উচ্চ রক্তচাপ - Hepertension, চতুর্থ বর্ষ - প্যাকটিস অব মেডিসিন

উচ্চ রক্তচাপ
Hepertension







হাইপার টেনশনের সংজ্ঞা:-  হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ বা সিস্টোল ও ডায়াস্টোল দ্বারা সমগ্র ধমনী মধ্যে এক অব্যাহত রক্তস্রোত সর্বদাই বর্তমান থাকে । এই দুই প্রেসারের যে বিয়োগফল তাহাই হইল পালস প্রেসার। সুস্থ মানবদেহে স্বাভাবিক রক্তের চাপ সাধারণত সিস্টোলিক ১২৫+৫ এবং ডায়াস্টোলিক ৭৫+৫। তবে একজন সুস্থ বয়স্ক ব্যক্তির রক্তের চাপ সিস্টোলিক ১১০ হইতে ১৫০ এবং ডায়াস্টোলিক ৭০ হইতে ৯০ পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা হয়। কিন্তু রক্তের চাপ উক্ত মাত্রা হইতে স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পাইলে তাহাকে হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলে। ডায়াস্টোলিক চাপের দীর্ঘস্থায়ী বর্ধিত অবস্থা সিস্টোলিক চাপের দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ।

শ্রেণীবিভাগ:- হাইপারটেনশন প্রধানত ২ প্রকার। যথা-
১) প্রাইমারী বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন।

ইহা আবার ২ প্রকার। যথা-
ক) এসেনশিয়াল বিনাইন হাইপারটেনশন।
খ) এসেনশিয়াল ম্যালিপনান্ট হাইপারটেনশন।

২) সেকেণ্ডারী হাইপারটেনশন।
ইহাও আবার ২ প্রকার।
ক) সেকেন্ডারী বিনাইন হাইপারটেনশন।
খ) সেকেন্ডারী ম্যালিগনান্ট হাইপারটেনশন। 

কারণতত্ত্ব:-
১) বংশানুক্রমিক প্রবণতা ।
২) হৃদপিণ্ড সজোরে পাম্প করিলে।
৩) শারীরিক পরিশ্রমের স্বল্পতা, অলস জীবন যাপন তৎসহ অতিভোজন এবং শারীরিক স্থূলতা। 
৪) অত্যধিক মানসিক পরিশ্রমের ফলে।
৫) কোপন স্বভাব, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, প্রভৃতি কারণে।
৬) প্রস্টেটের ও মূত্রগ্রন্থির পীড়া হইলে। রেনাল ধমনীর সংকীর্ণতা।
৭) পিটুইটারী গ্লাণ্ডের টিউমার, এড্রিনাল গ্রন্থির টিউমার প্রভৃতির ফলে । 
৮) ধমনীর কাঠিন্য, এথেরোমা, আর্টেরিগুলোস্কোলরোসিস প্রভৃতি। 
৯) মস্তিষ্কে রস বৃদ্ধি ও রক্তস্রাব হইয়া চাপবৃদ্ধি গুল্ম প্রভৃতি । 
১০) মুখ, নাক, টনসিল প্রভৃতির বিষ ক্ষতের ফলে।

লক্ষণাবলী:-
১) রক্ত চক্ষু উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম ইংগিত বিশেষ।
২) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শীত শীত ভাব, মাঝে মাঝে মাথাঘোরা এবং মাথা ব্যথা হওয়া।
৩) দৃষ্টি শক্তির হ্রাস দৃষ্টি ক্ষেত্রের ভিতর কম্পিত বস্তু দেখা, আলোর চতুষ্পার্শে রামধনুর ন্যায় বর্ণ দেখা, দ্বিত্ব দৃষ্টি।
৪) হঠাৎ উত্তেজনা হইতে নাসিকা ও মাড়ি হইতে রক্তস্রাব।
৫) কিডনীর ক্রিয়া ব্যাহত হওয়া ।
৬) হৃদযন্ত্রের বিকৃতি-হৃদপিণ্ডের মাংসপেশী আয়তনে ক্রমশ বাড়িতে থাকে । সামান্য শ্রমে শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্রের সংকোচন তাল বিকৃত হয় ।
৭) মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত- মস্তিষ্কের স্থানে স্থানে উপধমনীগুলির সংকোচন ঘটিয়া বা রক্ত নালিকাগুলির ভিতর রক্ত জমাট হইয়া ২/১টি কৈশিক রক্ত নালিকার দেয়াল ফাটিয়া রক্তস্রাব হইতে পারে। 
৮) সাময়িক সংজ্ঞা লোপ, বাকশক্তি লোপ, সাময়িক অন্ধত্ব, সেরিব্রাল প্রম্বোসিস, সন্যাস রোগ, নানাবিধ স্থানীয় পক্ষাঘাত প্রভৃতি ।
৯) সিস্টোলিক ১৪০ এর বেশী এবং ডায়াস্টোলিক ৯০ এর বেশী পরীক্ষায় ধরা পড়ে। 

