নিয়মনীতির উৎস ও উৎপত্তি - নিয়মনীতি - ১ম বর্ষ

  চতুর্থ অধ্যায়
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নিয়মনীতির উৎস ও উৎপত্তি 
Source and Origin of Principles of Homoeopathy





প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি কাহাকে বলে?

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমান রুগ্ন মানবতার আরোগ্য সাধন ও স্বাস্থ্যরক্ষার উদ্দেশ্যে স্বয়ং এবং তাঁহার অনুসারী ও সহযোগীদের মাধ্যমে বারংবার পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তিস্তম্ভ হিসাবে এবং চিকিৎসকের পথপ্রদর্শক স্বরূপ কতকগুলি বিধি বিধান প্রনয়ন করেন এবং ঐ সকল বিধি বিধান বারবারই নিরেট সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে, ঐ বিধি বিধানই হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি নামে অভিহিত । উদাহরণ স্বরূপ-সদৃশ নিয়মে চিকিৎসা, একক ঔষধ, সূক্ষ্ম ও পরিবর্তিত মাত্রা, ঔষধ পরীক্ষণ, ঔষধের শক্তিকরণ, রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্র্য, রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা প্রভৃতি । 





প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতির উৎস ও উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনা কর।

উত্তর : চিকিৎসার এক অন্ধকারময় যুগে মহাত্মা হ্যানিমান জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তখনকার দিনে চিকিৎসার কোন নিয়ননীতি ছিল না। চিকিৎসাকে লোকে তখন ভীতির চোখে দেখিত। একজন প্রখ্যাত এলোপ্যাথিক চিকিৎসক হইয়াও ইহার ক্ষতিকারক দিক দেখিয়া তিনি এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বর্জন করেন। এবং ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে তিনি চিরন্তন আরোগ্য নীতি হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করেন। কোন কোন উৎস হইতে কিভাবে হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন নিয়মনীতি আবিষ্কৃত হইয়াছে নিম্নে তাহা আলোচনা করা হইল : হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতির উৎসসমূহকে প্রধানতঃ দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা : 
(ক) পরোক্ষ উৎস ও 
(খ) প্রত্যক্ষ উৎস।
(ক) পরোক্ষ উৎস : যে সকল উৎসের মধ্যে হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির পরোক্ষ উৎস বা সন্ধান পাওয়া যায়, উহারা হইল হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতির পরোক্ষ উৎস। প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে কোন নিয়মনীতি ছিল না, তখনকার যুগের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মানবজাতির অকল্যাণই বেশী হইয়াছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অনুমান, আন্দাজ এবং অবৈজ্ঞানিক অবস্থা মহাত্মা হ্যানিমানকে দারুণভাবে চিন্তিত ও ব্যথিত করিয়াছিল। প্রচলিত এই অনিয়ম সমূহই তাঁহাকে পরোক্ষ ভাবে নিয়মনীতি অনুসন্ধানে প্রেরণা যোগায়।
(খ) প্রত্যক্ষ উৎস : যে সকল উৎসের মধ্যে হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ পরিচয় ও সন্ধান পাওয়া যায় ঐ সকল উৎসকে হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ উৎস বলা হয় । প্রত্যক্ষ উৎস সমূহ নিম্নরূপ
১) বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা, অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি দ্বারা হ্যানিমান তৎকালীন সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবৈজ্ঞানিকতা ও নিয়মশৃঙ্খলা হীনতা উপলব্ধি করিয়া ইহার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ সমূহ প্রাথমিক ভাবে হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ উৎস হিসাবে পরিগণিত। যেমন- ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে লিখিত ও ঔষধের কার্যকরী ক্ষমতা নির্ধারণের নতুন নিয়মনীতি এবং পরবর্তী নিয়মনীতি সম্পর্কে কতকগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা বিষয়ক রচনা', ১৭৯৭ খৃষ্টাব্দে লিখিত 'ব্যবহারিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহজলভ্যতার নিশ্চয়তা বিধান করার বাধা কি অনতিক্রম্য', ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে লিখিত অভিজ্ঞতা লব্ধ চিকিৎসা বিদ্যা', ১৮০৮ সালে লিখিত “চিকিৎসা বিজ্ঞানের পুনর্জন্মের বিরাট প্রয়োজনীয়তা' প্রভৃতি ।
২) উইলিয়াম কালেনের A treaties of the Materia Medica' পুস্ত কের ২য় খন্ডের সিঙ্কোনা অধ্যায়ে সিংকোনা দ্বারা “পাকস্থলীর উপর বলকারক ক্রিয়ার ফলাফল" সম্পর্কে হ্যানিমানের অনুবাদকের মন্তব্য এবং ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমানের নিজ দেহের উপর সিংকোনার প্রথম পরীক্ষণ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁহার সমগ্র জীবনের বহু ভেষজের প্রুভিং, তাঁহার সহকর্মীদের গ্রুডিং সমূহ, বিভিন্ন প্রুভিং সমিতির প্রুভিং সমূহ, প্রুভিং এর ফলাফল সম্বলিত বিভিন্ন পুস্তক পুস্তিকা, সংকলন এবং প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথের লিখিত বইপত্রসমূহ হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ উৎস।
হ্যানিমান লিখিত গ্রন্থসমূহ : ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত "ফ্রাগমান্ট ডি ভিরিবাস”, ১৮১০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত “অর্গানন অব মেডিসিন " নামক মহাগ্রন্থ এবং তৎপরবর্তী প্রকাশিত ইহার ছয়টি সংস্করণ, ১৮১১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত “মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা”, ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত " ক্রনিক ডিজিজেস”, প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ হোমিপ্যাথিক নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ উৎস। হ্যানিমান লিখিত 'অগনিন' মহাগ্রন্থ পাঠে একজন চিকিৎসক চিকিৎসা কার্যের নিয়মনীতি, রোগ সম্পর্কে জ্ঞান, ঔষধ সম্পর্কে জ্ঞান, চিকিৎসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য, আদর্শ আরোগ্য বিধান, ঔষধের প্রস্তুতি ও শক্তিকরণ, রোগ লক্ষণ, ঔষধ প্রয়োগের মাত্রা ও সময়, জীবনীশক্তি, রোগীর পথ্য ও পরিচর্যা প্রভৃতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিতে পারেন।
ইহা ছাড়া হ্যানিমানের পত্রাবলী, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ও সভা সমিতিতে প্রদত্ত ভাষণ সমূহও উৎস হিসাবে পরিগণিত।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি গুলি কি কি? বা, হোমিওপ্যাথির মূলনীতিসমূহ কি কি?

উত্তর : সুস্থদেহে প্রাকৃতিক রোগশক্তি ও ভেষজ শক্তির ক্রিয়ার পর্যবেক্ষণ, গবেষেণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হ্যানিমান আরোগ্য লাধনের শাশ্বত প্রাকৃতিক নীতি আবিষ্কার ও তাহার সার্থক প্রয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করিয়াছেন যাহা হোমিওপ্যাথি নামে অভিহিত। হোমিওপ্যাথির মূলনীতি বা নিয়মনীতিগুলি নিম্নরূপ যাহার উপর হোমিওপ্যাথির ভিত্তিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত ।
(১) সদৃশ নীতি : সুস্থ মানবদেহে কোন ঔষধ প্রয়োগ করা হইলে যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় সে সমস্ত লক্ষণ বিশিষ্ট কোন রোগীতে সে ঔষধ প্রয়োগ করিলে রোগী আরোগ্য লাভ করে। আরোগ্যের এই নিয়মকে হ্যানিমাन Similia Similibus Curantur বা সদৃশনীতিতে চিকিৎসা আখ্যায়িত করিয়াছেন। সুস্থ মানব দেহে ঔষধ প্রয়োগ জনিত লক্ষণসমূহ মেটিরিয়া মেডিকায় বর্ণনা করা আছে। কাজেই কোন রোগীর ক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষণ পাওয়া গিয়াছে, মেটিরিয়া মেডিকায় বর্ণিত ঔষধ সমূহের মধ্যে যে ঔষধে ঐ সব লক্ষণের সাদৃশ্য রহিয়াছে সেই ঔষধটিই উক্ত রোগীতে প্রয়োগ করিলে রোগ আরোগ্য হইবে।
(২) একক ঔষধ প্রয়োগ নীতি : হোমিওপ্যাথির নিয়ম হইল সদৃশমতে নির্বাচিত ঔষধ একক ও অবিমিশ্রভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে। কারণ প্রতিটি জঁনধের রোগ উৎপাদন ক্ষমতা স্বতন্ত্র। সুস্থ দেহে পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা একক ঔবধের বিশুদ্ধ গুণাবলীর পরিচয় পাই। একাধিক ঔষধ একই সঙ্গে প্রয়োগ করিলে যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে প্রাকৃতিক ব্যধির খুব কমই সাদৃশ্য থাকে।
(৩) ঔষধ পরীক্ষণ ঃ ঔষধের রোগ সৃষ্টিকারী এবং আরোগ্যকারী ক্ষমতার সাথে পরিচিত হওয়ার একমাত্র উপায় হইল ড্রাগ প্রুভিং বা ঔষধ পরীক্ষণ। যে ঔষধ চিকিৎসকের একমাত্র হাতিয়ার তা প্রয়োগ করার পূর্বে সেই ঔষধের উৎস, প্রকৃতি ও ধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার সম্পূর্ণরূপে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। সুস্থাবস্থায় ভেষজের যে শক্তি রোগোৎপাদন করে অসুস্থাবস্থায় সে শক্তিই রোগ দূরীভূত করে। আরোগ্যের মূলনীতিই হইল সদৃশনীতি। তাই হোমিওপ্যাথিক মূলনীতির অন্যতম। হইল ঔষধ পরীক্ষণ নীতি ।
(৪) একক মাত্রা : 'অর্গানন' গ্রন্থে হ্যানিমান একক মাত্রার ঔষধ প্রয়োগের নীতির কথা বলিয়াছেন। পরিবর্তিত একক মাত্রা প্রয়োগ অত্যন্ত আধুনিক, নিরাপদ ও অধিক কার্যকরী।
(৫) সূক্ষ্ম ও ক্ষুদ্রতম মাত্রানীতি : হোমিওপ্যাথিতে শক্তিকৃত ঔষধ ক্ষুদ্র প্ররোগ করা হয়। সুনির্বাচিত ঔষধের যতটা পরিমাণ ব্যবহার করিলে ঔষধের কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে না অথচ রোগী স্বল্পতম সময়ে স্থায়ীভাবে আরোগ্য লাভ করে, তাহাই ক্ষুদ্রতম মাত্রা। ক্ষুদ্রতম মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ হইলে প্রাণসত্ত্বা মৃদুভাবে উদ্দীপিত হয় এবং দেহতন্ত্রে সাম্যাবস্থা ফিরাইয়া আসার পক্ষেও সহায়ক।
(৬) শক্তিকৃত ঔষধ ব্যবহার নীতি : হোমিওপ্যাথি শক্তিতত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। হোমিওপ্যাথি মতে সুস্থাবস্থা, রুগ্নাবস্থা ও আরোগ্যবস্থা মানুষের সঙ্গীর সত্তার বিভিন্ন গুণগত অবস্থা। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় জীবনীশক্তি বনাম রোগশক্তি এবং জীবনীশক্তি ও ঔষধশক্তি বনাম রোগশক্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। জীবণীশক্তি ও রোগশক্তি সুক্ষ্ম। তাই ঔষধকেও সে স্তরে উন্নীত করিতে হইবে যেখানে রোগশক্তি ও জীবনীশক্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলিতেছে, এটা তখনই সম্ভব যদি ঔষধ স্থূলমাত্রায় প্রয়োগ না করিয়া শক্তিকৃত অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। ভেষজের অন্তর্নিহিত স্থূলশক্তির স্ফুরণ হয় শক্তিকরণের মাধ্যমে এবং শক্তিকৃত অবস্থায় হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
(৭) রোগীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ঔষধের সত্তাস্বাতন্ত্র্য্য ঃ রোগীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ঔষধের সত্ত্বাস্বাতন্ত্র্য হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির একটি বিশেষ দিক। আদর্শ আরোগ্য বিধানের জন্য রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে হইবে। রোগীর স্বতন্ত্রবোধক লক্ষন দ্বারা আমরা অসুস্থ ব্যক্তিটি হোমিওপ্যাথিক কোন ঔষধের রোগী তাহা নির্ণয় করিতে পারি। প্রতিটি মানুষের এমন কিছু বিশিষ্টতা থাকে যা তাকে অন্য মানুষ হইতে স্বতন্ত্র করিয়া তোলে। মানুষ যেমন স্বতন্ত্র তেমনি ঔষও স্বতন্ত্র । হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার কোন সাধারণীকরণ নাই ।
(৮) রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা; আঙ্গিক নয়, সামগ্রিক চিকিৎসা : হ্যানিমানের মতে এই নীতিটি প্রত্যেক চিকিৎসকের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। হোমিওপ্যাথিতে রোগ হইল দেহীর এক বিশেষ অবস্থা। রোগীতে প্রকাশমান যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক লক্ষণ গভীরভাবে অনুধাবণ করিয়া রোগের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়। প্রাকৃতিক চিকিৎসার নিয়ম হইল লক্ষণসমষ্টি দ্বারা চিকিৎসা করা। প্রতিটি মানবের জন্য প্রত্যেকটি রোগলক্ষণ স্বতন্ত্র, তাই লক্ষণ সমষ্টি দিয়াই রোগীর প্রযোজ্য ঔষধ নির্বাচন করিতে হইবে। সুতরাং রোগের চিকিৎসা না করিয়া রোগীর চিকিৎসা করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ হোমিওপ্যাথিতে দেহের কোন অংগের।
চিকিৎসা নাই। সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসা করিতে হয়। কারণ জীবণী শক্তির বিশৃঙ্খল অবস্থা হইলে দেহরাজ্যের বিভিন্ন অংগে বিকৃত লক্ষণ দৃষ্ট হয়। অংগ রোগী নহে। জীবনীশক্তি নিজেই রোগী। আংগিক রোগলক্ষণ জীবনীশক্তির পীড়িত হওয়ার সংকেত মাত্র।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তর : একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নিকট হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিনো হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হইল ।
(১) নিয়মনীতিই হইল হোমিওপ্যাথির ভিত্তি। হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসকের জ্ঞান অর্জন, রোগীর আদর্শ আরোগ্য সাধন, হোমিওপ্যাথির প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
(২) হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতিগুলি একজন চিকিৎসকের মহান উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করে এবং পথ প্রদর্শন করে।
(৩) চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অনুমান, অবৈজ্ঞানিকতা, কুসংস্কার অনির্ভরশীলতার পরিবর্তে হোমিওপ্যাথির নিয়ম নীতির দ্বারা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানভিত্তিক, কুসংস্কার বর্জিত, পরীক্ষা নিরীক্ষা ভিত্তিক এবং নির্ভরযোগ্য করিয়া - তুলিয়াছে ।
(৪) অতিদ্রুত, নির্ভরযোগ্য, নির্দোষভাবে, সহজবোধ্য নীতিতে রোগীর লক্ষণসমষ্টি নির্মূল করতঃ রোগীকে স্বাস্থ্যে পুনঃস্থাপন করার জন্য হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির সঠিক দিক নির্দেশ করে। হোমিওপ্যাথির নীতিমালা অনুসরণ না করিয়া আদর্শ আরোগ্য সাধন কোন কিছুতেই সম্ভব নয়।
(৫) হোমিওপ্যাথির নীতিমালা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় বহণ করে। রোগীর স্বাস্থ্য রক্ষা করা, রোগ প্রবণতা দূরীভূত করা, স্বাস্থ্যরক্ষা ও আরোগ্যের পক্ষে যাবতীয় ক্ষতিকর অবস্থা ও প্রতিকূল অর্থনৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক ও ক্ষতিকর রাষ্ট্রীয় তথা বিশ্ব পরিবেশকে নির্মূল করিয়া ব্যক্তি, পরিবার, জাতীয় তথা বিশ্বস্বাস্থ্য রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করিয়াছে ।
(৬) একজন আদর্শ চিকিৎসক হিসাবে চিকিৎসকের গুণাবলী নির্ধারণ ও গুণ অর্জনে উৎসাহিত করার জন্য হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি আদর্শ পথে চলিতে সহায়তা করে।
(৭) হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসরণ না করিয়া যে সব পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন রূপ মিশ্র পন্থার প্রচলন করিয়াছে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সে সব দেশে হোমিওপ্যাথিক দিনকে দিন ধ্বংস হইয়া যাইতেছে। অতএব হোমিওপ্যাথিকে টিকাইয়া রাখিতে গেলে নীতিমালা অবশ্যই অনুসরণ করিতে হইবে।



