জিঙ্কাম মেটালিকাম, ZINCUM MET - চতুর্থ বর্ষ - মেটেরিয়া মেডিকা


জিঙ্কাম মেটালিকাম
 ZINCUM MET



রাসায়নিক চিহ্ন:- জিঙ্কাম মেটালিকামের রাসায়নিক চিহ্ন- Zn. 

প্রতিশব্দ:- জিঙ্ক, দত্তা, মেটালিক জিঙ্ক। 

প্রস্তুত প্রণালী:- খনি হইতে বিভিন্ন আকারে ইহা পাওয়া যায়। ইহা নীলাভ সাদা বর্ণের এক প্রকার ধাতব পদার্থ । ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ৭.২। অধিক সময় পর্যন্ত ইহাকে উত্তপ্ত করিতে থাকিলে ইহা গলিয়া যায়। এবং অবশেষে জিঙ্ক অক্সাইড উৎপন্ন নীল বর্ণের শিখায় জ্বলিতে থাকে। তরল হাইড্রোক্লোরিক এসিডে অথবা সালফিউরিক এসিডে ইহা দ্রবীভূত হয়।

প্রস্তুত প্রণালী:- বিশুদ্ধ ধাতব দস্তা পরিশ্রুত জলের সাহায্যে খলের মধ্যে ঘর্ষণ করিলে চূর্ণবৎ পদার্থ পাওয়া যায়। দুগ্ধ শর্করার সহিত বিশুদ্ধ দস্তার বিচূর্ণ প্রস্তুত হয়। পরে হোমিও ফার্মাকোপিয়ার নিয়মানুসারে বিভিন্ন শক্তির ঔষধ প্রস্তুত হয়।

প্রস্তুতের ফরকুলা:- এফ-৭।

প্রুভার:- মহাত্মা হ্যানিমান এবং তাঁহার কয়েকজন সঙ্গী ইহা গ্রুভ করেন।

ধাতুপ্রকৃতি:- ইহা একটি এন্টিসোরিক ঔষধ। গাত্রচর্ম ঝুলিয়া পড়িয়াছে এমন, দেখিতে বৃদ্ধের ন্যায়, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে, মলিন, শীর্ণকায় ও শীত কাতুরে এই জাতীয় ধাতুর রোগীদের  উপযোগী।

ক্রিয়াস্থান:- রোগীর গভীরতম স্নায়ুকেন্দ্রে এবং জীবনতন্ত্রীতে প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে নিরতিশয় দুর্বল করিয়া এই ঔষধ ক্রিয়া বাঙ্কার উৎপন্ন করে। মস্তিষ্ক ও মেরুমজ্জার স্নায়ুমণ্ডলীতে, পৃষ্ঠবংশে, চর্মে এবং রক্তের উপর ইহা প্রবল ক্রিয়া প্রকাশ পায়।

মানসিক লক্ষণ:-
১) রোগীর মেজাজ সহজেই উত্তেতি হয়। নিস্তেজতাপূর্ণ অবস্থায় রোগী চুপচাপ পড়িয়া থাকে। চক্ষুদ্বয়   অর্ধনিমিলীত, এমনকি চোখের ভিতর আঙ্গুল প্রবশ করানো সত্ত্বেও রোগীর কোন সাড়াই পাওয়া যায় না। একেবারে মৃতবৎ পড়িয়া থাকাই ইহার প্রকৃতি । 
২) স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা। কোন কাজ করিতে কথা বলিতে অনিচ্ছা ও বিরক্তিবোধ ।
৩) যতক্ষণ পর্যন্ত রোগীর জ্ঞান থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মনে করে, যেন কত পাপই না করিয়াছে এবং একথা মনে করিয়া সে অত্যান্ত অস্থির হইয়া উঠে এবং ঐ অস্থিরতাটি তাহার পদদ্বয়েই প্রধানতঃ সীমাবদ্ধ থাকে।
৪) কোন প্রশ্ন করিলে রোগী বোকার ন্যায় চাহিয়া থাকে, কিম্বা প্রত্যেক প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিয়া উত্তর দেয়।
৫) রাত্রিকালে নিদ্রার মধ্যে হাঁটিয়া বেড়ায়।
৬) কোনও পরিশ্রম ও গণ্ডগোল সহ্য করিতে পারে না।
৭) কামোত্তেজনা সহ কামোন্মত্ততা। 

