প্রয়োগ পদ্ধতি ও ক্রিয়াফলের উপর ভিত্তি করিয়া হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক ঔষধের পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হলো। 


হইয়া যাওয়ার পর জীবনীশক্তি রোগশক্তির প্রভাবমুক্ত হয় ঠিকই কিন্তু ঔষধ শক্তির প্রভাবে আচ্ছন্ন থাকে। যেহেতু হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ হয় তাই ইহার ক্রিয়া যদিও প্রবলতর কিন্তু ক্রিয়াকাল ক্ষণস্থায়ী। ঔষধের ক্রিয়াকাল শেষ হইলেই ঔষধজাত সমস্ত লক্ষণ তিরোহিত হয় এবং জীবনীশক্তি ইহার প্রভাব মুক্ত হইয়া সুস্থ হইয়া উঠে । ইহাই হোমিওপ্যাথির সদৃশ বিধানবিষয়ক প্রাকৃতিক নিয়ম বা সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার।



প্রশ্ন- সদৃশ বিধান যে বিশ্বজনীন আরোগ্যের একমাত্র প্রাকৃতিক নিয়ম তাহা কিভাবে প্রমাণিত হয়?
বা, রোগ লক্ষণের সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ ছাড়া রোগ আরোগ্য হইতে পারে না কেন?
বা, দেখাও যে হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য প্রাকৃতিক আরোগ্যের নিয়ম অনুসারে সংঘঠিত হয়।

উত্তর ঃ আরোগ্য বিধানের জন্য আমাদের নিকট একটি পথই খোলা আছে, উহার ভিত্তি হইল প্রকৃতিকে নির্ভুলভাবে অনুসরণ করা অর্থাৎ প্রকৃতির ক্রিয়া ধারার পর্যবেক্ষণ। সতর্ক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে হোমিওপ্যাথিক রীতি বলা হয়। প্রাকৃতিক নিয়ম বলিতে আমরা বুঝি সেই সব চিরন্তন বিধান যে গুলি দ্বারা কোন প্রাকৃতিক ঘটনার সামগ্রিক গতিধারা প্রকাশ করা হয়। মানুষের দেহে রোগের সংক্রমন ও বিকাশের সময় তাহার স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। কতকগুলি চিহ্ন ও লক্ষণ এই রোগাবস্থার এক সামগ্রিক চিত্র আমাদের নিকট তুলিয়া ধরে। ঔষধ প্রয়োগে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়, রোগলক্ষণসমূহ অন্তর্নিহিত হয়, রোগী আরোগ্য লাভ করে। এখানে দেখা যায় রোগ ও ঔষধের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কোন শাশ্বত সম্পর্ক রহিয়াছে যাহার উপর আরোগ্য ক্রিয়া নির্ভরশীল। সেই সম্পর্কটি কি? অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়াছে যে, ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে, ঠিক যেমন প্রাকৃতিক রোগ শক্তি সুস্থদেহে রোগের সংক্রমন ঘটায়। সুস্থদেহে ঔষধ প্রয়োগে মানবের সমস্ত প্রাণসত্তার অবস্থার গুনগত পরিবর্তন ঘটায় যাহার প্রতিফলন হয় উৎপন্ন লক্ষণ সমূহের এক সামগ্রিক রূপে। রোগাবস্থায় প্রদত্ত ঔষধ এই লক্ষণসমষ্টি দূর করিয়া রোগীকে সুস্থাবস্থায় ফিরাইয়া আনে। কাজেই সুস্থ দেহে ঔষধ প্রয়োগ জনিত লক্ষণসমষ্টির জ্ঞান আমাদের রুগ্নাবস্থায় ঔষধের প্রয়োগ ক্ষেত্রকে সুনির্দিষ্ট করিয়া দেয়। রোগ ও ঔষধ সদৃশ। যে ঔষধের যে রোগ উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে, সেই ঔষধের সেই রোগ দূর করারও ক্ষমতা আছে। সদৃশ মতে ঔষধ প্রয়োগের ফলে ঔষধের প্রাথমিক ক্রিয়া হইল রোগীতে যে লক্ষণসমূহ বর্তমান আছে তদ্রূপ লক্ষণ উৎপাদন করা। লক্ষণসমূহের সাদৃশ্য হেতু সেই সব লক্ষণ প্রাকৃতিক রোগ দ্বারা অধিকৃত স্থান সমূহেই প্রকাশিত হয় এবং তেমনি ভাবে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। দুই সমভাবাপন্ন শক্তি তখন একই সময়ে একই ভূমিতে ক্রিয়াশীল থাকে। এরপর শুরু হয় ঔষধের গৌণ ক্রিয়া যাহ্য প্রাথমিক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া। ঔষধের শক্তি প্রাকৃতিক রোগ শক্তি অপেক্ষা বলবত্তর কিন্তু ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রদত্ত হয় বলিয়া স্বল্পকাল স্থায়ী। অতএর ঔষধের প্রবলতর শক্তিতে রোগের দুর্বলতর শক্তি বিলীন হইয়া যায়। ফলে রোগশক্তির কোন অস্তিত্ব আর থাকে না। ঔষধের ক্রিয়াকাল শেষ হইলে তাহার সৃষ্ট লক্ষণসমূহও তিরোহিত হয়। ইহাই সদৃশ বিধান বা হোমিওপ্যাথি এবং আরোগ্যের একমাত্র প্রাকৃতিক নিয়ম ।



প্রশ্ন- হ্যানিমান আরোগ্যের কি প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করেন?

উত্তর : আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম এই যে, জীবদেহের মধ্যে অদৃশ্য ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন দুইটি পীড়ার মধ্যে যদি একটি অপরটি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী হয় এবং উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিন্তু দৃশ্যতঃ অত্যধিক সদৃশ হয় তাহা হইলে শক্তিশালী পীড়াটি দূর্বলতর পীড়াটিকে চিরকালের জন্য ধ্বংস করিয়া দেয়।



প্রশ্ন- প্রাকৃতিক আরোগ্যর নিয়ম হইতে কি শিক্ষা লাভ করা যায়? 

উত্তর ঃ প্রাকৃতিক আরোগ্যের নিয়ম হইতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি শিক্ষা লাভ করা যায়
১) প্রকৃত পীড়ার কারণ এবং প্রকৃত আরোগ্যকারী ঔষধের ক্রিয়া ইহারা উভয়ই অদৃশ্য।
২) আরোগ্যের ক্ষেত্রে ঔষধের উৎপত্তির মূল ও পীড়ার উৎপত্তির মূল ভিন্ন হওয়া প্রয়োজন।
৩) আরোগ্য কল্পে ঔষধ শক্তি কর্তৃক সৃষ্ট লক্ষণসমষ্টি সমধিক সদৃশ।
৪) আরোগ্য করে ঔষধশক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী।
উল্লেখিত অবস্থাতেই প্রকৃত আরোগ্য সম্ভবপর।



প্রশ্ন-  দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক পীড়া একই শরীরে প্রবেশ করিলে সবল পীড়াটি দূর্বল পীড়াটিকে দূর করিয়া দেয় ইহা হইতে আমরা কি শিক্ষা লাভ করিতে পারি?

উত্তর ঃ হ্যানিমানের মতে “জীবশরীরে অদৃশ্য কারণজ দুইটি পীড়ার মধ্যে যদি একটি অপরটি অপেক্ষা বলবত্তর হয় এবং উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিছু দৃশ্যতঃ অত্যধিক সদৃশ হয় তবে বলবত্তরটি দুর্বলতরটিকে চিরকালের জন্য ধ্বংস করে।" এখানে অদৃশ্য কারণজ দুইটি, পীড়া বলিতে কি বুঝায়? অদৃশ্য কারণজ একটি পীড়া হইল প্রাকৃতিক পীড়া যাহাকে আমরা রোগ বলি। রোগীদেহে কতকগুলি লক্ষণ প্রকাশিত হয়। যাহা দ্বারা আমরা বুঝি যে মানব রোগাক্রান্ত হইয়াছে। আবার ঔষধেরও রোগ লক্ষণসমূহের সদৃশ লক্ষণ উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে। সদৃশ ঔষধটি প্রাকৃতিক রোগের সমলক্ষণ সম্পন্ন লক্ষণসমষ্টি উৎপাদন করে । তাহা হইলে দেখা যায় যে প্রকৃত আরোগ্যকারী ঔষধ ও প্রকৃত রোগের কারণ ইহারা উভয়ই অদৃশ্য এবং আরোগ্য করে ঔষধের উৎপত্তির মূল ও রোগের উৎপত্তির মূল বিভিন্ন। উৎপত্তির মূল বিভিন্ন হইলেও ঔষধের এবং রোগের শক্তি কর্তৃক উৎপন্ন লক্ষণ সমূহ সমধিক সদৃশ। ঔষধের সৃজশক্তি রোগের সুক্ষ্মশক্তি অপেক্ষা বলবস্তুর বিধায় ঔষধ প্রয়োগে দুর্বলতর রোগটি চিরদিনের জন্য হয়। এই কথাটি হইতে আমরা এই শিক্ষা লাভ করিতে পারি যে, প্রাকৃতিক নিয়মে বা সদৃশ লক্ষণ মতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে পীড়া সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়।



প্রশ্ন-  বিসদৃশনীতিতে আরোগ্য সাধন হয় না কেন?
বা, অসমলক্ষণ সম্পন্ন রোগ বা ঔষধ অধিকতর শক্তিসম্পন্ন হইলেও কোন রোগ আরোগ্য করিতে পারে কি না?

উত্তর ঃ হ্যানিমানের মতে যদি কোনও ঔষধ রোগের সদৃশতম লক্ষণ সমষ্টি উৎপাদন করিতে পারে এবং রোগের শক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী হয় তবেই তাহা রোগ দূর করিতে পারে। ইহার সমর্থনে তিনি বলিতেছেন যে অসমলক্ষণে কিছুতেই রোগ আরোগ্য হয় না। অসমলক্ষণে তিন প্রকার অবস্থার সৃষ্টি হইতে পারে। 
১) যদি একই মানব শরীরে দুইটি বিসদৃশ প্রাকৃতিক রোগ উপস্থিত হয় এবং যদি প্রথম রোগটি দ্বিতীয়টি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী বা সমানও হয় তবে বিসদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন নবাগত পীড়াটি শরীরে প্রবেশই করিতে পারে না। এই ক্ষেত্রে বিসদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন। ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় কোনও উপকারই হয় না।
২) প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রথম রোগটি যদি দ্বিতীয়টি অপেক্ষা দূর্বলতর হয়, তবে দ্বিতীয়টি যতক্ষণ থাকে, প্রথমটিকে দমন করিয়া স্থগিত রাখে মাত্র, আরোগ্য করিতে পারে না।
৩) প্রাকৃতিক অবস্থায় বিসদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট হইলে দ্বিতীয় রোগটি অনেক দিন শরীরে থাকিয়া প্রথমটির সহিত রোগী দেহের আপন আপন প্রিয় অংশে নিজ নিজ লক্ষণ প্রকাশ করিতে থাকে। কেহই কাহাকে নিরাময় করিতে পারে না। যদি বহুদিন বিসদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট তীব্র ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয়, তবে ঔষধজ কৃত্রিমরোগ, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক রোগের সহিত যোগ হইয়া নূতন নূতন - লক্ষণ উৎপাদন করে। তাই বিসদৃশ চিকিৎসায় রোগ নিরাময় হয় না, বরং রোগী নানা রূপ অজ্ঞাত জটিল পীড়ায় আক্রান্ত হইয়া থাকে।



প্রশ্ন-  দুইটি বিসদৃশ প্রাকৃতিক পীড়া একে অন্যকে অপসারিত বা দূর করিতে পারে না কেন?

উত্তর ঃ কোন ব্যক্তির দেহে একই সময়ে যদি দুইটি বা তাহার অধিক বিসদৃশ রোগ উপস্থিত হয় তাহা হইলে ইহারা একে অন্যকে ধ্বংস, অপসারণ বা আরোগ্য করিতে পারে না। প্রকৃতি নিজেও বিসদৃশ রোগের সাহায্যে রোগ আরোগ্য করিতে পারে না। নবাগত পীড়াটি যদি পুরাতন পীড়ার সমান বলশালী বা দুর্বলতর হয় তাহা হইলে নৃতনটি পুরাতনটির দ্বারা বিতাড়িত হইবে এবং দেহে কোন ক্রিয়া প্রকাশ করিতে পারে না। কিন্তু যদি নবাগত পীড়াটি প্রবলতর হয় তবে তাহার সংক্রমণে দূর্বলতর পূর্বোক্ত পীড়াটির ক্রিয়া সাময়িক ভাবে স্থগিত থাকে এবং নবাগতটির ক্রিয়াকাল শেষ হইলে প্রথমটির আবার আবির্ভাব ঘটে। মৃগীরোগে আক্রান্ত শিশুর মাথায় দাদ রোগের সংক্রমন ঘটিলে মৃগীরোগের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়। পরে দাদ রোগ বিলীণ হইয়া যাওয়ার পর মৃগীরোগ আবার দেখা দেয়।
সকল বিসদৃশ পীড়া সম্বন্ধে একই কথা, শক্তিশালীটি দুর্বলতরটিকে দমন। করিয়া রাখে। কিন্তু পরস্পরকে আরোগ্য দান করিতে পারে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুইটি পীড়া ইহাদের বৈশিষ্ট্যে একটি হইতে অন্যটি ভিন্নতর বলিয়া একে অন্যকে বাধা না দিয়া অবস্থান ও বিকাশের জন্য যার যার সুবিধা অনুযায়ী শরীরের পৃথক পৃথক অঙ্গ বাদিয়া নয়। অধিকাংশ স্থলে দুইটি পীড়ার একই দেহে অবস্থানের পর অবশেষে এক জটিল পীড়ার সৃষ্টি হয় এবং রোগীকে সংকটাপন্ন করিয়া আরোগ্যের অসাধ্য অবস্থায় উপনীত করে।



প্রশ্ন-  আরোগ্য ও রিকভারীতে পার্থক্য কি?