প্রশ্ন-  অর্গানন অব মেডিসিন কাহাকে বলে ?

উত্তর ঃ অর্গানন শব্দটি গ্রীক ভাষার Ergan শব্দ হইতে লওয়া হইয়াছে। ল্যাটিন ভাষায় ইহাকে বলে Organum, জার্মান ও ইংরেজী প্রতিশব্দ হইল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা দেহান্ত। অঙ্গপ্রতঙ্গসমূহ যেমন চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা প্রভৃতি। অভিধানগত অর্থ করিলে অর্গানন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় "Independent part of body which performs special functions" অর্থাৎ দেহস্থ বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যাহা সুনির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করিয়া থাকে তাহাকেই অর্গানন বলে ।
অর্গানন অব মেডিসিন বলিতে বুঝায় যে সমস্ত অংগ, অংশ অথবা সূত্র চিকিৎসাশাস্ত্রের নির্দিষ্ট কতকগুলো কাজকে নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করিতে সঠিক নির্দেশ দান করে তাহাকে অর্গানন অব মেডিসিন বলে। গ্রীসের দার্শনিক এরিষ্টটল তাঁহার যুক্তি শাস্ত্রের নাম রাখেন অর্গানন। অর্থাৎ ইহা হইল বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গবেষণার ধারাবাহিক নীতিমালামূলক ও নিয়মের একটি পদ্ধতি। মহাত্মা হ্যানিমান হোমিওপ্যাথির এই সংবিধান গ্রন্থে এরিষ্টটলের 'অর্গানন' শব্দটি একই অর্থে হুবহু ব্যবহার করিয়াছেন।




প্রশ্ন- অর্গানন হোমিওপ্যাথির পরম দিশারী বা অর্গাননকে হোমিওপ্যাথিক সংবিধান বলা হয় কেন?

উত্তর : হোমিওপ্যাথির নিয়মনীতির উৎপত্তি স্থান হইল অর্গানন। ইহাকে হোমিওশাস্ত্রের বেদান্তও বলা যায়। বেদান্ত শাস্ত্রে অধিকার থাকিলে যেমনি প্রতিটি বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়, তেমনি অর্গানন ভালভাবে জ্ঞাত হইলে হোমিওপ্যাথি তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। হোমিও বিজ্ঞানে অর্গানন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়া থাকে। যে চিকিৎসক অর্গাননের উপর যতটুকু দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জন করিতে পারিবেন, চিকিৎসা বিদ্যায় তিনি ততই সাফল্য লাভ করিবেন। পীড়া কি? মানব দেহে ইহা কিভাবে সংক্রমিত হইয়া মানুষের দেহ মনে বিভিন্ন লক্ষণের সৃষ্টি হয়, ঔষধ কি? কিভাবে ঔষধ আরোগ্য কার্য সম্পাদন করে, মানসিক ও দৈহিক কোন লক্ষণে কোন সুনির্দিষ্ট ঔষধ প্রয়োগ করা যাইবে, কতক্ষণ পর পর ঔষধ প্রয়োগ করা যাইবে, পরবর্তী ঔষধ কখন কিভাবে প্রয়োগ হইবে, আরোগ্যের প্রতিবন্ধকতা কি কি, ঐসকল প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায় কি প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা অর্গাননে আছে। এই সকল বিষয়ে জ্ঞান না থাকিলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সফলতা অর্জন অসম্ভব। তাই বলা যায় অর্গানন হোমিওপ্যাথির পরম দিশারী বা ইহাকে হোমিওপ্যাথিক সংবিধান বলাই যুক্তিযুক্ত।



প্রশ্ন- অর্গানন অব মেডিসিন পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর ।

উত্তর : চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষতঃ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রে মহাত্মা 'হ্যানিমান কর্তৃক লিখিত অর্গানন অব মেডিসিনের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্গানন অব মেডিসিন ছাড়া চিকিৎসা শাস্ত্র মূল্যহীন। অর্গানন পাঠে দেখা যায় ইহাতে আছে চিকিৎসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য, চিকিৎসার পদ্ধতি, রোগী পরীক্ষার পদ্ধতি, রোগীকে প্রশ্ন করার পদ্ধতি, রোগের প্রকার ভেদ, জীবনী শক্তির পরিচয়, মানসিক রোগ সৃষ্টির কারণ, সোরা সিফিলিস ও সাইকোসিসের উৎপত্তি ও বিকাশ, একসাথে কয়টি ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে, ঔষধের প্রয়োগ মাত্রা, ভুল ঔষধ প্রয়োগের পর করণীয় বিষয়, ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী, পথ্যাপথ্য প্রভৃতি অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী। উক্ত বিষয় সমূহ সম্বন্ধে যদি কোন চিকিৎসক অবহিত না হন, তাহা হইলে চিকিৎসা কার্য সম্পাদন তাঁহার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক চিকিৎসক অর্গাননের উপর বিশেষ নজর না দিয়া শুধুমাত্র মেটিরিয়া মেডিকার সাহায্যে চিকিৎসা করিয়া থাকেন। মেটিরিয়া মেডিকা একটি ঔষধ কোষ মাত্র। ইহাতে ঔষধের পরিচয় পাওয়া যায় বটে কিন্তু ইহার পরীক্ষা, নিরীক্ষা, শক্তি বিকাশ তত্ত্ব, সদৃশ লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, রোগ ও রোগী সম্পর্কিত ধারণা সহ উপরোলিখিত অর্গাননের বিষয় বস্তু কিছুই মেটিরিয়া মেডিকায় পাওয়া যায় না। চিকিৎসার নিয়মনীতি জানা না থাকিলে পূর্ণ চিকিৎসক হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রকৃত আরোগ্য ও রোগী চিকিৎসার জন্য অর্গানন শিক্ষা একান্ত অপরিহার্য।




প্রশ্ন- অর্গানন অব মেডিসিন কখন প্রকাশিত হয়?

উত্তর : এযাবত ডাক্তার হ্যানিমানের যুগান্তকারী হোমিও মহাগ্রন্থ 'অর্গাননের' ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮১০ খৃষ্টাব্দে অর্গাননের ১ম সংস্করণ, ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে ২য় সংস্করণ, ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে তৃতীয় সংস্করণ, ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে ৪র্থ সংস্করণ, ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ৫ম সংস্করণ এবং ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে ৬ষ্ঠ সংস্করণের পান্ডুলিপি রচিত হয় এবং ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ডাঃ বোরিক কর্তৃক অর্গাননের ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।



প্রশ্ন- বিভিন্ন নামপত্রে অর্গাননের নামকরণের পার্থক্য কি? বা, বিভিন্ন নামপত্রে অর্গাননের টাইটেলের কি কি পরিবর্তন সাধন করা হয়।

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমানের যুগান্তকারী হোমিও মহাস্থ "व" সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রতিটি সংস্করণেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জিত করা হয় এবং ছয়টি সংস্করণে গ্রন্থের নামকরণে তিনবার পরিবর্ত হয়।
১৮১০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত ১ম সংস্করণের নামকরণ করা হইয়াি "Organon of the Rational Healing Science" অর্থাৎ "মুক্তিসংগত আরোগ্য বিজ্ঞানের সংবিধান গ্রন্থ" এখানে আরোগ্য বিজ্ঞানের পূর্বে যুক্তিসংগত (Rational) কথাটি যোগ করার কারণ এই যে তখনকার দিনের প্রচলিত অন্যান্য আরোগ্য বিজ্ঞানকে বিশেষ করিয়া এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অযৌক্তিক প্রমাণ করাই ইহার উদ্দেশ্য ছিল।
দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থখানার নূতন নামকরন করা হয় "অর্গানন অব হিপিং আর্ট"। এখানে প্রথম সংস্করণের সহিত পার্থক্য এই যে, প্রথম সংস্করণের Rational কথাটি বাদ দিয়া Science কথাটি পরিবর্তন করিয়া Art কথাটি যুক্ত করেন। দ্বিতীয় সংস্করণের নামকরণের সার্থকতা আলাপ করিতে গেলে বলিতে হয় গ্রন্থের শিরোনাম সাধারণতঃ সংক্ষিপ্ত হওয়াই উচিত। তাই বৃহৎ নামটি দ্বিতীয় সংস্করণে সুন্দর ভাবে সংক্ষেপ করেন। তবে Rational, কথাটি বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় ১৮১০ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই নয় বৎসর হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিজ্ঞান অনেকটা সত্য বলিয়া প্রমানিত এবং প্রতিষ্ঠিত। আরোগ্য কার্যে এবং বাস্তবে যাহা যুক্তিসংগত তাহাকে বার বার যুক্তিসংগত বা Rational না বলাই ভাল। তাই দ্বিতীয় সংস্করণের শিরোনাম হইতে Rational শব্দটি বাদ দেওয়া অযৌক্তিক হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ Healing Science এর পরিবর্তে Healing Art বলিলেন কেন? উত্তরে বলা যায় Science শব্দটির অর্থ হইল বিজ্ঞান। অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য বলিয়া প্রমানিত বিশেষ জ্ঞান। ইহা Theoretical ও হইতে পারে আবার Practical ও হইতে পারে। শুধু Science বা বিজ্ঞান শব্দ দ্বারা ইহা Practical বা প্রয়োগমুখী কিনা তাহা বুঝানো সম্ভব নয়। Art শব্দের অর্থ হইল কলাকৌশল। Art কথাটির ধারা এই আরোগ্য বিজ্ঞান যে শুধু Theoretical নয় এবং ইহা যে বাস্তব ও প্রয়োগমুখী আরোগ্য বিজ্ঞান তাহাই প্রমাণিত হয়। ৩য়, ৪র্থও ৫ম সংস্করণেও এই নাম রাখা হইয়াছে ষষ্ঠ সংস্করণে ইহার নামকরণের পরিবর্তন সাধন করিয়া "অর্গানন অব মেডিসিন” নাম প্রয়োগ করেন। Healing art এর পরিবর্তে এখানে হ্যানিমান Medicine নামটি ব্যবহার করেন। বাংলা অর্থ করিলে দাঁড়ায় 'চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংবিধান গ্রন্থ'। এখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলিতে (Medicine) একটি আরোগ্যকারী বাস্তবধর্মী প্রয়োগমুখী ও মুক্তিসংগত বিজ্ঞান বুঝিয়া থাকে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্পন্ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলিতে হোমিওপ্যাথিকে বুঝানো হইয়াছে এবং হ্যানিমান ইহাকে Organon of Meadicine বলিতে কুণ্ঠিত হন নাই ।



প্রশ্ন- অর্গানন ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশের বিলম্বের কারণ কি?