চরিত্রগত লক্ষণ:- 
১) জীবনীশক্তির বিপর্যতা, কোন রোগ লক্ষণই স্বাভাবিক নিয়মে পরিস্ফুট হয় না।
২) শরীরস্থ স্বাভাবিক স্রাব চাপা পড়িয়া নানা প্রকার রোগাক্রমণ এবং বাধাপ্রাপ্ত দস্তোদম হেতু মস্তিষ্ক প্রদাহ।
৩) ঐ সকল বাধাপ্রাপ্ত অবস্থাদির পূর্ণবিকাশে রোগের উপশম ও আরোগ্য প্রবৃত্তি। 
৪) নিদ্রিতাবস্থায় শিশু কাঁদিয়া উঠে, নিদ্রাভঙ্গ হইলেই যেন সে কত ভয় পাইয়াছে এইরূপ ভাব দেখায়, কাঁদে এবং মস্তক এপাশ ওপাশ চালনা করিতে থাকে।
৫) মিষ্ট দ্রব্য আহার করিলেই বুক জ্বালা করে, বমি হয়, গা বমি করে।
৬) কোন পীড়ায় পদদ্বয় অজ্ঞাতসারে স্পন্দিত হয়, রোগী অবিশ্রান্ত পা নাড়ে।
৭) মিষ্টান্ন আহার করিলে কাশি বৃদ্ধি পায় এবং পাকস্থলী হইতে কণ্ঠমধ্যে মিষ্টরস উত্থিত হয়।
৮) ঋতুস্রাব আরম্ভ হইলে সকল প্রকার যন্ত্রণার উপশম এবং স্রাব বন্ধ হইলেই আবার যন্ত্রনা শুরু হয়। 
৯) দাঁত উঠার সময় দুর্বল শিশুদের তড়কা, কিন্তু জ্বর থাকে না। 
১০) ধনুষ্টংকার, মেরুদণ্ডের ইরিটেশন, স্নায়ুর ক্ষমতালোপ, পিঠ ছুইতে দেয় না।
১১) সন্ধ্যায়, রাত্রিতে ও প্রাতে চক্ষুর জ্বালা যন্ত্রণা বৃদ্ধি ।
১২) বসিয়া থাকিলে কোমর বেদনা বৃদ্ধি । 
১৩) আক্ষেপিক কাশি, কাশিবার সময় শিশু জননেন্দ্রিয়ে হাত দেয়।
১৪) পশ্চাৎ দিকে হেলিয়া না বসিলে প্রস্রাব হয় না।
১৬) মুখে রক্ত আস্বাদ ।
১৭) ধর্মাবস্থায় গায়ে কোন চাপা রাখিতে পারে না।
১৮) বেলা ১১টার সময় রাক্ষুসে ক্ষুধা, খাবার সময় খুব ক্ষুধার্ত কিন্তু তাড়াতাড়ি আহার করিতে পারে না।
১৯) মেনিনজাইটিস হইবার আশংকা। 
২০) পুরাতন শিরঃপীড়া মস্তিষ্কের ক্লান্তি বা অবসন্নতা।
২১) শিশু কলেরার পর হাইড্রোকেফালস।

প্রয়োগক্ষেত্র:-
জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়াশূন্যতা, শিরঃপীড়া, স্নায়বিক দুর্বলতা, শিশুপীড়া, শিশু কলেরা, হাইড্রোকেফালস, জ্বর বিকার, টাইফয়েড ও মেনিনজাইটিস, পাকস্থলীর পীড়া, কম্পন, উদরাময়, শিরাস্ফীতি, চক্ষুর পীড়া, কাশি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা প্রয়োগ হয়।

