গ্লোনয়িন - Glonoine, প্রথম বর্ষ

 গ্লোনয়িন
Glonoine




রাসায়নিক চিহ্ন:-  C2H5(NO3)3

প্রতিশব্দ:- গ্লোনয়িন নাইট্রো গ্লিসারিন।

উৎস ও বর্ণনা:- নাইট্রো গ্লিসারিন হইতে এই ঔষধটি প্রস্তুত হয়। ইহা এক প্রকার বিষাক্ত গন্ধবিহীন, ভারী মিষ্টি ঝাল স্বাদযুক্ত হলুদ বর্ণের তৈলাক্ত পদার্থ। জলে ইহা প্রায় দ্রবীভূত হয় না বলিলেই চলে কিন্তু সুরাসার, ইথার এবং মেথিলেটেড স্পিরিটে ইহা দ্রবীভূত হয়। ৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের কম তাপমাত্রায় রাখা হইলে ইহা সূঁচাকারে কঠিন হইয়া পড়ে এবং এই অবস্থায় নাড়াচড়া করিতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অনেক সময় ইহা বিস্ফোরণ ঘটাইয়া থাকে। জমাট নাইট্রিক এসিড এবং সালফিউরিক এসিডের মিশ্রণের সহিত গ্লিসারিন মিশ্রিত করিয়া ইহা পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ ব্যবহারিক মাত্রা গ্রেণ।

প্রস্তুত প্রণালী:- ১ ভাগ নাইট্রো গ্লিসারিণ ৯ ভাগ সুরাসারে দ্রব করিয়া ইহার ১০ শক্তি প্রস্তুত হয়। ইহার অন্যান্য উচ্চশক্তি সমূহ হোমিও ফার্মাকোপিয়ার নিয়মানুসারে পরিশ্রুত সুরাসারের সহিত প্রয়োগ হয়।

প্রস্তুতের ফরমূলা:- আমেরিকান এফ-৬-এ। জার্মানী এফ-৬-বি।

ক্রিয়াস্থান:- মেডুলা অবলঙ্গাটা, নিউমোগ্যাষ্টিক নার্ভ ও মস্তিষ্কের শিরা, আর্টার প্রভৃতির উপর ইহার প্রধান ক্রিয়া। ইহা উচ্চ রক্তচাপ কমাইবার উৎকৃষ্ট ঔষধ। নার্ভাস ও রক্ত প্রধান ধাতুতে ইহা শীঘ্র ক্রিয়া প্রকাশ করে। ২/১ ফোঁটা ১x শক্তির গ্লোনয়িন যদি কোনও সুস্থ ব্যক্তির জিহ্বায় ফেলিয়া দেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ তাহার মাথা দপদপ করিয়া শিরঃপীড়া আরম্ভ হইবে ও সেখানেই প্রায় অজ্ঞান হইয়া পড়িবে।

মানসিক লক্ষণ:
১। রোগী অত্যান্ত অলস, কাজকর্ম করিতে চায় না। 
২। অত্যধিক উত্তেজনা প্রবণতা, সামান্য মাত্র প্রতিবাদে উত্তেজিত হইয়া পড়ে এবং তাহার পর মাথার রক্ত সঞ্চয় জনিত লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায়। চৈতন্যসহ পতন। 
৩। রোগী কোথায় আছে তাহ বলিতে পারে না, পরিচিত রাস্তা অপরিচিত বোধ হয়। গৃহে যাইবার পথ দীর্ঘ মনে হয়।

