টিউবারকুলিনাম - TUBERCULINUM, চতুর্থ বর্ষ - মেটেরিয়া মেডিকা

টিউবারকুলিনাম 
TUBERCULINUM









প্রতিশব্দ:- টিউবারকল ব্যাসিলাই বা যক্ষ্মাজীবাণু।

উৎস:- যক্ষ্মারোগের জীবাণু হইতে ইহা প্ৰস্তুত হয়।

প্রস্তুত প্রণালী:- এই ঔষধটি প্রস্তুত করিবার একাধিক প্রণালী বা নিয়ম প্রচলিত আছে এবং সেই প্রণালী মতে ইহা ব্যাসিলিনাম বা সাধারণ নামধেয় - টিউবারকুলিনাম ব্যাসিলিনাম, টিউবারকুলিনাম বোভিনাম, ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
টিউবারকুলিনাম ব্যাসিলিনাম:- ব্যাসিলিনাম যক্ষ্মারোগগ্রস্ত রোগীর ফুসফুসকে ম্যাসেরেট করিয়া ঔষধ প্রস্তুত করিতে হয়। যেখানে যক্ষ্মাগ্রস্ত ফুসফুসের মধ্যে টিউবারকুলার ব্যাসিলাস অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখিতে পাওয়া যাইবে, কেবলমাত্র সেই ফুসফুসটিকেই ম্যাসেরেট প্রক্রিয়ায় ঔষধ প্রস্তুত করিতে লওয়া হয় এবং ব্যাসিলিনাম নামে তাহাকে আখ্যায়িত করা হয়। ফুসফুসের যক্ষ্মাজাত ফোঁড়ার পুঁজ হইতেও ইহা প্রস্তুত হইতে পারে। তবে যক্ষ্মারোগীর ফুসফুসের ক্ষতের পূঁজ হইতে যাহা প্রস্তুত তাহা টিউবারকুলিনাম এবং যক্ষ্মারোগগ্রস্ত ফুসফুসকে জলসিক্ত করিয়া যাহা প্রস্তুত করা হয় তাহা ব্যাসিলিনাম নামে পরিচিত।
টিউবারকুলিনাম 
বোভিনাম:- এই ঔষধটি ডাঃ কেন্ট ব্যবহার করিতেন যক্ষ্মাবিষ গাভীর শরীরে অনুপ্রবিষ্ট করিবার পর ঐ গাভীর গুটিকা রোগযুক্ত গ্রন্থি সংগ্রহ করিয়া টিউবারকুলিনাম বোভিনাম নামক ঔষধটি শক্তিকৃত করা হয়।

প্রুভার:- ডাঃ কেন্ট, ডাঃ বার্নেট, ডাঃ এলেন, ডাঃ নোবেল ও আরো অনেকেই ঔষধটি প্রুভ করেন।

ধাতুপ্রকৃতি:- ইহা একটি গভীর ক্রিয়াশীল এন্টিসোরিক, সাইকোটিক, সিফিলিটিক, ও সুগভীর টিউবারকুলার ঔষধ। দুর্বল শরীর ও গুটিকা ধাতু দোষযুক্ত ব্যক্তিদের পীড়ায় এই ঔষধটি অত্যন্ত উপযোগী। যদি বংশানুক্রমিক থাইসিস ও যক্ষ্মারোগের কোনও বিবরণ পাওয়া যায় এবং সুনির্বাচিত ঔষধও ফল পাওয়া যায় না তাহা হইলে ইহা ব্যবহারে সুফল পাওয় যায়।