স্নায়ুমণ্ডলী:- জিঙ্কাম মেট কেন্দ্রীয় স্নায়ুমণ্ডলীর উপর গভীর ক্রিয়াশীল। রোগীর গভীরতম স্নায়ুকেন্দ্রে এবং জীবনতন্ত্রীতে প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে নিরতিশয় দুর্বল করিয়া নিজ ক্রিয়া ঝংকার উৎপন্ন করে। মস্তিষ্ক ও মেরুমজ্জার স্নায়ুমণ্ডলীতে, ক্রিয়া প্রকাশ করিয়া মস্তিষ্ক ও পৃষ্ঠবংশীয় মজ্জার সামান্য উত্তেজনা প্রকাশ পাইয়া সর্ব শরীরের ভিতর দিয়া এক প্রকার কম্পন উপস্থিত হয় এবং আক্ষেপ, স্নায়ুশূল, প্রলাপ ইত্যাদি লক্ষণ উৎপন্ন করে। তৎপর স্নায়ুমণ্ডলীর ঘোর অবসাদ আনিয়া থাকে। স্নায়ুকেন্দ্রের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অস্বাভাবিক অবস্থাহেতু ইহার রোগী প্রধানত মস্তিষ্ক প্রদাহ ও হৃদপিণ্ডের দুর্বলতায় প্রায়ই কষ্ট পায় । ইহার বহু রোগীকে প্রচণ্ড প্রকৃতির মুর্ছায় আক্রান্ত হইতে দেখা যায় এবং ফলে নিরতিশয় শীর্ণতা, কামোত্তেজনাসহ কামোন্মত্ততা, দীর্ঘস্থায়ী নিদ্রাহীনতা পক্ষাঘাত প্রভৃতি অবস্থার আবির্ভাব হয়। রোগীর শারীরিক ও মানসিক শক্তির যখন এত অধিক ক্ষীণতা ও দুর্বলতা উপস্থিত হয় যে শরীরের কার্যকরী শক্তির অভাবে মল, মূত্র, ঋতু পর্যন্ত নির্গত হয় না, জীবনীশক্তির দুর্বলতা হেতু উদ্ভেদসমূহ পর্যন্ত বহির্মুখী হইতে পারে না, মানসিক দুর্বলতা হেতু রোগী কোনও বিষয় চিন্তা করিতে বা স্মরণ রাখিতে পারে না, সামান্য শব্দে বা স্পর্শে চমকাইয়া উঠে কথা বলিতেও কাজে অনিচ্ছা, বিষণ্ণতা ও জড়ভাবাপন্ন অবসাদগ্রস্ততা প্রভৃতি লক্ষণাবলী কেন্দ্রীয় স্নায়ুমণ্ডলীর উপর জিঙ্কামেটের প্রভাবেরই ফল। তবে জিঙ্কের আশ্চার্য লক্ষণ এই যে, এত দুর্বলতা ও শক্তিহীনতা সত্ত্বেও রোগী পদদ্বয় স্থির রাখিতে পারে না। অবিরত নাড়াচাড়া করিতে বাধ্য হয়।

শিরঃপীড়ায়:- ইহার পুরাতন প্রকৃতিযুক্ত মাথা ধরার সঙ্গে দুর্বলতা ও মাথার পিছন দিকে অত্যান্ত যন্ত্রণা থাকে। যন্ত্রণার প্রকৃতি ছিঁড়িয়া ফেলাবৎ এবং উহা কোনও প্রকার চাপ দিলে ও মুক্ত বাতাসে উপশমিত হয় এবং গরম ঘরে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শরীরের অন্যান্য স্থানের যন্ত্রণা অবশ্য গরমেই হ্রাস পায়। যন্ত্রণার মাত্রাধিক্যে জিঙ্ক রোগীর সমস্ত শরীরটি ঘর্মাপ্লুত হইয়া উঠে। কিন্তু ঐ ঘামে ইহার কোনও উপশমই আসে না। মস্তিষ্কের ক্লাস্তি বা অবসন্নতা, নিউরালজিক মাথা ব্যথা, সেই সময়ে যাহা দেখে, তাহার অর্ধভাগ দেখিতে পায়, অপরাধ দেখিতে পায় না। আলোক ভীতি ও শিরোঘূর্ণন । কপালের দিক হইতে মাথা ব্যথা আরম্ভ হইয়া পশ্চাৎদিকে ব্যপ্ত হয়।

শিশুপীড়ায়:- দাঁত উঠিতে ব্যাঘাত জন্মিয়া তড়কা, খেঁচুনী আক্ষেপ ইত্যাদি হইলে জিঙ্কমেট সুন্দর কার্য করে। তবে ঐ অবস্থায় জিঙ্কাম প্রয়োগ করিতে হইলে পর্যায়ক্রমে পাংশু ও রক্তাক্ত মুখাকৃতি সহ মাড়িতে মাড়িতে ঘর্ষণ বা দাঁত কিড়মিড়, এদিক ওদিক চাহনি, অনিচ্ছাকৃত ভাবে হাত ও পা অনবরত চালনা করা, জোরে চিৎকার করিয়া উঠা, মাংসপেশী খেঁচিয়া ধরা, অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া থাকা লক্ষণে ইহা ব্যবস্থা করিতে হয়। শিশু ঘুমাইতে ঘুমাইতে কাঁদিয়া উঠে কিংবা লাফাইয়া উঠিয়া বসে, হঠাৎ ভয় পাইয়া জাগিয়া উঠে ও চারিদিক তাকাইতে থাকে, সমস্ত শরীর কাঁপে প্রভৃতি লক্ষণে জিঙ্কমেট প্রযোজ্য । 

