কলোসিন্থিস
Colocynthis
প্রাকৃতিক অবস্থা:- কিউবার বিটোসিয়া (কুম্মাণ্ডাদি)।
প্রতিশব্দ:- বিটার আপেল, বিটার গোর্ড কলোসিন্থ, সাইট্রোলাস কলোসিন্থিস, কলোসিন্থিস ভালগ্যারিস, তিক্ত শশা।
বাংলা নাম:- রাখাল শশা, আকাশ ফল, ইন্দ্রাবরণী।
বর্ণনা:- ইহা কাষ্ঠযুক্ত শাখা ও মূল বিশিষ্ট বর্ষজীবী পত্রমোচী আরোহী লতা। মূল হইতে কোণাকৃতি বিশিষ্ট হইয়া উপরের দিকে উঠে। একটির পর একটি ডাঁটা খসখসে হইয়া থাকে। পাতাগুলি বৃত্তযুক্ত এবং বিভিন্ন আকারের। মে হইতে আগষ্ট মাসে এই সকল গাছড়ায় বড় আকারের হলদে ফুল আলাদা আলাদাভাবে দেখা যায়। ফলগুলি ২২ হইতে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের, কমলা লেবুর ন্যায় দেখিতে। ফলের রং হলদে, খোসা পাতলা এবং মসৃণ, স্বাদ অতিশয় তিক্ত।
উৎস:- বিটার আপেল নামক ভারতের উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে উৎপন্ন একজাতীয় গাছের ফলের বীজ হইতে এই ঔষধটি প্রস্তুত হয়।
প্রাপ্তিস্থান:- ভারতের উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে এই গাছগুলি ব্যাপকভাবে জন্মিয়া থাকে। সিংহল, আরব, উত্তর আফ্রিকা, উত্তমাসা অন্তরীপ এবং জাপানেও ইহারা জন্মিয়া থাকে।
প্রস্তুত প্রণালী:- এই ফলের খোসা ও বীচি ফেলিয়া দিয়া বীজের চতুর্দিকের নরম অংশ ঔষধার্থে ব্যবহৃত হয়। ফার্মাকোপীয়ার নিয়মানুসারে ফলের নরম অংশ শুষ্ক করিয়া চূর্ণ প্রস্তুত করিয়া সুরাসার ও পরিশ্রুত জল সহযোগে মূল অরিষ্ট প্রস্তুত হয়। ২০ শক্তি প্রস্তুত করিতে গেলে ১ ভাগ অরিষ্ট, ৩ ভাগ পরিশ্রুত জল ও ৬ ভাগ সুরাসারের প্রয়োজন। ৩০ এবং উচ্চ শক্তিতে পরিশ্রুত সুরাসার প্রয়োগ হয়।
ক্রিয়াস্থান:- স্নায়ুমণ্ডলী, অন্ত্র, মস্তক, উদর, পেশী প্রভৃতির উপর ইহা ক্রিয়া করিয়া থাকে। স্নায়ুমণ্ডলীতে ইহা ক্রিয়া প্রকাশ করিয়া নানা প্রকার স্নায়ুশূল ও সায়েটিকা বেদনা উৎপন্ন করে, আর অস্ত্রে ক্রিয়া প্রকাশ করিয়া প্রবল প্রদাহ উৎপন্ন করে সেজন্য প্রথমে জলের মত তরল মল, পরে আমরক্ত মিশ্রিত, বমন ও অসহ্য তীব্র উদর বেদনা প্রভৃতি লক্ষণাবলী প্রকাশ পায়।
কোন রোগীতে কলোসিন্থ প্রযোজ্য:- ক্রোধ প্রবণ ব্যক্তি, যাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেই রাগিয়া যায়। একটুতেই দোষ মনে করে, যে সকল স্ত্রীলোকের অধিক ঋতুস্রাব হয়, অথচ অলস এবং যে সকল ব্যক্তি অতি শীঘ্র শীঘ্র স্থূলকায় হইয়া পড়ে তাহাদের শরীরে ইহা দ্রুত ক্রিয়া প্রকাশ করে। মস্তক ও উদরেই কলোসিন্থের প্রধান লক্ষণ দেখা যায়। যে সময় বাতাস ঠাণ্ডা অথচ রৌদ্র প্রখর, সে সময় কলোসিন্থ ব্যবহারে শীঘ্র ঔষধের ক্রিয়া প্রকাশিত হয়।