ব্যাসিলিনাম ও বোভিনামের ব্যবহারের তুলনামূলক আলোচনা:- প্রায় একই প্রকার লক্ষণে টিউবারকুলিনাম ব্যাসিলিনামও টিউবারকুলিনাম বোভিনাম ব্যবহৃত হয়। তবে যে ক্ষেত্রে চর্মপীড়া চাপা পড়ার ইতিহাস থাকে, অর্থাৎ সোরাদোষ আছে, সেখানেই ব্যাসিলিনাম অধিক ব্যবহারযোগ্য মনে করিতে হয়। বোভিনাম ঔষধটি ব্যাসিলিনাম অপেক্ষা অধিক মাত্রায় সাইকোসিস দোষে পুষ্ট এবং গভীর ক্রিয়াসম্পন্ন। টিউবারকুলার রোগী ক্ষেত্রে উভয়েরই গভীরতা যদিও একই প্রকার বলিয়া মনে হয়, তথাপি এক শ্রেণীর টিউবারকুলার জাতীয় দাদ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত কতগুলি চর্মপীড়া চাপা পড়িলে ব্যাসিলিনামের সমলক্ষণযুক্ত টিউবারকুলোসিস বিকাশ লাভ করিতে দেখা যায়। সকলেই জানেন যে, সোরা ও সাইকোসিস দোযজ চর্মপীড়া মাত্রেই মিলিতভাবে চর্মদল আকারে বিকাশ লাভ করে। অপরদিকে টিউবারকুলার দোযজ চর্মপীড়ার উদ্ভেদগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন আকারে বিকশিত হইবার প্রবণতাযুক্ত এবং সিফিলিস দোষজ চর্মপীড়াসমূহ গভীর ক্ষতোৎপাদনকারী ও পচনমুখী। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, টিউবারকুলিনাম বোভিনামের মত ব্যাসিলিনাম কখনই পচনমুখী নয় ।
 
টিউবারকুলিনাম ব্যবহারের পূর্বশত:-
১) কোন রোগীতে টিউবারকুলিনাম প্রয়োগ করিবার পূর্বে তাহার পূর্ব পুরুষের কাহারও মস্তিষ্ক বিকৃতি বা পূর্ব বিকশিত যক্ষ্মারোগের ইতিহাস আছে কিনা তাহা দেখা উচিত।
২) কোন কারণ ব্যতীত দীর্ঘদিন যাবত রোগীর শুষ্ক ও শীর্ণ হইতে থাকা ।
৩) ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা, প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় সর্দি কাশির বৃদ্ধি ।
৪) অবিরত রোগ লক্ষণের পরিবর্তন।
৫) গাত্রচর্ম কুঞ্চিত এবং মুখমণ্ডলের বিরক্তিকর সুপষ্ট ছাপ। নিরতিশয় খিটখিটে মেজাজ, কলহপ্রিয়তা ও পাপাচারী সুদশ উত্তেজনা প্রভৃতি ইহার ব্যবহারে পূর্বশর্ত।