উত্তর : ঔষধ প্রয়োগে সহজবোধ্য নীতির সাহায্যে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিনা কষ্টে সামগ্রিক ভাবে রোগের দূরীকরণ ও বিনাশসাধন এবং রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরূদ্ধার করণকে আরোগ্য বলে । যে কোন উপায়ে সাময়িক ভাবে আপাততঃ স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাওয়াকে রিকভারী বলে।
রিকভারী প্রকৃতির দান, কোন ঔষধের সাহায্য ছাড়াই রিকভারী হইতে পারে। কিন্তু আরোগ্য প্রকৃতির অবদান নয়। ঔষধের সাহায্য ছাড়া আরোগ্য আসে না। রিকভারীতে স্বাস্থ্যের প্রত্যবর্তন হয় আর আরোগ্যে স্বাস্থ্যের পুনরূদ্ধার হয়। রিকভারীতে রোগ প্রবণতা দূর হয় না, তাই স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরিয়া পায় না। আরোগ্যে রোগ প্রবণতা দূর হয়, ফলে স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরিয়া পায়। পরাজিত ও অসুস্থ করে। তাই রোগশক্তি সমূহ হইতে ঔষধশক্তি অধিকতর কর্মক্ষম, স্বাধীন ও শক্তিশালী।




প্রশ্ন-  ঔষধ শক্তি কি বিনাশর্তে জীবনী শক্তিকে আবিষ্ট বা অসুস্থ করিতে পারে?

উত্তর : রোগোৎপাদিকা শক্তিসমূহের মানব স্বাস্থ্যের পরিবর্তন করিবার শক্তি বিভিন্ন প্রকার অবস্থার অধীন। কিন্তু ঔষধের শক্তি অবাধ ক্রিয়াশীল। ঔষধশক্তি প্রতিটি জীবিত মানুষের উপর সর্বকালে সর্ব অবস্থায় ক্রিয়া করিয়া থাকে অর্থাৎ ঔষধ শক্তি দ্বারা প্রতিটি মানুষই অসুস্থ হয়। এই অসুস্থতা শর্তবিহীন ভাবে হইয়া থাকে। অর্থাৎ ঔথমজনিত পীড়া কৃত্রিম, সুস্থ দেহে রোগজ লক্ষণ উৎপাদন করার জন্য ঔষধ প্রযুক্ত হইলেই যথেষ্ট। প্রযুক্ত ঔষধ দ্বারাই কৃত্রিম রোগ বিনাশর্তে উৎপন্ন হইয়া থাকে। ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি ব্যাপারে জীবনীশক্তির রোগ প্রবণতার শর্তাধীন নয়। ঔষধ বিনা শর্তেই সুস্থকে অসুস্থ করিতে পারে। যদি ঔষধের মাত্রা যথেষ্ট বৃহৎ হয় তাহা হইলে তাহার মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত লক্ষণ প্রকাশ পাইয়া থাকে। জীবিত মানবদেহ ঔষধশক্তির দ্বারা অধিক অভিভূত হইয়া থাকে এবং রোগীর স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটিয়া থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক রোগশক্তি অনুকূল শর্ত সাপেক্ষেই (প্রবণতা) ক্রিয়া করিয়া থাকে।




প্রশ্ন-  বিসদৃশ, বিপরীত এবং সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট ঔষধে পার্থক্য কি?

উত্তর : বিসদৃশ বা এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয় যে, সেই সব ঔষধ সুস্থ দেহে এমন রোগলক্ষণ সৃষ্টি করে যাহার সঙ্গে রুম ব্যাক্তির রোগলক্ষণের কোন সাদৃশ্য থাকে না।
বিপরীত বা এন্টিপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন ঔষধ যারা চিকিৎসা করা হয় যে, ঔষধ রোগ লক্ষণের বিপরীত লক্ষণ সৃষ্টি করিতে পারে।
সদৃশনীতি বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। যাহা সুস্থ মানবদেহে রোগ লক্ষণের সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করিতে পারে।




প্রশ্ন- ঔষধের মুখ্য ক্রিয়া ও গৌণ ক্রিয়া বলিতে কি বুঝ?

উত্তর : প্রত্যেক ঔষধেরই প্রাথমিক বা মুখ্য ক্রিয়া এবং গৌণ ক্রিয়া আছে। কোন ঔষধ সেবনের অব্যবহিত পরে তাহার ফলে যদি মানব স্বাস্থ্যের অবস্থান পরিবর্তন হয় অর্থাৎ ভাল হইতে মন্দ বা মন্দ হইতে ভালো হয়, জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ঔষধের এই ক্রিয়াকে তাহার প্রাথমিক বা মুখ্য ক্রিয়া বলে। এই ক্রিয়াটি ঔষধের শক্তি জীবনীশক্তির সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়। কেননা মৃতদেহে জীবনীশক্তির অস্তিত্ব নাই তাই ঔষধ ক্রিয়া করিতে পারে না। তাই ঔষধের মুখ্য ক্রিয়ার জন্য দেহে জীবনীশক্তির অস্তিত্ব আবশ্যক। যদিও ঔষধ ও জীবনীশক্তির মিলিত ক্রিয়া হইতে ঔষধের মুখ্য ক্রিয়া উদ্ভুত, তথাপি প্রধানতঃ ঔষধ দ্বারাই এই ক্রিয়াটি সাধিত হইয়া থাকে।
প্রথমে যখন ঔষধ শক্তি জীবনীশক্তির উপর কার্য করে, তখন জীবনী শক্তি নিশ্চেষ্ট ভাবে তাহা গ্রহন করিয়া কেবল বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশ করে। তারপর যখ ইহা সেই সকল পরিবর্তনের প্রতিকারকল্পে কার্য আরম্ভ করে তখন তাহাকে প্রতিক্রিয়া ও ঔষধের গৌণ ক্রিয়া বলে। ঔষধের মুখ্য ক্রিয়ার বিরুদ্ধে জীবনীশক্তি তাহার নিজ ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগ জীবনীশক্তির বৈশিষ্ট্য। ঔষধ শক্তির বিরুদ্ধে জীবনী শক্তির এই প্রতিক্রিয়াকে গৌণ ক্রিয়া বলে। মুখ্য ক্রিয়া প্রধানতঃ ঔষধের ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া তথা গৌণ ক্রিয়া জীবনীশক্তির ক্রিয়া।




প্রশ্ন- ভেষজশক্তির মুখ্য ক্রিয়া ও জীবনীশক্তির গৌণ ক্রিয়ার সংঘর্ষে কিভাবে আরোগ্য সাধিত হয়?

উত্তর : মুখ্য ক্রিয়া ও গৌণ ক্রিয়ার সংঘর্ষে কিভাবে আরোগ্য কার্য সাধিত হয়, সে বিষয়ে বলা যাইতেছে যে আমাদের সুস্থ দেহে যখন কৃত্রিম রোগ সৃষ্টিকারী ঔষধ তাহার প্রাথমিক ক্রিয়া প্রকাশ করে তখন জীবনীশক্তি একেবারে নিশ্চেষ্ট ও নিরপেক্ষ থাকিয়া ঔষধের ক্রিয়া হইতে দেয়। ফলে ঔষধ শক্তি অবাধে উহার ক্রিয়া প্রকাশ করিয়া স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটাইয়া থাকে। কিন্তু শীঘ্রই জীবনীশক্তির এই নিশ্চেষ্ট ভাব কাটিয়া যায়। হঠাৎ যেন জীবনীশক্তির মোহনিদ্রা ভাঙ্গিয়া প্রতিরোধ প্রস্তুত হয়। জীবনীশক্তি হঠাৎ জাগত হইয়া ইহার স্বভাব সুলভ প্রতিক্রিয়া আরম্ভ করে। যে হারে ঔষধ উহার মুখ্য ক্রিয়া করিয়াছিল, উহার তীব্রতার অনুপাতে জীবনীশক্তি তাহার প্রতিক্রিয়া বা গৌণ ক্রিয়া প্রকাশ করে। জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া সাধারণতঃ দ্বিমুখী।
(ক) মুখ্য ক্রিয়ার ফলে স্বাস্থ্যের বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয়, মুখ্য ক্রিয়া যত প্রবল হয় জীবনীশক্তিও তত প্রবল ভাবে প্রতিক্রিয়া চালায়।
(খ) যদি প্রকৃতির মধ্যে মুখ্য ক্রিয়ার বিপরীত কোন অবস্থা না থাকে, তবে জীবনীশক্তির নিরপেক্ষভাবে কাজ করিয়া বাহির হইতে তাহার উপর যে পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে অর্থাৎ ঔষধ সৃষ্ট পরিবর্তন সমূহ অপনোদনের জন্য স্বীয় শ্রেষ্ঠ শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করে এবং স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক অবস্থা আনয়ণ করে। জীবনী শক্তির এই যে গৌণ ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া তাহাকে আরোগ্য সাধিকা ক্রিয়া বলা হয়।
 



প্রশ্ন-  হোমিওপ্যাথিক ঔষধের দরুন স্বাস্থ্যের পরিপন্থি গৌণ ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় কি?
বা, সমলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধের ক্ষুদ্রমাত্রার গৌণ ক্রিয়া ও অসমলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধের বৃহত্তমাত্রার গৌণ ক্রিয়ার পার্থক্য কি?

উত্তর ঃ প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া আছে। মুখ্য ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হইলো গৌণক্রিয়া। ঔষধের প্রাথমিক ক্রিয়া বা মুখ্য ক্রিয়ার ফলে জীবনীশক্তি প্রতিক্রিয়া বা গৌণ ক্রিয়া প্রকাশ করে।
মুখ্য ক্রিয়া যদি প্রচন্ড হয় তবে গৌণ ক্রিয়াও প্রচন্ড হইবে, আর মুখ্য ক্রিয়া মৃদু হইলে গৌণ ক্রিয়াও মৃদু হইবে ।
এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বা অসম লক্ষণ মতে চিকিৎসায় স্থূল ও বৃহৎ মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগের ফলে জীবনীশক্তি যে গৌণ ক্রিয়া সৃষ্টি করে তাহা স্বাস্থ্যের জন্য পরিপন্থী। কারণ তীব্র ঔষধের গুরু মাত্রায় উৎপন্ন প্রচন্ড মুখ্য ক্রিয়ার প্রতি জীবনীশক্তির ততোধিক প্রতিক্রিয়ার ভীষন সংঘাতে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। পূর্বেই রোগ ভোগ করিয়া রোগী এত দুর্বল হইয়া পড়ে যে, এই প্রবল প্রক্রিয়ার মত প্রতিঘাত রোগী সহ্য করিতে পারে না।
হোমিওপ্যাথিতে ঔষধের স্বল্প মাত্রা প্রয়োগ হয় বিধায় সুস্পষ্ট গৌণক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। সদৃশ লক্ষনের হোমিওপ্যাথির প্রতিটি সূক্ষ্মমাত্রাতেই ঔষধের মুখ্য ক্রিয়া ঘটিয়া থাকে। একজন যথেষ্ট মনোযোগী পর্যবেক্ষক অবশ্যই প্রত্যক্ষ করিতে পারিবেন যে, ঔষধের এই মুখ্য ক্রিয়ার বিরুদ্ধে জীবন্ত যান্ত্রিক দেহ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যে পূণঃ প্রতিষ্ঠার আবশ্যকীয় প্রতিক্রিয়াটুকুই চালায়। এখানে জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া খুবই সামান্য। স্বাস্থ্যের পরিপন্থী কোন গৌণ ক্রিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগে পরিলক্ষিত হয় না ।




ভেষজ পরীক্ষণ (Proving of Drugs)

প্রশ্ন- ড্রাগ প্রুডিং বা ভেষজ পরীক্ষা কাহাকে বলে?