মানসিক লক্ষণ:-
১। রোগী অতিশয় উত্তেজিত, খিটখিটে স্বভাবের। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।
২। ক্রোধ ঘৃণা মিশ্রিত।
৩। রোগী একা থাকিতে চায়, কেহ তাহার নিকট থাকুক তাহা চায় না।
৪। খুবই নীচমনা।
৫। ক্রোধের পর পীড়ার আবির্ভার।
চরিত্রগত লক্ষণ:-
১। শরীর গরম হওয়ার পর ঠাণ্ডা জল পানে, গোল আলু খাওয়ায় মুখের বা উদরের কোন বড় নার্ভের বেদনায় আক্রান্ত হয় ও বেদনা বাম দিকেই বোধ করে। বেদনা স্থানে চাপিয়া ধরিয়া ছটফট করে এবং যন্ত্রণায় অধীর হয়।
২। ঘর্মে মূত্রের গন্ধ পাওয়া যায়।
৩। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইবার পর বাহ্য, বমি, পেট বেদনা, ঋতুবন্ধ, ফিট, মস্তিস্কের কোন পীড়ার উৎপত্তি।
৪। হঠাৎ তাড়াতাড়ি বামদিকে মাথা ফিরাইলে মাথা ঘুরিয়া উঠে।
৫। কলিক শূল বেদনা বা ডিম্বকোষের বেদনা জোরে চাপিয়া ধরিলে বা সম্মুখ দিকে ঝুকিলে সামান্য উপশম বোধ।
৬। সায়েটিকা নামক স্নায়ুশূল বেদনা, বাম উরু সন্ধিতে খিল ধরা মত বেদনা, আক্রান্ত স্থান চাপিয়া শয়ন করে।
৭। বিদ্যুৎ গতির ন্যায় বেদনা নীচে বাম উরুতে, বাম হাঁটুতে ও বাম হাঁটুর পশ্চাবর্তী স্থানে পরিচালিত হয়।
৮। রক্তামাশয় বাহ্যের পূর্বে পেটে প্রবল বেদনা ও কোঁথানী, হাত দিয়া পেট চাপিয়া ধরে।
৯। মুখে তক্তাস্বাদ।
১০। প্রস্রাব করার পর সমস্ত পেটে ব্যথা।
প্রয়োগক্ষেত্র:- শূল বেদনা, সায়েটিকা, বাত পীড়া, উদরাময়, আমাশয়, ঋতুশূল প্রস্রাবের পীড়া, শিরঃপীড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা প্রয়োগ হয়।
শূল বেদনা:- কলোসিন্থ পেটের শূল বেদনার সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধ। অন্য কোন ঔষধে এত তীব্র পেট বেদনা থাকে না। পেটে এক প্রকার ব্যথা ধরে, সেই ব্যাথা কোনও প্রদাহ জনিত নহে, উহাতে রোগী সম্মুখ দিকে ঝুঁকিয়া বসিয়া থাকিলে, বেদনার স্থানে জোরে চাপিয়া ধরিলে, পা গুটাইয়া কিম্বা উপুড় হইয়া শুইলে একটু উপশম হয়। বেদনার ধমকে প্রায়ই কাঁদে, ছটফট করে। এইরূপ ব্যথায় কলোসিন্থ নিম্ন শক্তি প্রয়োগে সত্বর বেদনার উপশম হয়। কলোসিন্থের শূল বেদনা অনেকটা স্নায়বিক ধরণের এবং তাহার সঙ্গে প্রায়ই বাহ্য বমি ইত্যাদি থাকে। বেদনার জন্যই এই বাহ্য বমি হইয়া থাকে। উহা পেটের দোষ হেতু নহে। আমাশয়ে এইরূপ বেদনা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। কলোসিন্থে মোচড়ানি, কামড়ানি কিম্বা খেঁচুনি থাকে। ম্যাগ ফস ঔষধটিও উদরশূল বেদনায় কলোসিন্থের সমকক্ষ। গরম প্রয়োগে ম্যাগ ফসের বেদনা উপশমিত হয়।
শূল বেদনায় ক্যামোমিলা ও ডায়স্কোরিয়ার সহিত কলোসিন্থের তুলনা:-