মানসিক লক্ষণ:- টিউবারকুলার রোগী মাত্রই অতিশয় ক্রোধী ও ভীতচিত্ত—এমনকি নিজের ছায়া দর্শনে পর্যন্ত রোগী অত্যন্ত ভীত বিরক্ত হইয়া উঠে নিরতিশয় খিটখিটে মেজাজ, কলহপ্রিয়তা ও পাপাচারী সদৃশ উত্তেজনাই ইহাদের মনের প্রকৃষ্ট মানসিক লক্ষণ। ঐ প্রকার ক্রুদ্ধতাসহ স্নায়বিক দুর্বলতার সংমিশ্রণ ও এই সকল রোগীতে লক্ষ্য করা যায়।
টিউবারকুলিনামের অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য এই যে, যে বস্তুতে তাহার রোগ লক্ষণ বৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা, তাহার প্রতিই সে অতিশয় আকৃষ্ট হইয়া উঠে। টিউবারকুলার দোষজ সমস্ত রোগীর মতই টিউবারকুলিনাম রোগী ও প্রকৃত প্রস্তাবে ‘যাযাবর' ‘ভবঘুরে' প্রকৃতিযুক্ত। এ কথার প্রকৃত অর্থ এই যে, ইহারা কখনই একটি নির্দিষ্ট স্থান, বিষণ্ণ বা বস্তুতে সন্তুষ্ট থাকিতে পারে না। মেজাজটিও ইহাদের অতিমাত্রায় পরিবর্তনশীল। এই সকল রোগী বারবার চিকিৎসক পরিবর্তন করে। ব্যস্ততা বিজড়িত ও উৎকণ্ঠাবিহীন ভবঘুরে ভাবই এই সকল রোগীর চিন্তাধারাকে সমাচ্ছন্ন করিয়া রাখে। ইহারা বরং নিজেদের অধঃপতিত অবস্থার বিষয় সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে, শুধু তাহাই নয়, মারাত্মক ও সাংঘাতিক অবস্থা চলিতে থাকা সত্ত্বেও এই দোষজ অনেক রোগীকেই আবার পরিপূর্ণ আশাবাদী হইতে দেখা যায়। টিউবারকুলার রোগী মাত্রেই মৃত্যু পথযাত্রী কাজেই তাহাদের মানসিক ও শারিরীক প্রতিটি লক্ষণই ক্রমান্বয়ে মৃত্যু পথের সহায়ক হইয়া উঠে ।
বিষণ্ণতা, সাময়িক হতাশা এবং ক্রন্দনশীলতাও এই দোষজ রোগীর সহচর। নিদ্রার পর ইহাদের মানসিক লক্ষণ বিশেষতঃ ক্রোধটি বৃদ্ধি পায়। এই সকল রোগীর শরীর অত্যন্ত শীর্ণ, শুষ্ক, গাত্রচর্ম কুঞ্চিত এবং মুখমণ্ডলে বিরক্তিকর একটি সুষ্পষ্ট ছাপ প্রতিফলিত থাকে। রোগী কখনই একেবারেই গম্ভীরভাব ধারণ করে, আবার কোনও সময় অতিমাত্রায় বাচাল হইয়া উঠে। অপরদিকে সন্তুষ্টির বা শৃঙ্খলাবোধের সামান্যতম চিন্তাটুকুও ইহাদের নিকট আশা করা যায় না। অতিমাত্রায় কুৎসিত ও কদর্য্য আবেষ্টনীই ইহাদের নিত্য সহচর।
ইহার রোগী স্বপ্নে সাপ ও কুকুর দেখে। আত্মীয় স্বজনের উপর দরদ কম। মানসিক পরিশ্রম করিতে চায় না। পরিচিত স্থান বা বস্তুকে অপরিচিত মনে করে। বয়স অপেক্ষা তাহাদের বুদ্ধি বেশী। রাত্রে ভয়ানক দুশ্চিন্তা থাকে ।

অদ্ভূত লক্ষণসমূহ:-
১) যে বস্তুতে রোগলক্ষণ বৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা, সে বস্তুর প্রতিই রোগী আকৃষ্ট হইয়া উঠে ।
২) রোগীর মেজাজে পরিবর্তনশীলতা এত বেশী যে ইহার রোগী বার বার চিকিৎসক পরিবর্তন অভিলাষ করে। পোষাক পরিচ্ছদ ও বন্ধুবান্ধবেরও পরিবর্তন করে।
৩) রোগী নিজের অধঃপতিত অবস্থার বিষয় সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে, এমনকি মারাত্মক ও সাংঘাতিক অবস্থা চলিতে থাকা সত্ত্বেও অনেক রোগীকেই আবার পরিপূর্ণ আশাবাদী হইতে দেখা যায় ।
৪) রোগী এত ভীত চিত্ত যে, নিজের ছায়া দর্শনে পর্যন্ত তাহারা অতিশয় ভীত ও বিরক্ত হইয়া উঠে।
৫) ভয় পাইলে হাতের তালু ও আঙ্গুলের ডগা হইতে ফোঁটা ফোঁটা ধর্ম নিঃসরণ।
৬) আট করিয়া কাপড় পরিলে গলদেশ পর্যন্ত ঐ বাধনটি ইহার রোগী অনুভব করে।
৭) শীতল দগ্ধপানের ইচ্ছা।
৮) প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করিলেও দমবন্ধভাব বা শ্বাসরোধ অনুভূতি ।
৯) সবচেয়ে ভাল ও পুষ্টিকর খাদ্যবস্তু গ্রহণ এবং আহারের মাত্রা বৃদ্ধি করা সত্ত্বেও রোগীর ক্রমিক শুষ্কতা ও শীর্ণতার ভাব চলিতে থাকে।
১০) লক্ষণাবলীর নিরন্তর পরিবর্তন হইতে থাকে, সুনির্বাচিত ঔষধেও পীড়ায় উপসর্গের উন্নতি সাধন হয় না।