উত্তর ঃ ভেষজকে আরোগ্যদায়িনী শক্তিরূপে ব্যবহার করিতে হইলে তাহার রোগোৎপাদিকা শক্তির পূর্ণ পরিচয় জানা আবশ্যক। প্রতিটি ভেষজ পরিমিত মাত্রায় সুস্থ মানবদেহের উপর প্রয়োগ করিয়া পরীক্ষা করা ব্যতীত তার সার্বিক পরিচয় জানার আর কোন নিশ্চিত ও স্বাভাবিক পথ নাই। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ভেষজের পরীক্ষা দ্বারাই কেবল আমরা জানিতে পারি কোন ভেষজ দেহতন্ত্রে কি ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিতে সক্ষম। ভেষজের অন্তর্নিহিত শক্তির সম্যক পরিচয় লাভ করার উদ্দেশ্যে সুস্থ মানবদেহে ভেষজের বিধিসম্মত পরীক্ষাকে ভোজের গুনাগুন পরীক্ষা বা ড্রাগ প্রুভিং বলে।






প্রশ্ন ঃ প্রকৃত মেটিরিয়া মেডিকা কি?
বা, মেটিরিয়া মেডিকা কাহাকে বলে?

উত্তর : প্রতিটি অবিমিশ্র ভেষজ সুস্থ মানবদেহে বহু স্থানে বহুবার পরীক্ষা করিয়া সেগুলি যে সব রোগ উৎপাদন ও লক্ষণ সৃষ্টি করে বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে সেগুলি যদি আমরা যত্ন ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সহজ, সরল ভাষায় লিপিবন্ধ করি তাহা হইলেই প্রকৃত মেটিরিয়া মেডিকা বা ভৈষজ্য বিজ্ঞান প্রস্তুত হয়। ইহা প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর এক গ্রন্থ যেখানে প্রাকৃতিক ভেষজরাশির গুনাবলীর পরিচয় এমন ভাবে লিপিবদ্ধ করা আছে যে তাহাদের সদৃশ চিত্র আরোগ্যযোগ্য বহু সংখ্যক প্রাকৃতিক পীড়ায় দেখা যায়।





প্রশ্ন- খাঁটি মেটিরিয়া মেডিকা কিভাবে প্রস্তুত হয়?

উত্তর : সুস্থ মানবদেহে ভেষজ পরীক্ষা করিয়া যে লক্ষণ সমূহ পাওয়া যায় সেগুলিকে একত্রে সন্নিবিষ্ট করিলেই মেটিরিয়া মেডিকা প্রস্তুত হয়না। এই জন্য সংগৃহীত সমস্ত লক্ষণকে ভাল ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করিয়া শ্রেণীবদ্ধ করিতে হইবে। তারপর সেগুলিকে ব্যাপক লক্ষণ, স্থানিক লক্ষণ ও সাধারণ লক্ষণ হিসাবে যুক্তিসংগতভাবে শ্রেনীবিভাগ করিতে হইবে। এরপর লক্ষণ সমূহকে তাহাদের দেহের প্রকাশ স্থল, অনুভূতি, হ্রাসবৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক লক্ষণ হিসাবে সম্পূর্ণ করিতে হইবে এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই সব লক্ষণকে সাজাইতে হইবে। মূল উদ্দেশ্য হইবে প্রতিটি পরীক্ষিত ভেষজের একটি সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপিত করা যায়। প্রতিচ্ছবি আমরা সর্বদাই প্রাকৃতিক ব্যাধিতে পাইয়া থাকি। খাঁটি মেটিরিয়া মেডিকা হইল হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহৃত ঔষধসমূহের অভ্রান্ত লক্ষ। পঞ্জিকা যাহাতে সুস্থদেহে ঔষধ সৃষ্ট কৃত্রিম পীড়ার প্রামান্য বর্ণনা দেওয়া আছে।





প্রশ্ন-  ঔষধ পরীক্ষার উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা কি?

উত্তর : ঔষধ পরীক্ষার সময় এই পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাদের সব সময় স্মরণ রাখা উচিত। সুস্থ দেহে ঔষধ পরীক্ষার উদ্দেশ্য হইল-
(১) প্রতিটি ঔষধের রোগোৎপাদিকা শক্তির পূর্ণ পরিচয় বিশদ ভাবে জানা, অর্থাৎ সুস্থাবস্থায় দেহযন্ত্রের ক্রিয়ায় ও অনুভূতিতে কিরূপ বিকৃতি সাধন করে তাহা জানা
২) প্রতিটি ঔষধের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যাবলীর স্বাতন্ত্র্য অনুধাবণ করা ও অন্য ঔষধ হইতে ইহাকে পৃথক করা। 
৩) সদৃশ লক্ষণযুক্ত রোগে এই ঔষধের উপযুক্ত প্রয়োগ বিধি সম্পর্কে জ্ঞান • লাভ করা। ডাঃ রবার্টস বলেন ড্রাগ প্রুভিং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হইল ঔষধ সৃষ্ট রোগের এক জীবন্ত চিত্র অংকন করা যাহাকে রোগীর দেহে দেখা মাত্র আমরা চিনিতে পারে।




প্রশ্ন- সুস্থ মানুষের উপর ঔষধ পরীক্ষার যৌক্তিকতা কি?

উত্তর : কোন ঔষধের অন্তর্নিহিত শক্তির সামগ্রিক পরিচয় শুধুমাত্র সুস্থ মানবদেহে সেই ভেষজের পরীক্ষা দ্বারাই সম্ভব। কেননা একমাত্র সুস্থ মানুষই সঠিক ভাবে বলিতে পারে ঔষধ প্রয়োগের ফলে তাহার দেহে ও মনে কি কি পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া ঔষধের ক্রিয়া মানুষ ও ইতর প্রানীতে অনেক সময় ভিন্ন হয়। সর্বদাই আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, আমরা ঔষধ ব্যবহার করি মানুষের জন্য। স্টুয়ার্ট ক্লোজ বলেন, হোমিওপ্যাথিক ঔষধের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। মানুষের দ্বারা, মানুষের উপর এবং মানুষের জন্য। তাছাড়া রুগ্ন মানুষের উপর পরীক্ষা করিয়া ঔষধের গুনাগুন জানা সম্ভব হয় না। কেননা ঔষধ প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যের যে পরিবর্তন আশা করা যায় তাহা রোগ লক্ষণের সহিত মিশিয়া যায়। ফলে ঔষধ সৃষ্ট স্বাস্থ্যের বিচ্যুতি পরিস্কার ভাবে জানা সম্ভব হয় না। তাই সুস্থ মানুষের উপর পরীক্ষা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নাই যাহা দ্বারা ঔষধ সমূহের গুনাগুনের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যাইতে পারে।




প্রশ্ন- রুগ্ন ব্যক্তির উপর ঔষধ পরীক্ষা করা যায় না কেন?

উত্তর : ভেষজ বা ঔষধ পরীক্ষার উদ্দেশ্যই হইল উহার রোগোৎপাদন ক্ষমতা আবিষ্কার করা। সুস্থকে অসুস্থ না করিয়া ভেষজের রোগোৎপাদন ক্ষমতা জানার আর কোন উপায় নাই। রুগ্ন মানুষের উপর পরীক্ষা করিয়া ভেষজের প্রকৃত গুনাগুন জানা সম্ভব নয়। কারণ রুগ্ন ব্যক্তির দেহ ও মনে প্রাকৃতিক ব্যাধির অশুভ প্রভাবের ফলে পীড়ার লক্ষণ ও ভেষজের লক্ষণগুলি এমন ভাবে মিশ্রিত হইয়া পড়ে যে, তখন কোন লক্ষণটি ভেজ দ্বারা আর কোন লক্ষণটি প্রাকৃতিক পীড়া হইতে উৎপন্ন হইয়াছে তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব হইয়া পড়ে। তখন পরীক্ষাধীন ভেষজের ক্রিয়া স্বতন্ত্র ভাবে পর্যবেক্ষণের কোন উপায় থাকে না এবং ভেষজের অবাধ ক্রিয়া বাধা প্রাপ্ত হয়।
 



প্রশ্ন ঃ ইতর প্রানীর উপর ঔষধ পরীক্ষা নিষিদ্ধ কেন?

উত্তর ঃ আমাদিগকে সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে আমরা ঔষধ ব্যবহার করি মানুষের জন্য, মনুষ্যেতর প্রানীর জন্য নয়। মুক, অসহায়, ইতর প্রানীর উপর হোমিওপ্যাথি কখনও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় না। ঔষধ পরীক্ষার উদ্দেশ্য হইল ঔষধের রোগোৎপাদন ক্ষমতা পরিপূর্ণ ভাবে উদ্ঘাটন করা। অসুস্থকে সুস্থ করিতে না পারিলে ঔষধের রোগোৎপাদন ক্ষমতা জানিবার আর কোন উপায় নাই। ঔষধের রোগোৎপাদন শক্তি জানিবার জন্য ইতর প্রাণীর উপর যদি পরীক্ষা করা হয় তাহা হইলে সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবে। কারণ ইতর প্রাণীর কোন বাকশক্তি নাই ফলে ঔষধের বস্তুনিষ্ঠ লক্ষণ সংগ্রহ করা সম্ভব হইলেও ব্যক্তিনিষ্ঠ ও মানসিক লক্ষণ জানা যায় না। সুতরাং ঔষধ পরীক্ষার মহান উদ্দেশ্য নিরর্থক হইয়া পড়ে।




প্রশ্ন- কাহার উপর হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পরীক্ষা করিতে হইবে?
বা, ড্রাগ প্রুভারের গুণাবলী কি কি?

উত্তর : নিম্নলিখিত ব্যক্তির উপর হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পরীক্ষা করিতে হইবে। 
১) পরীক্ষাকারী সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক হইতে হইলে। ইতর প্রানীর কোন বাকশক্তি নাই। তাই ঔষধের ব্যক্তিনিষ্ঠ ও মানসিক লক্ষণাবলী ইতর প্রানী হইতে জানা যায় না।
২) তীক্ষ্ণ ও ত্বরিৎ বুদ্ধির অধিকারী ও কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির উপর।
৩) পরীক্ষাকারী অকপট, সত্যবাদী ও সৎ ব্যক্তি হইতে হইবে।
৪) হোমিওপ্যাথির উপর দরদ, বিশ্বাস ও ভক্তি আছে এইরূপ ব্যক্তি। 
৫) প্রত্যক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ লক্ষ লক্ষণাবলী চিকিৎসার পরিভাষায় ব্যক্ত করার ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি। 
৬) সুশিক্ষিত ব্যক্তির উপর যাহাতে লক্ষনের প্রকার ভেদ বুঝিতে পারে।



 প্রশ্ন- হ্যানিমান কিভাবে ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন?

উত্তর : ভেষজকে আমরা তখনই ঔষধরূপে ব্যবহার করিতে পারি যখন ইহা সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষিত হইয়াছে। কিভাবে হ্যানিমান ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন সে সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা আছে। ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমান উইলিয়াম কালেনের মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদ করিতেছিলেন। কালেন সাহেবের মেটিরিয়া মেডিকায় মন্তব্য ছিল, যে সিঙ্কোনা কম্পজ্বরের ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়, সেই সিঙ্কোনাই বৃহৎ মাত্রায় প্রয়োগ করিলে কম্পজ্বর সৃষ্টি হয়। কালেন সাহেবের এই মন্তব্যে হ্যানিমান সন্তুষ্ট হইতে না পারিয়া নিজের উপর কয়েকবার পরীক্ষা চালাইলেন। সিঙ্কোনা কম্পজ্বর সারে কেন এই প্রশ্নে হ্যানিমানের কৌতুহলী মন অস্থির হ উঠে। ইহার কারণ জানার জন্য তিনি নিজ সুস্থদেহে সিডোনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তিনি স্কুল মাত্রায় সিঙ্কোনা সেবন করিলেন। ইহার ফলে তাঁহার দেহ ও মনে কম্পজ্বরের যাবতীয় লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই আক্রমণ অতিক্রান্ত হওয়ার কিছুকাল পরে তিনি পুনরায় সিঙ্কোনা গ্রহণ করেন। তাহাতে ঐ একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
হ্যানিমান সিঙ্কোনাকে কম্পজ্বরের নিরসনের উত্তম অস্ত্র হিসেবেই জানিতেন। কিন্তু এখন দেখিলেন সেই সিঙ্কোনা তাঁহার সুস্থ দেহে কম্পজ্বরের আক্রমণ চালাইয়া প্রাকৃতিক কম্পজ্বরের অনুরূপ সদৃশ লক্ষণাবলী উৎপাদনে সক্ষম। তাই তিনি পরিচিত কতিপয় ঔষধ দ্বারা সুস্থ মানব দেহের উপর গভীর পরীক্ষা শুরু করিলেন এবং স্বতন্ত্র ভাবে পরীক্ষিত কতিপয় ঔষধের মধ্যে এই ক্রিয়ানীতি লক্ষ্য করিয়া মুগ্ধ হইলেন। একোনাইট স্কুল মাত্রায় প্রয়োগ করিয়া দেখিতে পাইলেন প্রদাহযুক্ত জ্বরের সূচনা হয়, তার সঙ্গে থাকে পিপাসা, অস্থিরতা ও মৃত্যুভীতি। আবার এইরূপ অবস্থায় একোনাইট সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ করা হইলে সমস্ত উপসর্গ বিলীন হইয়া যায়। এমনিভাবে নাক্স ভমিকা, পালসেটিলা, বেলেডোনা প্রভৃতি ঔষধ পরীক্ষায় একই সত্যের সন্ধান পাওয়া গেল যে ভেষজের রোগোৎপাদিকা শক্তিই তার আরোগ্যদায়িনী শক্তি। যে ভেষজ যে রোগ সৃষ্টি করিতে পারে সেই ভেষজই সেই ধরণের রোগ আরোগ্য করিতে পারে। সুতরাং তিনি দেখিলেন যে, রোগ আরোগ্য করিতে হইলে ঔষধের রোগাৎপাদন ক্ষমতা জানা দরকার এবং তাহা একমাত্র ভেষজ পরীক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এই ভাবে হ্যানিমান ভেষজ পরীক্ষণ নীতিতে উপনীত হইলেন।




প্রশ্ন- ভেষজ পরীক্ষাকালীন পরীক্ষাকারীর কর্তব্য কি?

