স্যানিকিউলা - SANICULA, চতুর্থ বর্ষ - মেটেরিয়া মেডিকা


স্যানিকিউলা 
SANICULA




প্রতিশব্দ বা সমসূত্র:- অটোয়ার ঝর্ণার পানি একোয়া, স্যানিকিউলা প্রস্রবনের পানি।

উৎস ও ঔষধ প্রস্তুতি:- আমেরিকার অটোয়াতে প্রাপ্ত খনিজ ধাতু মিশ্রিত ঝর্ণার পানি হইতে ইহা প্রস্তুত হয়। খনিজ ধাতু মিশ্রিত ঝর্ণার পানিকে উত্তপ্ত করার পর যে লবণ অবশিষ্ট থাকে উহা হইতে বিচূর্ণাকারে ঔষধ প্রস্তুত করা হয়, পরে হোমিও ফার্মাকোপিয়ার নিয়মানুসারে তরল ক্রমে বিভিন্ন শক্তির ঔষধ প্রস্তুত হয়।

প্রস্তুতের ফরমূলা:- এফ-৭।

প্রুভার:- ডাঃ গান্ডুলাস ও ডাঃ সেরবিনো ইহা প্রভ করেন।

ধাতুপ্রকৃতি:- ইহা সোরিক, সাইকোটিক ও গভীর টিউবারকুলার ঔষধ।

মানসিক লক্ষণ:- রোগীর মন অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, সর্বদাই আদর যত্নে থাকিতে চায়, অনবরত খাইতে চায়। রোগী অতিশয় একগুঁয়ে খেয়ালী ও মতলবী। শিশুরোগী ক্রোধে একেবারে অধীর হইয়া পিছন দিকে বাঁকিয়া অবিরত চিৎকার করিতে থাকে। অন্ধকারে ও নিম্নগতিতে বড়ই ভয় পায়। শিশুদেরকে বিছানায় শোয়াইবার সময় নামাইবার পথে ভয় পাইয়া কাঁদিতে থাকে। অস্থির ও চঞ্চলমতি শিশু। কেহ তাহাকে স্পর্শ করিলে রাগিয়া যায়। আলোক ভীতি।

চরিত্রগত লক্ষণ:-
১) নিদ্রাকালে শিশুরোগীর মাথায় ও ঘাড়ে প্রচুর ঘাম হয় এবং ঐ ঘামে বালিশটি বহুদূর পর্যন্ত ভিজিয়া যায়।
২) রোগীকে দৃশ্যত গরম কাতর মনে হয় কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সে শীত কাতর, কিন্তু আশ্চর্য কথা প্রচণ্ড শীতের দিনেও সে তাহার পায়ের লেপটি খুলিয়া ফেলে।
৩) উপরোক্ত লক্ষণসহ শীর্ণতা।
৪) শীতল বাতাসে অথবা শীতল কিছু প্রয়োগে চক্ষু হইতে জল পড়ে।
৫) কর্ণের পশ্চাৎ দিকে হাজাবৎ স্থান । 
৬) দড়ির ন্যায় চটচটে ও টানিলে লম্বা হয় এই প্রকার শ্লেষ্মা।
৭) জিহ্বা বড়, থলথলে এবং জ্বালাকর। ঠাণ্ডা লাগিবার উদ্দেশ্যে জিহ্বা বাহির করিতে থাকে। জিহ্বার উপর দাহ।
৮) গাড়ীতে চড়িয়া বমনোদ্বেগ ও বমন, ঘনঘন কিন্তু অল্প পরিমাণে জল
পান করে। পেটের মধ্যে জল পড়িলেই বমি হইয়া যায়।
৯) মল বৃহদাকার, ভারী এবং নির্গমকালে বেদনাদায়ক। বহু কষ্ট করিয়া কোঁথ দিবার পরে মল আংশিক ভাবে নির্গত হয়। পশ্চাৎ দিকে চলিয়া যায় এবং গুহ্যদ্বারের কিনারায় ভাঙ্গিয়া খসিয়া পড়ে। মলে দুর্গন্ধ।
১০) উদরাময়, মল পরিবর্তনশীল।
১১) জরায়ুতে টাটানি ব্যথা। প্রদর, তৎসহ মাছের আচার অথবা পুরাতন পনীরের ন্যায় গন্ধবিশিষ্ট স্রাব। প্রদর স্রাবে পচা গন্ধ ।
১২) পায়ের তলায় জ্বালা ।
১৩) চর্ম মলিন, তৈলাক্ত বাদামী রং বিশিষ্ট এবং কুঞ্চিত।
১৪) দুগ্ধ পানের ইচ্ছা, খাইবার পর বাহ্য হয়।
১৫) পায়ের পাতায় ও মাথায় দুর্গন্ধ ঘাম।
১৬) যানবাহনে বিশেষতঃ জলযানে দুর্দমনীয় বমনেচ্ছা ও বমন।