লক্ষণাবলী:- শিরঃপীড়া, দৃষ্টি বিভ্রম, স্বল্প পরিশ্রমে ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা, হৃদযন্ত্রে বেদনা অনুভব, বিবমিষা ও মধ্যে মধ্যে বমন, শ্বাসকষ্ট, আক্ষেপ, গোড়ালিতে শোথ, মাথা ঘোরা, চোখে সর্ষেফুল দেখা, দুর্বলতা প্রভৃতি লক্ষন দৃষ্ট হয়। ম্যালিগন্যান্ট কেসের লক্ষণ ক্রমশই বৃদ্ধি দেখা যায়। হয়ত রক্তস্রাব হইয়া একটি চক্ষু অন্ধ হইয়া গেল। চোখের পাতা ফোলা, ধমনীর আক্ষেপ, দেহের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে, ঘিলু মধ্যে রক্তস্রাব। হার্টের আকার বৃদ্ধি। মৃত্রযন্ত্রের মধ্যে সামান্য রক্তস্রাব দেখা যায়।

প্যাথলজি:- মৌলিক রক্তচাপ বৃদ্ধিগ্রস্ত রোগীদের প্রাথমিক অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই হৃদপিণ্ডের ক্রিয়াগত বা গঠনগত কোন প্রকার বিকৃতি পাওয়া যায় না। এই বিকৃতির প্রধান কারণ রক্ত সঞ্চালনতন্ত্রের বহির্ভাগের অর্থাৎ উপধমনীর আক্ষেপ উপস্থিত হইবার ফলে আভ্যন্তরীণ চাপ বা পেরিফেরাল রেজিস্টান্স বৃদ্ধি।  ধমনীর এই আক্ষেপ দীর্ঘদিন হইতে থাকিলে তাহার ফলে ক্ষুদ্রধমনীগুলির এবং বাম ভেন্ট্রিলের হাইপারট্রপি হয়। ক্রমশ যকৃত, প্লীহা, কিডনী, প্যানক্রিয়াস, পাকাশয়, মস্তিষ্ক, অস্ত্র, মায়োকার্ডিয়াম ও এওটা, করোনারী আর্টারী, রেটিনা প্রভৃতির ক্ষুদ্র ধমনীসমূহের অন্ত ও মধ্য আবরণের কাঠিন্য উপস্থিত হইয়া তাহাদের ছিদ্র সংকুচিত এবং ক্রমশ বন্ধ হইয়া যায়। উপধমনীগুলির ক্রিয়াগত সংকোচন হইতে উদ্ভূত উচ্চ রক্তচাপ বেশী দিন স্থায়ী হইলে মূত্রগ্রন্থির এক প্রকার বিকৃতি ঘটায় এবং বিকৃত মূত্রগ্রন্থি রেনিন নামক এক প্রকার রস সৃষ্টি করে যার ফলে রক্তচাপ আরও বৃদ্ধি পায় এবং উপধমনীগুলির প্রাচীর গাত্রের বিকৃতি ঘটায়।