উত্তর : ভেষজ পরীক্ষা চলাকালীন প্রত্যক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ লব্ধ লক্ষণাবলী চিকিৎসার পরিভাষার প্রকাশ করার জন্য পরীক্ষাকারীকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। পরীক্ষা চলাকালীন তাঁহাকে অনুকুল পরিবেশের মধ্যে থাকিতে হইবে। সকল প্রকার দৈহিক ও মানসিক ক্লান্তি, উদ্বেগ, দুচিন্তা, দুর্ভাবনা, অমিতাচার ইত্যাদি পরিহার করিতে হইবে। তাঁহাকে মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাসিখুশীর মধ্যে থাকিতে হইবে। মনোযোগ বিভ্রান্তকর কোন কার্যে তিনি ব্যস্ত থাকিতে পারিবেন না।



প্রশ্ন-  চিকিৎসকের নিজের উপর ঔষধ পরীক্ষণের সুবিধা কি? 

উত্তর : ভেষজ পরীক্ষার নিমিত্তে চিকিৎসকের নিজের উপর ঔষধ প্রয়োগ করাই উত্তম। একজন স্বাস্থ্যবান, সুখানুভূতি সম্পন্ন ও নিরপেক্ষ চিকিৎসক পরীক্ষার জন্য ঔষধ নিজের উপর প্রয়োগ করিলে ঔষধ কর্তৃক সৃষ্ট লক্ষণাবণী বিস্তারিত সঠিক ও নিঃসংশয় জ্ঞানার্জন করিতে পারেন। চিকিৎসকের নিজের উপর ঔষধ পরীক্ষার সুবিধা নিম্নরূপ :
১) ঔষধের ভেষজগুন তথ্য আরোগ্যকারী শক্তি চিকিৎসকের নিকট নিশ্চিতরূপে প্রমান হয়।
২) নিজদেহে ঔষধ পরীক্ষা করিতে চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ কার্যে ক্রমেই পারদর্শী হইয়া উঠেন যাহা চিকিৎসকের জন্য একান্তই প্রয়োজন।
৩) অন্য লোকের উপর ঔষধ প্রয়োগ করিলে তাঁহার বর্ণনার উপর বিশ্বাস করিতে হয়। তাই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে একটু সন্দেহ থাকিয়া যায়, নিজের উপর প্রয়োগে সে সংশয় থাকে না ।
৪) চিকিৎসকের নিজ অনুভূতি, চিন্তা ও লক্ষণাবলী বুঝার ক্ষমতা এবং এইসব বিষয়ে উৎকর্ষতা জন্যে যাহা একজন চিকিৎসকের জন্য একান্তই প্রয়োজন । 



প্রশ্ন-  স্বাস্থ্যের উপর ঔষধ পরীক্ষণের প্রতিক্রিয়া কি?

উত্তর : সুস্থ মানবদেহে ঔষধ প্রয়োগ করা হইলে ঔষধ শক্তির দ্বারা জীবনীশক্তির সুশৃঙ্খল প্রানক্রিয়া ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়। ফলে দেহের একাধিক যন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই বিশৃঙ্খলা আনয়নকারী ক্রিয়াই ভেষজের রোগ উৎপাদন ক্ষমতা এবং এই রোগ উৎপাদনকরী ক্ষমতা থাকিলেই আমরা তাহাকে ভেষজ বলিয়া থাকি। তাই ভেষজের গুণই হইল ধ্বংসাত্মক। সুস্থদেহে ভেষজের পরীক্ষা হইলে উহার প্রতিক্রিয়া হিসাবে নানারূপ শারীরিক বিশৃংঙ্খলা দেখা দেয়।




প্রশ্ন-  স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের উপর ঔষধ পরীক্ষা করা প্রয়োজন কেন?

উত্তর : স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের উপরই ঔষধ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কেননা স্ত্রী ও পুরুষের প্রধান পার্থক্য তাহাদের লিঙ্গের মধ্যে। তাই কোন ঔষধ প্রয়োগের ফলে জননেন্দ্রিয়ের কিরূপ পরিবর্তন হয় তাহা পর্যবেক্ষণের জন্য স্ত্রী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ঔষধ পরীক্ষা করিতে হইবে।
জননেন্দ্রিয় বলিতে পুরুষের শুক্রাশয়, শুক্রনালী, প্রস্টেট গ্লান্ড, লিঙ্গ প্রভৃতি এবং স্ত্রীলোকদের ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী, ভ্যাজাইনা, জরায়ু, স্তন প্রভৃতি বুঝায় ।




প্রশ্ন- ড্রাগ প্রুভিং বা ভেনজ পরীক্ষার নিয়মাবলী বর্ণনা কর ।

উত্তর : ভেষজ পরীক্ষার দ্বারা আমরা ভেষজের গুনাবলীর যথার্থ পরিচয় পাই এই গুণাগুণ পরীক্ষার উপরই সমগ্র চিকিৎসাকলার যথার্থতা এবং মানবজাতির কল্যাণ নির্ভর করে। সুস্থ দেহে ভেষজ সুপরীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত উহা ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। কারণ ঔষধের রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা জানা না হইলে উহার আরোগ্যকারী ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় না !

১) যে ভেষজটি পরীক্ষা করিতে হইবে উহা সর্বতোভাবে বিশুদ্ধ ও অকৃত্রিম হইতে হইবে। ২) ভেষজ পরীক্ষক বা প্রভারকে অবশ্যই দেহ ও মনে সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে হইবে যাহাতে ভেষজ প্রয়োগ দ্বারা যখন তাহার দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিচ্যুতি ঘটানো হইবে তখন সে অবস্থার সঠিক পরিচয় নির্ধারণ করা সম্ভব।
৩) প্রভারকে অবশ্যই বিশ্বস্ত, বিবেকবান ও সত্যনিষ্ঠ হইতে হইবে। কারণ তাহার প্রদত্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করিয়াই রুগ্ন মানুষে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।
৪) পরীক্ষা চলাকালীন প্রভারের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার স্বাভাবিক বজায় থাকিতে হইবে। তাহা হইলেই ভেষজের ক্রিয়ার ফলে স্বাভাবিক অবস্থা হইতে প্রভারের অবস্থার যে পরিবর্তন ঘটিবে তার প্রকৃত তথ্য পাওয়া সম্ভব হইবে।
পরীক্ষা চলাকালীন প্রভারকে সব রকম দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম, অমিতাচার, কামুকতা, শক্তিক্ষয় ও উত্তেজনা পরিহার করিয়া চলিয়া হইবে। ৫) গ্রুভারের খাদ্য পানীয় নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে। সে সব দ্রব্যে ভেষজগুন বর্তমান সেগুলি খাদ্য হইতে বাদ দিতে হইবে। সব রকম নেশা জাতীয় জিনিস পরিহার করিতে হইবে।
৬) গ্রুভারের বোধশক্তি ও অনুভূতি প্রথর থাকা দরকার।
৭) স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের উপরই ভেষজের পরীক্ষা হওয়া দরকার, রাহাতে যৌন ক্ষেত্রে ঔষধের ক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
৮) সকল লোক ভেষজ দ্বারা একই রকম প্রভাবিত হয় না। বিভিন্ন ব্যক্তিতে বিভিন্ন শক্তিতে ভেষজ পরীক্ষা করিয়াই ইহার গুনাবলীর সার্বজনীনতা জানা যায় ।
৯) ভেষজের প্রকৃতির উপর ভেষজ স্থূলমাত্রা, নিম্নশক্তি বা উচ্চশক্তিতে প্রুভিং করিতে হইবে। তবে স্থূল অবস্থার প্রয়োগ না করিয়া শক্তিকৃত ভেষজ প্রয়োগ করা উচিত।
১০) ভেষজের মাত্রা এমন হওয়া উচিত যাহা প্রানসভাকে সহসা অভিভূত না করিয়া তাহার উপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। প্রথম মাত্রা প্রয়োগের পর যদি উল্লেখযোগ্য কোন লক্ষণ প্রকাশিত না হয় তাহা হইলে দ্বিতীয় মাত্রা প্রয়োগ করা যাইতে পারে। তবে ভেষজের পুনঃ প্রয়োগ নির্ভর করে ভেষজের প্রকৃতি এবং প্রাণ সত্তার প্রতিক্রিয়ার উপর।
১১) ভেষজ প্রয়োগের পর লক্ষণ সমূহ যখন যেভাবে প্রকাশিত হয়, ঠিসেভাবে পারস্পর্য রক্ষা করিয়া সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। প্রতিটি লক্ষণের স্থিতিকাল, অবস্থান, অনুভূতি, হ্রাসবৃদ্ধি এবং আনুষঙ্গিক লক্ষণগুলিও লক্ষ্য করিতে হইবে।
(১২) ভেষজের সর্বোত্তম প্রুভিং সম্ভব হয় যদি স্বাস্থ্যবান, অনুভূতিপ্রবণ ও সংস্কার মুক্ত চিকিৎসক নিজের উপর ভেষজ পরীক্ষা করিয়া ভেষজের প্রুভিং এর যথার্থতা বিচার ও গুনাবলী সম্পর্কে সুনিশ্চিত হইতে পারে। ভেষজ পরীক্ষার পর ভেষজচিত্র সম্পূর্ণরূপে নির্ণীত হইলেই সেই ভেষজ পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয় এবং তখনই আমরা ভেষজকে ঔষধরূপে ব্যবহার করতে পারি।



প্রশ্ন- পরীক্ষাকারীর খাদ্য ও পানীয় কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে? 

উত্তর : পরীক্ষাকালীন পরীক্ষাকারীর খাদ্য ও পানীয় সম্বন্ধে বিশেষ বিচার বিবেচনা করিতে হইবে। অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাদ্য, মাদক দ্রব্য, কাঁচা শষ্য, সালাদ আহার এবং সকল প্রকার উত্তেজক পানীয় বর্জন করিতে হইবে। স্বাস্থ্য রক্ষ। অথচ সহজে পরিপাক হয় এইরূপ লঘুপাক খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করিতে হইবে ।




প্রশ্ন- পরীক্ষিত ঔষধের লক্ষণাবলী কিভাবে লিপিবন্ধ করিতে হইবে?

উত্তর : পরীক্ষিত ঔষধের দ্বারা উৎপাদিত লক্ষণসমূহের আবির্ভাব অনুসারে লক্ষণাবলীর পূর্ণ বিবরণ পরপর লিপিবদ্ধ করিতে হইবে এবং লক্ষণগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করিতে হইবে। 
যথা- ১) অবস্থান ( Location ); 
2 ) অনুভূতি (Sensation); 
৩) হ্রাসবৃদ্ধি (Modality)।




প্রশ্ন- ড্রাগ বা ভেষজ প্রয়োগ বিধি কি? 
বা, ভেষজ পরীক্ষায় উধের শক্তি কেমন হওয়া উচিত?

উত্তর : ভেষজের প্রকৃতির উপর ভোজ স্থূলমাত্রা, নিম্নশক্তি বা উচ্চ শক্তিতে প্রুভিং করিতে হইবে তাহা নির্ভর করে। নে আমাদের মনে রাখিতে হইবে স্কুল অবস্থার ভেষঙ্গ প্রয়োগ করা হইলে ইহার অন্তর্নিহিত শক্তির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। লেখজকে শক্তিকৃত করিলে ভেষজের আবদ্ধ শক্তি মুক্ত হয় এবং মানবদেহে তার ক্রিয়ার বৈচিত্র্য। স্পষ্টতর হয়। ভেষজ প্রয়োগ সম্পর্কিত কতকগুলি নির্দেশক নীতি আছে। সেগুলি হইল ।
(ক) যে সমস্ত ভেষজ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় প্রাণসত্তার তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ক্রিয়াগত বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে সেগুলিকে गा বা নিম্নশক্তিতে পরীক্ষা করা হয়। যেমন ইপিকাক, লোবেলিয়া, সাইকিউটা প্রভৃতি।
(খ) যে সমস্ত ভেষজ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় দেহযন্ত্রের উপর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া করে সে সমস্ত ভেষজ সব সময় উচ্চ শক্তিতে প্রতিৎ করিতে হয়। যেমন- আর্সেনিক, ল্যাকেসিস, মার্কারি, প্রভৃতি।
(গ) যে সকল ভেষজ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় প্রাণসত্তার উপর উল্লে- খযোগ্য কোন ক্রিয়া প্রকাশ করে না, সে সমস্ত ভেষজকে উচ্চশক্তিতে পরীক্ষা করা উচিত। যেমন-লাইকোপোডিয়াম, সাইলেসিয়া, গ্রাফাইটিস প্রভৃতি।
(ঘ) অন্যান্য যে সকল ভেষজের ক্রিয়া তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় মৃদু, তাহাদের মধ্য শক্তিতে পরীক্ষা আরম্ভ করিয়া ক্রমশঃ উচ্চ শক্তিতে পরীক্ষা করা উচিত।
(ঙ) সমস্ত ঔষধই বিভিন্ন শক্তিতে ও বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করা উচিত, যাহাতে ঔষধের গুনাবলীর বিশেষ করিয়া সূক্ষ্ম বৈশিষ্টাবলীর বিস্তারিত তথ্য অবগত হওয়া যায়।



প্রশ্ন- ঔষধ পরীক্ষায় ভেষজের মাত্রা বা পরিমান কিরূপ হইবে?
বা, ঔষধ পরীক্ষায় কি পরিমাণ ঔষধ ব্যবহার করিতে হইবে?