প্রয়োগক্ষেত্র:- অসাড়ে বিছানায় প্রস্রাব, শিশুদের রিকেট পীড়া, উদরাময় ও কোষ্ঠবদ্ধতা, স্ত্রীপীড়া, শ্বেত প্রদর, জরায়ুর স্থানচ্যুতি, বাত পীড়া, নখের পীড়া, চর্মপীড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা প্রয়োগ হয়।

শিশুচিত্র:- শিশুরোগের ইহা উত্তম ঔষধ। শিশুদের শরীরে একেবারে বিবর্ণ ও শীর্ণ। দুর্বল শরীরে সর্বস্থানেই চুলকানি, অপরিচ্ছন্ন পদতল ও তাহাতে ক্ষতকারী আঁসটে গন্ধযুক্ত ও শীতল ঘর্ম, হাতের তলাও শীতল ঘর্মযুক্ত, মাথার পশ্চাৎদেশে ও ঘাড়ে প্রচুর ধর্ম, মাথায় মরামাস, চুলের লাবণ্যহীতা, কোষ্ঠবদ্ধতা বা উদরাময়, পেটটি বড় অথচ সব শরীরে বিশেষত গলদেশটি শুষ্ক। ইহাকে রিকেটস বা 'পুঁয়ে পাওয়া' বলে। ইহার শিশুর নিদ্রাকালে মাথায় ও ঘাড়ে প্রচুর ঘাম হয় এবং ঐ ঘামে বালিশটি। বহুদূর পর্যন্ত ভিজিয়া যায় । শীর্ণতাটি রোগী দেহে এত বেশী পরিস্ফুট থাকে যে, তাহাকে ঠিক যেন বৃদ্ধের মত দেখার গায়ের চামড়া যেন চকচক করিতে থাকে এবং ঘাড়ের চামড়া কোঁচকাইয়া ভাঁজ ভাঁজ মত হইয়া যায়। ইহার শিশু মাত্রই নিদ্রার মধ্যে শয্যায় মূত্রত্যাগ করে এবং তাহারা ক্রমেই অতিশয় শীর্ণ হইয়া পড়ে। অবস্থা যাহাই হউক অতিশয় ক্রুদ্ধ ও একগুঁয়ে মেজাজ যেন একটি ছোট খাট 'গুন্ডা' বিশেষ এবং তৎসহ নিম্ন গতিতে ও অন্ধকারে ভয় এই লক্ষণ কয়টি উপরোক্ত লক্ষণাবলীর সহিত বর্তমান থাকিলে নির্ভয়ে স্যানিকিউলা প্রয়োগ করা চলে।