চরিত্রগত লক্ষণ:-
১) রোগীর গায়ের রঙ হালকা এবং বক্ষঃস্থল সরু।
২) সব সময় পরিশ্রান্ত, নড়াচাড়ায় অতীব ক্লান্তি উদ্ভূত হয়। কাজ করিতে বিরক্তি ।
৩) লক্ষণাবলী নিরন্তর পরিবর্তন হইতে থাকে এবং সুনির্বাচিত ঔষধেও পীড়ার উপসর্গের উন্নতি সাধন হয় না।
৪) সামান্য কারণেই সর্দি লাগে ।
৫) দ্রুত শীর্ণতা প্রাপ্তি। শিশুদের উদরাময় যাহা বহু সপ্তাহ ধরিয়া চলিতে থাকে, নীলাভ মালিন্য ।
৬) খিটখিটে মেজাজ, বিশেষতঃ জাগরিত হইয়া অবসাদগ্রস্ত, বিষণ্ণ। কুকুরের ভয়, জন্তু সম্পর্কে ভয়, কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করিবার স্পৃহা, অভিশাপ দেওয়ার বা শপথ করিবার ইচ্ছ।
৭) মস্তিষ্কের গভীর দেশ আক্রমণকারী শিরঃপীড়া, প্রবল স্নায়ুশূল।
৮) পরাঙ্গপুষ্ট জীবাণুকৃষ বেশ ব্যাধি যাহাতে চুলে জটা পড়িয়া যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটকসহ ঝাঁকে ঝাঁকে বাহির হয়, ঐগুলিতে তীব্র বেদনা থাকে, নাসিকার মধ্যে স্ফোটকসমূহ পরপর উদ্ভূত হইতে থাকে, সবুজ পচা গন্ধবিশিষ্ট পুঁজ নির্গত হয়।
৯) রোগী উজ্জ্বল সাদা বস্তু বা আয়নার মত স্বচ্ছ চকচকে জিনিষের প্রতি চাহিয়া থাকিতে পারে না। সঙ্গীত, আলোক, সামান্য শব্দ যন্ত্রণা কষ্টও অসহ্য।
১০) আঁট করিয়া কাপড় পরিলে গলদেশ পর্যন্ত ঐ বাঁধনটি ইহার রোগী অনুভব করে।
১১) সর্ব সময়ের জন্য নিষ্ফল মলবেগ এবং সেজন্য নিদ্রার ব্যাঘাত। দুর্গন্ধযুক্ত উদরাময়ের পর দারুন কোষ্ঠবদ্ধতা, শয্যামূত্র ।
১২) কর্ণ হইতে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, কর্ণের মধ্যে ঢোলের ন্যায় পর্দায় ছিদ্র হইয়া যায়।
১৩) পাকস্থলীতে অবসন্নতা বোধ এবং ক্ষুধা অনুভূতি, শীতল দুগ্ধ পানের ইচ্ছা।
১৪) অতি প্রত্যুষে অকস্মাৎ উদরাময়, মল কালচে বাদামী ও দুর্গন্ধযুক্ত, সজোরে নির্গত হয়।
১৫) ঋতু স্রাবের কয়েক দিন পূর্ব হইতেই স্তনদ্বয়ে স্ফোটক সদৃশ যন্ত্রণা, স্রাব আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণার বৃদ্ধি। ঋতু স্রাবের দাগ বস্ত্রাদিতে লাগিলে ধৌত করিলেও তাহা উঠিতে চায় না। বরং সবুজাভ কালবর্ণের দাগ থাকিয়া যায়।
১৬) ঋতুস্রাবের সময় যন্ত্রণাবিহীন উদরাময় বা স্বাভাবিক মলত্যাগ। স্তনে মৃদু প্রকৃতির টিউমার।
১৭) টনসিলের বিবৃদ্ধি, নিদ্রাকালে কঠিন শুষ্ক কাশি। প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করিলেও দমবন্ধভাব বা শ্বাসরোধ অনুভূতি। কঠিন খুকধুকে কাশি, প্রচুর ধর্ম এবং দেহের ওজনের হ্রাসপ্রাপ্তি ।
১৮) পুরাতন একজিমা, প্রচণ্ড চুলকানি, রাত্রিতে বৃদ্ধি। যক্ষ্মারোগগ্রস্ত শিশুদের ব্রন।
১৯) ভয় পাইলে হাতের তালু ও আঙ্গুলের ডগা হইতে ফোঁটা ফোঁটা ঘর্ম নিঃসরণ।
২০) হাতে পায়ের প্রচণ্ড জ্বালা ও উত্তাপবোধ হেতু ঠাণ্ডা জলে ঐ অঙ্গ ডুবাইয়া রাখার অভিলাষ। হাতের নখের অগ্রভাগ পাখির নখের আকার ধারণ, পায়ের তলায় কড়া, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নখকুনি ।