কলেরায়:- ভেদবমনের সঙ্গে বালিশ মাথা অনবরত এপাশ ওপাশ করা, হাত পা ছোঁড়া, মস্তিষ্কে জল সঞ্চয় সন্দেহ ও মেনিনজাইটিস ইত্যাদি লক্ষণে জিঙ্কাম বিশেষ উপকারী। ইহা ছাড়া যখন রোগীর বাহ্য প্রস্রাব সমস্তই বন্ধ, তৎসঙ্গে উক্ত মস্তিষ্ক লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় কিংবা একবার প্রস্রাব দেখা দিয়া ও তাহার পর উক্ত প্রকারের কতিপয় মস্তিষ্ক লক্ষণসহ ছটফটানি, পিপাসা, হাত পা সমস্ত শরীর শরীর ঠাণ্ডা, কেবল বুকের পাঁজরটি মাত্র গরম এই সমস্ত ভয়াবহ লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়, তখন ত্বরিৎ জিঙ্কাম প্রয়োগ করা উচিত।

হাইড্রোকেফালসের (মস্তিষ্কে জল সঞ্চয়):- শিশু কলেরার উপসর্গরূপে এই পীড়া হইলে তাহাতে ভেদ বমনের সঙ্গে বালিশ মাথা অনবরত এপাশ ওপাশ করা, হাত পা ছোঁড়া, হাত পা সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা, ইহা ছাড়া কলেরা না হইয়া যদি পীড়া স্বাধীনভাবে কিংবা অন্য কোনও পীড়ার উপসর্গ রূপে প্রকাশিত হয় তাহাদের এবং টিউবারকুলার মেনিনজাইটিসে যদি শিশুর একটু আচ্ছন্নভাব আসিলেই ভয় পাওয়ার মত চীৎকার করিয়া উঠা, ক্রমাগত ক্রন্দন, পেশীর কম্পন, সর্বদা পা নাড়া প্রভৃতি কতকগুলি লক্ষণ-বেঁচুনি হইবার পূর্বে বা পরে দৃষ্ট হয় তাহা হইলেও জিঙ্কাম প্রযোজ্য ।

জ্বর বিকারে:-
বিকারের সাধারণ কারণ দুইটি-
১) মস্তিস্কের কনজেশন, 
২) মস্তিস্কের ইরিটেশন বা প্যারালাইসিস। 
প্রথমোক্ত কারণে বিকার হইলে চক্ষু লালবর্ণ, শেষোক্ত কারণে পীড়া হইলে চক্ষু সাদা বর্ণ থাকে। যেখানে পীড়ায় রোগীর চক্ষু সাদা তৎসহ হাত পা এবং সর্বাঙ্গের কম্পন থাকে তথায় জিঙ্কামই একমাত্র ঔষধ । জিঙ্কামে মস্তিষ্কে প্যারালাইসিস উৎপাদন করিয়া বিকার হয়। কনজেশন হেতু বিকারে চক্ষু লালবর্ণ থাকিলে যদিও তৎসহ হাত পায়ের কম্পন বর্তমান থাকে জিঙ্কাম আদৌ উপযোগী নহে। অন্য ঔষধের প্রয়োজন হয়। জিঙ্কামের পীড়ায় মাথায় আইসব্যাগ প্রয়োগ করা উচিত নয়।

