স্নায়ুতন্ত্রের পীড়া , তৃতীয় অধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ


তৃতীয় অধ্যায় 
স্নায়ুতন্ত্রের পীড়া 
Diseases of the Nervous System








প্রশ্ন- উর্ধপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষতের সংজ্ঞা দাও ।
বা, আপার মোটর নিউরোনের লিজন্‌স এর সংজ্ঞা দাও ।

উত্তর : উর্ধপেশী উদ্দীপক নিউরোনের পেশীর ক্ষতি সাধিত হইলে তাহাকে উর্ধপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষত বলে ।



প্রশ্ন- উর্ধপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষতের লক্ষণাবলী লিখ ।
উত্তর : লক্ষণাবলী :
১) আক্ষেপধর্মী টোন বৃদ্ধি । ইহার বৈশিষ্ট্য হইল নিষ্ক্রিয় সঞ্চালনের প্রতি বর্ধিত বাধা, যাহা সঞ্চালন শুরু হওয়ার সময় সবচাইতে বেশী হয়, সমান তালে অব্যাহত থাকে এবং নিষ্ক্রিয় সঞ্চালনের সময় হঠাৎ হ্রাস পায়। ইহা সাধারণতঃ উর্ধাঙ্গে ফ্লেক্সর পেশীসমূহে এবং নিম্নাঙ্গে এক্সটেনসর পেশীসমূহে দেখা যায় ।
২) টেন্ডন প্রতিবর্তসমূহের বিস্তার বৃদ্ধি এবং ক্লোনাস থাকিতে পারে ।
৩) দেহের এক পার্শ্বে অংশ বিশেষের সঞ্চালনগত দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত দৃষ্ট হয়।
৪) অব্যবহারজনিত সামান্য শীর্ণতা দেখা দেয়। তবে পেশীর কোন অবক্ষয় ঘটে না।
৫) সংশ্লিষ্ট পেশীসমূহের স্বাভাবিক বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা দেখা দেয়।
৬) উদরিক প্রতিবর্তসমূহের বিলুপ্তি ঘটে।
৭) একটি এক্সটেনসর পদতলীয় সাড়া।



প্রশ্ন-  নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরনের ক্ষতের সংজ্ঞা দাও ।
বা, লোয়ার মোটর নিউরোনের লিজন্‌স এর সংজ্ঞা দাও ।

উত্তর : নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের পেশীর ক্ষতি সাধিত হইলে তাহাকে নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষত বলে।
 



প্রশ্ন- নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষতের লক্ষণাবলী লিখ ।
উত্তর ঃ লক্ষণাবলী- যে সকল পেশী ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। শুধুমাত্র সেই সকল পেশীতে নিম্নলিখিত লক্ষণাবলী প্রকাশ পায়।
১) নিষ্ক্রিয় সঞ্চালনে টোনের শিথিলতা বা অভাব ।
২) আক্রান্ত নিউরোন সমূহের শীর্ণতা।
৩) আক্রান্ত নিউরোনসমূহের দ্বারা সংঘটিত প্রতিবর্তনসমূহের অনুপস্থিতি।
৪) পেশীর দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত। ইহার ফলে প্রধান উদ্দীপক বা সমন্বয়কারী হিসাবে ঐচ্ছিক কিংবা অনৈচ্ছিকভাবে অথবা প্রতিবর্তন সংকোচনের মধ্যে এই পেশীগুলি যে সকল সঞ্চালনে অংশগ্রহণ করে তাহার সবগুলিই বাধাপ্রাপ্ত হয় ।
৫) প্রান্তিক স্নায়ু ও পেশীসমূহের বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা পরিবর্তিত হয়। ৬) একক তন্তুগুলি যখন আর তাহাদের আনুষঙ্গিক নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের প্রভাবাধীন থাকে না, তখন উহারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংকুচিত হয় । ইহাকে কম্পন বলে । এই জাতীয় স্বতঃস্ফূর্ত সংকোচন জনিত কম্পন দেখা দেয় । ৭) ফাইব্রাস টিসু দ্বারা সংঘটিত প্রতিস্থাপনের ফলে সৃষ্ট পৈশিক সংকোচন এবং পরিপোষণ সংক্রান্ত পরিবর্তন সাধিত হয়।



প্রশ্ন- ঊর্ধপেশী উদ্দীপক নিউরোন এবং নিম্নপেশী উদ্দীপক নিউরোনের ক্ষতের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা লিখ ।
উত্তর : চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা- আক্রান্ত অঙ্গ ভালভাবে চালন করা এবং মর্দন করা কর্তব্য। সরিষার তৈল বা অলিভ অয়েল ভালভাবে মালিশ করিলে এবং উষ্ণ সেঁক তাপে উপকার দর্শে। এই পীড়ায় লক্ষণানুসারে একোনাইট, বেলেডোনা, আর্ণিকা, এগারিকাস, এলুমিনা, ইগ্নেশিয়া, ক্যানাবিস ইন্ডিকা, স্ট্যানাম, লিডাম, ককুলাস, ইস্কিউলাস, প্লাম্বাম, ফাইজসটিগমা, কস্টিকাম প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহৃত হয়।