দৈহিক লক্ষণ:- ইহার রোগীর ক্ষীণকায় দেহ, মুখাকৃতি পাতলা, নয়ন নীলবর্ণ, দেহ গৌরবর্ণ, বক্ষস্থল সরু, চ্যাপ্টা ও অপ্রসারিত।

প্রয়োগক্ষেত্র:- যদিও অল্প কয়েকটি লক্ষণের উপর নির্ভর করিয়া টিউবারকুলিনামের মত গভীর কার্যকরী ঔষধ প্রয়োগ করা সুবিবেচনার কাজ নয়, তথাপি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বীকার করিতে হয় যে, বহু সংখ্যক রোগীতেই টিউবারকুলিনাম বোভিনাম কার্যত বিনা লক্ষণেই নির্বাচন ও প্রয়োজন করিবার প্রয়োগ হয়। শুধু তাহাই নয়, এই ঔষধটি প্রয়োগ করিতে হইলে অনেক সময় চিকিৎসকের নিবুদ্ধিতারই প্রমাণ হয়। যখন দেখা যাইবে, সামান্যতম কারণ ব্যতীতই রোগী দীর্ঘদিন হইতে শীর্ণ ও শুষ্ক হইতেছে, তাহার মনটি অধিরাম অসন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে বা তাহার মধ্যে বংশগত টিউবারকুলার দোষের ইতিহাস, মানসিক বিরক্তি, অসন্তুষ্টি এবং সব সময়ের জন্য অবসন্নতা থাকে, তখনই এই ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত। যেখানে চিকিৎসিত রোগী কেবলমাত্র ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা প্রাপ্ত হইয়া প্রতি সন্ধ্যায় ও সকালে সর্দি কাশিতে ভুগিতেছে এবং তাহার মনটি বিরক্তিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, অথবা দীর্ঘদিন যাবত কোনও রোগী বিশৃঙ্খলাযুক্ত সবিরাম জ্বরে ভুগিতে থাকে এবং তাহার মধ্যে শুধু রাক্ষুসে ক্ষুধার সঙ্গে স্থায়ী শীর্ণতা ব্যতীত নির্বাচন যোগ্য অন্য কোন লক্ষণ বর্তমান থাকে না, সে রোগীতে ইহা প্রয়োগ করা উচিত। ইহার মানসিক ও চরিত্রগত লক্ষণাবলীর সহিত যদি শিরঃপীড়া, অস্ত্রের ক্ষয়, শিশু যকৃতপীড়া, জ্বর পীড়া, উন্মাদ পীড়া, বহুব্যাপক সর্দি, হৃদকম্প, হাঁপানী, অস্থিক্ষত, বয়োব্রণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইহা প্রয়োগ হয় ।

