বাতজ্বর - Rheumatic Fever, চতুর্থ বর্ষ - প্যাকটিস অব মেডিসিন

রিউম্যাটিক ফিভার   
Rheumatic Fever





রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বরের সংজ্ঞা:- বাতজ্বর হৃদপিণ্ড রক্তবহামণ্ডলের বিশেষ পরিবর্তন সাধক জীবাণু সংক্রামিত একটি সংক্রামক ব্যাধি। জ্বরসহ দেহের বড় বড় সন্ধিসমূহের সৌত্রিক বিধানসমূহে এক প্রকার প্রদাহ, স্ফীতি ও বেদনা হয় এবং হৃদপিণ্ডের সংকটজনক উপসর্গসমূহ বর্তমান থাকে । শরীরের সন্ধিস্থানসমূহেই এই পীড়া হইয়া থাকে ।

কারণতত্ত্ব:- নিম্নলিখিত কারণে রিউম্যাটিক ফিভার হইতে দেখা যায়।
১) হোমিওপ্যাথিক বা সদৃশ বিধানমতে সাইকোটিক ধাতুগত অবস্থা এই রোগের প্রধান কারণ।
২) তরুণ সন্ধি বাতে সাইনোভিয়াল মেমব্রেনের প্রদাহ হয় এবং সেই প্রদাহ বশত জ্বর হয়।
৩) ভিটামিন সি এর অভাব এবং মাইক্রোকক্কাস নামক জীবাণুর আক্রমণ । 
৪) স্ট্রেপটোকক্কাস ও হেমোলাইটিকাস নামক জীবাণুর সংকলন।
৫) উপযুক্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব । 
৬) আহারের অনিয়ম, অনেক্ষণ ভিজা বস্ত্র পরিয়া থাকা বা বৃষ্টিতে ভেজা, ঘর্মাবস্থায় শরীরে ঠাণ্ডা লাগানো প্রভৃতি। 
৭) ঠাণ্ডা লাগা ও সেঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বসবাস। 
৮) বংশানুক্রমিক পীড়ার প্রবণতা ।

লক্ষণাবলী:- রিউম্যাটিক ফিভারের লক্ষণাবলী নিম্নে প্রদত্ত হইল।
পীড়ার প্রথম অবস্থায় জ্বরসহ সন্ধিস্থল প্রদাহিত হয় অর্থাৎ বড় বড় সন্ধিগুলি স্ফীত, আরক্ত ও বেদনাযুক্ত হয়। নড়াচড়ায় বেদনা ও টাটানি বৃদ্ধি পায়। জ্বর হঠাৎ ১০২/১০৪ ডিগ্রী পর্যন্ত হয়। সাধারণতঃ প্রথমে জানু ও গুলফ সন্ধি আক্রান্ত হয় এবং পর্যায়ক্রমে স্কন্ধের, কনুই, হাতের কব্জি, উরু সন্ধি ও হাত পায়ের ছোট ছোট সন্ধিগুলিও আক্রান্ত হয়। পীড়ার সহিত প্রায়ই টনসিলের প্রদাহ থাকে। নাড়ীর গতি দ্রুত নয়, তবে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হইলে নাড়ী দ্রুত ও অনিয়মিত হয়। বাতের আক্রমণ একসন্ধি হইতে অন্য সন্ধিতে চলিয়া বেড়ায়। বেদনা যন্ত্রণা রাত্রে বেশী হয়। গাঁট ভিন্ন পেরিকার্ডিয়াম, এন্ডোকার্ডিয়াম, পুরা, পেরিটোনিয়াম, প্রভৃতিও আক্রান্ত হয়। পেরিকার্ডিয়াম আক্রান্ত হইলে বক্ষ বেদনা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, হৃদপিণ্ডের অনিয়মিত গতি প্রভৃতি লক্ষণ দৃষ্ট হয়। যুবকদের পীড়া হইলে হৃদপিণ্ডই শীঘ্র আক্রান্ত হয়। শিশুদের হইলে জ্বর ও সন্ধি আক্রমণ প্রবল না হইয়া হাত পা, উদর ও পঞ্জর পেশীর তীব্র বেদনাসহ হৃদপিণ্ড আক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং মাথার উপর, স্ক্যাপুলার প্রান্ত, কনুইয়ের পার্শ্বে, হাতের কব্জিতে কঠিন ও বেদনা যুক্ত পিণ্ড সমূহের উদ্ভব ঘটে। ইহা ছাড়া চামড়ার উপর চাকা চাকা দাগ, চামড়ার নিচে গুটি, স্নায়ুতন্ত্রের গোলযোগ, ক্ষুধাহীনতা, মাথা বাপা, গা হাত পায়ে ব্যথা, রক্তহীনতা, পেটে কলিক বেদনা প্রভৃতি লক্ষণ প্রকাশ পায়।