চরিত্রগত লক্ষণ:- 
১। মুখ যেন ফ্যাকাশে ও রক্ত শূণ্য।
২। রোগী চক্ষুর সম্মুখে যেন কাল কাল কি উড়িতেছে দেখে।
৩। হঠাৎ অজ্ঞানের ভাব হইলে কোথা আছে রোগী বুঝিতে পারে না বা যে স্থানে থাকে তাহা চিনিতে পারে না।
৪। ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক শিরঃপীড়া, মাথা ও কপাল দপদপ করে, মাথায় কোনও প্রকার গরম, রৌদ্র. টুপী, কাপড় সহ্য করিতে পারে না।
৫। সূর্য যতই উঠিতে থাকে শিরঃপীড়াও তত বৃদ্ধি হয়। সূর্য নিম্নগামী হওয়ার সাথে সাথে শিরঃপীড়ার উপশম।
৬। প্রতিটি বস্তুর অর্ধেকটা পরিষ্কার ও অর্ধেকটা অন্ধকার দেখে।
৭। শরীরের বাহির ও ভিতর উভয় দিকে স্পন্দন অনুভব।
৮। বুক ধড়ফড়ানি অত্যন্ত বেশী, প্রত্যেক হৃদস্পন্দন নিজের কানে শুনিতে পায়।
৯। কনজেশন হেতু শিশুর ধনুষ্টঙ্কার।

প্রয়োগ ক্ষেত্র:- অতিশয় রৌদ্র ভোগের মন্দ ফলে, সানস্ট্রোক, মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চয়, মূর্ছা, শিরঃপীড়া, তড়কা, সর্দি গর্মী, হৃদপিণ্ডের পীড়া, স্ত্রীপীড়া, রক্তচাপ, হাঁপানি, হার্টফেলিওর ও এনজাইনা পেক্টোরিস প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা ব্যবহৃত হয়।

শিরঃপীড়া লক্ষণ:- সূর্য অনুসরণকারী শিরঃপীড়া। ইহার সূর্য ক্রমশঃ যতই উপরে উঠিতে থাকে ততই শিরঃপীড়ার বৃদ্ধি এবং যতই নিম্নগামী হইতে থাকে শিরঃপীড়ার ততই উপশম হইতে থাকে। মাথায় ভয়ানক দপদপানি যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা, মনে হয় যেন মাথা চূর্ণ হইয়া যাইবে। এই জাতীয় শিরঃবেদনা ঘাড় হইতে আরম্ভ হয় এবং সম্মুখ কপাল পর্যন্ত বিস্তৃত হইতে থাকে। রক্ত যদি হঠাৎ তীব্র বেগে মস্তকাভিমুখে সঞ্চালিত হইয়া সেই রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়ার হঠাৎ কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটে তাহা হইলেই ঐ জাতীয় শিরঃপীড়ার আবির্ভাব হইয়া থাকে। এই জাতীয় শিরঃবেদনায় রোগী মাথায় হাত দিলেও সেই দপদপানি স্পষ্ট অনুভব হয়। রোগীর মুখ ঘোর লালবর্ণ দেখা যায় এবং মাথায় হাত বুলাইলেও স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে মাথার উপরের কিংবা ঘাড়ের শিরাগুলি যেন ফুলিয়াছে। গ্যাস ও বৈদ্যুতিক আলোক কার্য করিবার ফলে মস্তকে উত্তাপ অনুভূতি। মস্তক ভারীবোধ, কিন্তু বালিশের উপর মাথা রাখিতে পারে না। মস্ত কের চারিধারে কোন প্রকার উত্তাপ সহ্য করিতে পারে না।

মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চয় লক্ষণ:- মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত চীৎকার, সেজন্য রোগী ক্রন্দন করে। ইহা ছাড়া রোগীর মনে হয় যেন তাহার মাথাটি কত বড় হইয়াছে। এই লক্ষণ এপিসেই নির্দিষ্ট। তবে এই প্রকার লক্ষণসহ যদি অতিমাত্রায় দপদপানি ব্যথা ও সেই সঙ্গে বমন হইতে থাকে তাহা হইলে গ্লোনয়িনই বেশী ফলপ্রদ। গ্লোনয়িনে মাথা গরম, হাত পা ঠাণ্ডা থাকে। পীড়ার প্রথম হইতেই খেঁচুনী হয়, মাথায় জল দিলে আক্ষেপ বাড়ে। মস্তিষ্কে প্রবল রক্ত সঞ্চয়সহ স্নায়ুশূল ও সৃতিকাক্ষেপে এই ঔষধটি ব্যবহৃত হয়।