উত্তর : ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে অর্গাননের ৫ম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশ হয় ৭৮ বৎসর পর অর্থাৎ হ্যানিমানের মৃত্যুর পর। কি কারণে এই বিলম্ব তাই নিম্নে দেওয়া হইল।
১৮৪২ খৃষ্টাব্দের ২০শে ফেব্রুয়ারী প্যারিস হইত হ্যানিমান প্রকাশক সোয়েবকে সংস্করণটি প্রকাশের জন্য পত্র মারফত জানান। কিন্তু প্রকাশের ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু হওয়ার পূর্বেই তিনি পরের বৎসর মৃত্যু বরণ করেন। ৬ষ্ঠ সংসরণ অর্গাননের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করার জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয় কিন্তু ডাঃ হ্যানিমানের বিধবা স্ত্রী ম্যাডাম মেলেনীর অতিরিক্ত অর্থ দাবী করায় প্রতিবারেই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের ৩রা এপ্রিল রিচার্ড ও জানডার ঘোষনা করেন হ্যানিমানের পৌত্র সুস হ্যানিমানের সম্পাদনায় ৬ষ্ঠ সংস্করণের অর্গানন গ্রন্থ প্রকাশিত হইতেছে। কিন্তু উদ্যেক্তাদেরকে ম্যাডাম মেলেনী পত্র মারফত স্মরণ করাইয়া দেন যে মূল পাণ্ডুলিপি একমাত্র তাহার নিকটই আছে এবং সে সাথে জার্মান গ্রন্থ স্বত্ত্বও। তাই আইনের বিধানে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ডাঃ হেরিং এর নেতৃত্বে ফিলাডেলফিয়ার দি ফ্যাকাল্টি অব দি হ্যানিমান মেডিকেল কলেজ হইতে ৬ষ্ঠ সংস্করণের অর্গাননের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন কিন্তু এবারও ম্যাডাম মেলেণীর অতিরিক্ত অর্থ দাবীর কারণে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। নিউইয়র্কের ডাঃ ক্যারল ডানহাম ও ম্যাডাম মেলেনীর সঙ্গে পান্ডুলিপি নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেন। কিন্তু কোন চুক্তি সম্পাদনের পূর্বেই তিনি মারা যান।
১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে ডাঃ বায়েস লন্ডন স্কুল অব হোমিওপ্যাথির পক্ষ হইতে ৬ষ্ঠ সংস্করণের পান্ডুলিপি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করিয়া ম্যাডাম মেলেনীর অগ্রাহ্য করার কারণে ব্যর্থ হন। হ্যানিমানের বিধবা পত্নীর ইচ্ছা ছিল পাণ্ডুলিপি আমেরিকার হোমিওপ্যাথদেরকে হস্তান্তর করিবেন এবং বিনিময়ে তিনি পঞ্চাশ হাজার ডলার অর্থ দাবী করিয়াছিলেন। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দের ২৭মে ম্যাডাম মেলেনী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁহার উত্তরাধীকারীগণ তাঁহার মৃত্যুর পর আর তেমন দর কষাকষি করেন নাই। অর্গাননের ৬ষ্ঠ সংস্করণ তাই ১৯২১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং ডাঃ বোরিক গ্রন্থখানার ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন।




প্রশ্ন-  কখন কাহার দ্বারা অর্গানন অব মেডিসিনের ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়?

উত্তর : ৬ষ্ঠ সংস্করণের পাণ্ডুলিপি দুইবার হারাইয়া খাওয়ার উপক্রম হয় । প্রথম বার ফ্রাঙ্কো প্রুসিয়ান যুদ্ধের সময় ১৮৭০-৭১ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯১৪-১৮ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময়। অবলুপ্তির চির অন্ধকার হইতে উদ্ধার করিয়া ডাঃ উইলিয়াম বোরিক ডাঃ হ্যানিমানের মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর ৬ষ্ঠ সংস্করণের ইংরেজী অনুবাদ করিয়া ১৯২১ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশ করেন।



প্রশ্ন-  অর্গাননের ৫ম ও ৬ষ্ঠ সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।

উত্তর ঃ ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে হ্যানিমান জার্মানের কোথেলে অবস্থান কালে অর্গানন ৫ম সংস্করণ সমাপ্ত করে। ইহার দশ বৎসর পর ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে তিনি ৬ষ্ঠ সংস্করণের পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত করিয়াছিলেন। ৬ষ্ঠ সংস্করণের ক্ষেত্রে তিনি সুদীর্ঘ ১০ বৎসর সময় পাওয়ায় তাঁহার আরও পরিণত বয়সে ইহার সাথে যুক্ত হইয়াছে তাঁহার জীবনের পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ বিরাট অভিজ্ঞতা। অর্গাননের ৫ম সংস্করণের প্রকাশ এবং ৬ষ্ঠ সংস্করণের পান্ডুলিপি প্রস্তুতের মাঝখানের সময়ের এই ব্যবধান মহাত্মা হ্যানিমান তাঁহার একাগ্র সাধনা, গবেষণা ও বাস্তব অজ্ঞিতার বহু নতুন তথ্য ও তত্ত্বের আলোকেই ৫ম সংস্করণের অনেক অংশের পরিবর্তন করেন এবং নূতন তথ্য যোগ করেন। নিম্নে অর্গাননের ৫ম ও ৬ষ্ঠ সংস্করণের পার্থক্য সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হইল ।
(১) ৫ম সংস্করণের গ্রন্থখানার নামকরন ছিল 'অর্গানন অব হিলিং আর্ট', ৬ষ্ঠ সংস্করণে ইহার নাম করণ করা হয় 'অর্গানন অব মেডিসিন'। .
(২) ৫ম সংস্করণ ১৮৩৩ খৃষ্ঠাব্দে প্রকাশিত হয়। ইহাতে সর্বমোট সূত্রের সংখ্যা ২৯৪। ৬ষ্ট সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২১ খৃষ্টাব্দে। ইহার সূত্র সংখ্যা ২৯১। ৫ম সংস্করণ হ্যানিমানের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়, আর ৬ষ্ঠ সংস্ককরণ তাঁহার মৃত্যুর ৭৮ বৎসর পর উইলিয়াম বোরিক কর্তৃক ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হয়।
(৩) ৫ম সংস্করণের কয়েকটি সূত্র যেমন : ৫২-৫৫, ৬০-৬৪, ২৪৬-২৪৮ প্রভৃতি সূত্রগুলি বাস্তবতার আলোকে অপুর্ণাঙ্গ ছিল। ৬ষ্ঠ সংস্করণের বাস্তবতার আলোকে ও লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা ৫ম সংস্করণের কয়েকটি সূত্র যেমন ৫২-৫৫, সূত্রসমূহ সম্পূর্ণ নতুনভাবে পরিবর্তিত আকারে উপস্থাপন করেন। ৬০-৭৫ সূত্রগুলিও পরিস্কারভাবে বিশ্লেষণ করেন।
(৪) ৫ম সংস্করণে জীবনীশক্তিকে Vital Force বলা হইয়াছে অথচ ৬ষ্ঠ সংস্করণে ঐ জীবনীশক্তিকে Vital Principle নামে অভিহিত করা হইয়াছে।
(৫) ৫ম সংস্করণে ১৪৮ নং অনুচ্ছেদটি নাই, যাহা ৬ষ্ঠ সংস্করণে নতুনভাবে সংযোজিত হইয়াছে। এই সূত্রে হ্যানিমান পীড়ার মূল কারণ সম্বন্ধে নতুন তথ্য দিয়েছেন।
(৬) ৫ম সংস্করণে ঔষধ প্রস্তুতের জন্য দশমিক ও শততমিক রীতির উল্লেখ করা হইয়াছে। ৬ষ্ঠ সংস্করণে উক্ত দুই রীতি ছাড়াও পঞ্চাশ সহস্রতমিক রীতির নতুন ভাবে সংযোজন করা হইয়াছে।
(৭) ৫ম সংস্করণে সূত্রসমূহের নিচে কোন পাদটীকা নাই। ৬ষ্ঠ সংস্করণে সূত্রে  প্রদত্ত বিষয়টিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য সূত্রের নীচে পাদটীকা সংযোজিত হইয়াছে।
(৮) ৫ম সংস্করণে ঔষধের ক্ষুদ্রমাত্রা বলিতে একটি মাত্র ছোট বটিকা বুঝাইয়াছেন। ৬ষ্ঠ সংস্করণে ক্ষুদ্রমাত্রা বলিতে বুঝাইয়াছেন একটি ক্ষুদ্রবটিকাকে ৮ হইতে ৪০ বড় চামচ পরিমান পানিতে সম্পূর্ণ মিশ্রিত করিয়া আলোড়নের মাধ্যমে উহা শক্তিকৃত করিতে হইবে। এ শক্তিকৃত ঔষধ হইতে এক ফোঁটা পরিমাণ ঔষধ অর্ধ আউন্স পরিমান পানিতে মিশ্রিত করিয়া সেই পানি হইতে স্বল্প পরিমানকে ক্ষুদ্রমাত্রা বলিয়াছেন।
(৯) ৫ম সংস্করণে ২৮৩ নং সূত্র বাতিল করিয়া ৬ষ্ঠ সংস্করণে নূতনভাবে লিখিত হইয়াছে। ২৮০ নং সূত্রেও 'হোমিওপ্যাথির বৃদ্ধি'কে বাতিল করিয়া ‘ঔষধজ রোগ' বলা হইয়াছে ।
(১০) ৫ম সংস্করণের ২৮৫ হইতে ২৮৯ এবং ২৯১ ও ২৯২ এই সূত্রগুলি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিয়া ৬ষ্ঠ সংস্করণে নূতনভাবে লিখিত হইয়াছে ।
(১১) ৫ম সংস্করণে তরুণ পীড়ায় শততমিক শক্তির ঔষধ ঘনঘন প্রয়োগের কথা বলা হইয়াছে এবং চিররোগে একবারে একটি মাত্র নির্দিষ্ট শক্তির ঔষধের একমাত্রা ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। ৬ষ্ঠ সংস্করণের তরুণ এবং চিররোগ উভয় পীড়াতেই পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ঔষধকে সূক্ষ্মশক্তিতে নিয়া প্রয়োগ করিতে উপদেশ দেন।
(১২) ৫ম সংস্করণে শততমিক শক্তির ঔষধ প্রয়োগের পর যে ঔষধজনিত প্রচন্ড অনভিপ্রেত বৃদ্ধি হইত, ৬ষ্ঠ সংস্করণে পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতির যথাযথ ক্ষুদ্রতম মাত্রায় প্রয়োগ করা গেলে সেইরূপ মারাত্মক বৃদ্ধির কোন ভয় নেই।
(১৩) ৫ম সংস্করণে ঔষধের দ্বারা একটি চির বা অচির রোগীকে আরোগ্য করিতে যে সময় লাগে, ৬ষ্ঠ সংস্করণের ঔষধের দ্বারা চিকিৎসা করা হইলে সেইরূপ দীর্ঘ সময় আর লাগে না। অনেক ক্ষেত্রে আগেকার অর্ধেক বা এক চতুর্থাংশ সময়ে তাহা করা যায়।
খ) নিয়মনীতি ও মতামত (Principle and opinion)