কার্যকারিতা:- মস্তিষ্কের গভীর দেশ আক্রমণকারী শিরঃপীড়া, প্রবল স্নায়ুশূল। পরাঙ্গপুষ্ট জীবাণকৃত কেশ ব্যাধি, যাহাতে চুলে জটা পড়িয়া যায়, মাথায় সাবান দেওয়ার পর মাথা ব্যথা। রোগী ভয় পাইলে হাতের তালু ও আঙ্গুলের ডগা হইতে ফোঁটা ফোঁটা ধর্ম নিঃসরণ।
 হাতে পায়ে প্রচণ্ড জ্বালা ও উত্তাপ বোধ হেতু ঠাণ্ডা জলে ঐ ঐ অঙ্গ ডুবাইয়া রাখার অভিলাষ। হাতের নখগুলির অগ্রভাগ পাখির নখের আকার ধারন করে, পায়ের তলায় কড়া। পায়ের বৃঙ্গাঙ্গুলিতে নখকুনি ।

শুষ্কতায় টিউবারকুলিনামের লক্ষণ:- টিউবারকুলিনামের রোগী ক্রমাগত মানসিক ও দৈহিক শুষ্কতা চলিতে থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই উহার কারণটি খুঁজিয়া পায় না- এমনটি পূর্বাপেক্ষা অধিকতর পুষ্টিকর খাদ্য বস্তু গ্রহণ করা সত্ত্বেও তাহার ক্রমিক শীর্ণতার ভাব চলিতে থাকে। ঐ সঙ্গে তন্তুরাজির সুষ্পষ্ট ক্ষয়টিও সমভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। এক্ষেত্রে ক্ষয় এবং তাহার ক্রমবর্ধমান গতির প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। কারণ বহুদিন পূর্বেই রোগী খাদ্য বস্তুর পুষ্টি গ্রহণের স্বাভাবিক ও অন্তর্নিহিত শক্তিটি হারাইয়া ফেলে। তাহার শরীরের ঐ প্রকার বিশৃঙ্খলাটি খাদ্য বস্তুর পরিমাণ বা গুণগত অবস্থার উপর মোটেই নির্ভরশীল নয়, রোগীর নিজস্ব দোষগত দৈহিক অবস্থাটিই ঐ প্রকার শুষ্কতার জন্য দায়ী। মোট কথা, যে শক্তিটির দ্বারা রোগী খাদ্যবস্তুর সারাংশ গ্রহণ করিয়া তাহার দৈনন্দিন ক্ষয়টি পূরণ করে এবং দেহটিকে নূতনভাবে পরিপোষণ করে, তাহা একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায়। যক্ষ্মা রোগীর জীবনদীপটি একটি আলোক বর্তিকার উভয়দিক প্রজ্জ্বলিত হওয়ার মতই ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে থাকে। এই তাবস্থায় একমাত্রা টিউবারকুলিনামের উচ্চশক্তি ক্রিয়াতেই রোগীর জীবনীশক্তি সঞ্জীবিত হইয়া উঠে এবং রোগীও খাদ্যবস্তুর সারাংশ গ্রহণের শক্তিটি ফিরিয়া পায় ।

যক্ষ্মাপীড়ায় লক্ষণ:- বংশগত যক্ষ্মার ইতিহাস থাকিলে ইহা প্রয়োগ হয়। রোগী খায় দায় অথচ দিন দিন শুকাইয়া যায়। আজ একপীড়া, কাল অন্য পীড়া। সব সময় সর্দি লাগিয়াই আছে। সর্দি যেন কিছুতেই ভাল হইতে চায় না। ক্ষয় প্রাপ্তিসহ শুষ্ক আক্ষেপিক কাশি ঘুষঘুষে জ্বর। প্রাতঃকালীন উদরাময় ও নৈশ ঘর্ম। বাম বক্ষে এবং বাম দিকের পিঠে তীক্ষ্ণ বেদনা। প্রাতঃকালে পূজ মিশ্রিত গয়ার উঠে, কাশিতে হৃদকম্পন ও পিঠে বেদনা হয়। ব্যাসিলিনাম দ্বারা গয়ারের পরিবর্তন হয়, ক্রমশঃ গয়ারের পুঁজের পরিমাণ কম হয় ও ফুসফুসের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করায় ফুসফুস পরিষ্কার হয়। প্রকৃত যক্ষ্মা না হইলেও ফুসফুসের কোনও পুরাতন পীড়ায় ইহা উপকারী।