টাইফয়েড এবং মেনিনজাইটিসে:- টাইফয়েড জাতীয় জ্বরের শেষের দিকে যখন রোগীর মস্তিষ্কের গোলযোগ দেখা দেয়, তখনই সাধারণত ইহা প্রয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র বলিয়া বিবেচিত হয়। মস্তিষ্ক প্রদাহ আনয়নকারী অন্য কোনও ঔষধের লক্ষণ লইয়া আরম্ভ হইতে দেখা যায় কিন্তু উহারা কেহই রোগীকে সম্পূর্ণ আরোগ্য করিতে পারে না, ফলে জিঙ্কের অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া সে রোগী ক্রমান্বয়ে ধীর গতিতে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। জিঙ্কামের রোগীর উত্তেজনা জ্ঞাপক পরিপূর্ণ লক্ষণাদি নিরতিশয় দুর্বলতাপূর্ণ অবস্থা ভিন্ন অন্য কোনও সময় পরিস্ফুট হইবার সম্ভাবনা থাকে না, কাজেই রোগীর দুর্বলতা আসিবার পূর্বে ইহা প্রয়োগ করার মত সুযোগ বা সমলক্ষণও প্রায় ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। জিঙ্কামের মেনিনজাইটিস ও টাইফয়েড রোগীর পূর্বলক্ষণের ইতিহাসের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ অবসাদ ও দৌর্বল্য আসিবার পূর্বে আক্ষেপের রূপ লইয়া আবির্ভূত অর্থদৈহিক স্নায়বিক উত্তেজার ইতিহাস যথা- 
১) অনৈচ্ছিকভাবে একটি হাত ও একটি পা অবিরত নড়িতে থাকা, 
২) বারংবার আবির্ভূত অর্থদৈহিক বা উভয় পার্শ্বের কম্পন। 
৩) স্বরযন্তের কার্যহীনতারূপ এক প্রকার পক্ষাঘাত এবং ঐ হেতু লালাস্রাব। 
৪) ধীর গতিতে তাপমাত্রাটি হ্রাস পাইতে পাইতে স্বাভাবিক তাপমাত্রা অপেক্ষা নিম্নতাপাংকে উপস্থিত হয় এবং 
৫) প্রচণ্ড দুর্বলতা ও আগাগোড়া প্রতিক্রিয়া শক্তির অভাব-এই কয়েকটি লক্ষণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ঔষধ নির্বাচন করিতে হইবে। ইহা ছাড়া রোগের প্রথম অবস্থায় জিঙ্ক রোগী প্রায় সব সময়েই আচ্ছাদিত থাকিতে ভালোবাসে, কেননা সে শীতকাতর রোগীর ক্ষুধাতৃষ্ণাও প্রবল থাকে, তাহাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করিলে বোকার মত চাহিয়া থাকে এবং পুনরাবৃত্তি না করিয়া উত্তর দিতে পারে না। নিদ্রার মধ্যে চীৎকার দিয়া কাঁদিয়া উঠে এবং ভয়ে সর্বশরীরটি কাঁপিতে থাকে এবং চক্ষের চাহনি স্থির হইয়া যায় । অতঃপর ইহার রোগটি বৃদ্ধি পাইয়া জিঙ্কের পরিপূর্ণ অবস্থায় আসিয়া পড়িলে রোগীকে দেখিতে ঠিক যেন একটি মৃতদেহ জীবিত কি মৃত বুঝা যায় না। চক্ষুদ্বয় কোটরাগত, জ্যোতিহীন, অতিশয় ধীর ও ক্ষীণ নাড়ী, ধীর শ্বাস- প্রশ্বাস মল মূত্র ও ধর্ম সকল প্রকার প্রাব শূন্যতা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। মেনিনজাইটি পীড়ায় মস্তিষ্ক আবরণীর পর্দর প্রদাহ হয়। কোনও প্রকার চর্মপীড়া রুদ্ধ হইয়া বা শিশুদের দন্তোদ্গামকালীন এই পীড়া হইলে এবং তাহাতে সম্পূর্ণ অজ্ঞান, আক্ষেপিক টান, কম্পন, টেরাদৃষ্টি, খেঁচুনি প্রভৃতি উপসর্গ থাকিলে ইহা উপকারী।

