পাইরোজেনিয়াম - PYROGENUM, চতুর্থ বর্ষ - মেটেরিয়া মেডিকা

পাইরোজেনিয়াম 
PYROGENUM









প্রতিশব্দ:- পচা মাংসের নোসড।

উৎস ও প্রস্তুত প্রণালী:- পচনশীল পেশীময় গোমাংস হইতে এই ঔষধ প্রস্তুত হয়। পচনশীল গোমাংস পানিতে ভিজাইয়া দুই সপ্তাহ ধরিয়া রৌদ্রে রাখিবার পর তাহা হইতে মূল অরিষ্ট এবং হোমিও ফার্মাকোপিয়ার নিয়মানুসারে বিভিন্ন শক্তির ঔষধ প্রস্তুত করা হয়।

প্রস্তুতের ফরমুলা:- এফ ৮। প্রশ্ন-১২.০৪ ।  

প্রুভার:- ডাঃ সোয়ান, ডা এলেন, ডা বার্নাট এবং ডাঃ সারবিন প্রমুখ চিকিৎসকবৃন্দ ইহা প্রভ করেন।

ক্রিয়াস্থান:- ইহা একটি নোসড শ্রেণীভূক্ত ঔষধ। মস্তিষ্ক, রক্ত, পাকস্থলী, জননেন্দ্রিয়, শ্বাসনালী, প্রভৃতির উপর ইহা ক্রিয়া করিয়া থাকে।

মানসিক লক্ষণ:- মানসিক বিশৃঙ্খলা। জ্বরের সময় রোগী বেশী কথা বলে এবং চিন্তা করে। অসংলগ্ন প্রলাপ। রোগী মনে করে যে সে সারা বিছানা জুড়িয়া রহিয়াছে। সে অনুভব করে যে মাথাটি বালিশের উপর আছে কিন্তু দেহের অন্যান্য অংশ যে কোথায় আছে বুঝিতে পারে না। রোগী মনে করে তাহার অনেকগুলি হাত পা গজাইয়াছে। রোগী উত্তেজনা প্রবণ। বিভিন্ন পার্শ্বে শয়নে নিজেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বলিয়া মনে করে।

চরিত্রগত লক্ষণ:-
১) বাচালতা ও শীত কাতরতা।
২) উত্তাপ ও ধর্মের সহিত মিশ্রিত তীব্র শীত অথবা শুষ্ক উত্তাপের সহিত স্পষ্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কামড়ানি, অস্থিরতা, সঞ্চালনে উপশম ।
৩) সেপটিক জ্বর। প্রলাপ ও বিকার।
৪) ঠাণ্ডা লাগিলে পীড়ার উৎপত্তি।
৫) নাড়ী ও তাপের অসমতা। নাড়ী খুব দ্রুত এবং পত্রিতাপও অধিক। আবার নাড়ী ও গাত্রতাপ দুই ভাবের হয়, সামসা থাকে না। 
৬) মুখমণ্ডল বিবর্ণ, শীতল মর্মে আবৃত। 
৭) মুখে দুর্গন্ধ, স্বাদ পঁচা, জিহ্বা লেপাবৃত এবং বাদামী বর্ণ, মাঝখান দিয়া কানডোরা, দাঁতে দন্তমল, মুখ হইতে পঁচা গন্ধ বাহির হয়।
৮) দুর্গন্ধযুক্ত উদরাময়। কোষ্ঠবদ্ধতায় ও মল দুর্গন্ধযুক্ত।
৯) স্বল্পমূত্র। এগবুমেনযুক্ত মূত্র।
১০) শিরঃপীড়া মাথা যেন ফাটিয়া যায়। শরীরের মাংসপেশীতে টাটানি।
১১) বমি কাল ও দুর্গন্ধযুক্ত।
১২) পচনশীল দূষিত অবস্থা হইতে উৎপন্ন দ্রুতগামী শয্যাক্ষত । 
১৩) সকল যন্ত্রণাই বসিয়া থাকিলে বাড়ে। সঞ্চালনে ও উত্তাপে উপশম ।