বহিঃপিরামিডীয় এবং লঘুমস্তিষ্কীয় ক্ষত 
Extra pyramidal and Cerebellar lesion


প্রশ্ন-  এক্সট্রা পিরামিডাল লিজনের লক্ষণাবলী লিখ।
 উত্তর : বহিঃপিরামিডীয় ক্ষতের লক্ষণাবলী :
১) পার্কিনসনের পীড়ার ক্ষেত্রে টোনের বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ স্টোন বৃদ্ধি পাইতে পারে এবং কোরিয়ার ক্ষেত্রে টোন হ্রাস পাইতে পারে। টোনবৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য হইল-টোন বৃদ্ধি নিষ্ক্রিয় সঞ্চালনের সমগ্র পর্যায় ব্যাপী বিদ্যমান থাকে এবং বিপরীত দিকের পেশীগুলিকে সমগ্রভাবে প্রভাবিত করে। ইহা সমতলীয় ও নমনীয় হইতে পারে অথবা বিরতিযুক্ত হইতে পারে।
২) ঐচ্ছিক সঞ্চালনে গোলযোগ, বহিঃপিরামিডীয় রোগে সত্যিকারের পক্ষাঘাত দেখা দেয় না। তবে সঞ্চালনের মন্থরতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গভঙ্গি সঞ্চালনে কিছুটা দুর্বলতা দৃষ্ট হয়। তাহা ছাড়া মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হয়। এবং ক্ষতের বিপরীত পার্শ্বে অঙ্গ বিন্যাসগত সমন্বয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সঞ্চালন যেমন, হাঁটার সময় বাহুর আন্দোলন প্রভৃতি লুপ্ত হয় ৷
৩) - অনৈচ্ছিক সঞ্চালন দেখা দেয়। প্রধান অনৈচ্ছিক সঞ্চালন হইল পার্কিনসনের ব্যাধিজনিত কম্পন, কোরিয়াজনিত সঞ্চালন এবং বিষম সঞ্চালন। 



প্রশ্ন-  সেরিবিলার লিজনের লক্ষণাবলী লিখ ।
বা, লঘুমস্তিষ্কীয় ক্ষতের লক্ষণাবলী লিখ ।

উত্তর ঃ লঘুমস্তিষ্কীয় ক্ষতের লক্ষণাবলী :
১) সঞ্চালনের গোলযোগ দেখা দেয়। সমন্বয় হীনতা, টোনের স্বল্পতা, এবং সেই সাথে যদি পেশীয় সংকোচন পেশী টাকুসমূহের দ্বারা অনিয়মিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহা হইলে চলন বৈকল্য দেখা দেয়।
২) পেশীর টোনের স্বল্পতা (Muscular Hypotonia)
৩) টেন্ডনের প্রতিবর্তসমূহের বিশৃঙ্খলা। প্রতিবর্তসমূহ হ্রাস পায় অথবা দোদুল্যমান হইয়া থাকে।
৪) অঙ্গবিন্যাস ও চলনভঙ্গির বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যেদিকে ক্ষতটি অবস্থিত, সেইদিকে মাথা ঝুলিয়া থাকিতে পারে এবং রোগীও সেইদিকে ঝুলিয়া থাকিতে পাত্রের বা পড়িয়া যাইতে পারে। রোগীর চলন টলটলায়মান হয় এবং ঢলিয়া পড়িবার প্রবণতা প্রদর্শন করে।




সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনা
Cerebro Vascular Accident 


প্রশ্ন- সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনা কাহাকে বলে?
উত্তর : হঠাৎ যদি মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহের বিঘ্ন ঘটিয়া রোগী অসুস্থ হইয়া পড়ে তাহাকে সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনা বলে। বর্তমানে ইহাকে সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ বলা হয়।
 
প্রশ্ন- সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনার কারণতত্ত্ব লিখ।
উত্তর ঃ কারণতত্ত্ব ঃ এই পীড়ার সঠিক কারণ অদ্যাবধি জানা যায় নাই । তবে ধমনী, শিরা ও কৈশিক নালীসমূহের ক্ষতের কারণে ইহা হইতে পারে বলিয়া ধারণা করা হয়। নিম্নলিখিত কারণে এই পীড়া হইতে পারে।
১) ধমনীর স্থূলতা।
২) থ্রম্বোসিস।
৩) এম্বোলিজম।
৪) ধমনী প্রদাহ ।
৫) সেরিব্রাল টিউমার বা অ্যাবসেস।
৬) সাব এরাকনয়েডে রক্তক্ষরণ।
৭) বৃদ্ধ বয়সে।



