রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্রীকরণ - ৬ষ্ঠ অধ্যায়- ১ম বর্ষ

 ৬ষ্ঠ অধ্যায়

রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্রীকরণ

(Individualization of Patients and drugs)





প্রশ্ন-  রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্রীকরণ বলিতে কি বুঝ?


উত্তর ঃ রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্রীকরণ হোমিওপ্যাথি নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বৈচিত্র্যই বিশ্বপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। স্বাতন্ত্রই তার মর্মবাণী। প্রতিটি মানুষ একে অন্য হইতে পৃথক। মানুষের এই স্বাতন্ত্রই তাহার অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের জন্যই অসংখ্য লোকের ভিড় হইতে আমাদের পরিচিত লোকদোকে চিনিয়া নিতে ভুল হয় না। ব্যক্তিসত্তা যেমন সব মানুষ হইতে একক মানুষকে স্বাতন্ত্র দান করে তেননি ব্যক্তিত্বতেই ব্যক্তিমানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত থাকে। কোন দুই চরিত্র হুবহু একরূপ হয়না।

রুগ্ন প্রকৃতির স্বাতন্ত্র্য্য : ব্যক্তি মানুষের স্বাতন্ত্র্য্য তা সুস্থাবস্থায় যেমন সত্য তেমনি তার অসুস্থাবস্থায়ও সত্য এবং তখন উহা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়। রোগাক্রান্ত হইলে বিভিন্ন মানুষে বিভিন্ন রূপ প্রতিক্রিয়া হয়। এই প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ হয় বিভিন্ন লক্ষণরাজির মাধ্যমে। লক্ষণসমূহ সম্মিলিত ভাবে একটি কা প্রকৃতির চিত্র ভুলিয়া ধরে। সেই রোগীর চিত্রে এমন কিছু বিশিষ্টতা থাকে সামগ্রিক ভাবে যাহার তুলনা অন্য রোগীতে পাওয়া যায় না। প্রতিটি রুগ্নমানুষ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে এক একটি অনন্য চরিত্র। বিচিত্র লক্ষণরাজি মিলিত ভাবে রুগ্নব্যক্তির এমন এক প্রতিকৃতি সৃষ্টি করে যার বিকল্প অন্য রোগীতে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না ।

ঔষধের স্বাতন্ত্র্য : প্রতিটি ঔষধ অন্য ঔষধ হইতে স্বতন্ত্র। একটি ঔষধের সঙ্গে অন্য একটি ঔষধের কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে এমনি কিছু বৈসাদৃশ্য থাকে যাহার দ্বারা একটিকে অন্যটি হইতে অতি সহজে পৃথক করা চলে। প্রতিটি ঔষধে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যাবলী থাকে যাহার ঠিক সদৃশ রূপটি অন্য ঔষধে পাওয়া যায় না। প্রতিটি ঔষধ সুস্থ দেহে এমন কতকগুলি বিচিত্র লক্ষণ সৃষ্টি করে যাহা অন্য কোন ঔষধ সৃষ্টি করিতে পারে না।


প্রশ্ন-  হোমিওপ্যাথিতে রোগী ও ঔষধের স্বাতন্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা কি?

বা, হোমিওপ্যাথিতে স্বাতন্ত্র্য্য নির্ণয় পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর।

বা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় স্বাতন্ত্রীকরণের ভূমিকা কি?


উত্তর : হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ঔষধের সত্তা-স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় করার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব অপরীমি । হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালী মূলতঃ স্বাতন্ত্রীকরণ নীতির উপর নির্ভর করে। স্বাতন্ত্রীকরণ বা ব্যষ্টিকরণ বলিতে বুঝায় পৃথক করা বা আলাদা করা। স্বভাবজা বিশিষ্টতা অনুসারে বহু হইতে রুগ্ন ব্যক্তি মানুষকে বা তাহাকে প্রদেয় ঔষধটিকে পৃথক করিয়া নেওয়া। রোগীর ও ঔষধের ব্যাপক লক্ষণসমূহ স্বাতন্ত্রীকরণ ক্রিয়ায় সহায়তা করে।



প্রশ্ন- রোগ নির্ণয়ে ও ঔষধ নির্বাচনে স্বাতন্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা বা ভূমিকা কি?