প্রয়োগক্ষেত্র:- বিষাক্ত জ্বর, রক্ত দূষিত হইয়া জ্বর, সূতিকা জ্বর, অস্ত্রোপচারের পর জ্বর, ক্ষত হইতে জ্বর, সেপটিক, ডিপথিরিয়া, নিমোনিয়া, স্ত্রীরোগ, উদরাময়, কোষ্ঠবদ্ধতা, শ্বাসযন্ত্রের পীড়া, প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা প্রয়োগ হয়।

জিহ্বা লক্ষণ:- পাইরোজেনের জিহ্বা লাল এবং শুদ্ধ, পরিষ্কার, ফাটা ফাটা, মসৃন যেন বার্ণিশ করা হইয়াছে। 

সেপটিক জ্বরে:- সেপটিক জ্বর, টাইফয়েড জ্বর ও সেপটিমিসিয়া হেতু প্রসূতি জ্বরে ইহা বিশেষ উপযোগী। পাইরোজেনের রোগী পীড়ার কষ্টের নানা বিষয়ে চিকিৎসকের নিকট অভিযোগ করে। রোগীর সারা দেহে টাটানি বেদনা, বিছানা শক্ত বলিয়া মনে হয়। এক পার্শ্বে অধিকক্ষণ শুইয়া থাকিতে পারে না। রোগী মনে করে সে সারা বিছানা জুড়িয়া আছে, যেন তাহার অনেকগুলি হাত পা গজাইয়াছে। মাথাটি বালিশের উপর মনে হয় কিন্তু দেহের ১০৬ ডিগ্রী পর্যন্ত পৌঁছে, তৎসহ ক্ষততাবোধ ও কনকনানি। নাড়ী খুবই দ্রুত এবং গাত্রতাপও অনুরূপভাবে অধিক। আবার অনেক সময় নাড়ী ও গাত্রতাপের মধ্যে রক্তদুষ্টি জনিত জ্বরে কোন সামস্য থাকে না। দেহ হইতে পচা গন্ধ বাহির হয়, এমনকি মৃতের ন্যায় গন্ধ। নিঃশ্বাস, ধর্ম ও স্রাবে ইরসিপেলাস এবং অস্ত্রোপচারের পরবর্তী রক্তদৃষ্টি জনিত জ্বর, শব ব্যবচ্ছেদ কালীন জ্বর। জ্বরে সর্বাঙ্গে থেঁতলানো ব্যথা, প্রচুর গরম ঘাম, ঘাম হওয়া সত্ত্বেও জ্বর কমে না। গণ্ডদ্বয় আরক্তিম ও উত্তাপ বিশিষ্ট। মুখে দুর্গন্ধ, জিহ্বা লেপাবৃত এবং বাদামী বর্ণের। মাঝখান দিয়া কাল ডোরা। দন্তমল। তরল দুর্গন্ধযুক্ত, বেদনাহীন মল, বা কাল কাল বর্ণের ন্যায় পচা গন্ধযুক্ত কোষ্ঠবদ্ধতার মল। সেপটিক জ্বরে উপরোক্ত লক্ষণে পাইরোজেন উত্তম ক্রিয়া করিয়া থাকে।

স্ত্রীপীড়া ও প্রসবাস্তিক জ্বরে:- জরায়ু হইতে রক্তস্রাব, পঁচা গন্ধ, স্বল্প প্রসবাস্তিক স্রাব। প্রসবাস্তিক স্রাব লোপ। প্রবল শীত ও প্রসবাস্তিক জ্বর। ঋতুস্রাব মাত্র একদিন থাকে, তারপর রক্তাক্ত প্রদর স্রাব। গর্ভস্রাবের পরবর্তী রক্তদৃষ্টি জনিত জ্বর, জরায়ুর নির্গমন। রোহিনী বহু বৎসর পূর্বেকার সূতিকা জ্বরের পর আর ভাল হইতে পারেন নাই ইহা পাইরোজেন সম্বন্ধে চিন্তা করিবার একটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র।