উত্তর ঃ সকল ভেষজের প্রকৃতি একরূপ নয়। উগ্র প্রকৃতির ভেষজ অল্প মাত্রায় প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সেজন্য এই ধরনের ভেষজ অতি অল্প পরিমানে প্রয়োগ করা উচিত। মৃদু শক্তি বিশিষ্ট ভেষজ আরও অধিক পরিমানে প্রয়োগ করিয়া পরীক্ষা করিতে হইবে। দূর্বল শক্তি বিশিষ্ট ভেষজ শুধু বেশী পরিমানেই প্রয়োগ করিলে চলিবে না গ্রুভারকে নীরোগ ও কোমল প্রকৃতির উত্তেজনাপ্রবণ ও অনুভূতিশীল হইতে হইবে। সর্বক্ষেত্রেই ভেষজের মাত্রা এমন হইতে হইবে যাহা প্রাণসত্তাকে সহসা অভিভূত না করিয়া তাহার উপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। পরীক্ষার নিমিত্ত ভেষজের কি পরিমান প্রুভারকে প্রয়োগ করিতে হইবে, তাহা নির্ভর করে। প্রভারের প্রবণতার উপর। প্রভারের প্রবণতা যত বেশী হইবে তত কম পরিমাণ ভেসজ জীবনীশক্তির উপর ক্রিয়া প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হইবে। প্রভারের প্রবণতা যদি মাঝামাঝি ধরনের হয় তবে সে ক্ষেত্রে স্থূলমাত্রা প্রয়োগে আমরা মূল্যবান তথ্য লাভ করি। অতএব আমাদের নীতি হইবে আমরা ভেষজের এইরূপ মাত্রা ও পরিমাণ প্রয়োগ করিব যাহা সমগ্র প্রাণসভায় নিবিড়ভাবে পরিব্যপ্ত হইয়া জীবনীশক্তির উপর নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করিবে এবং তাহা দ্বারা দেহযন্ত্রের ক্রিয়াগত বৈলক্ষণা সৃষ্টি করিবে।




প্রশ্ন- পরীক্ষার জন্য পরিমিত বৃহৎ মাত্রায় ঔষধ ব্যবহারের অসুবিধা কোথায়?

উত্তর : ড্রাগ প্রুভিং করার সময় দেখা গিয়াছে যে ঔষধের কার্যকারিতা অবগত। হইবার জন্য পরীক্ষাকারীকে স্থল মাত্রায় ভেষজ পদার্থ সেবন করাইয়া ইহার অন্ত নিহিত শক্তির পরিচয় লাভ করা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু স্থূল ভেষজকে নিয়মানুসারে আলোড়ন, ঘর্ষণ, মর্দন বা কাঁকি দিয়া উচ্চশক্তি সম্পন্ন করিয়া প্রয়োগ করিলে ইহার " শক্তি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। স্থলাবস্থার সুপ্ত শক্তি এই পদ্ধতিতে বহুগুণে বর্ধিত হইয়া শক্তি জাগ্রত ও পক্রিয় হইয়া উঠে। তাই স্থূল ভেষজ সেবন করাইয়া ঔষধের অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না এবং ভেষজ লক্ষণও পরিস্ফুট হয় না। তাই স্থল মাত্রায় বা অপরিমিত বৃহৎ মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করা ঠিক নহে।



প্রশ্ন- ভেষজ পরীক্ষায় কখন মাত্রার পূণঃপ্রয়োগ করিতে হয়?

উত্তর : ভেষজের পুণঃ প্রয়োগ নির্ভর করে ভেষজের প্রকৃতি এবং প্রাণসত্তার প্রতিক্রিয়া শক্তির উপর। কতকগুলি ভেষজ আছে যেগুলি ক্রিয়া খুব শীঘ্ৰ প্ৰকাশ হয়। এবং তাহাদের ক্রিয়া সাধারনতঃ স্বল্পকাল স্থায়ী হয়। যেমন-একোনাইট, ইপিকাক প্রভৃতি। এই সকল ভেষজ তাই ঘনঘন প্রয়োগ করিতে হয়। আবার এমন কতকগুলি ভেষজ আছে যেগুলির ক্রিয়া প্রকাশ হইতে বেশ সময় লাগে। ইহাদের ক্রিয়া সাধারনতঃ দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন- লাইকোপোডিয়াম, সাইলেসিয়া, নেট্রাম মিউর প্রভৃতি। সেজন্য এই সকল ভেষজ প্রয়োগ করিয়া লক্ষণের প্রকাশের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হয় এবং দীর্ঘ সময় অন্তর পুনঃ প্রয়োগ করিতে হয়। এই বিষয়ে নির্দেশক নীতি হইল যতক্ষন পর্যন্ত প্রদত্ত ভেষজের ক্রিয়া বর্তমান থাকে, অর্থাৎ যতক্ষন পর্যন্ত ভেষজসৃষ্ট লক্ষণ বর্তমান থাকে ততক্ষণ পুনঃপ্রয়োগ চলে না। আমাদের সর্বদা স্মরন রাখিতে হইবে ভেষজ পরীক্ষার ফলাফলের সূত্র ধরিয়াই আমরা রোগীকে ঔষধ প্রয়োগ করি।



প্রশ্ন- ড্রাগ প্রুভিং বা ভেষজ পরীক্ষায় কি স্থাস্থ্যহানি ঘটে?

স্থূলমাত্রায় যদি অধিক পরিমাণে ঔষধ ব্যবহার করা হয় তাহা হইলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়া স্বাভাবিক। বার বার ঔষধ প্রয়োগের ফলে সাধারন ভাবে মনে করা হইতে পারে যে স্বাস্থ্যহানি ঘটিতে পারে। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখা দরকার পরীক্ষা করার জন্য ঔষধ সূক্ষ্ম মাত্রায় শক্তিকৃত ঔষধ ব্যবহার করা হয় এবং লক্ষণ প্রকাশ করিয়া উহার ক্রিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই তিরোহিত হয়। অভিজ্ঞতা হইতে দেখা
 গিয়াছে যে বার বার ঔষধ প্রুভিং এর ফলে স্বাস্থ্য আরও সুদৃঢ় হইয়াছে এবং বাহ্যিক রোগাক্রমণ প্রতিরোধ করার পক্ষে দেহ আরও যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে। তাই শক্তিকৃত সূক্ষ্মমাত্রায় ঔষধ ব্যবহারে স্বাস্থ্যহানি ঘটে না ।




প্রশ্ন- ভেষজ পুনঃ পুনঃ পরীক্ষণ কেন হওয়া প্রয়োজন?

উত্তর : কেবলমাত্র একজন প্রভারের উপর পরীক্ষা করিয়া কোন ভেষজের প্রকৃত চরিত্র উদ্‌ঘাটিত হইতে পারে না। এই জন্য প্রতিটি ভেষজ বিভিন্ন ধাতু বিশিষ্ট বহু সংখ্যক স্ত্রী-পুরুষের উপর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিবেশে বার বার পরীক্ষা করা এবং সেগুলি যথার্থভাবে লিপিবদ্ধ করা উচিত। কোন লক্ষণ প্রথমেই সামান্য বলিয়া বা কেবলমাত্র একজন প্রভার লিপিবন্ধ করিয়াছেন বলিয়া তাহা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কেলি কার্বের কাশি রাত্রি ৩ ঘটিকায় বৃদ্ধি একজন মাত্র প্রভার লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই লক্ষণটি বাদ দিলে আমরা কেলি কার্বের এক বিরল ও অদ্ভুত লক্ষণ সম্বন্ধে অমূল্য তথ্য হইতে বঞ্চিত হইতাম।



প্রশ্ন- ভেষজের প্রুডিং কখন সম্পূর্ণ হইয়াছে বলা যায়?

উত্তরঃ কোন ভেষজের প্রভিং তখনই সম্পূর্ণ হইয়াছে বলা যাইবে (১) ভেষজ পরীক্ষা করিয়া আর নতুন কোন বৈশিষ্ট্যজনক লক্ষণ পাওয়া যায় না। (২) পূর্বে অন্য ব্যক্তিতে পরীক্ষা করিয়া যে সকল লক্ষণ পাওয়া গিয়াছিল পরবর্তী পরীক্ষাগুলিতে শুধু নেই সমস্ত লক্ষণই পাওয়া যায়। (৩) প্রতিটি লক্ষণের প্রকাশস্থল, অনুভূতি, হ্রাসবৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক লক্ষণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য অবগত হওয়া গিয়াছে। অর্থাৎ এককথায় বলা যাইতে পারে ভেষজ পরীক্ষার পর ভেষজ চিত্র সম্পূর্ণ রূপে নির্ণীত হইলেই সেই ভেষজ পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়।




প্রশ্ন- ঔষধ পরীক্ষা ও রোগী পরীক্ষার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।

উত্তর : ঔষধ পরীক্ষা ও রোগী পরীক্ষার মধ্যে সম্পর্ক একে অন্যের পরিপূরক। হোমিওপ্যাথিতে সুস্থদেহে ঔষধ পরীক্ষা দ্বারা দেখা হয় উক্ত ঔষধ কি কি রোগলক্ষণ সৃষ্টি করিতে সক্ষম। এইভাবে প্রতিটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের পরীক্ষালব্ধ লক্ষণ মেটিরিয়া মেডিকায় লিপিবদ্ধ থাকে। ঔষধের গুণাগুণ হইল সুস্থদেহে ঔষধ যে লক্ষণ উৎপন্ন করে, ঠিক অনুরূপ লক্ষণ প্রকাশিত রোগীতে সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা রোগ নিরাময় করিতে সক্ষম। তাই কোন রোগীতে সৃষ্ট লক্ষণাবলী, ঔষধ সৃষ্ট লক্ষণাবলীর সাথে সদৃশ হইলে তাহা প্রয়োগ করা হয়। ইহাই হোমিওপ্যাথির মূল কথা। বস্তুত ঔষধ পরীক্ষা ও রোগী পরীক্ষার সম্পর্ক যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
ঘ) ঔষধের শক্তির বিকাশন বা শক্তিকরণ (Dynamization or potentization of drugs) :



প্রশ্ন-  ঔষধের শক্তিকরণ বলিতে কি বুঝ ?

উত্তর : ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে হ্যানিমান ঘোষনা করেন যে, সাধারণ অর্থে জড় পদার্থ বলিতে যাহা বুঝায় ভেষজ পদার্থ তেমন জড় ও অনড় নয়। তাহার আসল স্বরূপ- হইল বিশুদ্ধ শক্তি। এই শক্তি ভেষজ পদার্থে সুপ্ত থাকে। বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভেষজের শক্তির ক্রিয়া ক্ষমতাকে ইচ্ছামত বৃদ্ধি করা যায়। যে প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাকৃতিক পদার্থের অন্তনির্হিত সূক্ষ্ম ভেষজগুণ স্ফুরিত, বিকশিত ও ঔষধরূপে ব্যবহারের উপযোগী হয় তাহাকে ভেষজের শক্তির বিকাশন বা শক্তিকরণ প্রক্রিয়া বলে।
হ্যানিমান ভেষজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করার প্রক্রিয়াই শুধু আবিষ্কার করেন নাই বরং তিনি একটি সুনির্দিষ্ট মান অনুযায়ী সেই শক্তিকে বিভিন্ন স্তরে উন্নীত করার পন্থাও উদ্ভাবন করিলেন যাহাতে এ য়াজন অনুযায়ী ঔষধ বিভিন্ন শক্তিতে ও বিভিন্ন মাত্রায় স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা চলে।




প্রশ্ন-  শক্তিকরণ প্রক্রিয়া কিরূপে সম্পাদিত হয়?