জটিলতা:- এই পীড়ার জটিলতাসমূহ নিম্নে দেওয়া হইল। 
১) রাইট হার্ট ফেলিওর বা কসজেসটিভ হার্ট ফেলিওর।
২) সেরিব্রাল হেমারেজ।
৩) লেফট ভেন্ট্রিকুলার হাইপারট্রফি।
৪) হাইপারটেনসিভ এনকেফালোপ্যাথি।
৫) সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস প্রভৃতি।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও পথ্য:- জীবনযাপন প্রণালীকে সহজতর করার চেষ্টা করিতে হইবে। দুশ্চিন্তা পরিহার এবং দৈহিক ও মানসিক সম্পূর্ণ বিশ্রাম এবং সুনিদ্রা একাস্ত প্রয়োজন। সর্বদা কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করিতে হইবে। কোন কাজেই তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। দেহের উচ্চতা অনুসারে ওজন বেশী হইলে খাদ্যে সংযম করিয়া ওজন কমাইয়া ফেলিলে হৃদযন্ত্র অকারণ পরিশ্রম হইতে রক্ষা পায়। খাদ্যে লবণ বর্জন সুচিকিৎসা। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং গুরুপাক খাদ্য মাংস প্রভৃতি বর্জনীয়। ঈষদুষ্ণ পানিতে গোছল করা উচিত। শর্করা ও শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য যেমন চাউল, গম প্রভৃতি যথাসম্ভব কমাইতে হইবে। খালি পেটে প্রচুর পানি সেবন উপকারী। দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম উপকারী। 

ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ:-
১) গ্লোনয়িন- রোগী অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং রোগপ্রবণ। রক্তবহুল ব্যক্তি। সামান্য উত্তেজনায় বা গরমের মধ্যে কাজ করিলে বা মাথায় রৌদ্র লাগিলে মাথায় রক্ত উঠে। মনে হয় মাথাটি ফাটিয়া যাইবে। হৃদপিণ্ডের দিকেও রক্ত ধাবিত হয়।
২) বেলেডোনা- অত্যধিক রৌদ্রতাপ বা হাওয়ার দরুন হঠাৎ রক্ত চাপ বৃদ্ধির ফলে সন্যাস রোগের লক্ষণ প্রকাশ। মুখমণ্ডল রক্তিম, ক্যারোটি ধমনীর দপদপানি, সামান্য শব্দে চমকাইয়া উঠে। শুইয়া থাকিতে পারে না ।
৩) ল্যাকেসিস- মদ্যপায়ীদের মস্তিষ্ক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদপিণ্ডের রোগ, কষিয়া কাপড় পরিতে চায় না, ঘুম হইলেই কষ্ট বৃদ্ধি এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি। নিদ্রাভীতি কারণ ঘুম আসিলেই কষ্ট বৃদ্ধি ।
৪) একোনাইট কোন প্রকার ভয় পাইয়া রক্তচাপ বৃদ্ধি। শারীরিক এবং মানসিক চঞ্চলতার ভাব খুব বেশী, অত্যধিক মৃত্যুভয়। শুইয়া থাকিলে মুখমণ্ডল রক্তিম, উঠিয়া বসিলে পাংশু দেখায়।
৫) অরাম মেট— যে কোন বিষয়ে ব্যস্ততা, উত্তর লাভের জন্য অপেক্ষা না করিয়া প্রশ্ন করিয়া যায়। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা, আত্মহত্যার চিন্তা। সিস্টোলিক প্রেসারের তুলনায় ডায়াস্টোলিক প্রেসার অপেক্ষাকৃত বেশী ।
ইহা ছাড়া লক্ষণানুযায়ী আর্নিকা, ব্যারাইটা মিউর, নাক্স ভমিকা প্রভৃতি ঔষধও এই পীড়ায় ব্যবহৃত হয়।

ভাবীফল:- উপসর্গবিহীন সাধারণ উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক সময় বিনা উপদ্রবে সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বাঁচিতে পারে। কিন্তু যে সকল রোগীতে মূত্রগ্রন্থির বা হৃদযন্ত্রের স্থায়ী বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়াছে তাহাদের আয়ু বিনা চিকিৎসায় বা আধুনিক তীব্র ঔষধ দ্বারা ২/৩ বৎসরের বেশী আশা করা উচিত নয়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় পীড়ার নিরাময় হয়। তবে ম্যালিগন্যান্ট ক্ষেত্রে রোগীর আয়ুষ্কাল খুবই সীমাবদ্ধ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