কোষ্ঠবদ্ধতা ও উদরাময়ে:- স্যানিকিউলার কোষ্ঠবদ্ধতা ও উদরাময় দুই অবস্থাই বিদ্যমান। সেজন্য ইহার শিশুর কখনও কোষ্ঠবদ্ধতা আবার কখনও উদরাময় লক্ষণ বর্তমান থাকে। কোষ্ঠবদ্ধতার মল সহজে বাহির হইতে চায় না। অনেক সময় আঙ্গুল দিয়া বাহির করিতে হয়। সাদা সাদা গুটলে প্রকৃতির মল, শক্তই হোক বা নরমই হোক, অত্যন্ত কোথ দিয়া বাহির করিতে হয় এবং এলুমিনা ও কষ্টিকামের ন্যায় দাঁড়াইয়া মলত্যাগ করিলে মল বরং পরিস্কার হয়। কখনও বা ম্যাগ মিউরের ন্যায় মল কাটিয়া কাটিয়া বাহির হয় আবার কখনও বা সাইলিসিয়া ও থুজার ন্যায় খানিকটা বাহির হইয়া মলটি পুনরায় ভিতরে ঢুকিয়া যায়। স্যানিকিউলার শিশু সালফারের ন্যায় স্বভাবতঃ বড়উ অপরিচ্ছন্ন- তাহাকে যতই পরিষ্কার রাখা হোক না কেন, তাহার গায়ে মলের পদ্ধ ছাড়ে। ইহার মলে আর একটি অদ্ভূত লক্ষণ এই যে, মল চারিকোনা, ঠিক যেন বরফের মত ছুরি দিয়া চারিকোনা কাটা। ইহা ছাড়া সপ্তাহ কালব্যাপী মলবেগের অভাব, আমমিশ্রিত মল, নিদ্রাবস্থায় অসাড়ে আমরক্ত মিশ্রিত মলত্যাগ, রক্তস্রাব যুক্ত আঙ্গুর গুচ্ছের ন্যায় অর্শ বলিতে সূঁচ ফোটাবৎ সুতীব্র বেদনা, মলত্যাগ কালে নিম্নাস্ত্র বাহির হওয়া প্রভৃতি পালসেটিলা ও ক্যামোমিলার ন্যায় নানা বর্ণের পরিবর্তনশী। কখনও শেওলার মত, আবার কখনও বা ফেনাযুক্ত সবুজ বর্ণের বিশেষতঃ মলত্যাগের কিছুক্ষণ পরে আর্জেন্ট নাইটের ন্যায় মলের বর্ণটি সবুজ হইরা যায় এবং শিশু আহারের পর ক্যাক্টেরিয়া ফসের ন্যায় দুর্গন্ধ মল ত্যাগ করে। শিশুর গুহ্যদ্বারটি হাজিয়া ক্ষতযুক্ত হয় এবং মলত্যাগ কালে যন্ত্রণায় শিশু প্রায়ই কাঁদিতে থাকে।

প্রস্রাব লক্ষণ:- ইহার শিশুর মূত্রবেগ ধারণের অক্ষমতা বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। বেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি মূত্র ত্যাগের কথা চিন্তা করা মাত্রই প্রস্রাব ত্যাগ করিতে হইবে। তাহা না হইলে শিশু শয্যাতেই উহা ত্যাগ করিয়া ফেলে। সেজন্য শয্যা মূত্র রোগেও ইহা উপকারী। তবে ইহার শিশুর মূত্রে শয্যায় লাল দাগ ধরে। উক্ত লক্ষণের সহিত শিশুর বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক লক্ষণ একগুঁয়ে ও খিটখিটে মেজাজ, শীর্ণতা, ঘাড়ের চামড়ায় অতিশয় শুষ্কতা এবং ঐ স্থানে প্রচুর ঘর্ম, সর্দি প্রবণতা ও বুকে তরল সর্দির ঘড়ঘড় আওয়াজ এবং শীতের রাত্রে গাত্রাচ্ছাদন খুলিয়া ফেলার ইচ্ছা প্রভৃতি মনে রাখার মত লক্ষণ।

প্রদর স্রাবে:- মৎস্যগন্ধ বিশিষ্ট শ্বেতপ্রদর স্রাবই ইহার একটি বিশেষ লক্ষণ। উপরন্তু যোনিভ্যন্তরস্থিত যন্ত্রাদির বহির্গমন অনুভূতিটি এত প্রবল আকার ধারণ করে যে, রোগিনী যোনী পথটি হাত দিয়া চাপিয়া রাখিতে বাধ হয়। চলাফেরা করিলে উহা বৃদ্ধি এবং শয়নে বা বিশ্রামে উপশম পায়। গর্ভবর্তী নারীদের নিম্নাঙ্গের স্ফীতি। ইহার ধাতু স্রাব বিলম্বে প্রকাশিত হয় এবং ঐ সময় জরায়ুতে ভ্যাদাল ব্যথার ন্যায় ব্যথা থাকে। সঙ্গমের পর যোনী হইতে মাছ ধোয়া জলের ন্যায় গন্ধযুক্ত স্রাব নির্গত হয় এবং ভালভাবে স্নান করার পরও ঐ গন্ধ যায় না।