ক্যামোমিলাও কতকটা কলোসিন্থের সদৃশ ঔষধ এবং দুই ঔষধই রাগজনিত উদর শূলে ব্যবহৃত হয়। ক্যামোতে শিশুদের উদর শূলে পেটে বায়ু জমে, পেট ফোলে, ছেলে ছটফট করে, কাঁদে এবং যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া পড়ে। কিন্তু কলোসিন্থের মত কোঁকড়াইয়া পা গুটাইয়া থাকে না।
ডায়াস্কোরিয়া:- বায়ু সঞ্চয় জনিত উদর শূলে উপযোগী। ইহার বেদনা নাভি স্থলের নিম্নে, কুঁচকীর স্থান হইতে আরম্ভ হইয়া পরে সমস্ত পেটে ছড়াইয়া পড়ে। কখনও হাতে পায়ে পর্যন্ত পরিচালিত হয়। কলোসিন্থের সহিত ডায়াস্কোরিয়ার প্রভেদ এই যে, কলোর রোগীর বেদান পা গুটাইয়া কুঁকড়ি হইয়া শুইলে, সামনে নত হইলে, চাপিয়া ধরিলে বেদনার উপশম হয়। কিন্তু ডায়স্কোতে উহার ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ রোগী কুঁকড়ি হইয়া থাকিলে, সামনের দিকে ঝুঁকিলে ও চাপিয়া ধরিলে বেদনা বাড়ে। পিছের দিকে হেলিয়া থাকিলে বেদনার উপশম।
সায়েটিকা:- সায়েটিকা কটিদেশের স্নায়ুশূল বা এক প্রকার বাত। পাছা ও উরুর পশ্চাতে একটা মোটা স্নায়ু আছে উহাই সায়েটিকা স্নায়ু। সায়েটিকা স্নায়ু হইতে বেদনা আরম্ভহইয়া হাঁটু ও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বেদনা পরিব্যাপ্ত হইলে ও সেই বেদনা নড়াচড়ায় বৃদ্ধি পাইলে ইহা উপকারী। বেদনার প্রকৃতি তীরবিদ্ধবৎ। পা ও কোমর অসাড় বোধ। যে দিকে বেদনা সেদিকে চাপিয়া থাকিতে ভালবাসে। জোরে চাপে ও গরমে বেদনার উপশম হয়। উপরোক্ত লক্ষণসহ গাঁট শক্ত ও টেণ্ডন ক্ষুদ্র হওয়া ও জোরে চাপিয়া শুইলে আক্রান্ত পার্শ্বের উরুর উর্ধের অস্থিতে খিল ধরার মত বেদনায় কলোসিন্থ উপকারী।
উদরাময় ও আমাশয়ে লক্ষণ:- উদরাময় জলের মত পাতলা, অল্প সবুজ বর্ণের হড়হড়ে বাহ্য হয়। মল খুব হলদে রঙের, গন্ধকের মত রং, তাহার সহিত ফেনা মিশ্রিত থাকে। বাহ্যের সঙ্গে হয় আম না হয় রক্ত, না হয় কিছু পিত্ত মিশ্রিত থাকে। অনেক সময় রক্ত বাহ্যও হয়। কলোসিন্থে অনেক সময় বাহ্য বেশী হইলে বর্ণহীন হইয়া থাকে এবং পাতলা বাহ্যের সহিত আম মিশ্রিত থাকে। ইহাতে বাহ্যের পূর্বে পেটে অত্যন্ত কামড়ানি ব্যথা এবং বাহ্যের বেগ থাকে। এত বেগ যে রোগী তাহাতে বেসামাল হইয়া পড়ে। বাহ্যের সময় পেটে বেদনা, কোঁথানি, গা বমি বমি এবং মলদ্বারে ও প্রস্রাব দ্বারে খুব জ্বালা যন্ত্রণা থাকে। পেটের যন্ত্রণা বাহ্যের পর নিবৃত্তি হয়। কিন্তু যদি বাহ্যের পর একবার পেট ব্যথা আরম্ভ হয় তাহা হইলে বেশ কষ্ট দায়ক হইয়া পড়ে। ইহার বাহ্য টক বা কাগজ পোড়ার মত এক প্রকার খর গন্ধযুক্ত। মলদ্বার হাজিয়া যায়। পেটের পীড়ায় জিহ্বার ডগায় জ্বালা, তিক্তাস্বাদ, ক্ষুধা, পিপাসা, গা বমি বমি, আবার কাঠ বমি, আবার কিছুমাত্র গা বমি বমি না থাকিয়াও ভুক্ত দ্রব্যের অথবা সবুজ বর্ণের তিক্ত বমি, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি অন্য কতকগুলি লক্ষণও ইহাতে দৃষ্ট হয়। আমাশয়ের শূলানী ও পেট বেদনা কলোসিন্থে উপকার না হইলে মার্কসলের প্রয়োজন হয়।