প্রশ্ন-  নিয়মনীতি ও মতামতের সংজ্ঞা দাও ।

উত্তর : নিয়মনীতির সংজ্ঞা : যাহার ভিত্তি করিয়া বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয়, যাহা অপরিবর্তনীয়, যাহা বিশ্বজনীন সত্য, স্বতসিদ্ধ, স্বতস্ফুর্ত এবং জ্ঞানের অনিবার্যরূপ তাহাই নিয়মনীতি। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত প্রচেষ্টার দ্বারা কোন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যে বিধি ব্যবস্থা আবিষ্কৃত এবং বার বার সত্য বলিয়া প্রমাণিত তাহাই হইল নিয়মনীতি। যেমন মাধ্যাকর্ষণ নীতি (The law of gravitation) বস্তুর অবিনাশিতাবাদ নীতি (The law of indestructibility of matter), শক্তির নিত্যতার সূত্র (The law of conservation of energy), গতির সূত্র (The law of motion), প্রাকৃতিক ক্রিয়ানীতি (The law of natural action) প্রভৃতি। নীতি বিশ্বজনীন অপরিবর্তনীয় সত্য। পৃথক পৃথক সত্য হইতে সমষ্টিগত সত্যে উপনীত হইয়া নীতি আবিষ্কার হয়। মহাত্না হ্যানিমানের আবিষ্কৃত আরোগ্য কলা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক নিয়মনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
মতামতের সংজ্ঞা : অণুমান, আন্দাজ বা অভিজ্ঞতার উপর বা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ধারনা হইতে যে তত্ত্ব প্রবর্তিত, যাহা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়, যাহা অন্ধ বিশ্বাস, ধারণা অনুসারে প্রচলিত তাহার নাম মতামত । মতামত অনবরত পরিবর্তিত হইতে থাকে, মতের অসারতা প্রমাণিত হইলেই ইহা পরিত্যক্ত হয়।
ব্যক্তিগত মতামতের উপর নির্ভর ও ভিত্তি করিয়াই প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালিত। ইহার কোন প্রাকৃতিক নিয়ম নাই। সেজন্য মহাতা হ্যানিমান প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে “Medicine of opinic" বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এবং “Medicine of principle” বা হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করিয়াছেন ।




প্রশ্ন- নিয়মনীতি ও মতামতের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : নিয়মনীতি ও মতামতের মধ্যে পার্থক্য নিম্নে প্রদত্ত হইল ।



প্রশ্ন- নিউটনের গতিসূত্রগুলি লিখ।

উত্তর : নিউটনের গতিসূত্রগুলি নিম্নে বর্ণিত হইল।
১) প্রথম সূত্র : কোন বস্তুর উপর বলের লব্ধি শূণ্য হইলে উহা স্থির থাকিবে অথবা সমবেগে সরল পথে চলিতে থাকিবে। ২) দ্বিতীয় সূত্র : বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার উহার উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং ভরবেগের পরিবর্তন প্রযুক্ত বলের দিকেই হইবে।
৩) তৃতীয় সূত্র : প্রতেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। 


প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাক্ষেত্রে নিউটনের গতিসূত্রের তৃতীয় সূত্র প্রমাণ কর।
বা, সদৃশ প্রতিহত করে, বিসদৃশ আকর্ষণ করে'-ব্যাখ্যা কর। 
বা, "ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সমান ও বিপরীত ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : রোগ ও ঔষধ দুইটি শক্তি। ঔষধশক্তির ধর্ম হইল রোগ শক্তিকে আঘাত করা ও প্রতিহত করা। বৈজ্ঞানিক নিয়ম হইল Similar Repels অর্থাৎ সদৃশ প্রতিহত করে। রোগ ও ঔষধ সদৃশ। প্রাকৃতিক রোগের বিরুদ্ধে ঔষধজ কৃত্রিম রোগকে নিযুক্ত করা হইলে প্রাকৃতিক সদৃশ নীতিতে উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলিতে থাকে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র হইল প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। মহাত্মা হ্যানিমানের চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্য নীতি হইল : 'Similia Similibus Curenture' অর্থাৎ সদৃশকে সদৃশ দ্বারা প্রতিহত করিয়া আরোগ্য সাধন করা। পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটে তাহা ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলেই ঘটিয়া থাকে। কাজেই প্রতিটি ঘটনায় দুইটি দিক থাকে। একটি ক্রিয়া অপরটি প্রতিক্রিয়া। ক্রিয়া যত বেগে দেওয়া হয়, প্রতিক্রিয়াও তত বেগে দেখা দিবে। এই ক্রিয়া দুই প্রকার। একটি শুভ অন্যটি অভ। রোগ মাত্রই অশুভ। এই অশুভ শক্তির ক্রিয়া হইতে বাঁচিবার জন্য দেহের ভিতরে অবস্থিত জীবনীশক্তি প্রতিক্রিয়া চালায়। রোগ শক্তির ক্রিয়া আর জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া সমান হইলে আমরা অসুস্থ হই না। ইহাকে বলে সদৃশ সদৃশকে প্রতিহত করে। অন্যদিকে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার চাইতে প্রবলতর হইলে আমরা অসুস্থ হই। ইহাকে বলে বিসদৃশ আকর্ষণ করে। যখন অধিক শক্তিশালী ঔষধ দ্বারা ক্রিয়া প্রদর্শিত হয়। তখন রোগের দিক হইতে প্রতিক্রিয়ার ভারসাম্যের অভাব ঘটে এবং রোগের বিপর্যয় ঘটে। ফলে আমরা আরোগ্য লাভ করি। তাই বলা হয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ক্ষেত্র নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রের সমতুল্য। অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ।



প্রশ্ন- বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি কি? আলোচনা কর। 
অথবা, আরোগ্যের বিশ্বজনীন নিয়ম “সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার আলোচনা কর।
অথবা, সদৃশনীতি অনুসারে আরোগ্য সম্পাদনের প্রক্রিয়া বর্ণনা কর। 
অথবা, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বা সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধ কি প্রক্রিয়ায় আরোগ্য সাধন করে ?

উত্তর : বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি হইল “Similia Similibus Curentur" অর্থাৎ সদৃশ বিধানে আরোগ্য সাধন। সংস্কৃতে বলা হয় “সমঃ সম সময়তি" এবং ইংরেজীতে বলা হয় “Let like be cured by like"। আরোগ্যের জন্য রোগ ও ঔষধ সদৃশ হইতে হইবে। সুস্থ মানবদেহে কোন ঔষধ প্রয়োগ করিলে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় সে সমস্ত লক্ষণবিশিষ্ট কোন রোগীতে সেই ঔষধ প্রয়োগ করিলে রোগী আরোগ্য লাভ করে। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে এই সদৃশনীতিতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে কেন এবং কিভাবেই বা আরোগ্য সম্পাদিত হয়। হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য নীতি নিউটনের গতি বিষয়ক তৃতীয় সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নীতিটি হইল : প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সুস্থ জীবনীশক্তি যদি রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহা হইলে জীবনীশক্তির বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং লক্ষণাকারে ইহা দেহের বিভিন্ন অংগে প্রকাশ পায়, ইহার নাম রোগ। আবার সদৃশবিধান মতে সুস্থ দেহে রোগাৎপাদিকা শক্তি সঞ্জীব সত্তার সংস্পর্শে আসিয়া প্রাকৃতিক রোগের অনুরূপ অথচ প্রবলতর এক কৃত্রিম রোগ সৃষ্টি করে। যেহেতু সদৃশ বিধান মতে প্রয়োগকৃত ঔষধের শক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী, তাই ঔষধ দ্বারা সৃষ্ট লক্ষণারাজিও প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ অপেক্ষা প্রবলতর হইবে। সজীব দেহে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম রোগ একসাথে দুইটি রোগের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যে প্রবলতর সদৃশ রোগলক্ষণ সৃষ্টি হয় তাহাতে পূর্বতন প্রাকৃতিক রোগের দুর্বলতর লক্ষণগুলি বিলীন হইয়া যায়। দুর্বলতর রোগলক্ষণসমূহ বিলীন


প্রশ্ন-৫.৯। উপশম কাহাকে বলে?

উত্তর : রোগীর কর্ণীকর উপসর্গসমূহ সাময়িকভাবে দূরীভূত করিয়া রোগীর আরাম বিধান করাকে উপশম বলে। উপশমের লক্ষ ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত সীমিত। উপশমে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার হয় না। রোগলক্ষণসমূহ চাপা পড়ে উপশমে রোগী সাময়িক ভাবে আরাম বোধ করে।

প্রশ্ন-৫.১০। আরোগ্য ও উপশমের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : আরোগ্য খুব ব্যাপক এবং এক নিগূঢ় অর্থ বহনকারী। আর উপশম অত্যন্ত সীমিত। আরোগ্যে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার হয়। কিন্তু উপশমে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার হয় না। আরোগ্যে রোগলক্ষণ দূরীভূত হয় আর উপশনে রোগলক্ষণ চাপা পড়ে। আরোগ্যে রোগী স্থায়ীভাবে আরামবোধ করে। আর উপশমে রোগী সাময়িকভাবে আরাবোধ করে।

প্রশ্ন-৫.১০। রোগীর আরোগ্য কিসের উপর নির্ভর করে?

উত্তর : আরোগ্য চিকিৎসাকলার প্রত্যক্ষ ফল। সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করিয়া ঔষধের সূক্ষ্ম ক্রিয়ার সাহায্যে ক্ষেত্রের পরিবর্তন সাধন দ্বারা ইহা সম্পন্ন করিতে হয়। রোগলক্ষণের সহিত ঔষধের লক্ষণ মিলিলে রোগ আরোগ্য হয়। সুস্থ দেহে ঔষধ প্রয়োগের ফলে যে সকল লক্ষণ প্রকাশিত হয়, প্রাকৃতিক রোগে ঐ সকল লক্ষণেই সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধটি প্রয়োগে রোগ লক্ষণ দূরিভূত হয়। এই সদৃশনীতি ভিন্ন অন্য কোন নীতি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই যাহা দ্বারা প্রকৃত আরোগ্য সাধন করা সম্ভবপর। আরোগ্য ক্রিয়া সামিত হয় রোগীর অবস্থার গুনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে যাহাতে তাহার দেহতত্ত্বে ডাইনামিক ভারসাম্য পুণঃস্থাপিত হয়, দেহযন্ত্রের ক্রিয়া আবার স্বাভাবিক ছন্দে অব্যাহত ভাবে চলে। প্রাকৃতিক নিয়ম সদৃশনীতি অনুসারে চিকিৎসার উপরই রোগীর আরোগ্য নির্ভর করে।

প্রশ্ন-৫.১২। হোমিওপ্যাথিক প্রাকৃতিক আরোগ্য নীতিটি কি?

উত্তর : আরোগ্য বিধানের জন্য আমাদের নিকট দুইটি মাত্র পথ খোলা আছে। একটি হইল বিসদৃশ, বিপরীত বা প্রকৃতি বিরুদ্ধ নীতি। এই পদ্ধতিতে এমন ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয়, সেই সব ঔষধ সুস্থদেহে এমন রোগলক্ষণ সৃষ্টি করে যার সঙ্গে রুগ্ন ব্যক্তির রোগলক্ষণের কোন সাদৃশ্য থাকে না। ইহা কোন প্রাকৃতিক নিয়ণ ভিত্তিক নয়।

অন্য পথটির ভিত্তি হইল প্রকৃতিকে নির্ভুলভাবে অনুসরণ করা অর্থাৎ প্রকৃতির ক্রিয়া ধারার পর্যবেক্ষণ, সর্তক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে
নিয়মনীতি ১৩৩

হোমিওপ্যাথিক রীতি বলা হয়। প্রকৃতির আরোগ্য বিধানের শাশ্বত নিয়মের উপর ভিত্তি করিয়াই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রাকৃতিক বিধান রচিত হইয়াছে। এই তত্ত্বের মূলকথা হইল মানবদেহে সংক্রমিত দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমন যারা স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যায় যদি শেষোক্ত রোগটি ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন হয় অথচ পূর্বতার রোগের সঙ্গে সদৃশ। লক্ষ বিশিষ্ট হয়।

প্রশ্ন-৫.১৩। দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক পীড়া একই শরীরে প্রবেশ করিলে দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে নির্মূল হয় কিভাবে?

বা, সদৃশবিধান যে আরোগ্যের একমাত্র প্রাকৃতিক উপায় তাহা কিভাবে প্রমাণ

করা যায়?