জরায়ুর উপর কার্যকারিতা:- জরায়ুতে প্রসব ব্যথার মত ব্যথা থাকে। শ্বাসবন্ধ করিলে ও জরায়ুতে চাপ দিলে উপশম বোধ। নাভি বা ঠিক তাহার উপর হইতে ব্যথা আরম্ভ হইয়া জরায়ু পর্যন্ত নামে আবার কখনও জরায়ুতে ব্যথা আরম্ভ হইয়া উপর দিকে উঠে।

শিরঃপীড়ায় লক্ষণ:- মাথায় ভয়ানক রক্ত সঞ্চয়, তৎসহ চাপনবৎ বেদনা এবং দপদপানি। চাপে উপশমিত হয়। মাথায় প্রচুর ঘর্ম, কাশিতে গেলে মাথার পশ্চাৎ ভাগে বেদনা প্রাতে জাগিয়া উঠিলে অনুরূপ যন্ত্রণা। চক্ষু তারকাদ্বয় স্পর্শকাতর, উপর দিকে বা বাহিরের দিকে ঘুরাইলে, ক্ষততাবোধ।

পাকস্থলীর লক্ষণ:- উদর স্ফীত, টাটান ও কর্তনবৎ বেদনা পাকস্থলীর পীড়ায় প্রচুর তরল, দুর্গন্ধযুক্ত উদরাময়, অসাড়ে মলত্যাগ, বেদনাহীন মল, পচা মাংসের ন্যায়। কষ্টকর কোষ্ঠবদ্ধতার মলও পঁচা মাংসের ন্যায় গন্ধ বিশিষ্ট, শক্ত, শুষ্ক, কাল, পচা গন্ধযুক্ত। জলপাইয়ের আকারে কাল কাল বলের ন্যায় মল, রক্তাক্ত নরম সরু মলের সহিত অতিশয় কোঁথানি ।

শ্বাসযন্ত্রের পীড়ায় লক্ষণ:- কাশির সহিত প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত নিশাধর্ম। যক্ষ্মাপীড়ার শেষ কয়েক সপ্তাহে ইহা উৎকৃষ্ট উপশমদায়ক। কাশিতে কণ্ঠনালী ও বায়ু নালীতে জ্বালা করে। পচা গন্ধ ঘন পুঁজের ন্যায় গয়ার, কাশি শুইলে বৃদ্ধি, উঠিয়া বসিলে উপশম। রক্তাক্ত ও লোহার মরিচার ন্যায় গয়ার। শ্বাস ত্যাগ কালে সাঁই সাঁই শব্দ। ক্ষীণগলা, ভাঙার ন্যায় স্বর এবং স্বর ভঙ্গ। কণ্ঠনালী হইতে শ্লেষ্মার বড় বড় চাপযুক্ত গয়ার উঠে। নিমোনিয়ায় উপরোক্ত লক্ষণেও ইহা ব্যবহৃত হয় ।

প্রস্রাবের পীড়ায় লক্ষণ:- স্বল্প মূত্র অথবা অবরুদ্ধ। মূত্রে লাল তলানি, ধুইয়া ফেলা কঠিন, এলবুমেনযুক্ত মূত্র, জ্বর আসিলে ঘন ঘন মূত্র প্রবৃত্তি ।
 
প্রান্তদেশে কার্যকারিতা:- পাইরোজেন প্রান্তদেশেও ক্রিয়া করিয়া থাকে। হস্তপদ ও বাহুর অসাড়তা, যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং অস্থিতে কনকনানি ব্যথা, শয্যা অতিশয় কঠিন বোধ হয়। মাথায় ভয়ানক রক্তসঞ্চয় ও দপদপানি বেদনা। মাথায় প্রচুর ঘর্ম, রোগী অনুভব করে তাহার মাথাটি বালিশের উপর আছে কিন্তু দেহের অন্যান্য অংশ যে কোথায় আছে বুঝিতে পারে না। মনে করে যে তাহার অনেকগুলি হাত পা গজাইয়াছে। উত্তাপ ও ধর্মের সহিত বা শুদ্ধ উত্তাপের সহিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কামড়ানি, অস্থিরতা, সঞ্চালনে ও উত্তাপে উপশম। গাল ও গলা ফোলে।