প্রশ্ন- সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনার লক্ষণাবলী বা উপসর্গ বা ক্লিনিক্যাল ফিচার লিখ ।
উত্তর : লক্ষণাবলী : পূর্বানুভূতিমূলক লক্ষণ হিসাবে মৃদু মাথাধরা এবং গা ম্যাজ ম্যাজ করা ভাব দেখা দেয়। ফোকাল অসমর্থতার সূচনা যে কোন সময়ে ঘটিতে পারে এবং সকল ক্ষেত্রেই ঘুমঘুম ভাব দেখা দেয়। মাথা ব্যথা তীব্রতর হইতে থাকে । মাথাঘোরা দেখা দেয়, চলন অসংগতি ও বমন, যুগ্মদৃষ্টি ও ট্যারা দৃষ্টি দেখা দেয়। অনেক সময় রোগীর মৃগী মূর্ছা দেখা দেয়। পক্ষাঘাত ও বাক জড়তা দেখা দিয়া রোগীর জ্ঞান লোপ পায় ।


প্রশ্ন- সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনার রোগ নির্ণয় প্রণালী বা ডায়াগনোসিস লিখ ।
উত্তর : রোগ নির্ণয় প্রণালী : সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীর অসমর্থতার প্রকৃতি প্রথমে চিহ্নিত করিতে হইবে এবং ক্ষতের অবস্থানস্থল ও ব্যাপ্তি অনুমান করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ কার্যশক্তির গোলযোগের অন্যান্য সম্ভাব্য কারণসমূহ বাদ দেওয়া। তৃতীয়ত সংবহননালীয় রোগতত্ত্বের প্রকৃতি নির্ধারণ । চতুর্থত তন্ত্রীয় সংবহনের অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো এবং আনুষঙ্গিক রোগসমূহ চিহ্নিত করা। একটি সম্পূর্ণ স্ট্রোকের মেয়াদকাল সাধারণত সঠিক রোগ নির্ণয় সম্পর্কে ইংগিত প্রদান করে। সেরিব্রাল টিউমারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দ্রুত বর্ধমান অসমর্থতা প্রকাশ পায়। ক্ষণস্থায়ী রক্তাভাবজনিত আক্রমনসমূহকে মৃগী ও অর্থশিরঃশূল হইতে পৃথক করিতে হইবে। ৫০ বসর বয়সের পর অর্ধশিরঃশূলের আক্রমণ কমই দেখা যায়। অন্যদিকে ক্ষণস্থায়ী রক্তাভাবজনিত আক্রমণগুলি সাধারণত ঐ বয়সের পর সংগঠিত হইয়া থাকে।
 
প্রশ্ন- সেরিব্রো ভাসকুলার দূর্ঘটনার ভাবীফল লিখ।
উত্তর : ভাবীফল- এই পীড়ায় আক্রান্ত রোগীর আরোগ্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
স্ট্রোকের পর কলাবিনষ্টির ক্ষেত্রে প্রথম মাসের মধ্যেই মৃত্যুর হার ৩০%। একই সময়ে ইন্ট্রাসেরিব্রাল রক্ত ক্ষরণের ফলে মৃত্যুর হার ৮০%। সাব এরাকনয়েডে রক্তক্ষরণের পর শতকরা ৬৫ ভাগ রোগী এক মাসের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। যে কোন স্ট্রোক তাহা কালাবিনস্টির কারণেই হোক বা রক্তক্ষরণের কারণেই হোক ইহার জটিলতা হিসাবে চেতনার ব্যাঘাত, যুক্তদৃষ্টির ত্রুটি এবং তীব্র অর্ধাঙ্গ পক্ষাঘাত দেখা দেয়। প্রাথমিক ভাবে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অনেকেই হৃদপিণ্ডের কলাবিনষ্টিতে মৃত্যুবরণ করে।


প্রশ্ন— সেরিব্রো ভাসকুলার দুর্ঘটনার জটিলতা লিখ ।
উত্তর : জটিলতা— এই পীড়ায় নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দেয় ।
১) অর্ধাঙ্গ পক্ষাঘাত।
২) মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।
৩) বাকশক্তির জড়তা ।
৪) চেতনার ব্যাঘাত
৫) যুক্ত দৃষ্টির ত্রুটি।
৬) চিত্ত ভ্রংশ ।


প্রশ্ন- সেরিব্রোভাসকুলার দুর্ঘটনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা লিখ ।
উত্তর : চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা- খুব অল্পসংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসাযোগ্য অবস্থান বর্তমান থাকে। রোগীকে সর্বদা পূর্ণ বিশ্রামে রাখিতে হইবে। স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া চলিতেছে কিনা সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখিতে হইবে এবং ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করিতে হইবে। রোগীর অচৈতন্যাবস্থা ও চলৎশক্তিহীনতার বিপদ থেকে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা নিতে হইবে। সম্ভব হইলে রোগ সংঘটনকারী ক্ষতের চিকিৎসা করিতে হইবে। আবশ্যক বোধে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন ও ন্যাজোগ্যাস্ট্রিক ফিডিং দিতে হইবে এবং ক্যাথিটারের সাহায্যে প্রস্রাব করাইতে হইবে। যত শীঘ্র সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে পাঠাইতে হইবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