উত্তর : প্রকৃতির আরোগ্য বিধানের শাশ্বত নিয়ম হইল মানবদেহে সংক্রমিত দুর্বলতর প্রাকৃতিক রোগ অধিকতর শক্তিশালী অপর এক রোগের সংক্রমন রা স্থায়ীভাবে নির্মূল করা যায়, যদি শেষোক্ত রোগটি ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন হয়, অথচ পূর্বতর রোগের সংগে সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট হয়। কোন রোগ আরোগ্য করিতে হইলে আর একটি সদৃশ কৃত্রিম রোগ সৃষ্টি করিতে হইবে। অদৃশ্য কারণজ একটি পাঁড়া হইল প্রাকৃতিৰ পীড়া যাহাকে আমরা রোগ বলি। রোগী দেহে কতকগুলি লক্ষণ প্রকাশিত হয় যাহা দ্বারা আমরা বুঝি যে মানুষ রোগাক্রান্ত হইয়াছে। আবার ঔষধেরও রোগলক্ষণ সমূহের সদৃশ লক্ষণ উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে। সদৃশ ঔষধটি প্রাকৃতিক রোগের সমলক্ষণ সম্পন্ন লক্ষণসমষ্টি উৎপাদন করে। তাহা হইলে দেখা যায় যে প্রকৃত আরোগ্যকারী ঔষধ এবং প্রকৃত রোগের কারণ ইহারা উভয়ই অদৃশ্য এবং আরোগ্য করে ঔষধের উৎপত্তির মূল ও রোগের উৎপত্তির মূল বিভিন্ন অর্থাৎ ভিন্ন কারণ হইতে উৎপন্ন। উৎপত্তির মূল বিভিন্ন হইলেও ঔষধের এবং রোগের শক্তি কর্তৃক উৎপন্ন লক্ষণসমূহ সমধিক সদৃশ। দুইটি সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন পীড়া একই সঙ্গে একই দেহে অবস্থান করিতে পারেনা। একটিকে অপরটির জন্য স্থান ছাড়িয়া দিতেই হয়। যদি দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক পীড়া একই দেহে পরস্পর মিলিত হয় তাহা হইলে উহারা একে অন্যের ধ্বংস সাধন করে। এই ধ্বংস সাধন প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত রূপে সম্পাদিত হয়। দুইটি প্রাকৃতিক সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন পীড়ার মধ্যে দুর্বলতর পীড়াটি প্রবলতরটির নিকট নতি স্বীকার করে। যখন প্রবলতর রোগটি রোগীকে আক্রমন করে তখন ক্রিয়ার বা লক্ষণের সাদৃশ্য হেতু দেহের ঠিক সেই সেই অংশেই সে নিজের স্থান করিয়া নেয় যেখানে পূর্বের দুর্বলতর রোগশক্তি ক্রিয়া প্রকাশ করিয়াছিল। অতএব প্রথমে আগত সকল রোগশক্তি দ্বারা আবিষ্ট হইয়া দুর্বলতরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেজন্য দুইটি সদৃশ রোগ যখন একই দেহে মিলিত হয় তখন শক্তিশালীটি দুর্বলতরটিকে একেবারেই ধ্বংস করিয়া দেয়। ইহা হইতেই প্রমানিত হয় সদৃশ বিধানেই আরোগ্যের একমাত্র প্রাকৃতিক নিয়ম ।



প্রশ্ন- সদৃশনীতিতে প্রকৃতিতে পীড়া অপসারণের কয়েকটি উদাহরণ দাও।

উত্তর ঃ সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন পীড়া দ্বারা প্রাকৃতিক নিয়মে রোগ নিরাময়ের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। মহাত্মা হ্যানিমান অর্গানন গ্রন্থের ৪৬ সূত্রে এবং ৩০ সূত্রের পাদটীকায় এই সকল উদাহরণ ভুলিয়া ধরিয়াছেন। উদাহরণ স্বরূপ ভয়ংকর বসন্ত পীড়ার নাম করা যায় এই পীড়াটি সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন বহু পীড়া দূরীভূত ও আরোগ্য সাধন করিয়াছে। যেমন :

১) ডাঃ ক্লিন লক্ষ্য করিয়াছেন দুই বৎসর স্থায়ী অন্ধত্ব বসন্তের আক্রমনে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছে! 
২) বসন্ত পীড়ার প্রায়শঃই রোগী বধির হইয়া যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। জে, ক্লস বলিয়াছেন, বসন্তের আক্রমনে তিনি পুরাতন বধিরতা ও শ্বাসকষ্ট আরোগ্য হইতে দেখিয়াছেন ।
৩) বসন্ত পীড়ার প্রায়ই গুরুতর ভাবে অন্ডকোষ বৃদ্ধি দেখিতে পাওয়া যায়।
ডাঃ ক্লিন দেখিয়াছেন কোন ব্যক্তির বাম অন্ডকোষে আঘাত লাগিয়া স্ফীত হইয়াছিল, পরে ঐ ব্যক্তির বসন্ত পীড়া হওয়ায় তাহার অন্ডকোষ স্ফীতি আরোগ্য লাভ করিয়াছে।
৪) ডাঃ ওয়েন্ট দেখিয়াছেন যে, বসন্তের যন্ত্রণাদায়ক লক্ষণ যেহেতু আমাশয়, তাই একটি আমাশয় রোগীর বসন্ত হওয়ায় তাহার উক্ত পীড়া আরোগ্য লাভ করে।
৫) গো বসন্তের টিকা লইবার পর যদি বসন্ত পীড়া হয় তাহা হইলে টিকা বৃদ্ধি প্রাপ্ত না হইয়া শুকাইয়া যায়। যেহেতু বসন্ত প্রবল ও সদৃশ পীড়া। অন্যদিকে টিকা পাকিয়া গেলে বসন্ত রোগ আক্রমণ করিলেও বসন্তকে প্রশমিত ও মৃদু করিয়া দেয়, ডাঃ মুরী এইরূপ অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।
৬) অনেক পরিদর্শক লক্ষ্য করিয়াছেন যে, গো বসন্তের টিকা দেহে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হইলে শিশুর শরীরে পূর্ব হইতে অবস্থিত একপ্রকার চর্মপীড়া যাহা ছোট ছোট শুষ্ক কদাচিৎ বড় ও সপূঁজ চারিধারে লালবর্ণ যুক্ত স্ফোটক গোল গোল, উহা আরোগ্য হইতে দেখা যায়। ছেলেদের বহু দিন স্থায়ী ঐ প্রকার কষ্টদায়ক চর্মরোগ সদৃশ লক্ষণ হেতু গো বসন্তের টিকা উঠিবার পর সম্পূর্ণ ও স্থায়ীভাবে আরাম হইয়াছিল। 
৭) জে, হান্টার এবং হার্ডেজ বলিয়াছেন, গো বসন্তের টিকা লাল হইয়া উঠার সময় রোগী সবিরাম জ্বরে আক্রান্ত হয়, তাই সবিরাম জ্বরে আক্রান্ত দুইটি রোগীকে বসন্তের টিকা প্রয়োগের দ্বারা আরোগ্য করা হইয়াছিল।
৮) কোন ব্যক্তির জ্বালাকর হয় বৎসর স্থায়ী মুখ, ঘাড়, ও বাহুর চর্মরোগ প্রতি ঋতু পরিবর্তনের সময় বৃদ্ধি পাইত। হাম আক্রান্ত হওয়ার পর তাহার চর্ম রোগাক্রান্ত স্থানটির উপরিভাগ সামান্যমাত্র ফুলিয়া উঠে কিন্তু হাম আরোগ্য হওয়ার পর ঐ চর্মরোগটিও আরোগ্য হইয়া যায়। পুনরায় উহা আর দেখা যায় না।
উক্ত উদাহরণ হইতে হ্যানিমান দেখান যে দুইটি সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন পীড়া একই দেহে উৎপন্ন হইলে শক্তিশালীটি দূর্বলতরটিকে চিরতরে ধ্বংস করে। প্রকৃতির এই সব সদৃশ আরোগ্য নীতির সমর্থন ও প্রত্যক্ষ অনুসরণ লক্ষ্য করা যায় সদৃশ বিধান বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে। এই আরোগ্য নীতি এতদিন প্রকৃতিতেই ছিল। প্রকৃতি একমাত্র সদৃশ নিয়মেই রোগ আরোগ্য করে। হ্যানিমান ইহাকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করিয়াছেন। সেজন্যই হোমিওপ্যাথি একটি প্রাকৃতিক আরোগ্য বিধান।



প্রশ্ন-  আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম কি উপায়ে সমর্থিত হয়?

উত্তর : মহাত্মা হ্যানিমানের অভ্রান্ত উপলব্ধি ও বিশুদ্ধ পরীক্ষার ফলেই আমরা আরোগ্যের যথার্থ প্রাকৃতিক নিয়ম জানিয়াছি। রোগলক্ষণের সঙ্গে ঔষধলক্ষণ মিলিলে রোগ নিরাময় হয়। ঔষধ সুস্থদেহে রোগ উৎপাদন করে আবার অসুস্থদেহে রোগ আরোগ্য করে। সুস্থদেহে ঔষধ প্রয়োগের ফলে যে সকল লক্ষণ প্রকাশিত হয়, প্রাকৃতিক রোগে ঐ সকল লক্ষণেই সদৃশলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধটি প্রয়োগে রোগ লক্ষণ দূরীভূত হয়। তবে রোগলক্ষণ হইতে অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী সদৃশলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধটি সদৃশনীতি অনুসারে যাবতীয় পীড়া আরোগ্য করিয়া থাকে। পৃথিবীর সর্বত্রই আরোগ্য সাধনের এই যে প্রাকৃতিক নীতি তাহা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বিশুদ্ধ পরীক্ষা ও অভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ দ্বারা সর্বদাই ইহা প্রতীয়মান হইতেছে। এই সদৃশনীতি ভিন্ন অন্য কোন নীতি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই যাহা দ্বারা প্রকৃত আরোগ্য সাধন করা সম্ভবপর। আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম জগতে এভাবেই সমর্থিত হইয়াছে।
 খ) হোমিওপ্যাথিক ভেষজ ও নিরাময় (Homoeopathic Drug and Remery) :



প্রশ্ন-  ভেষজ বা ড্রাগ কাহাকে বলে?

উত্তর : যে পদার্থ মানব দেহতন্ত্রের সাম্যাবস্থায় বিশৃংঙ্খলা আনয়ন করে তাহাকে ভেষজ (Drug) বলে। ভেষজ দেহযন্ত্রের ক্রিয়াগত বৈলক্ষণ্য অনুভূতির বিকৃতি সাধন ও দেহকলার গঠনগত পরিবর্তন সাধনে সক্ষম। অর্থাৎ সজীবদেহে পীড়া উৎপাদন করিতে সক্ষম যাবতীয় বস্তুই ভেষজ। সুস্থ শরীরে ভেষজ প্রয়োগে শরীর অসুস্থ হয় এবং অসুস্থ শরীরে প্রয়োগ করিলে সুস্থ হইয়া উঠে। ভেষজ হইল ঔষধি গুনসম্পন্ন বস্তু যাহা হইতে ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। ভেষজ বিভিন্ন প্রকারের -যেমন উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজ রোগজ, সুস্থ গ্রন্থিরসজ, শক্তিজ প্রভৃতি।



প্রশ্ন-  ঔষধ বা মেডিসিন কাহাকে বলে?