গ্লোনয়িনের তড়কা:- মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডে রক্তের উচ্ছান। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চয় হেতু তীব্র আক্ষেপ। প্রসবের সময় কিংবা প্রসবের পর অনেক দুর্বল স্ত্রীলোকের আক্ষেপযুক্ত তড়কা হয়। সেই সময় যদি দেখা যায় যে, মুখ রক্তের মত লাল বর্ণ, ফোলা ফোলা, নাড়ী মোটা ও কঠিন মুখে ফেনা, অজ্ঞান, হাতের আঙ্গুল কখনও মুঠো কখনও ফাঁক, প্রস্রাবে এলবুমেন এই সকল লক্ষণ থাকে, তাহা হইলে গ্লোনয়িন উপকারী।

সর্দিগর্মী পীড়ায় গ্লোনয়িনের ও বেলেডোনার পার্থক্য:- রোগীর নাড়ী প্রথমে পুষ্ট কিছুক্ষণ পর দুর্বল হয়, নিঃশ্বাস আয়াসের সহিত পড়ে এবং চক্ষুর পলক না পড়িয়া স্থির হইয়া থাকে। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হইয়াই এই লক্ষণসমূহ দৃষ্ট হয়। অত্যন্ত গা বমি, বমি এবং বুক ধড়ফড়ানি প্রভৃতি লক্ষণগুলি ইহাতে থাকে। উত্তাপ জনিত পীড়ায় তাহা প্রখর রৌদ্র লাগিয়া হউক বা দারুণ গ্রীষ্ম বশতঃই হউক অথবা আগুনের উত্তাপে কার্য করিবার জন্যই হউক উক্ত লক্ষণ দেখিলেই গ্লেনয়িন ব্যবহার্য। ইহাতে রোগীর পেটে এক প্রকার বেদনা হয়। মুখে অরুচি এবং উদরাময়। পথ চলিতে চলিতে যদি হঠাৎ কেহ মূর্ছিত হইয়া পড়ে এবং জ্ঞান থাকিলেও যদি বলে 'আমি কোথায় আছি' নিজের বাড়ী ও রাস্তা ভুলিয়া যায় তাহা হইলে গ্লেনয়িন উত্তম ঔষধ।
বেলেডোনা- রোগীর মাথায় প্রচণ্ড জ্বালা ও সুঁচ ফোটার মত ব্যথা, আলো ও শব্দ অসহ্য। চোখ উজ্জ্বল ও লাল। মুখশ্রী লাল ও ফুলো। রগের শিরায় অত্যন্ত দপদপানিসহ মাথাব্যথা। মাথা গরম ও হাত পা ঠাণ্ডা। সংজ্ঞা ও বাকশক্তি লোপ। প্রচণ্ড বিকার ও তড়কা। মস্তক ব্যতীত সর্বঙ্গে ঘর্ম। মাথা বেদনায় বেলেডোনার মত তত যাতনা থাকে না এবং ঐ সকল যত হঠাৎ আরম্ভ হইয়া ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে আবার উপশমও যত শীঘ্র হয়, বেলেডোনায় সেইরূপ হয় না। বেলে মস্তক পিছনে নোয়াইলে মাথার যন্ত্রণা কতকটা যেন উপশম হয়। গ্লোনয়িনে ঐরূপ করিলে যাতনার বৃদ্ধি হয়।

হৃদপিণ্ডের পীড়ায়:- হৃৎশূল পীড়ায় রক্ত বেগে হৃদপিণ্ডে ধাবিত হওয়ার প্রথমে হৃদপিণ্ডের মধ্যে পাখির ঝটফটানির মত স্পন্দন অনুভব, পরে জোরে জোরে হৃৎস্পন্দন হইতে থাকে। রোগী মনে করে তাহার হৃৎপিণ্ড বুঝি ফাটিয়া যাইবে। শ্বাস-প্রশ্বাসে খুব কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে বেদনা-এই বেদনা ক্রমে বুক হইতে সারা শরীরে ছড়াইয়া পড়ে। শেষে হাতে পর্যন্ত পরিচালিত হয়। সে সময় মোটেই শক্তি থাকে না। গ্লোনয়িনে বুক ধড়ফড়ানি অত্যন্ত বেশী, বুক ভিন্ন সমস্ত শরীরে এমনকি আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত অনুভূত হয়।