শ্রেণীবিভাগ:- রিউম্যাটিক ফিভার প্রধানত দুই প্রকার। যথা-
১) তরুন। 
২) পুরাতন ।

রোগ নির্ণয়:- এই পীড়ায় সময়ে সময়ে বুকাস্থি ও কণ্ঠাস্থি সন্ধি, মেরুদণ্ড প্রভৃতি আক্রান্ত হওয়ার ফলে রোগ নির্ণয় কষ্টকর হইয়া পড়ে। পর্যায়ক্রমে সন্ধিসমূহের আক্রমণ এবং তাহার পরে উহাদের গঠন বিকৃতি না থাকা, সন্ধি প্রদাহসহ গাত্র তাপের বৃদ্ধি এবং প্রদাহের উপশমসহ প্রচুর ঘাম হইয়া গাত্র তাপের হ্রাস, হৃদপিণ্ডের পীড়া, বাত পিত্তাদির উদ্ভব প্রভৃতি দ্বারা পীড়া নির্ণীত হইয়া থাকে। হৃদপিণ্ডের ইন্টারস্টিসিয়াল টিসু মধ্যে সরিষার চেয়েও চোট ডিম্বাকার নডুল দেখা যায়। হৃদপিণ্ড পরীক্ষায় ফ্রিকসন সাউন্স পাওয়া যায়। জলজমিলে উক্ত শব্দ পাওয়া যায় না। তখন হৃদস্পন্দন মৃদু হয় ও পরীক্ষায় ডাল সাউন্ড পাওয়া যায়। রক্তে ESR এবং শ্বেত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

জটিলতা:- এই পীড়ায় নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
১) কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর। 
২) এওটিক স্টেনোসিস।
৩) মাইট্রাল রিগারজিটেশন। 
৪) কোরিয়া বা তাণ্ডব রোগ ।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:- আক্রান্ত স্থান গরম কাপড় দ্বারা ঢাকিয়া রাখা উচিত। পীড়া আক্রমণের প্রথমাবস্থা হইতে রোগী শয্যা গ্রহণ করা উচিত। যতদিন পর্যন্ত বেদনা যন্ত্রণা সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত না হয় এবং যে পর্যন্ত নিদ্রাবস্থায় হৃদস্পন্দন সংখ্যা স্বাভাবিক না হয় সে পর্যন্ত শয্যাত্যাগ করা উচিত নয়। সেঁক তাপে যন্ত্রণার উপশম হয়।

পথ্য:- তরল খাদ্য, দুগ্ধ এবং সুসিদ্ধ পানি গ্রহণ করা উচিত। ফলের রস বা অম্ল রসাত্মক দ্রব্য, মাংস প্রভৃতি নিষিদ্ধ । 

ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ:-
১) একোনাইট- পীড়ার প্রথমাবস্থায় উপকারী। সন্ধিস্থান ও পেশীতে কাটিয়া ফেলার ন্যায় বেদনা, প্রবল জ্বর, অস্থিরতা, অন্তর্দাহ ও ছটফটানি। আক্রান্ত স্থান স্ফীত, আরক্ত ও প্রদাহিত। উৎকণ্ঠা, মৃত্যুভয়, পিপাসা, ঘর্মশূন্যতা বর্তমান, বুকে খোঁচা মারা বেদনা জন্য শ্বাসকষ্ট।
২) বেলেডোনা- হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগিয়া একাধিক সন্ধির প্রদাহসহ উজ্জ্বল লালবর্ণ ও স্ফীতি, আক্রান্ত স্থান স্পর্শ করা যায় না, রাত্রে বেদনার বৃদ্ধি, প্রবল জ্বর, উত্তাপ প্রয়োগে বেদনার উপশম, গাত্র শুষ্ক, শিরঃপীড়া, পিপাসা, চোখমুখ লালবর্ণ প্রভৃতি লক্ষণে ব্যবহার্য। 
৩) কলচিকাম-আক্রান্ত সন্ধিসমূহ লাল, উত্তপ্ত ও স্ফীত, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বা মলিন বর্ণ স্ফীতি। এক সন্ধি হইতে অন্য সন্ধিতে গমনশীল বাত। হৃদপিণ্ড আক্রান্ত হইলে হৃদপিণ্ডে সূচীবিদ্ধবৎ বা কাটিয়া ফেলার ন্যায় অসহ্য বেদনা। কটি ও ত্রিকাস্থি দেশে যাতনা। প্রস্রাব স্বল্প ও লালবর্ণ। 
৪) আর্ণিকা- আঘাত লাগিয়া বাত বেদনা, আক্রান্ত সন্ধিসমূহ ফুলিয়া উঠে। ছিঁড়িয়া ফেলার ন্যায় বেদনা, কেহ আক্রান্ত স্থান স্পর্শ করিবে এই ভয়ে ভীত। বিছানা কঠিনবোধ। সামান্য নড়াচড়ায় বা শয্যা গরম হইয়া উঠিলেই পীড়ার বৃদ্ধি।
৫) রাসটক্স- প্রথম নড়চাড়ায় বেদনার বৃদ্ধি, ক্রমাগত নড়াচড়ায় ও গরম প্রয়োগে উপশম। ভিজা ঠাণ্ডা লাগা হেতু বাত জ্বর, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে বাস হেতু পীড়া। সন্ধিসমূহ ও পেশীতে ছিঁড়িয়া ফেলাবৎ বেদনা ৷ অতিশয় অস্থিরতা, শীতল বাতাস অসহ্য। জিহ্বার অগ্রভাগ লাল ত্রিকোণ চিহ্ন বিশিষ্ট । ইহা ছাড়া এই পীড়ায় লক্ষণানুসারে ব্রায়োনিয়া, এপিস, পালসেটিলা, আর্সেনিক, এসিড বেঞ্জো, ক্যালমিয়া, ল্যাক ক্যান, ক্যাক্টাস, কলোফাইলাম, ক্যামোমিলা, লিডাম, ফাইটোলাক্কা প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

ভাবীফল:- পীড়া সুচিকিৎসিত না হইলে বা পীড়া আরোগ্যের পর শীঘ্র শীঘ্র চলাফেলা আরম্ভ করিলে প্রায়শই হৃদপেশীর দুর্বলতা এবং হৃদকোঠরের প্রসারতা চিরস্থায়ী হইয়া রোগীকে প্রায় অকর্মন্য করিয়া ফেলে। প্রবল বাতজ্বরে তরুণ আক্রমণ মাসাধিক কাল পরে সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়। কিন্তু প্রায়ই জ্বর আক্রমণের প্রবণতা থাকে বা পীড়া পুরাতন আকার ধারণ করে। প্রতিকুল ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের উপসর্গসমূহ মারাত্মক হইয়া উঠে। অনেক সময় নিউমোনিয়া ও প্রবল জ্বরে রোগী মারা যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