উত্তর : যে পদার্থ মানবদেহে প্রবিষ্ট হইলে জীবনীশক্তির সুসামঞ্জস্য প্রাণক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করিয়া দেয় এবং একাধিক যন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত হয়, এই বিশৃংঙ্খলা আনয়নকারী ক্রিয়াই হইল ভেষজের রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা এবং কোন পদার্থের যদি এইরূপ ক্ষমতা থাকে তাহাকে আমরা ঔষধ বলি। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফার্মাকোপীয়ার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভেষজ পদার্থ হইতে প্রস্তুতকৃত পদার্থ যাহা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী প্রয়োগে রোগ আরোগ্য এবং রোগ প্রতিরোধ করিতে সক্ষম তাহাই ঔষধ। মূলত দুই শ্রেনীতে ঔষধকে ভাগ করা যায়। যথা : বিসদৃশ ঔষধ ও সদৃশ ঔষধ।





প্রশ্ন-  ভেষজ ও ঔষধের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : ভেষজ হইল ঔষধ প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল। হোমিওপ্যাথিক ভেষজ স্থূল পদার্থ বিশেষ। তবে শুধুমাত্র শক্তি শ্রেণীর ভেষজ সূক্ষ্ম। অপরদিকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সূক্ষ্ম শক্তি বিশেষ। পদার্থের মধ্যে ঔষধি গুন থাকিলেই উহাকে ভেষজ বলে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ভেষজ হইতে ফার্মাকোপীয়ার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রস্তুত না হইবে ততক্ষণ উহাকে ঔষধ বলা যায় না। বহু ভেষজ পদার্থ আমরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করি কিন্তু সচরাচর কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু ঔষধ মানবদেহে প্রতিক্রিয়া জন্মাইতে পারে। ভেষজ সুস্থ মানুষের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয় নাই কিন্তু ঔষধ সুস্থ মানুষের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হইয়াছে, বিশেষ করিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। হেমিওপ্যাথিতে রোগী চিকিৎসার জন্য সরাসরি ভেষজ ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু ঔষধ রোগীর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। ভেষজের রোগোৎপাদিকা শক্তি এবং রোগ বিনাশকারী শক্তি আছে কিন্তু রোগ প্রতিষেধক শক্তি নাই। অথচ ঔষধের রোগৎপাদিকা, রোগ বিনাশকারী এবং রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতাও আছে।
মোট কথা ঔষধ ও ভেষজ একই পদার্থ। সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষার পর ভেষজ পদার্থ দ্বারা উৎপন্ন লক্ষণসমূহ সঠিকভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে নির্ধারিত হয় এবং ভেষজের সেই রোগোৎপাদিকা শক্তিকে যখন রুগ্নব্যক্তির উপর আরোগ্যকারী শক্তিরূপে নিঃসন্দেহে প্রয়োগ করা হয় তখনই সেই ভেষজ পদার্থকে ঔষধ বলা হয়। ঔষধের রোগ চিত্র নির্ণিত হইয়াছে কিন্তু ভেষজের হয় নাই। সুপরীক্ষিত ভেষজই ঔষধ ।




প্রশ্ন- রিমেডি বা রোগ প্রতিকারক ঔষধ কাহাকে বলে?

উত্তর : নির্দিষ্ট উপসর্গ বা লক্ষণে ব্যবহৃত বিশেষ ঔষধটিকে রিমেডি বা রোগ প্রতিকারক বলে। অর্থাৎ যাহা দ্বারা দেহ ও মনের পীড়া বা বিকৃত লক্ষণাদি দূরীভূত হয় এবং যাহা দ্বারা দেহের বহিরাগত অহিতকর বস্তুর অপসারণ এবং স্বাস্থ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় তাহাকেই রিমেডি বলে।




প্রশ্ন- ভেষজ ও খাদ্যের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : যে পদার্থ দ্বারা মানবদেহতন্ত্রের সাম্যাবস্থায় বিশৃংঙ্খলা আনয়ন করে তাহাকে ভেষজ বলে। ভেষজের ক্রিয়া মানবদেহের পক্ষে ধ্বংসাত্মক। ইহার বিপরীত হইল খাদ্য। খাদ্য মানবদেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধির পক্ষে হিতকর ও অপরিহার্য। খাদ্য ও ভেষজ উভয়ই প্রাণসত্তার উপর ক্রিয়া করে। একই দ্রব্য বিভিন্ন অবস্থায় খাদ্য বা ভেষজ হইতে পারে। যেমন লবন সাধারণ ও পরিশুদ্ধ অবস্থায় আমাদের খাদ্য। কিন্তু শক্তিকৃত অবস্থায় সুস্থ দেহের পক্ষে ক্ষতিকারক। আবার এমন দ্রব্য আছে যাহা সাধারণ অবস্থায় মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক, কিন্তু ভেষজরূপে মানবের পক্ষে পরম কল্যাণকর। মানুষের সুস্থাবস্থায় খাদ্য যে কাজ করে রুগ্নাবস্থায় ভেষজ সেই কাজ করিয়া থাকে। উভয়ের কাজ হইল পুনর্গঠন মূলক। ভেষজ দেহযন্ত্রের ক্রিয়া বিশৃংখলা দূর করে এবং দেহতন্ত্রে শৃংঙ্খলা ও সাম্যাবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যাহাতে প্রাণক্রিয়া আবার স্বাভাবিক ছন্দে চলিতে পারে।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক ভেষজ ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : হোমিওপ্যাথিক ভেষজ : যে সকল ভেষজ হোমিওপ্যাথিক নিয়ম অনুযায়ী সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষা করা হইয়াছে উহাদিগকে হোমিওপ্যাথিক ভেষজ (Drug) বলে।
হোমিওপ্যাথিক ঔষ যে সকল হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ার নির্দিষ্ট ফরমূলায় সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষিত ভেষজ হইতে প্রস্তুত এবং যাহা সদৃশ নীতি অনুযায়ী আভ্যন্তরীন বা বাহ্যিক প্রয়োগে রোগারোগা ও রোগ প্রতিরোধ করিতে সক্ষম তাহাকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বলে।




প্রশ্ন-  হোমিওপ্যাথিক ঔষধের উৎসসমূহ কি কি?

উত্তর : ঔষধরূপে ব্যবহারোপযোগী অজস্র ভেষজ প্রকৃতির ভাণ্ডারে বর্তমান রহিয়াছে। ভেষজের উৎস অনুসারে ভেষজকে নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা চলে।

যথা :
(১) উদ্ভিজ্জ যেমন একোনাইট, আর্নিকা, ব্রায়োনিয়া, চায়না, নাক্স ভমিকা প্রভৃতি।
২) প্রাণিজ যেমন এপিস, ক্যান্থারিস, ল্যাকেসিস প্রভৃতি।
৩) খনিজ যেমন ক্যালকেরিয়া, সালফার, অরাম, ফেরাম, গ্রাফাইটিস প্রভৃতি । 
৪) রোগজ-যেমন সোরিনাম, সিফিলিনাম, মেডোরিনাম, ভ্যাকসিনিনাম।
৫) সার্কোস-অর্থাৎ সুস্থ প্রাণীকোষ বা গ্রন্থিরস হইতে তৈরী ভেষজ যেমন থাইরয়ডিনাম, কোলেস্টরিন, ইউরিক এসিড প্রভৃতি।
৬) অদৃশ্য শক্তি।
৭) স্টক ভ্যাকসিন ।
৮) বাউয়েল নোসোডস ।
৯) এন্টিবায়োটিক্স ।
১০) ইমপন্ডারেবিলিয়া অর্থাৎ ওজন করা যায় না এমন পদার্থ হইতে প্রস্তুত যেমন এক্স-রে, রেডিয়াম প্রভৃতি ।




প্রশ্ন-  হোমিওপ্যাথিক ঔষধের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

উত্তর : হোমিওপ্যাথিক ঔষধের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ :
১) হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বিভিন্ন ধরনের শক্তিকৃত পদার্থ ও শক্তিকৃত শক্তি বিশেষ। ঔষধ তৈরীর জন্য বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিজ, প্রাণীজ, খনিজ, রোগ বীজজাত প্রভৃতি পদার্থকে বিভিন্ন প্রকার ভেষজবহের সহিত নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রিত করিয়া শক্তিকৃত করা হয় ।
২) হোমিওপ্যাথিক ঔষধ একক ভাবে সুস্থ মানুষের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হইয়াছে। 
৩) হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণসমষ্টির সদৃশ লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়।
৪) একবারে একটি মাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীতে প্রয়োগ করা হয়। বিভিন্ন ঔষধের সংমিশ্রণ হোমিওপ্যাথিতে নাই।
৫) হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এক সময়ে একটি পরিবর্তিত মাত্রার প্রয়োগ করিতে হয়।
৬) হোমিওপ্যাথিক ঔষধের দ্বারা রোগের চিকিৎসা করা হয় না, রোগীর চিকিৎসা করা হয়। রোগীর কোন অংগ বিশেষের বা আংশিক চিকিৎসা করা হয় না। সামগ্রিক ভাবেই সম্পূর্ণ রোগীর চিকিৎসা করা হয়।
৭) হোমিওপ্যাথিক ঔষধ স্থূলমাত্রায় প্রয়োগ করা হয় না। সুক্ষ্ম বা ক্ষুদ্রতম মাত্রায় ইহা প্রয়োগ করিতে হয়।
৮) যথার্থভাবে সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন হোমিও ঔষধ প্রয়োগে আদর্শ আরোগ্য সাধিত হয় এবং রোগীর পূর্ব স্বাস্থ্য পুণরায় ফিরিয়া আসে।

 


প্রশ্ন- এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর : ঔষধের প্রকৃতি, নীতি, প্রয়োগ পদ্ধতি ও ক্রিয়াফলের উপর ভিত্তি করিয়া হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক ঔষধের পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হইল ৷



প্রশ্ন-  ঔষধ প্রয়োগ সম্বন্ধে প্রকৃতির শিক্ষা কি?

উত্তর ঃ ঔষধ সম্পর্কে প্রকৃতি হইতে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, রোগীকে দ্রুত, স্থায়ী ও নিশ্চিত রূপে আরোগ্য করিতে হইলে একমাত্র সদৃশ লক্ষণবিশিষ্ট ঔষধ নির্বাচন করিতে হইবে। ডাঃ ক্লিন দেখিয়েছেন বসন্ত রোগের অন্ধত্ব উৎপাদন করিবার ক্ষমতা হেতুই তাহা দ্বারা বৎসরাধিক কাল স্থায়ী অন্ধত্ব দূরীভূত হইয়া গিয়াছে। এইরূপ অনেক দৃষ্টান্ত খ্যাতনামা চিকিৎসকগন লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। সমলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধ নির্বাচন করার জন্য প্রকৃতিই আমাদিগকে শিক্ষা দেয়। আগুনে হাত পুড়িয়া গেলে যদি ঠান্ডা জলে হাত ডুবাইয়া রাখা হয়, তাহাতে ক্ষণিক যন্ত্রনা হ্রাস হয় কিন্তু পরক্ষণেই ফোস্কা পড়িয়া যায় ও ক্ষত হয়। কিন্তু সেই পোড়া হাত যদি আগুনের সামান্য উত্তাপে রাখা যায় তাহা হইলে অল্প সময়ের জন্য জ্বালা বৃদ্ধি পাইলেও পরমূহূর্তে জ্বালার উপশম হয়, ফোস্কা বা ঘাও হয় না। শীঘ্রই স্থায়ী ভাবে আরোগ্য হইয়া যায়। এই সকল ঘটনার দ্বারা অত্যন্ত সহজ ভাবেই বুঝা যায় যে সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন চিকিৎসাই প্রকৃত আরোগ্যের সাধক। ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা আরোগ্য সাধন করিতে হইলে সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধই প্রয়োগ করিতে হইবে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক উদাহরণ হইতে আমরা বুঝিতে পারি যে, আরোগ্যের জন্য ঐ সকল ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে, যে সকল ঔষধে ঐ জাতীয় পীড়া সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে।
 



প্রশ্ন- কি প্রকার ঔষধ সমূলে রোগ বিনাশ করিতে পারে? 
বা, ঔষধ সদৃশ লক্ষণ না বিসদৃশ লক্ষণের দ্বারা আরোগ্য সাধন করে?

উত্তর : চিকিৎসাধীন রোগীতে রোগ লক্ষণ সমূহ দূরীভূত করার জন্য হ্যানিমান দুই প্রকার ঔষধ প্রয়োগের কথা বলিয়াছেন। একটি হইল সদৃশনীতি অর্থাৎ রোগীদেহে প্রকাশিত লক্ষণ সমূহের সদৃশলক্ষণ উৎপাদনকারী একটি ঔষধের সাহায্যে। অপরটি হইল বিসদৃশনীতি অর্থাৎ রোগী দেহে প্রকাশিত লক্ষণের বিপরীত লক্ষণ সৃষ্টিকারী একটি ঔষধের সাহায্যে। হ্যানিমান যে অভিজ্ঞতার উপর জগতের জীবন রক্ষাকারী ঔষধের প্রয়োগবিধি স্থাপন করিয়াছেন তাহা সহজলভ্য নয়। তিনি এখানে অভিজ্ঞতা বলিতে বিদ্ধে, প্রকৃতিলব্ধ, সত্যময় অভিজ্ঞতার কথা বলিয়াছেন। যে অভিজ্ঞতা আজ এক প্রকার, আগামীকাল অন্যরূপ দেখায় তাহার কোন মূল্য নাই। অর্থাৎ সত্যময় অভিজ্ঞতার কোন পরিবর্তন নাই। একবার অভিজ্ঞতা হইতে বুঝা গেল কুইনিন সর্বজ্বরের ঔষধ। কিন্তু যদি কয়েকদিন পর দেখা যায় যে কুইনিন। প্রয়োগে সর্বপ্রকার জ্বর সারে না, তখন যদি তাঁহারাই আবার বলেন আর্সেনিক সক জ্বরের ঔষধ। তবে এই অভিজ্ঞতাকে কে বিশ্বাস করিবে। আর রোগীও বা কেন এই জাতীয় ঔষধ প্রয়োগে আরোগ্য লাভ করিবে? একমাত্র অভ্রান্ত অভিজ্ঞতা ও সত্যমর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করিয়াই যাহা সদৃশ বিধান নামে বর্তমানে পরিচিত, সে ভাবেই ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে। সদৃশ বিধানমতে ঔষধ প্রয়োগের পর রোগলক্ষণ সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। শুধু তাহাই নয়, সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধ নির্বাচন ছাড়াও ঔষধের শক্তি রোগের শক্তি অপেক্ষা, অধিকতর হওয়া প্রয়োজন। তাহা হইলেই ঐ ঔষধ শীঘ্র নিশ্চিত রূপে ও সমূলে রোগ নির্মূল করিতে পারে। এখানে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে ঔষধ শুধু সমলক্ষণ মতে হইলেই রোগ আরোগ্য হয় না, ঔষধের শক্তি রোগ শক্তি অপেক্ষা আরও শক্তিশালী হইতে হইবে। অতএব ঔষধ নিসদৃশলক্ষণ দ্বারা আরোগ্য কাজ সম্পাদন করিতে পারে না, সদৃশ লক্ষণের সাহায্যেই আরোগ্য ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।




প্রশ্ন- ঔষধের কিরূপ শক্তি থাকা আবশ্যক?
বা, সুস্থ ব্যক্তিকে অসুস্থ করিতে না পারিলে ঔষধ রোগ আরোগ্য করিতে পারিত না কেন? 
বা, মানব স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা না থাকিলে ঔষধ কখনও রোগারোগ্য করিতে পারিত না-উক্তিটির যথার্থতা প্রমাণ কর।
বা, প্রাকৃতিক পীড়া আরোগ্য করিতে হইলে ঔষধের কি কি গুণ থাকা আবশ্যক?