ইনফ্লুয়েঞ্জায় লক্ষণ:- প্রচণ্ড দপদপানিসহ জ্বর ও ভীষণ অস্থিরতা। মৃদু নাড়ীসহ শরীরে উচ্চতাপ কিংবা দ্রুতনাড়ীসহ নিম্নতাপ । আগুনের উত্তাপেও শীত দূর হয় না। অস্থিরতাসহ মাথা ফাটিয়া যাওয়ার মত ব্যথা। বিছানা কঠিন মনে হয়। শরীরে ব্যথা। নড়াচড়ার সূচনায় ও নড়াচড়ায় উপশম। স্বচ্ছ পানির মত প্রচুর প্রস্রাব ত্যাগসহ জ্বর।

টাইফয়েড জ্বরে লক্ষণ:- জ্বরের সময় রোগী বেশী কথা বলে, মেজাজ খিটখিটে হয়। শরীর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে ভুল ধারণা হয়, মনে হয় সমস্ত বিছানা জুড়িয়া সে শুইয়া আছে। যে পাশে শোয় সে পাশে ব্যথা বোধ হয় বলিয়া রোগী পার্শ্ব পরিবর্তন করে। মলে ভয়ানক দুর্গন্ধ। পাইরোজেনে শরীরের উত্তাপ খুব বেশী ।

হৃদপিণ্ডের গোলযোগে লক্ষণ:- হৃদপিণ্ডের চারিদিকে ক্লান্তিবোধ, বুক ধড়ফড়ানি। হৃদপিণ্ড স্থানে অতিশয় পূর্ণতা রোধ। হৃদপিণ্ডের শব্দ আপন কানে শুনিতে পায়। নাড়ী অতিশয় দ্রুত, দৈহিক উত্তাপের সহিত মিল থাকে না, রোগী হৃদপিণ্ড সম্বন্ধে সচেতন থাকে।

ডিপথিরিয়ায় লক্ষণ:- রোগীর গাল ও গলা ফোলে, মুখ দিয়া পচা গন্ধ বাহির হয়, জিহ্বা লেপাবৃত এবং বাদামী বর্ণের। মাঝখান দিয়া কাল ডোরা। দাঁতে দন্তমল। জ্বরের তুলনায় নাড়ী দ্রুত চলে । পীড়া হঠাৎ আক্রমণ করে এবং দেখিতে দেখিতে গুরুতর আকার ধারণ করে। সরিবাম জ্বর। প্রচুর তরল দুর্গন্ধযুক্ত বেদনাহীন উদরাময়, পচা মাংসের ন্যায়। নাক ঠাণ্ডা, গালে লাল গোলাকার দাগ। রোগী গরম পানি পান করিতে পারে।

উপশম বা বৃদ্ধি:- এক পাশে শুইলে, ভিজা ঠাণ্ডায় গরম ঘরে বসিয়া থাকিলে ।

উপশম:- বিশ্রামে, নড়াচড়ায়।

সম্বন্ধযুক্ত ঔষধ:- প্রসবাস্তিক জ্বরে আর্ণিকা, বেলেডোনা, নিমোনিয়া, রাসটক্স, আর্সেনিক, ল্যাকেসিস, ডিপথিরিয়া, পাইটোলাক্কা, ডিপথিরিনাম। ইহা ছাড়া এচিনেসিয়া, কার্বোভেজ, ও ব্যাপটিসিয়ার সহিতও তুল্য ।

অনুপূরক ঔষধ:- আর্সেনিক, ব্রায়োনিয়া ।

ক্রিয়ানাশক ঔষধ:- ল্যাকেসিস, আর্সেনিক। 

ব্যবহারের শক্তি বা ক্রম:- নিম্নশক্তি প্রয়োগ অনুচিত। ৩০ হইতে ২০০ বা তদুর্ধ শক্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