উত্তর : রোগ পরীক্ষা ও রোগচিত্র অংকন প্রক্রিয়া, ঔষধের গুনাগুন পরীক্ষা, মেটিরিয়া মেডিকা অধ্যয়ণ, ঔষধ নির্বাচন, ঔষধের শক্তি নির্ণয়, ঔষধ প্রয়োগ কলা, রোগীর আনুষঙ্গিক চিকিৎসা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ে হোমিওপ্যাথি স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসরণ করিয়া চলে। হোমিওপ্যাথিতে স্বাতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে প্রতিটি রোগীকে অন্য রোগী হইতে এবং প্রত্যেক ঔষধকে অন্য ঔষধ হইতে পৃথক করিয়া নেয়। যেহেতু হোমিওপ্যাথি একটি লাক্ষণিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এখানে রোগের নয়। রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে রোগীর ব্যক্তিচরিত্র, দৈহিক কাঠামো, দৈহিক ও মানসিক লক্ষণ প্রভৃতি সঠিক ভাবে সংগ্রহ করার পর তাহার মূল্যায়ন ও শ্রেণী বিভাগ করিয়া যে অসাধারণ, একক বিরল লক্ষণ পাওয়া যায় ঐ সকল লক্ষণ একত্রিত করিলেই রোগীর ব্যক্তিসত্তাগত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এই বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করিয়াই এক রোগীর সহিত অন্য রোগীর পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। এক একটা রোগীর ব্যক্তিসত্তা অন্য রোগীর ব্যক্তিসত্তার সহিত পৃথকীকরণ করিতে না পারিলে সুনির্বাচিত ঔষধটি খুঁজিয়া বাহির করা যায় না আবার সুনির্বাচিত ঔষধটি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইলে প্রতিটি ঔষধের নিজস্ব একক "অসাধারণ, অদ্ভুত ও বিরল লক্ষণের সমষ্টিতে যে সত্তাগত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তাহা অন্য ঔষধে হুবহু পাওয়া যায় না। এই সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য হইতেই ঔষধের প্রকৃতি জানা যায়। এইভাবে বহুসংখ্যক ঔষধের সত্তার পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য ও তাহাদের সত্তা যাতা বা পার্থক্য নির্ণয় করার জ্ঞান অর্জন করিতে পারিলেই চিকিৎসকের জ্ঞানের ভান্ডার পরিপূর্ণ হইয়া উঠিনে। এই জ্ঞান লাভ করিলেই চিকিৎসক বুঝিতে পারিবেন কোন নির্দিষ্ট সত্তা বিশিষ্ট রোগীর জন্য এখন কোন সদৃশ সরা বিশিষ্ট ঔষধটি প্রয়োজন। রোগীর যেমন একটি জীবন্ত ব্যক্তি সত্তা আছে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলিও ঠিক তেমনি এক একটি সজীবসত্তা বিশিষ্ট।

স্বাতন্ত্রীকরণের পর হোমিওপ্যাথি সাদৃশ্য খোঁজে। প্রতিটি রোগী চরিত্রের সঙ্গে মিলন ঘটানোর জন্য মেটিরিয়া মেডিকা উপযুক্ত ঔষধ চরিত্রের অন্বেষন করে। তন্মধ্যে যেই ঔষধটি রোগ চরিত্রের সঙ্গে সর্বাপেক্ষা সাদৃশ্যযুক্ত বলিয়া বিবেচিত হয়।

 উহাই শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হয়। দুই সদৃশ চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ মিলনের পর এই মিলিত চরিত্রের অন্তর্ধাণ ঘটে এবং রোগী আরোগ্য লাভ করে। কাজেই রোগী স্বাতন্ত্রীকরণের জান ব্যতীত প্রকৃত রোগারোগ্য সম্ভবপর নয়।


সমাপ্ত



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