পাকস্থলী সংক্রান্ত লক্ষণ:- জিঙ্কামের বমি লক্ষণ আছে এবং উহা ঠিক বিসমাধের মত। কেননা জলটুকু উদরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি হইয়া যায়। তবে জিঙ্কের মত মদ্য জাতীয় উত্তেজক পানীয়ে বৃদ্ধি ও স্নায়বিক দুর্বলতা বিসমাথে নাই। চিনিতে ও দুগ্ধ পানে জিঙ্ক রোগীর বমি এবং মাথা ব্যথা বৃদ্ধি পায়। বেলা ১১টার দিকে প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ এবং ঐ সময় কোন খাদ্য বস্তু না পাইলে উদরে শূন্যতা বোধসহ পদদ্বয়ে অতিশয় দুর্বলতা ও কম্পন আরম্ভ হয়। বারবার ক্ষুধাবোধ অথচ সামান্য ২/১ গ্রাস আহারের সঙ্গে সঙ্গেই উদর, মধ্যে পরিপূর্ণ বোধ এই বৈশিষ্ট্যটিও ইহাতে লক্ষ্য করা যায়। উদরটি বায়ুতে উপশম হইয়া উঠিলে জিঙ্ক রোগী আঁট করিয়া কাপড় পরিতে পারে না, তাহাতে অস্বস্তিবোধ হয়। সকল প্রকার উত্তেজক খাদ্যে ইহার রোগীর রোগলক্ষণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
 
উদরাময় লক্ষণ:— উদরাময়, আমাশয় এবং শিশু কলেরার বর্ধিত অবস্থায় জিঙ্কাম প্রযোজ্য। যখন দেখা যাইবে যে শিশুটি অস্থির, মাথাটি বলিলে এক মুহূর্তের জন্য স্থির থাকিতে পারে না, বিবর্ণ মুখ, জ্বর নাই, হাইড্রোকেফালস হইবার উপক্রম; তখনই ইহা প্রযোজ্য। জিঙ্কামে পেটে খুব ঘড়ঘড় করিয়া ডাকে, বাহ্যের রঙ সবুজ, বাহ্যের সঙ্গে সাদা আম ও সময়ে সময়ে কোঁথানি থাকে। বাহ্য হঠাৎ বন্ধ হইয়া মস্তিষ্ক লক্ষণ প্রকাশিত হইলে ইহার দ্বারা বিশেষ উপকার হয়। উদরাময়ের মলদ্বার অত্যন্ত কুটকুট করে, বোধ হয় যেন কৃমি হইয়াছে, বাহ্যের সময় মলদ্বার জ্বালা করে।

শীরাস্ফীতি লক্ষণ:- কোনও নির্দিষ্ট কারণে শিরার রক্ত একস্থানে অধিকক্ষণ জমিরা থাকিলে শিরা সকল শক্ত ও ফুলিয়া উঠে। ইহাকে ভেরিকোষ ভেনস বলে। এই পীড়ায় শরীরের নিম্নাঙ্গ অর্থাৎ পা ফুলিলেও সেই ফোলা লিঙ্গদেশ পর্যন্ত পরিচালিত হইতে জিঙ্কাম উপকারী। পীড়ার তরুণ অবস্থায় পালসেটিলা ফলপ্রদ, পীড়া একটু পরাতন হইয়া আসিলে পালসেটিলার পর জিঙ্কামে অধিক উপকার হয়।

চক্ষুপীড়ায়:— চক্ষুপ্রদাহ, চক্ষু লালবর্ণ হয়, জন পড়ে, কর কর করে, যেন চক্ষুতে বালি পড়িয়াছে। আলোক সহ্য হয় না। কোনও চক্ষু পীড়ায় জ্বালা যন্ত্রণা, কর কর করা ইত্যাদি উপসর্গগুলি প্রাতে কিম্বা সন্ধ্যার পর হইতে বৃদ্ধি হইয়া রাত্রিতে অত্যন্ত বৃদ্ধি হইলে জিঙ্কাম ।

কাশি:- স্পপ্রিয়ার মত জিনের কাশি মিষ্টিদ্রব্য সেবনের পর বৃদ্ধি ঘটে। আক্ষেপ জাতীয় কাশির সঙ্গে সঙ্গেই ইহার রোগী বিশেষতঃ শিশুরোগী তাহার প্রজনন যন্ত্রে হাত দিতে থাকিলে জিঙ্ক প্রয়োগে সুন্দর কাজ হইতে দেখা যায় ।