ব্লাড প্রেসার - উচ্চ রক্তচাপ:- উচ্চ রক্তচাপ কমাইবার ইহা উৎকৃষ্ট ঔষধ। ব্লাড প্রেসার বেশী হইলে গ্লোনয়িন ১৪ শক্তি ১ ফোঁটা, ক্র্যাটেগাস মাদার ৫ ফোঁটা, প্যাসিফ্লোরা মাদার ৭ ফোঁটা উক্ত মাত্রায় তিনটি ঔষধ জ্জ ঘন্টা অন্তর পর্যায়ক্রমে দিবেন। গ্লোনয়িনে মস্তকের পশ্চাৎ ভাগে রক্ত সঞ্চয়, মস্তকে পূর্ণতা, প্রভৃতি লক্ষণ বর্তমান থাকে।

স্ত্রীপীড়ায়:- স্ত্রীপীড়ায় স্বাভাবিক ঋতুলোপকালের (৪৫-৫২ বৎসর বয়সে) রক্তস্রাবে এই ঔষধ স্যাঙ্গুনেরিয়ার ন্যায় উপকারী। রক্ত খুব উজ্জল, জমা জমা এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত, আবার এই সঙ্গে যদি গা বমি বমি ও বমনের সহিত পূর্বোক্তরূপ শিরঃপীড়া এবং মুখে ও অন্যান্য অঙ্গে উত্তাপোচ্ছাসের সহিত আরক্তিমতা থাকে তাহা হইলে এই ঔষধ উপকারী। রোগিনীর শরীরে আগুনের হলকার মত গরম অনুভব হয়। গর্ভাবস্থায় ধনুষ্টঙ্কারাদি আপেক্ষিক রোগ।

আঘাতজনিত পীড়ায়:- কোন স্থানে আঘাত লাগিয়া বহুকাল পর যদি সেখানে ব্যথা হয় বা নানা প্রকার যন্ত্রণাবোধ হইতে থাকে অথবা যদি আঘাত জনিত কাটার স্থানটিতে পুনরায় ব্যথা হয় ও পাকিয়া পুঁজ নির্গত হয় তাহা হইলে গ্লোনয়িন আভ্যন্তরীক ও বাহ্যিক ব্যবহার্য।

প্রান্তদেশে:- হৃৎপিণ্ডের পীড়ায় প্রান্তদেশে একপ্রকার লক্ষণ দৃষ্ট হয়। হৃৎশূলের বেদনা বুক হইতে সারা দেহে ছড়াইয়া পড়ার সাথে সাথে হাত এমন কি আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত পরিচালিত হয়। সে সময় রোগীর হাতে মোটেই শক্তি থাকে না। রোগীর মাথা ভারী বোধ, বালিশের উপর মাথা রাখিতে পারে না। সর্বাঙ্গে চুলকানি লক্ষণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শেষাংশে অধিক। সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে টানিয়া ধরার ন্যায় ব্যথা। পৃষ্ঠ বেদনা। সমগ্র মেরুদণ্ডের নিম্নে বেদনা। উল্লেখিত প্রান্তদেশের লক্ষণসমূহ গোনয়িনে দৃষ্ট হয়।

বৃদ্ধি:- রৌদ্রে, সূর্যরশ্মি এবং উন্মুক্ত অগ্নির সান্নিধ্যে। মাথা নিচু করিলে, সিঁড়িতে উঠিলে, গ্যামালোকে, কেশ কাটিলে।

উপশম:- মদ্যপানে, স্থিরভাবে অবস্থানে, শৈত্যে।

ক্রিয়ানাশক:- নাক্স, কফিয়া, ক্যাফার, একোনাইট।

অনুপূরক:- এমিলনাইট, বেলেডোনা, ওপিয়ম, স্ট্রামোনিয়াম, ভিরেট্রাম ভিরিডি।

ক্রিয়াস্থিতিকাল:- ১দিন।

গ্লোনয়িনের ব্যবহারের শক্তি:- ৩০ হইতে ২০০ শক্তি।



প্রভাষক, ডাঃ মহি উদ্দিন
ফরাজী হোমিও হল ফেনী। 
01814319033

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