উত্তর : সাধারণতঃ বিশেষ রীতিতে ঘর্ষণ ও চূর্ণীকরণ অথবা দ্রীকরণ ও আলোড়ন দ্বারা ভেষজের আবদ্ধ শক্তিকে মুক্ত করা হয়। যে বস্তুকে শক্তিতে রূপান্ত রিত করিতে হইবে সেই বস্তুর এক ক্ষুদ্র অংশ কোন এক ভেষজগুনহীন নিষ্ক্রিয় পদার্থের সঙ্গে ঘর্ষণ, পেষন ও আলোড়ন করা হয়। দুগ্ধ শর্করা, সুরাসার, এবং পরিশ্রুত জল সাধারনত অনৌষধি মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে পদার্থের অনু পরমানুতে যে সূক্ষ্ম ভেষজ গুনগুলি আবদ্ধ ছিল সেগুলি ক্রমে ক্রমে মুক্ত হইতে থাকে। যতই প্রক্রিয়া চালানো যায় ততই পদার্থের গভীরে নিহিত সূক্ষ্মতম গুণাবলীর স্ফুরণ হইতে থাকে। পদার্থের জড়সত্তা ধীরে ধীরে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং সেই শক্তি অনৌষধি মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াতে প্রতিটি ভেষজের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট অক্ষুন্ন থাকে।




প্রশ্ন- শক্তিকরণের প্রকৃত তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
বা, মূল ঔষধ ও শক্তিকৃত ঔষধের ক্রিয়ার পার্থক্য কি?

উত্তর : ডাঃ জার বলেন, ক্রমাগত ঘর্ষণ বা দ্রবীকরণ ও আলোড়নের ফলে ঔষধ দুর্বল বা অধিক শক্তিশালী হয়না। কিন্তু তাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্টাবলীর আরও স্পষ্টতর বিকাশ হয়। ঔষধের নিম্ন ও উচ্চশক্তির মূল পার্থক্য তাহাদের শক্তির প্রাবল্য বা দুর্বলতায় নয়। মূল পার্থক্য হইল ঔষধের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যবলীর প্রকাশ ক্ষমতায়। ঔষধের মূল আরক বা নিম্নশক্তিতে ঔষধের শুদু সাধারণ লক্ষণগুলিই প্রকাশ পায়। কাজেই সেই লক্ষণগুলিকে অন্যান্য ঔষধের লক্ষণ হইতে আলাদা করা খুব কঠিন কিছু ঔষধকে যত উচ্চ হইতে উচ্চতর শক্তিতে উন্নীত করা যায় ততই তার পরিচায়ক লক্ষণ সমূহ স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং অন্য ঔষধের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য্য স্পষ্টতর হয়।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিতে স্থুল ঔষধ ব্যবহৃত হইতে পারে না কেন?
বা, হোমিওপ্যাথিক মতে রোগীকে শক্তিকৃত ঔষধ দেওয়া হয় কেন?

উত্তর : হোমিওপ্যাথিতে রোগীকে আরোগ্য করার জন্য অবশ্যই সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন শক্তিকৃত ঔষধ প্রয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেহ ও মনের রক্ষক, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক জীবনীশক্তিকে রোগশক্তি তার সুক্ষ্ম ক্ষতিকারক গতিশীল প্রভাবের দ্বারা আক্রমন করে। জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রাপ্ত হইলে দেহমনে যে বিকৃত লক্ষণাবলী সৃষ্টি হয় উহাই রোগ নামে অভিহিত। জীবনীশক্তি সূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয়। আবার অতীন্দ্রিয় অশুভ শক্তি দ্বারাই জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খলা ঘটে। কারণ সূক্ষ্ম শক্তি দ্বারাই সূক্ষ্ম প্রভাবিত হয়। স্থল ঔষধ শক্তি দ্বারা সূক্ষ্ম শক্তিকে আঘাত করিলে কোন কাজ হয় না। রোগশক্তি যদি স্থুল হইত তাহা হইলে স্কুল ঔষধশক্তি উহাকে আবিষ্ট করিতে পারিত। রোগশক্তির সূক্ষ্ম গতিশীল প্রভাবে মৃগ্ধ গতিশীল জীবনীশক্তির উপর যে বিকৃত লক্ষণসমষ্টির সৃষ্টি করে, তাহা দূর করিতে হইলে ঔষধকেও একটি সূক্ষ্ম গতিশীল আরোগ্যকারী শক্তি হইতে হইবে, যাহা রোগীর ঐ সূক্ষ্ম বিকৃতির স্তর পর্যন্ত পৌঁছাইতে পারে ও রোগীর উপর রোগলক্ষণের সদৃশ প্রকৃতির অথচ রোগশক্তি অপেক্ষা কিছুটা শক্তিশালী গতিশীল প্রভাবের সৃষ্টি করিতে পারে। একমাত্র প্রতিকারক সাদৃশ্য লক্ষণসম্পন্ন ঔষধশক্তি দ্বারাই জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খল অবস্থার দূরীকরণ সম্ভবপর। ঔষধ তাহার জড় অংশ দ্বারা মানব স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে না। প্রভাব বিস্তার করে তাহার অভ্যন্ত রন্থ সূক্ষ্ম তেজোময়ী শক্তি দ্বারা।



প্রশ্ন-  বিভিন্ন রোগী ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের শক্তি নির্ধারণের কাজ প্রধানতঃ নিম্নোক্ত বিবেচনার উপর নির্ভর করে। 

উত্তর : বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের শক্তি নির্ধারণের কাজ প্রধানতঃ নিম্নোক্ত বিবেচনার উপর নির্ভর করে।
১) রোগীর অবস্থা : রোগীর প্রবণতার পরিমাপের উপর শক্তি নির্ধারণ বহুলাংশে নির্ভর করে। রোগ লক্ষণের সঙ্গে ঔষধের সাদৃশ্য যত নিবিড় হইবে ঔষধের বৈচিত্রময় পরিচায়ক লক্ষণসমূহ যত স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাবে রোগীতে পরিস্ফুটিত হইবে, সেই ঔষধের প্রতি রোগীর প্রবণতা তত বেশী হইবে এবং ঔষধের তত উচ্চশক্তি প্রয়োজন হইবে (অনার যেখানে রোগ লক্ষণ সাধারন ধরনের এবং নিদানগত লক্ষণের সংখ্যাই প্রধান, সুক্ষ্ম বৈচিত্রপূর্ণ লক্ষনের অভাব, সে সমস্ত ক্ষেত্রে জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়ার শক্তির দুর্বলতা সূচিত করে। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবণতা নিম্নস্তরের, কাজেই উচ্চশক্তির ঔষধ মোটেই কার্যকরী হইবেনা, নিম্নশক্তিতেই ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে। ডাঃ জার বলেন, যদি কোন ক্ষেত্রে রোগলক্ষণসমূহ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়না কিংবা পরিচায়ক লক্ষণসমূহের অভাব বা সংখ্যাল্পতা থাকে অথবা যেখানে ২/৩টি ঔষধের লক্ষণ ফুটিয়া উঠে সেখানে রোগীর প্রবণতা কম বলিরা ধরিতে হইবে! এইসব ক্ষেত্রে যে ঔষধ রোগলক্ষণের সহিত সর্বাধিক সাদৃশ্য বহন করে সেই ঔষধ নিম্নশক্তিতে (৩-১২) প্রদান করিতে হয়। কিন্তু যেখানে লক্ষণসমষ্টি সুস্পষ্ট ভাবে সেই ঔষধই নির্দেশ করে সেখানে ঔষধের উচ্চশক্তি (২০০ও) প্রদান করিতে হয়।
(ক) রোগীর বয়স : শিশু, যুবক ও তেজস্বী ব্যক্তিদের প্রবণতা বেশী, সেইজন্য তাহাদের ক্ষেত্রে মধ্য ও উচ্চশক্তি প্রয়োগ করিতে হয়, বয়সের সঙ্গে প্রবনতা কমে, তাই বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিম্ন হইতে মধ্যশক্তির ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়।
(খ) ধাতু ও গড়ন স্নায় প্রধান, রফ প্রধান, রাগ প্রধান ধাতু ব্যক্তি এবং বুদ্ধিজীবি, উৎসাহী ও আবেগ প্রবণ ব্যক্তিদের প্রবণতা বেশী। কাজেই এই সব ক্ষেত্রে উচ্চশক্তি প্রয়োগ করিতে হয়। শ্লেম্মা প্রধান ধাতুর ব্যক্তি, জড়বুদ্ধি, কর্মে শ্লথ, আলস্যপরায়ণ যাহাদের মাংসপেশী দৃঢ় ও সবল এবং যাহারা দৈহিক পরিশ্রম করে। তাহাদের প্রবণতা কম, এই সবক্ষেত্রে ঔষধের নিম্নশক্তি, বৃহৎমাত্রা ও পুনঃপ্রয়োগের প্রয়োজন হয়। জড়ধী, পৌরুষহীন, বধির, বোবা ব্যক্তিদের প্রবণতা নিচুস্তরের এই সব ক্ষেত্রেও নিম্নশক্তির ঔষধ প্রদান করিতে হয়।
(গ) নিদানগত অবস্থা : নিদানগত অবস্থা প্রবণতার পরিবর্তন সাধন করে। এই অবস্থায় প্রাণসত্তার প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা কমিয়া যায়। কাজেই এইসব অবস্থার সর্বদাই নিম্নশক্তি ব্যবহার করিতে হয়। হৃদপিন্ডের পীড়ার অন্তিম অবস্থায় ডিজিটেলিস নির্দিষ্ট হইলেও এই ঔষধের কোন শক্তিতেই বিশেষ কোন ক্রিয়া হয়না। একমাত্র মূল আরকের স্থূলমাত্রা জীবনী শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করিতে পারে। আবার যাহারা অধিক ঔষধ ব্যবহার করেন, তাহাদের ক্ষেত্রে উচ্চশক্তির ঔষধ ভাল কাজ করে।
(ঘ) রোগীর দৈহিক ও মানসিক অবস্থা :- যেখানে রোগীতে প্রতিক্রিয়া তীব্র সেখানে উচ্চশক্তি, আর যেখানে প্রতিক্রিয়া দুর্বল সেখানে নিম্নশক্তি প্রদান করিতে হয়। রোগী অত্যন্ত দুর্বল হইলে নিম্নশক্তি এবং সবল হইলে উচ্চশক্তি। রোগী অস্থির ও অসহিষ্ণু হইলে সর্বদাই নিম্নশক্তি।
(ঙ) চিকিৎসার উদ্দেশ্য:- রোগীর অভিপ্রায়ের উপরও শক্তি নির্বাচিত হইয়া থাকে। চিররোগের যদি কোনরূপ উপশম চায় তবে নিম্নশক্তিতে এবং যদি স্থায়ী আরোগ্য লাভ করিতে চায় এবং তার জন্য যথোচিত ধৈর্য ধারণ করিতে রাজী থাকে তবে ঔষধের উচ্চশক্তি প্রদেয়।
(চ) ধাতুগত চিকিৎসা : ধাতুগত চিকিৎসায় সর্বদাই উচ্চশক্তি ব্যবহৃত হয়। ধাতুগত চিকিৎসায় কোন ঔষধ উচ্চশক্তিতে প্রদান করার পর নতুন কোন উপসর্গ দেখা দিলে যদি সেই সমস্ত লক্ষণ রোগীতে পূর্বে কখনও দেখা না দিয়া থাকে তবে সদৃশমতে নির্বাচিত ঔষধের নিম্নশক্তি প্রদান করিতে হয়।