উত্তর : মানুষের স্বাস্থ্য ইন্দ্রিয়াদির সহজ ও স্বাভাবিক অনুভূতি ও ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। সুস্থ লোকের শারিরীক ও মানসিক এই অবস্থার যদি পরিবর্তন হয়। তবে তাহার নাম রোগ, যাহা বাহ্যিক ভাব লক্ষণ রূপে প্রকাশ লাভ করে। আবার রুগ্ন অস্বাভাবিক অবস্থা হইতে পুনরায় স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের নাম। আরোগ্য। অর্থাৎ রোগ লক্ষণ সমূহ অপসারিত হইলেই আরোগ্য সম্পাদিত হয়। যাহা ঔষধ তাহা মানব স্বাস্থ্যের বিকৃতি উৎপাদন করিতে পারে; অর্থাৎ সুস্থ ঔষধ প্রয়োগ করিলে ঔষধশক্তি জীবনীশক্তির উপর ক্রিয়াশীল হইয়া জীবনীশক্তির বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, ফলে দেহ ও মনে কতিপয় লক্ষণ জন্মায়। অর্থাৎ সুস্থ ব্যক্তিকে অসুস্থ করিতে পারে, মানব স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটাইতে পারে। ঠিক তেমনি প্রয়োগকৃত সদৃশ ঔষধ রোগীর শারীরিক মানসিক অনুভৌতিক ক্রিয়া সমূহের পরিবর্তন সাধন করে এবং রোগীর অস্বাভাবিক অবস্থার বিনাশ সাধন করিয়া রোগীকে সুস্থাবস্থায় ফিরাইয়া আনে। সদৃশ নীতির ফলেই এই আরোগ্য অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সংঘটিত হয়। যদি ঔষধ শক্তি সুস্থাবস্থায় শারীরিক ও মানসিক বিকৃতি আনয়ন করিতে না পারিত তাহা হইলে বিকৃত শারীরিক ও মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন সাধন করিতে পারিত না। অতএব ঔষধ সমূহ স্বাস্থ্যের বিকৃতি উৎপাদন করিতে পারে বলিয়াই তাহারা রোগজ শারীরিক, মানসিক ও অনুভৌতিক বিকৃতি সমূহও দূর করিতে পারে। অতএব ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হইতে হইলে উহার স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি থাকা একান্তই আবশ্যক। ঔষধের আর একটি শুন আছে, তাহা হইল ঔষধের প্রকৃতি ও প্রতিকৃতি রোগের প্রকৃতি ও প্রতিকৃতির সদৃশ হওয়া প্রয়োজন। আরোগ্য সাধনের জন্য যে ঔষধ প্রয়োগ করা হইবে, ঐ ঔষধের রোগীর লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ লক্ষণ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকিতে হইবে। একমাত্র রোগশক্তি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী এবং সদৃশ ঔষধই রোগ নিরাময় করিয়া প্রকৃত আরোগ্য সাধন করিতে পারে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ঔষধ যত শক্তিশালী হোক না কেন, তাহা যদি সদৃশ না হইয়া বিসদৃশ হয় তবে কিছুতেই রোগ আরোগ্য করা যাইবে না।




প্রশ্ন- ঔষধের আরোগ্য সাধিকা শক্তি সম্বন্ধে কিভাবে পরিচয় পাওয়া যায়?

উত্তর : যে বস্তু সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে অর্থাৎ যে বস্তুর মধ্যে স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি নিহিত আছে তাহাই ঔষধ। সুস্থ দেহে যেমন ঔষধ রোগ সৃষ্টি করে তেমনি অসুস্থ দেহের রোগ আরোগ্যও ঔষধ দ্বারা হইয়া থাকে অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সাধন করে। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি বা আরোগ্য সাধিকা শক্তি ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয় যে ইহা দৃষ্টিগোচর হইতে পারে। তবে পর্যবেক্ষণ দ্বারা পরিলক্ষিত হয় যে, ঔষধ প্রয়োগে সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। ঔষধের এই আরোগ্য সাধিকা শক্তির পরিচয় জানিতে হইলে একমাত্র পথ হইল "সুস্থ মানবদেহে ইহার প্রয়োগ" । সুস্থ দেহে ঔষধ প্রয়োগ হইলে ঔষধের অন্ত নিহিত শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়া সুস্থ ব্যক্তির দেহ মনে বিপর্যয় সাধিত হয়, বিকৃত লক্ষণ উৎপাদিত হয়, অদ্ভূত অদ্ভূত লক্ষণসমূহ উৎপাদিত হইয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয়। তাই ঔষধের আরোগ্য সাধিকা শক্তির পরিচয় লাভের জন্য সুস্থ দেহে যে সব অস্বাভাবিক ও বিকৃত লক্ষণাদি উৎপাদিত হইয়াছে ঐ সম্পূর্ণ লক্ষণ সমষ্টির উপর নির্ভর করিতে হইবে। অর্থাৎ ঐ লক্ষণ সমষ্টি দ্বারা গঠিত রোগ চিত্রই ঔষধের আরোগ্যকারী ক্ষমতার পরিচয় বহন করে। ঐ জাতীয় লক্ষণ সমষ্টি রোগীদেহে উৎপাদিত হইলে সদৃশ ঔষধটি প্রয়োগে ঐ সকল লক্ষণ দূরীভূত হয়, অর্থাৎ ঐ ঔষধ দ্বারা আরোগ্য সাধিত হয়। কাজেই ঔষধের রোগ উৎপাদিকা ক্ষমতা হইতে উহার আরোগ্য সাধিকা শক্তি সম্পর্কে আমরা অবহিত হইতে পারি। মনে রাখিতে হইবে যে ঔষধের রোগ উৎপাদিকা শক্তি ও রোগ নাশিনী শক্তি একই, উহা কোন পৃথক বস্তু নয় ।





প্রশ্ন- ঔষধের রোগোৎপাদিকা শক্তির পরিচয় কিভাবে পাওয়া যায়?

উত্তর : ঔষধ প্রাণসত্তার উপর নিঃশর্ত ভাবে ক্রিয়া করে। ঔষধের এই ক্রিয়া 'প্রাণসত্তার পক্ষে শত্রুভাবাপন্ন। প্রাণসত্তায় স্বভাবতই তাই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন হয় কতকগুলি লক্ষণের মাধ্যমে। প্রাকৃতিক রোগ শক্তির আক্রমনে যেমন লক্ষণসমূহের সৃষ্টি হয়, ঔষধ প্রয়োগেও দেহীর দেহ ও মনে বিচিত্র লক্ষণরাজি সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত লক্ষণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমস্ত লক্ষণের মধ্যে এক নিবিড় যোগ সূত্র থাকে। সমস্ত লক্ষণ মিলিত ভাবে এক অখন্ড রোগ চিত্র তুলিয়া ধরে। প্রকৃতিতে প্রতিটি উদ্ভিদ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি পদার্থ আকৃতি ও প্রকৃতিতে স্বতন্ত্র । প্রতিটি ভেষজও তাই সুস্থ মানবদেহে যে ক্রিয়া প্রকাশ করে তাহা স্বতন্ত্র। কাজেই কোন ঔষধ সুস্থদেহে যে লক্ষণসমষ্টি সৃষ্টি করে অন্য কোন ঔষধ প্রয়োগে সেই লক্ষণসমষ্টি হয় না। ইহা হইতে ঔষধের রোগোৎপাদিকা শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কিভাবে ক্রিয়া করিয়া থাকে?

উত্তর : হোমিওপ্যাথিতে ঔষধের ক্রিয়া অতীন্দ্রিয় স্তরে হইয়া থাকে। শক্তিকৃত অবস্থায় ঔষধের অন্তর্নিহিত শক্তির স্ফুরণ হয়। ঐ শক্তিকৃত ঔষধ মানবদেহে প্রয়োগের সাথে সাথে বিপরীতধর্মী প্রাণসত্তার দিকে ধাবিত হয়। কেননা বিপরীতধর্মী শক্তি পরস্পরকে আকর্ষণ করে। অসংখ্য সংজ্ঞাবাহী স্নায়ুর সাহায্যে ঔষধশক্তি প্রথমে মস্তিষ্কে এবং পরে সারা দেহে ছড়াইয়া পড়ে। রোগ শক্তির ন্যায় ঔষধশক্তিও প্রাণসত্তা বা জীবনীশক্তির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। ফলে প্রতিরোধ মূলক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যেহেতু ঔষধটি রোগ লক্ষণের সহিত সাদৃশ্য যুক্ত কাজেই ঔষধ শক্তি রোগী দেহতন্ত্রের ঠিক সেই অংশে রোগ লক্ষণের সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করিবে, যে অংশে রোগশক্তি পূর্ব হইতে রোগলক্ষণ সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে। যেহেতু ঔষধশক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা প্রবলতর সেজন্য ঔষধশক্তি রোগ শক্তির অধিকার করা স্থানটি দখল করিয়া নেয়। সদৃশ মতে ঔষধ প্রয়োগ করা হইলে ঔষধের সেই সব লক্ষণই ক্রিয়াশীল হয় যেগুলির সহিত রোগলক্ষণের মিল আছে। ঔষধের অন্যান্য লক্ষণ প্রাকৃতিক রোগ লক্ষণের সহিত কোন রূপ সম্পর্ক না থাকায় আদৌ কার্যকরী হয় না। এই কারণে ঔষধ প্রয়োগে অপর কোন অংশে নূতন কোন রোগলক্ষণ সাধারণতঃ প্রকাশ পায় না। হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ অত্যন্ত ক্ষুত্র মাত্রায় প্রয়োগ হয় বলিয়া ইহার ক্রিয়া প্রবলতর হইলেও স্বল্পক্ষণ স্থায়ী হয়। সেজন্য ঔষধের ক্রিয়াকাল শেষ হইলে ঔষধ সৃষ্ট লক্ষণারাজিও তিরোহিত হয়।




প্রশ্ন-  ঔষধ দ্বারা রোগ আরোগ্যের সুবিধা কি?
বা, প্রাকৃতিক রোগ সদৃশ শক্তিশালী প্রাকৃতিক রোগ দ্বারা চিকিৎসার পরিবর্তে সদৃশ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের দ্বারা আমরা কেন চিকিৎসা করি?
বা, প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ অপেক্ষা সমলক্ষণযুক্ত ভেষজ প্রয়োগের সুবিধা কি? 