স্ত্রীরোগ:- স্ত্রী পীড়ায় ডিম্বকোষের মধ্যে ছিদ্র করিবার ন্যায় বেদনা। শরীরকে সামনের দিকে কোঁকড়াইয়া ফেলিতে হয়, তৎসহ অত্যন্ত অস্থিরতা থাকে। ডিম্বকোষের অভ্যন্তরে ছোট, বর্তুলাকার টিউমার, যাহার মধ্যে তরল বা অন্য কোন পদার্থে পূর্ণ একটি থলি থাকে। যোনীর অভ্যন্তরে খিল ধরে এবং সব কিছু ঠেলিয়া বাহির হইবার ন্যায় জোর করে। এই অবস্থা প্রতিরোধের জন্য তাহাকে সামনের দিকে বক্র হইয়া গুটিশুটি মারিয়া বসিয়া থাকিতে হয়।
বৃদ্ধি:- ক্রোধ ও ঘৃণায়, আহারের পর, সন্ধ্যায়, বিশ্রামে নিজকৃত অপরাধজনিত মনঃপীড়া।
উপশম:- শরীর দুমড়াইয়া রাখিলে, জোরে চাপে, গরমে, মাথা সম্মুখ দিকে বক্র করিয়া শয়নে, বায়ু নিঃসরণে।
অনুপূরক:- মার্কসল, ব্রায়োনিয়া, বেলেডোনা, নাক্স ভম, সালফার, কষ্টিকাম।
ক্রিয়ানাশক:- ওপিয়াম, স্ট্যাফিগ্রেসিয়া, কফিয়া, ক্যাম্ফর, কষ্টিকাম, ক্যামোমিলা।
ক্রিয়া স্থিতিকাল:- ১ হইতে ৭ দিন।
ক্রম:- ৩৪ হইতে ২০০ শক্তি।
পরামর্শ:-
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রেও রুগীর উচিত একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। কারণ:
ব্যক্তিভেদে রোগ ভিন্ন হতে পারে: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় রোগ নয়, রুগীর সামগ্রিক লক্ষণ, মানসিক অবস্থা, শারীরিক গঠন, জীবনধারা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ঔষধ নির্বাচন করা হয়।
সঠিক ঔষধ নির্বাচন জরুরি: একই রোগের জন্য একাধিক হোমিও ঔষধ থাকতে পারে, কিন্তু কোনটি রুগীর উপযোগী তা নির্ধারণ করতে একজন বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
মাত্রা ও সময়জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ: কখন, কী পরিমাণে, কতদিন ঔষধ খেতে হবে—তা ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী হওয়া উচিত।
নিজে নিজে ঔষধ গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে: ভুল ঔষধ বা মাত্রা রুগীর সমস্যাকে জটিল করে তুলতে পারে, কিংবা উপসর্গ লুকিয়ে রেখে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তাই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাও অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করা উচিত।
0 মন্তব্যসমূহ