২) রোগের প্রকৃতি, অবস্থা, গতি, তীব্রতা ও দেশ বিকাশ, স্থায়িত্ব ও স্থিতির স্থान :
(ক) অচিররোগের ক্ষেত্রে রোগশক্তি শুধু দেহ যন্ত্রের ক্রিয়াগত পরিবর্তন সাধন করে। সেইজন্য অচির পীড়ায় নিম্ন ও মধ্যশক্তি ঘনঘন প্রয়োগ করা উচিত। চিররোগের ক্ষেত্রে রোগশক্তি প্রাণসত্তাকে নিবিড়ভাবে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। কাজেই গভীর ক্রিয়াশীল অর্থাৎ উচ্চ শক্তির ঔষধ প্রদান করিতে হয়।
(খ) অর্জিত রোগের ক্ষেত্রে পীড়ার স্তর অনুযায়ী নিম্ন হইতে মধ্যশক্তি এবং উগ্রাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ হইলে উচ্চতম শক্তি প্রযোজ্য ।
(গ) চাচা দেওয়া রোগের চিকিৎসায় সর্বদা উচ্চ শক্তির ঔষধ ব্যবহৃত হয়।
(ঘ) মানসিক রোগের তরুন ও প্রবল প্রকোপের সময় সাধারণতঃ লঘুক্রিয় ঔষধের নিম্ন বা মধ্যশক্তি এবং পরে অবস্থা কিছুটা শান্ত হইলে দীর্ঘক্রিয় ঔষধের উচ্চশক্তি প্রদান করিতে হয়।
(ঙ) রোগের অবস্থা : রোগে দেহ যন্ত্রের কোন গঠনগত পরিবর্তন সাধিত হইলে নিম্নশক্তি। এই সব ক্ষেত্রে উচ্চশক্তি প্রয়োগ হইলে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যে দেহী তা অনেক সময় সহ্য করিতে পারেনা। রোগের পরিণাম অবস্থায় যেখানে সুনির্বাচিত ঔষদেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না সেখানে ঔষধের মূল আরক হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করা যাইতে পারে।
(চ) রোগের গতি ও তীব্রতা : কলেরা প্রভৃতি মারাত্মক ধরনের পীড়া দ্রুত খারাপের দিকে ধাবিত হইলে নিম্নশক্তির ঔষধ ঘনঘন প্রয়োগ করা উচিত। অসহ্য যন্ত্রনায় যেখানে রোগী ছটফট করে উপশমের জন্য নিম্নশক্তি। রোগের গতি যেখানে বাহির হইতে ভেতরের দিকে, নিম্ন হইতে উর্ধ্বের দিকে, অপ্রধান অঙ্গ হইতে প্রধান অঙ্গ সঞ্চারিত হয় তখন অবস্থা মারাত্মক বুঝিতে হইবে এবং প্রতিকারের নিমিত্ত নিম্নশক্তি প্রদান করিতে হইবে।
(ছ) রোগ বিকাশের স্তর স্থায়িত্ব ও স্থিতির স্থান : রোগ স্থুল স্তরে অবস্থান করিলে নিম্নশক্তি, সূক্ষ্মস্তরে অবস্থান করিলে মধ্য হইতে উচ্চশক্তি অতীন্দ্রিয় স্তরে অবস্থান করিলে উচ্চ হইতে উচ্চতম শক্তি প্রদেয়। মানসিক স্তরে বিদ্যমান থাকিলে উচ্চশক্তি, দৈহিক স্তরে থাকিলে নিম্ন শক্তি। চক্ষু, কর্ণ, মস্তিষ্ক, জরায়ু, স্নায়ু প্রভৃতি সূক্ষ্ম ও অনুভূতিশীল যন্ত্রসমূহের পীড়ায় মধ্য ও উচ্চশক্তি। তবে হৃদপিন্ড প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের পীড়ায় নিম্নশক্তি হইতে আরম্ভ করাই যুক্তিসঙ্গত। চর্য অনুনাদী প্রভৃতি স্থুল যন্ত্রসমূহের পীড়ায় নিম্নশক্তি।
একই রোগের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন শক্তির প্রয়োজন হয়। রোগের প্রারম্ভিক অবস্থায় নিম্নশক্তি, পরবর্তী অবস্থায় মধ্য হইতে উচ্চশক্তি। কলেরা রোগে প্রথমে নিম্নশক্তি, প্রতিক্রিয়া শুরু হইলে মধ্যশক্তি। ব্রংকাইটিস পীড়ায় প্রথম অবস্থায় নিম্নশক্তি, পুরাতন হইলে উচ্চশক্তি। সিফিলিস পীড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন অচিকিৎসিত অবস্থায় কোন জটিলতা প্রাপ্ত হয় নাই তখন নার্ভাস ও রক্ত প্রধান ধাতুর রোগীকে মার্কারি মধ্য বা উচ্চ শক্তিতে এবং রোগী শ্লথ প্রকৃতির হইলে নিম্নশক্তিতে আরোগ্য হইবে। কিন্তু সেই পর্যায় অতিক্রান্ত হইলে নিম্নশক্তিতে আর কাজ হইবে না। দুরারোগ্য পীড়ার সাধ্যের বাহিরে চলিয়া গেলে নিম্নশক্তি। সন্দেহজনক ক্ষেত্রে সর্বদাই নিম্নশক্তি। আয়ুর্বেদ বা এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পর রোগীকে নিম্নশক্তি। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পর রোগীকে ৩০ শক্তির ঔষধ দিয়া চিকিৎসা আরম্ভ করিতে হইবে।
৩) ঔষধের প্রকৃতি : ঔষধের প্রকৃতির উপরও শক্তি নির্ধারণ নির্ভর করে।
(ক) লঘু ক্রিয় ও দীর্ঘ ক্রিয় ঔষধ ঃ যে সব ঔষধের ক্রিয়া অগভীর এবং স্বল্পকাল স্থায়ী সে সব ঔষধ নিম্নশক্তিতে ব্যবহৃত হয়। যেসব ঔষধের ক্রিয়া গভীর ও দীর্ঘকাল স্থায়ী সেগুলি মধ্য ও উচ্চশক্তিতে প্রযুক্ত হয়।
(খ) যেসব ঔষধ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থ দেহে প্রয়োগ করিলে বিশেষ কোন লক্ষণ উৎপন্ন হয় না সেগুলি মধ্য বা উচ্চ শক্তিতে প্রয়োগ করিতে হয়। যেসব ঔষধ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থ দেহে দেহযন্ত্রের বৈলক্ষণ্য সৃষ্টি করিতে পারে সেগুলি সাধারনতঃ নিম্নশক্তিতে প্রযুক্ত হয়। আবার যে সব ঔষধ স্বাভাবিক অবস্থায় দেহযন্ত্রের উপর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া করে সেগুলি উচ্চশক্তিতেই প্রয়োগ বিধেয়। রোগজ ভেষজ সর্বদাই উচ্চশক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
(গ) সুনির্বাচিত ঔষধে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হইলে প্রতিক্রিয়া আনার জন্য অন্তর্বর্তী যে ঔষধ ব্যবহৃত হয় তাহা উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করা হয়।
(ঘ) কতকগুলো ঔষধ বিভিন্ন শক্তিতে বিভিন্নরূপ ক্রিয়া করে। যেমন
(১) হিপার সালফ, মার্কুরিয়াস, সাইলিসিয়া নিম্নশক্তিতে পূজ উৎপাদন করে, উচ্চশক্তিতে পূঁজ নিবারণ করে।
(২) ব্রায়োনিয়া ২০০ স্তন দুগ্ধ বৃদ্ধিতে এবং ৩x স্তন্য হ্রাসের নিমিত্ত প্রযুক্ত হয়।
(৩) আঘাত লাগার দরুণ তরুণ পীড়ার আর্ণিকা নিম্নশক্তি কিন্তু আঘাতজনিত কারণে যদি পরবর্তীকালে কোন পীড়া দেখা দেয় তবে আর্ণিকা উচ্চশক্তি অধিকতর উপযোগী।
(৪) কোষ্ঠকাঠিন্য নির্দিষ্ট হইলে নাক্সভম নিম্নশক্তি এবং উদরাময়ে উচ্চশক্তি।
(৫) আফিমসেবীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হইলে ওপিয়াম উচ্চশক্তি।
(৬) আর্সেনিক এলবাম পাকস্থলী, অস্ত্র ও কিডনীর পীড়ায় নিম্নশক্তি এবং নিউরালজিয়া, স্নায়ু ও চর্মের পীড়ায় উচ্চ শক্তিতে। ক্রণিক পীড়ায় আর্সেনিক নির্দিষ্ট হইলে উচ্চশক্তিতে প্রযোজ্য।
 (৭) যৌনক্রিয়ার আধিক্য হেতু দুর্বলতায় নির্দিষ্ট হইলে এসিড ফস নিম্নশক্তি।
(৮) যৌনক্রিয়ার অতিশয্য হেতু দূর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, বার বার প্রস্রাবের বেগ প্রভৃতি উপসর্গযুক্ত রোগে স্ট্যাফিসেগ্রিয়া নির্দিষ্ট হইলে ৩০ শক্তি বিশেষ উপযোগী।
৯) পডোফাইলাম ব্যবহারকালে যকৃতের তরুণ রোগে মধ্য ও উচ্চশক্তি, পুরাতন রোগে নিম্নশক্তি, শিশু কলেরা, কলেরা ও উদরাময় রোগে উচ্চশক্তি, সবিরাম জ্বরে মধ্য ও উচ্চশক্তি।
উপরোক্ত আলোচনা হইতে প্রতিয়মান হয় যে ঔষধের শক্তি নির্ধারণের ভিত্তি কোন একটি কারণে উপর নির্ভর করে না। রোগীর সামগ্রিক অবস্থা নির্দেশক যাবতীয় ঘটনার বিচার করিয়া ঔষধের শক্তি নির্ধারণ করিতে হয়।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক নিম্ন ও উচ্চশক্তির ক্রিয়া কি একই রকম?

উত্তর : সাধারণতঃ সুনির্বাচিত ঔষধের । হইতে ৩০ শক্তি পর্যন্ত নিম্নশক্তি এবং ২০০ হইতে উর্ধ্বতম শক্তিকে উচ্চশক্তি বলা হইয়া থাকে। নিম্নশক্তি ও উচ্চশক্তির ক্রিয়া একরূপ নয়। ঔষধের কার্যকরী শক্তি প্রকৃতপক্ষে রোগলক্ষণের সঙ্গে তার সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে। উচ্চশক্তির ঔষধ রোগ প্রবনতার যে স্তরে ক্রিয়া করে নিম্নশক্তির ঔষধ সেই স্তরে পৌছাইতেই পারেনা। এই জন্য নিম্নশক্তিতে যেখানে কোন ক্রিয়াই দর্শে না, উচ্চশক্তিতে সেখানে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়।

ঔষধের প্রকৃতি অনুযায়ী একই শক্তির বিভিন্ন ঔষধ বিভিন্ন স্তরে ক্রিয়া করিয়া থাকে। লঘু ক্রিয় ঔষধের ক্রিয়া অগভীর, সে সমস্ত ঔষধ নিম্নশক্তিতে (৩, ৬, ৩০) এবং যে সব ঔষধের ক্রিয়া গভীর সেগুলি উচ্চশক্তিতে প্রযুক্ত হয়। যে সব ভেষজ স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থদেহে দেহযন্ত্রের ক্রিয়ার বৈলক্ষণ্য সৃষ্টি করিতে পারে সেগুলি সাধারণতঃ নিম্নশক্তিতে এবং যে সব ভেষজ তাহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় দেহ যন্ত্রের উপর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া করে সেগুলি উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করা হয়। রোগজ ভেষজ সর্বদা উচ্চশক্তিতে ব্যবহার হয়। কিছু কিছু ভেষজ আছে যেগুলি সুস্থ দেহে পরীক্ষার সময় তাহাদের ক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী বলিয়া প্রমানিত হইয়াছে। কিন্তু সেগুলি অচিররোগে দ্রুত ও স্বল্পকাল স্থায়ী ক্রিয়া করে যেমন-বেল, সালফার, আর্সেনিক প্রভৃতি। রোগ যত তীব্র হয়, ঔষধের ক্রিয়াকালও তত ক্ষুদ্র হয়। এই সব ক্ষেত্রে ঔষধ পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ করিতে হয়। কিন্তু চিররোগের বেলায় সেই একই ঔষধ উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করিয়া তাহার ক্রিয়া করার জন্য দীর্ঘ সময় দিতে হয়। তাই বলা যায় হোমিওপ্যাথিক নিম্ন ও উচ্চ শক্তির ক্রিয়া একই রকম নয়।


 

প্রশ্ন- শক্তিকরণের ফলে স্থূল ঔষধের ক্রিয়ার কি পরিবর্তন হয়?

উত্তর : ঔষধ যত বেশী বিভাজিত হয় ততবেশী সূক্ষ্ম হয়। অন্যদিকে ঔষধ যত বেশী সূক্ষ্ম হইবে তত বেশী শক্তিশালী হইবে। স্কুল ঔষধ প্রয়োগ করিলে ঔষধ শক্তি রোগশক্তির সাথে সংগ্রামে পরাজিত হয়। বিভাজিত করিয়া শক্তিকৃত করিলে অর্থাৎ ঔষধের স্থূলত্ব ঘুচাইলে আভ্যন্তরীক সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে যাহা রোগশক্তিকে ধ্বংস করিতে সক্ষম। যদিও দশমিক, শততমিক বা পঞ্চাশ সহস্রতমিক রীতিতে বিভাজিত হইলে স্থূল পদার্থ থাকে না বলিয়া অনেকে উপহাস করিত, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ইহাকেই সত্য বলিয়া মানিয়া নিতে কেহ অস্বীকার করেন নাই।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিতে শক্তিকরণ পদ্ধতিসমূহ কি কি?
বা, দশমিক রীতি, শততমিক রীতি ও পঞ্চাশ সহস্রতমিক রীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