উত্তর : প্রকৃতি রোগের সাহায্যে রোগ আরোগ্য করে সত্য কিন্তু সমলক্ষণ মতে রোগ আরোগ্য করিতে প্রকৃতির হাতে খুব অল্প সংখ্যক পীড়াই আছে। ঐ সকল পীড়া বসন্ত, হাম প্রভৃতি মারাত্মক পীড়া। এই সকল মারাত্মক পীড়া দ্বারা সমলক্ষণ মতে রোগ আরোগ্য হইলেও তাহা অনিশ্চিত ও বিপদ সংকুল। আমাদের চোখের সামনে আমরা দেখিতে পাই যে, পৃথিবীতে অসংখ্য ভেষজ পদার্থ আছে তাহা প্রয়োগ করিয়া মানুষের সকল পীড়া আরোগ্য করা যায়। তাহা ছাড়া পীড়া আরোগ্যের জন্য সদৃশ লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক পীড়া ব্যবহার করা অপেক্ষা এই সকল ভেষজ দ্রব্যের ব্যবহার অনেক সুবিধা জনক । নিম্নলিখিত কারণে আমরা প্রাকৃতিক রোগ দ্বারা চিকিৎসা না করিয়া সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধের দ্বারা চিকিৎসা করিয়া থাকি ।
(ক) সদৃশ লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক পীড়ার সংখ্যা প্রকৃতিতে খুব অল্প সংখ্যক আছে। কিন্তু মানুষের যাবতীয় পীড়ার সমলক্ষণ সম্পন্ন কৃত্রিম রোগ সৃষ্টিকারী ভেষজ পদার্থ পৃথিবীতে অসংখ্য। এই ভেষজ পদার্থ সবজাতীয় পীড়ার মোকাবেলা করিতে সক্ষম।
(খ) রোগ দ্বারা রোগ আরোগ্য করার চেষ্টা করিলে একটি ধ্বংস হয় কিন্তু অপরটি মারাত্মক আকার ধারণ করিয়া দেহে অবস্থান করিয়া থাকে, যাহার জন্য পুনরায় নতুনভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে ক্ষণস্থায়ী ঔষধ শক্তি দ্বারা রোগ আরোগ্য হইবার পর ঔষধ শক্তি বিলুপ্ত হইয়া যায়। নতুনভাবে ঔষধ শক্তিকে বিদূরিত করার জন্য কোন চিকিৎসা গ্রহন করিতে হয় না।
(গ) সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধের শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রনাধীন। আমরা আবশ্যক মত রোগ আরোগ্যের ক্ষেত্রে ঔষধের শক্তি বৃদ্ধি বা হ্রাস করিতে পারি। কিন্তু কোন প্রাকৃতিক পীড়াকে এইভাবে শক্তিকৃত করা যায় না বা শক্তির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভবপর নয়।
(ঘ) আমাদের ইচ্ছামত প্রাকৃতিক পীড়া আসিয়া আমাদের চিকিৎসা কর্মে সহায়তা করেনা এবং প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক শক্তিশালী রোগ সৃষ্টি করিতেও তারা পটু
(ঙ) ঔষধ শক্তিকে অধিকতর শক্তিশালী করিয়া রোগীতে প্রয়োগ করিবার ক্ষমতা ও কৌশল আমাদের জানা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক রোগের ক্ষেত্রে তাহা করা যায় না।
(চ) প্রাকৃতিক রোগ দ্বারা আরোগ্য করিতে গেলে অধিকতর শক্তিশালী রোগটি (সর্বশেষ প্রয়োগকৃত) দেহে থাকিয়া যায় এবং রোগী প্রচুর কষ্ট ভোগ করে। কিন্তু ঔষধ প্রয়োগে রোগীর চিকিৎসা হইলে রোগী কোন যন্ত্রনা ভোগ করে না। ঔষধ শক্তি অল্পকাল মধ্যে নিঃশেষ হইয়া যায়।
(ছ) প্রাকৃতিক রোগ ক্ষেত্রে আমাদের সংকীর্ণ জ্ঞান হেতু সকল প্রাকৃতিক রোগের উপর আমরা প্রভাব বিস্তারে অক্ষম। যে সব রোগের নাম জানি সেগুলিও আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নাই। কিন্তু ঔষধের উপর আমাদের জ্ঞান প্রচুর এবং উহা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই সকল কারণেই সদৃশ লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক রোগকে রোগারোগ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করিয়া ভেষজ দ্রব্য বা ঔষধকে আরোগ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। অতএব চিকিৎসকের অধীন কৃত্রিম রোগবীজ স্বরূপ ঔষধ দ্বারা প্রাকৃতিক রোগ দূর করা, প্রাকৃতিক পীড়া দ্বারা প্রাকৃতিক রোগ দূর করা অপেক্ষা সর্বতোভাবে সুখসাধ্য। ঔষধের শক্তি সূক্ষ্ম, মাত্রা অল্প, সেবনে কষ্ট নাই, ভয়ংকর অস্ত্রাদির প্রয়োজন নাই, সাংঘাতিক ভাব নাই, সেবনে উৎপীড়ন ও আরোগ্যান্তে তাহারই ফল ভোগ নাই। অতএব আরোগ্য অচিরে মৃদু ও স্থায়ীভাবে সম্পন্ন হয়।



প্রশ্ন-  ঔষধের রোগারোগ্য ক্ষমতা কিসের উপর নির্ভর করে?

উত্তর : সদৃশ লক্ষণ মতে প্রয়োগকৃত ঔষধে রোগ আরোগ্য লাভ করে। ঔষধের এই আরোগ্যকারী ক্ষমতা নিম্নলখিত শর্তের উপর নির্ভর করে।
(ক) ঔষধের মধ্যে রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা বর্তমান থাকিতে হইবে।
(খ) ঔষধ দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম রোগের লক্ষণাবলী প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণাবলীর ' পদৃশ হইতে হইবে ।
(গ) ঔষধের শক্তি রোগ শক্তি অপেক্ষা বলবত্তর হইবে তাহা হইলেই ঔষধ রোগারোগ্য করিতে সক্ষম হইবে।




প্রশ্ন-  সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধের ক্ষুদ্র মাত্রার বিরুদ্ধে জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়ার বিশেষত্ব কি?

উত্তর ঃ সদৃশ মতে চিকিৎসা করিলে দেখা যায় যে অতি সূক্ষ্ম মাত্রায় ঔষধ প্রদান করিলেও উহা রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করিয়া আসল প্রাকৃতিক পীড়াটির স্থান দখল করিয়া উক্ত পীড়া দূরীভূত করিয়া দিতে সমর্থ হয়। ক্ষুদ্র মাত্রায় ব্যবহৃত হইলেও ঔষধ শক্তি রোগশক্তি অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী তাই আরোগ্যের পর কিছু ঔষধজ ব্যাধি অবশিষ্ট থাকে। সেই ব্যাধির জন্য অবশ্য জীবনীশক্তির বিশেষ কিছু করিতে হয় না। তাহা আপনি আপনিই চলিয়া যায়। ঐ অবশিষ্ট ঔষধজ পীড়ার জন্য জীবনীশক্তির কোন প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ঔষধের এই অবশিষ্ট শক্তি এতই সামান্য যে ইহার দ্বারা দেহক্ষেত্রে সৃষ্ট কৃত্রিম রোগলক্ষণ অত্যন্ত অল্প ও ক্ষণস্থায়ী। জীবনীশক্তির এখানে কোন প্রতিক্রিয়ারই প্রয়োজন হয় না বরং জীবনীশক্তি নিরপেক্ষ থাকিয়া আপন শ্রেষ্ঠ শক্তি বলে রোগীকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে নীত করে।




প্রশ্ন- অসমলক্ষণ বিশিষ্ট ঔষধের কর্মকৌশল ও পরবর্তী ফল কিরূপ কি? 
বা, বিসদৃশ ঔষধের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার বিশেষত্ব কি এবং উহার অপকারিতা কি?

উত্তর : বিসদৃশ চিকিৎসায় বা এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় রোগলক্ষণ বিদূরীত করার জন্য যে বিসদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তাহা রোগলক্ষণের সহিত একেবারে সম্বন্ধহীন বা বিপরীত সম্বন্ধবিশিষ্ট তাহা বলা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় প্রবল বেদনায় আফিম প্রয়োগ করিলে আফিম কিন্তু বেদনা নাশ করে না। ইহার ক্রিয়া দ্বারা অনুভূতি অপহৃত হয় বলিয়া রোগী বেদনা বোধ করে না। ঔষধের বিপরীত লক্ষণ দ্বারা রোগ লক্ষণকে প্রতিহত করাই এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য, কিন্তু বাস্ত বিক পক্ষে তাহা নয়। সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধ প্রয়োগে ঔষধলক্ষণ যে ভাবে রোগ লক্ষণের অধিকৃত স্থান দখল করিয়া থাকে, বিসদৃশ ঔষধলক্ষণও রোগীদেহের সেই সেই রুগ্নাংশে উপস্থিত হয় এবং যেহেতু রোগলক্ষণের বিসদৃশ তাই উহা অতি ক্ষীণ ভাবে রোগলক্ষণকে আবিষ্ট করে। বিসদৃশ ঔষধের এই প্রাথমিক বা মুখ্য ক্রিয়ার সময় জীবনীশক্তি রোগলক্ষণ ও ঔষধজ লক্ষণ কোনটাই উপলব্ধি করিতে পারে না। ক্ষণিক উপশমকারী ঔষধের সহিত রোগীর অবস্থার মিল থাকে না বরং বিপরীত ভাবে প্রতিক্রিয়া করিতে জীবনীশক্তিকে বাধ্য করে। হোমিওপ্যাথির সদৃশ লক্ষণ সম্পন্ন ঔষধের কৃত্রিম পীড়া যেমন সাদৃশ্য ও তীব্রতা হেতু স্বাভাবিক পীড়ার স্থান দখল করে, এলোপ্যাথির বিসদৃশ ঔষধ সেভাবে স্বাভাবিক পীড়ার স্থান দখল করিতে পারে না। ঔষধজ কৃত্রিম রোগলক্ষণ সমূহ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হইয়া যায় অথচ প্রাকৃতিক রোগটি থাকিয়া যায়। ক্ষণিক উপশমকারী ঔষধ অধিকমাত্রায় প্রয়োগ হয়, তাই তাহা ঐ ঔষধের বিপরীত ভাবে ক্রিয়া করিতে জীবনীশক্তিকে বাধ্য করে। জীবনীশক্তির এই প্রতিক্রিয়া ঔষধের ক্রিয়ার বিপরীত কিন্তু প্রাকৃতিক রোগের স্বধর্মী। তাই রোগলক্ষণ আরও বৃদ্ধি পাইয়া রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন করিয়া তোলে। পীড়ার লক্ষণটির বিপরীত লক্ষণ বিশিষ্ট ঔষধ প্রয়োগ করা হইয়াছিল বিধায় ঔষধের ক্রিয়া বিলুপ্ত হইলে ঐ লক্ষণটি জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া হেতু ঔষধের বর্ধিত মাত্রার অনুপাতে বর্ধিত ভাবে প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই রোগের আরও বৃদ্ধি ঘটে ।



প্রশ্ন- প্রাকৃতিক রোগশক্তি ও ঔষধশক্তির মধ্যে কোনটি শক্তিশালী?

উত্তর : জীবনীশক্তির উপর কাজ করিতে রোগশক্তি অপেক্ষা ঊষ শক্তি অধিকতর কার্যক্ষম। সৃষ্টিকর্তা মানুষের জীবনীশক্তিকে রোগোৎপাদক শক্তিসমূহ হইতে অধিক শক্তিশালী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। আমাদের জীবনীশক্তি যদি অনাহার, কু-অভ্যাস, অপুষ্টি, শোক তাপ প্রভৃতি হেতু দুর্বল হইয়া প্রবণতা প্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে রোগশক্তি ইহাকে আক্রমন ও পরাস্ত করে। অর্থাৎ রোগোৎপাদক শক্তি সমূহ যাঁহারা আমাদের প্রাণনাশের জন্য অবিরত ছিদ্র অনুসন্ধান করিতেছে তাহাদের শক্তি বিভিন্ন অবস্থার অধীন। নিদারুন মহামারীতেও গ্রামের অধিকাংশ লোকই রক্ষা পায় বা আদে। আক্রান্ত হয় না। সুতরাং জীবনীশক্তি যে রোগোৎপাদিকা শক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ঔষধের শক্তি অবাধ এবং কোন বিশেষ অবস্থার অধীন নয়। সুস্থ জীবনীশক্তিকেও ঔষধশক্তি আবিষ্ট করিয়া স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটাইতে পারে। সাধারণ জড়শক্তি সম্পন্ন জড় পদার্থের সংমিশ্রণে প্রস্তুত ঔষধের শক্তির অবশ্য সীমা আছে। কিন্তু হোমিওপ্যাথি মতে ঘর্ষণ, আলোড়ন, মর্দন প্রভৃতি প্রথায় জড়ের সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হইলে প্রত্যেক ঔষধই অনন্ত শক্তি সম্পন্ন হইয়া সমস্ত জীবজন্তু ও মানব দেহকে সকল সময়ে অভিভূত করিতে পারে। সুস্থ জীবনী শক্তি সহজেই বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। আমরা জানি রোগোৎপাদিকা শক্তি দুর্বল জীবনীশক্তিকে অসুস্থ করে। কিন্তু ঔষধের শক্তি সুস্থ জীবনীশক্তিকেও আক্রান্ত,


















































একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