প্রান্তদেশে:— প্রান্তদেশের জিন্নামের কার্যকারিতা অদ্ভূত। রোগী একবার তাহার হাত, একবার তাহার মাথা পরপর নাড়ে। শরীরের নিম্নাঙ্গের বিশেষতঃ পায়ের অবিরাম নড়ন ইহার একটি স্মরণযোগ্য লক্ষণ। দাঁড়াইয়া হউক, চেয়ার বেঞ্চিতে বসিয়া হউক রোগী ক্রমাগত পা নাড়ায় ও পায়ের তলা সড়সড় করে বোধ হয় যেন পায়ে ছারপোকা বেড়াইতেছে, তাহাতে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়। জিঙ্কের পায়ের ঘামে দুর্গন্ধ থাকে ও উহা ক্ষতকারী, সেজন্য আঙ্গুলগুলির ফাঁকে প্রায়ই হাজা জন্মিতে দেখা যায় এবং ঐস্থানগুলিতে এত বেশী স্পর্শকাতরতা থাকে যে সামান্য ঘর্ষণও সহ্য হয় না। ইহার রোগী ভেদ বমনের সঙ্গে বালিশে মাথা অনবরত এপাশ ওপাশ করে, হাত-পা ছোঁড়ে, মস্তিষ্কে জল সঞ্চয় সন্দেহ। কলেরায় রোগীর হাত-পা ও সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা, কেবল বুকের পাঁজরাটি মাত্র গরম। দেহের বিভিন্ন স্থানের যন্ত্রণায় বিশেষতঃ নিম্ন প্রান্তদেশস্থিত বা মেরুদণ্ডের নিম্নদেশের যন্ত্রণার সময় ইহার রোগী যথেষ্ট পরিমাণ আচ্ছাদনের সাহায়ে শরীরটিকে গরম রাখিতে চায়। ইহাই জিঙ্কের প্রান্তদেশের লক্ষণ।

খাদ্যে বিতৃষ্ণা:- জিঙ্কামের রোগীর মিষ্টিদ্রব্য, দুগ্ধ ও মাছ মাংসের মত জান্তব খাদ্যে বিতৃষ্ণা থাকে এবং রান্না করা খাদ্যাদি, বিশেষত গরম খাদ্য সে পছন্দ করে না।

স্ত্রী উপসর্গে:- রজঃস্রাব আরম্ভ হইলে সকল প্রকার যন্ত্রণার প্রায় উপশম এবং স্রাব বন্ধ হইলেই যন্ত্রণার পুনরাবির্ভাব ঘটে। ইহার রোগিনীর রাত্রিকালে অতিশয় কাম পিপাসা জাগে। এমনকি রোগিনী অস্বাভাবিক উপায়ে কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। একই রাত্রে অনেকবার তাহার সঙ্গমেচ্ছা জাগে। বাম ডিম্বকোষ বিদ্ধবৎ বেদনা, টিপিলে সামান্য উপশম হয় এবং ঋতুস্রাবে সম্পূর্ণ উপশম ঘটে।

বৃদ্ধি:- মদ্য জাতীয় সামান্য উত্তেজক পানীয়ে, ঘর্ম, সর্দি, ঋতু ইত্যাদি শরীরস্থ স্বাভাবিক স্রাবে, বিশেষ করিয়া হাম, বসন্ত, স্কার্লেট ইত্যাদি উত্তে জাতীয় চর্মপীড়া চাপা পড়িলে, স্পর্শে, শব্দে, শরীর উত্তপ্ত হইলে, রাত্রিতে, সন্ধ্যায়, পরিশ্রমে, মিষ্ট আহারে ও দুগ্ধ পানে ।
 

উপশম:- স্রাব আরম্ভে, মর্দনে, চুলকাইলে, আহারের সময় এবং মুক্ত গরম বাতাসে। 

সম্বন্ধযুক্ত ঔষধসমূহ:- মস্তিষ্কে জল সঞ্চয়ে ক্যাল ফস। বেলেডোনার এবং ক্যালকেরিয়া, চায়না, ফস, পালস, রাস, সিপিয়া ও সালফারের সহিত অতুলনীয়। ভূতের ভয়ে একোনাইট।

অনুপূরক ঔষধসমূহ:- ক্যালকেরিয়া ফস, হিপার সালফ, সালফার, সিপিয়া, পালসেটিলা, ইয়েশিয়া ।

পূর্ববর্তী ঔষধসমূহ:- বেলেডোনা, এসিড।

পরবর্তী ঔষধসমূহ:- হিপার, ইগ্নেশিয়া, পালসেটিলা, সিপিয়া।

 ক্রিয়ানাশক ঔষধসমূহ:- ক্যাফর, হিপার।

 ক্রিয়া স্থিতিকাল:- ৩০ হইতে ৪০ দিন।

 শক্তি বা ক্রম:- ৩০ হইতে ১০০০ শক্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