উত্তর : ঔষধ শক্তিকরণের জন্য হোমিওপ্যাথিতে তিনটি পদ্ধতি বিদ্যমান। যথা :
দশমিক পদ্ধতি : ডাঃ হেরিং কর্তৃক এই রীতি প্রবর্তিত হয়। এই রীতিতে মূল ঔষধ ১ ভাগ, ৯ ভাগ দুগ্ধ শর্করার সহিত ১ ঘন্টা কাল বলে ঘর্ষণ করিলে প্রথম দশমিক শক্তির ঔষধ প্রস্তুত হয়। প্রথম শক্তির ঔষধের একভাগ আবার নয় ভাগ দুগ্ধ শর্করার সঙ্গে মিশ্রিত করিয়া ১ ঘন্টা কাল ঘর্ষণ করিলে দ্বিতীয় দশমিক শক্তির ঔষধ প্রস্তুত হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। দশমিক শক্তির ঔষধকে সংখ্যার ডানে x বা 'দ' চিহ্নদ্বারা ঔষধের শক্তি প্রকাশ করা হয়।
শততমিক পদ্ধতি ঃ ইহা ডাঃ হ্যানিমান কর্তৃক প্রবর্তিত হয়। শততমিক প্রক্রিয়ায় একভাগ ঔষধের মূল আরকের সঙ্গে ৯৯ ভাগ সুরাসার মিশ্রিত করিয়া উত্তমরূপে ঝাঁকানি দিয়া প্রথম শততমিক শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। প্রথম শততমিক শক্তির ১ ভাগ আবার ৯৯ ভাগ সুরাসার মিশ্রিত করিয়া ঝাঁকানি দিয়া দ্বিতীয় শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে উচ্চশক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। শুধুমাত্র সংখ্যাদ্বারা এই ঔষধের শক্তি প্রকাশ করা হয়।
পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি : হ্যানিমানের শেষ জীবনে তিনি এই পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন যাহা অর্গাননের ৬ষ্ঠ সংরক্ষণে প্রকাশিত হয়। ভেষজের অন্তনির্হিত শক্তির সর্বোত্তম বিকাশ সাধনের মাধ্যমে আরোগ্য ক্রিয়া দ্রুততর ও কষ্টবিহীন করার উদ্দেশ্যে তিনি পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতিতে প্রথমে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মূল ঔষধের বিচূর্ণ প্রস্তুত করা হয়। এই জন্য ভেষজের একগ্রেন তিনশ গ্রেন দুগ্ধশর্করার সঙ্গে তিনটি পর্যায়ে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তিন ঘন্টা ধরিয়া ঘর্ষণ করার পর এমন ভাবে একটি মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয় যাহাতে সেই মিশ্রনের একগ্রেনের মধ্যে মূল ভেষজ্ঞের দশলক্ষাংশ মাত্র বিদ্যমান থাকে। এই বিচূর্ণের একগ্রেন ৫০০ ফোঁটা লঘুকৃত সুরাসারে (১ ভাগ সুরাসার ৪ ভাগ পরিশ্রুত জল) দ্রব করা হয়। এই মিশ্রনের ১ ফোঁটা নিয়া ১০০ ভাগ ফোঁটা বিদ্ধে সুরাসারে মিশ্রিত করিয়া ১০০ বার সজোরে ঝাঁকুনি দিতে হয়। এইভাবে ঔষধের প্রথম শক্তি প্রস্তুত করা হয়। এইবার একশতটির ওজন ১ গ্রেন হয় এইরূপ অনুবটিকা ঐ ঔষধে সিক্ত করিয়া ব্লটিং কাগজে তাড়াতাড়ি শুকাইয়া নিতে হয় এবং উমে ছিপিযুক্ত শিশিতে সেইগুলি রাখা হয়। এই ঔষধকে প্রথম শক্তির ঔষধ বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। প্রথম শক্তির অনুমটিকার একটি নিয়া আবার একশত ফোঁটা বিশুদ্ধ সুরাসারের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয় এবং একশত বার প্রবল ঝাঁকি দিয়া তাহাতে শক্তি সঞ্চারিত করা হয়। সুরাসার মিশ্রিত এই তরল ভেষজের পূর্বোক্ত উপায়ে আবার অনুবটিকা সিক্ত ও শুষ্ক করিয়া দ্বিতীয় শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে উচ্চ হইতে উচ্চতর শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত ঔষধে ভেষজের স্থূল অংশ প্রতি পর্যায়ে পঞ্চাশ হাজার শুন হ্রাস পায়। এইজন্য এই প্রক্রিয়াকে পঞ্চাশ সহস্রতমিক প্রক্রিয়া বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত ঔষধের শক্তি সাধারণতঃ ০/১ ০/২ ০/৩ ইত্যাদি দ্বারা অথবা এম/১, এম/২, এম/৩ ইত্যাদি চিহ্ন দ্বারা সূচিত হয়।




প্রশ্ন- শক্তিকরণ (Potentization) এবং দ্রবীকরণ (Dilution) বলিতে কি বুঝ?

উত্তর : ঔষধের শক্তিকরণকে ভেষজের দ্রবীকরণ বলা সমীচীন নয়। ঘর্ষণ বা দ্রবীকরণ এবং আলোড়ন দ্বারা প্রাকৃতিক পদার্থসমূহের আবরণ উন্মুক্ত হয় এবং অন্ত গ্রন্থ রুদ্ধ শক্তি মুক্ত হয়। হ্যানিমান বলিয়াছেন, একগ্রেন লবন অনেকটা জলে মিশ্রিত করিলে ঐ মিশ্রণ কখনও প্রভুত শক্তিসম্পন্ন নেট্রাম মিউরে পরিণত হয় না। তেমনি নানা প্রকার খনিজ পদার্থ, কয়লা, বালুকা, প্রভৃতি অনড় পদার্থের অন্তর্নিহিত শক্তির কোন পরিচয় দ্রবীকরণের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। শক্তিকরণ ভাই শুধু দ্রবণ নয়, অনৌষধি দ্রব্যের সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দ্রবণ, ঘর্ষণ ও আলোড়ন।





প্রশ্ন- পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি আলোচনা কর।

উত্তর : পঞ্চাশ সহস্রতমিক নির্বাচিত শক্তির একটি মাত্র বড়ি দিয়া ৪০/৩০/২০/১৫ বা ৮ টেবিল চামচ পানিতে দ্রবীভূত করিতে হইবে। যাহাতে পানি কয়েকদিনের মধ্যে নষ্ট না হয়। উক্ত দ্রবণসহ শিশিকে প্রত্যেকবার ব্যবহারের পূর্বে ৮/১০/১২ বার ঝাঁকি দিতে হইবে। তারপর ঐ শিশি হইতে এক টেবিল চামচ একবারে নিয়া ৭/৮ চামচ পানিতে মিশাইয়া উহা হইতে এক চামচ প্রত্যহ বা চিররোগে একদিন পর এবং অচিররোগে ২-৬ ঘণ্টা পরপর রোগীকে প্রয়োগ করিতে হইবে। রোগী ভাল অনুভব করিলেও এইভাবে প্রত্যহ বা ১ দিন পর বা ৩/৭ দিন পর একমাত্রা প্রয়োগ করিতে হইবে যতক্ষণ না কোন বৃদ্ধি ঘটে। হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি ঘটিলে ২/৪ দিন ঔষধ বন্ধ রাখিয়া পুনরায় পরবর্তী শক্তির ঔষধ আরও লঘুকরণ করিয়া প্রয়োগ করিতে হইবে। অর্থাৎ প্রথম কাপে প্রস্তুত দ্রবণ হইতে ১ চামচ নিয়া আর একটা কাপ বা গ্লাসে একই প্রক্রিয়ায় দ্রবণ প্রস্তুত করিয়া উহা হইতে একবারে এক চামচ রোগীকে দিতে হইবে। উহাতেও বৃদ্ধি হইলে তৃতীয় কাপ বা গ্লাসে লঘু করিয়া তাহা হইতে এক চামচ রোগীকে একবাবে প্রয়োগ করিতে হইবে। প্রতিবার পুনরায় প্রয়োগ করিতে হইলে ঐ একই নিয়ম অনুসরণ করিতে হইবে।
সুতরাং দেখা যাইতেছে যে একমাত্র হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি ছাড়া ঔষধ পুনঃপ্রয়োগ করিয়া যাইতে হইবে। যতক্ষণ না রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। ইহার কারণ হইল এই যে, এই শক্তির ঔষধের ক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী নহে। তাই দ্বিতীয় মাত্রা প্রয়োগের পূর্বেই ইহার ক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষ হইবে। এইভাবে প্রয়োগে করিতে করিতে যদি শেষের দিকে হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি দেখা দেয় অথবা পূর্বের চলিয়া যাওয়া লক্ষণগুলি পুনরায় দেখা দেয় তবে কয়েকদিন ঔষধ বন্ধ রাখিয়া মাত্রা আরও কমাইয়া এবং প্রয়োগকাল আরো বাড়াইয়া প্রয়োগ করিতে হইবে যতক্ষণ না অবশিষ্ট লক্ষণগুলি দূর হয়।
সোরা, সিফিলিস ও সাইকোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলির চিকিৎসা করার সময় যতদিন প্রাথমিক লক্ষণ বর্তমান থাকে ততদিন এইভাবে একবারে কয়েক চামচ প্রয়োগ করিতে হইবে। কারণ এখানে বৃদ্ধির সম্ভাবনা নাই। ইহা ছাড়া প্রাথমিক লক্ষণের অবস্থা দেখিয়া বুঝা যাইবে রোগ কতটুকু আরোগ্য হইল। যদি চলাকালীন নতুন লক্ষণ দেখা দেয় বা বর্তমান লক্ষণগুলির পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে তবে অন্য ঔষধ নির্বাচন করিয়া ঐ একই নিয়মে প্রয়োগ করিতে হইবে।
এই রীতিতে পরবর্তী শক্তি প্রয়োগে বেশী বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ০/১ হইতে আরম্ভ করিয়া ০/২ ০/৩ ০/৪, এইভাবে ০/৩০ পর্যন্ত প্রয়োগ করা যায়। দুই শক্তির মধ্যে ব্যবধান খুবই কম হওয়ায় বেশী বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না।



প্রশ্ন- পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য কি?

উত্তর : পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য হইল ঔষধকে যতটা সম্ভব বেশী শক্তিকৃত করা। কিন্তু একই সাথে শক্তির তীব্রতা হ্রাসের জন্য যতটা সম্ভব বেশী পরিমাণে লঘুকরণ করা। ঔষধের ডাইনামিসকে নিয়ন্ত্রিত করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য। ফলে প্রয়োজন মত পুনঃপ্রয়োগ করা যায়। অথচ বৃদ্ধি ঘটিবে না বা ঘটিলেও স্বল্পকাল স্থায়ী হইবে।



প্রশ্ন- পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি ব্যবহারের সুবিধা কি কি? 

উত্তর : পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি ব্যবহারের সুবিধা নিম্নরূপ :
১) হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি যথাসম্ভব কম হয় এবং যেটুকু হয় তাহাও প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রিত করা যায়।
২) মানসিক রোগীতে যেখানে শততমিক শক্তির ঔষধ সামান্য মাত্রায় প্রয়োগ করিলেও বৃদ্ধি অনিবার্য এবং রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর, সেখানে পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তি কোন প্রকার বৃদ্ধি ছাড়াই আরোগ্য করিতে পারে।
৩) গভীর ক্রিয়াশীল ঔষধও দরকার মত বহুবার এমনকি মাসের পর মাস ব্যবহার করা যায়।
৪) সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিসের প্রাথমিক স্তরে যেখানে হ্যানিমান অধিক পরিমাণে বার বার ঔষধ প্রয়োগ করিতে উপদেশ দিয়াছেন সেখানে এই শক্তি অত্যধিক ফলপ্রসু।
৫) একই ধাতুগত ঔষধ একই সাথে উপশমদায়ক ও আরোগ্যকারী হিসাবে ব্যবহার করা যায়। উপশম প্রদানের জন্য পৃথক ঔষধ দরকার হয় না।
৬) দীর্ঘদিনের অবদমিত লক্ষণ পুনঃপ্রকাশের জন্য এই শক্তি উত্তম কাজ করে। 
৭) একদেশীয় বা দুরারোগ্য রোগে অনেক রোগীকে এই শক্তির ঔষধ আরোগ্যযোগ্য করিয়া তোলে।




প্রশ্ন-  পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ব্যবহারের অনুবিধা কি?

উত্তর : সর্বদা এই ঔষধ পরিশ্রুত পানিতে প্রয়োগ করিতে হয়। তাই পরিশ্রুত ও পরিশুদ্ধ পানি ছাড়া এই ঔষধ ব্যবহার করা যায় না। যাহাতে পানি নষ্ট না হয় সেজন্য উন্নতমানের সুরাসার ব্যবহার করা প্রয়োজন। ১৫ হইতে ৩০ দিন পর্যন্ত যাহাতে দ্রবণটা ভাল থাকে সেজন্য উন্নতমানের কর্ক ও শিশি ব্যবহার করা উচিত। বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কোন সময় ঔষধের লঘুকরণ ও প্রয়োগকাল বৃদ্ধি করিতে হইতে পারে। তাই দূরের রোগীদের ক্ষেত্রে এই শক্তির ঔষধ ব্যবহারে কিছুটা অসুবিধা দেখা দিতে পারে। ইহা ছাড়া প্রয়োগ পদ্ধতির এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সামান্য জটিলতা সাধারণ হোমিও চিকিৎসকদের এই শক্তির ঔষধ ব্যবহার নিরোৎসাহি করে।




প্রশ্ন- প্রাকৃতিক রোগশক্তি ও ঔষধশক্তির ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : প্রাকৃতিক রোগশক্তি ও ঔষধশক্তি ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন সদৃশ সৃ শক্তি। উহাদের ক্রিয়ার পার্থক্য হইল প্রাকৃতিক রোগশক্তি বিনাশর্তে জীবদেে উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না। যখন জীবনীশক্তির রোগ প্রবণতা থাকে কেবল তখনই জীবদেহ রোগশক্তি কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া অসুস্থ হয়। কিন্তু বিনাশর্তে সব সময় জীবদেহের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে এবং জীবে অসুস্থ হইয়া পড়ে। ইহার কারণ হইল- ক) জীবনীশক্তিতে স্বাভাবিকভাবে ঔষধজনিত রোগ জন্মিবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে রোগ প্রবণতা থাকে। খ) ঊষার শক্তি ও মাত্রা আমরা ইচ্ছামত হ্রাস-বৃদ্ধি করিতে পারি না।





সমাপ্ত






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