চর্মপীড়ায়:- পায়ের অতিরিক্ত ঘর্ম হওয়ার ফলে ঐ স্থানে ক্ষত, পায়ের আঙ্গুলে ঐ প্রকার ঘর্মের পর ক্ষত। কানের পেছনের দিকে সাদা সাদা আঠা আঠা রক্তস্রাবী ক্ষত হয়, জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদ্বারে হাজিয়া গিয়া রস নির্গত হয়। চোখের ভ্রু ও দাড়িতে প্রচুর আইশের মত খুস্কি উঠে।

নখের পীড়ায়:- নখের উপরও স্যানিকিউলা সুন্দর কাজ করে। অনেক সময় নখগুলি বিশেষতঃ হাতের নখগুলি মূলদেশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ঝুলিয়া পড়িলে ইহা উত্তম ক্রিয়া করে। তবে সর্বক্ষেত্রেই ইহার ধাতুগত লক্ষণের মিল থাকা চাই।

বাতরোগে:- রোগী পৃষ্ঠদেশে বা দক্ষিণ কক্ষের সংযোগ স্থলে টাটানি ও আড়ষ্টবহু বেদনা জন্য হাত দুইটি পিছনের দিকে ফিরাইতে বা উপরে ভুলিতে পারে না। তাহাতে বেদনা আরও বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় শক্ত কোনও জিনিষের উপর শয়ন করিলে উপশমবোধ করে কিন্তু মৃদু সঞ্চালন সহ্য করিতে পারে না।

প্রান্তদেশে কার্যকারিতা:- ইহার রোগীর হাতের তলায় ও পায়ের তলায় ঘর্ম এবং শীতলতা। মাথার পশ্চাৎদেশে ও ঘাড়ে ঘর্ম, মাথায় মরামাস, চুলের লাবণ্যহীতা। নিদ্রাকালে ইহার শিশুর মাথায় ও ঘাড়ে প্রচুর ঘাম হয়। শীর্ণতাটি এত বেশী সুপরিস্ফুট যে, রোগীকে দেখিতে বৃদ্ধের ন্যায়, ঘাড়ের চামড়া কোঁচকাইয়া ভাঁজ ভাঁজ মত হইয়া যায়। রোগীর গুহ্যদ্বারটি হাজিয়া ক্ষতযুক্ত হয়। রোগী পৃষ্ঠদেশে বা ডান কাঁধের সংযোগ স্থলে টাটানি ও আড়ষ্টরৎ বেদনা জন্য হাত দুইটি পিছন দিকে ফিরাইতে বা উপরে ভুলিতে পারে না। তাহাতে বেদনা আরও বৃদ্ধি পায়। রোগীর বিশেষ করিয়া হাতের নখগুলি মূলদেশ হইতে বিছিন্ন হইয়া ঝুলিয়া পড়ে। প্রান্তদেশে উপরোক্তরূপ কার্যকারিতায় স্যানিকিউলা উপযোগীতার সহিত ব্যবহৃত হয়।

বৃদ্ধি:- নিম্নগতিতে, অন্ধকারে, সামান্য স্পর্শে, সঞ্চালনে, পশ্চাৎদিকে হাত ফিরাইলে, আলোকে, শব্দে, ঋতু পরিবর্তনে, বিশেষতঃ ভিজা ঠাণ্ডায়।

উপশম:- আহারের পর, বিশ্রামে, উত্তাপে, খোলা বাতাসে।

সদৃশ ঔষধ:- ক্যামোমিলা, আয়োডিয়াম, নেট্রাম মিউর, সাইলিসিয়া, সিপিয়া, এলো।

শক্তি বা ক্রম:- ৩০ ও ২০০ শক্তি। ৫০ হাজার শক্তি পর্যন্ত ইহা ব্যবহারে সুন্দর ফল পাওয়া গিয়াছে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