মস্তিষ্ক বিকৃতিতে ব্যবহার:- ডাঃ কেন্ট ও বার্নেটের মতে মস্তিষ্ক বিকৃতি এবং ফুসফুসের ক্ষয়রোগ অভিন্ন এবং একই বস্তু-ইহারা যেন একই মুদ্রার উভয় দিক। সুতরাং চিকিৎসাধীনে ফুসফুসের বিশৃঙ্খলাযুক্ত কোনও রোগীর মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিলে সতর্কতার সহিত তখনই উপযুক্ত বহু রোগীই তথাকথিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা কুফলে পাগল হইয়া গিয়াছে । মস্তিষ্ক অপেক্ষা ফুসফুসদ্বয়ই অধিকতর বাহ্যস্তরের যন্ত্র, সেজন্য ফুসফুস ব্যাধিটি একবার মস্তিষ্ক বিকৃতিতে রূপান্তরিত হইলে প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যতীত অন্য কিছুতেই কখনই আরোগ্য হইতে চায় না। প্রকৃত লক্ষণানুসারে টিউবারকুলিনাম ব্যবহারে আশাতীত ফল পাওয়া যায়।

সর্দির বৈশিষ্ট্য:- ইহার রোগীর সর্দি লাগার বৈশিষ্ট্য এই যে, কিভাবে বা কেন সর্দি লাগিল তাহা রোগী কিছুতেই বুঝিতে পারে না, এমনিক পর্যাপ্ত পোষাক পরিচ্ছদ ও যাহাতে ঠাণ্ডা না লাগে তাহার সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন এবং অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা আবহাওয়া না হওয়া সত্ত্বেও ঠাণ্ডা লাগার হাত হইতে রোগী কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করিতে পারে না। অন্ত নিহিত দোষ হেতুই ইহার সর্দি লাগার প্রবণতাটি আসিয়া থাকে এবং ঐ প্রবণতা হেতুই রোগী বারবার সর্দিতে আক্রান্ত হয়। এইরূপ অবস্থায় হোমিওপ্যাথিক মতে কোনও একটি এন্টিউিবারকুলার ঔষধের সাহায্যে রোগীর ধাতুগত চিকিৎসা করাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা মনে করিতে হইবে।

শৈশবকালের আন্ত্রিক ক্ষয়ে বৈশিষ্ট্য:- ইহা একটি রোগলক্ষণ বা রোগের শেষ পরিণতি বিশেষ। সাধারণতঃ যক্ষ্মারোগগ্রস্ত মাতাপিতার শিশু সন্তানদের মধ্যেই এই অবস্থাটি বিকাশ লাভ করিতে দেখা যায়। ঐ সকল শিশুদের মধ্যে একবার ক্ষুধার অভাব রাক্ষুসে ক্ষুধা, গ্লাণ্ডস্ফীতি, রুক্ষ মেজাজ, অবিরত অসন্তুষ্টি, জয় ঢাকের মত উদর, যকৃত ও প্লীহার কাঠিন্যতা, দাঁতের গোড়া হইতে রক্তপাত, রাত্রিতে দাঁতের কড়মড়ানি, শয্যামূত্র, বিনাকারণে মধ্যে মধ্যে জ্বর, নিত্যনূতন খাদ্য ও খেলনা প্রভৃতির প্রতি অদম্য অভিলাষ প্রভৃতি লক্ষণগুলি শৈশবকালিন আন্ত্রিক ক্ষয়ের পূর্বাভাষরূপে সুস্পষ্টাকারে বিকাশ লাভ করে।
কোনও শিশুকে টিউবারকুলিনাম বোভিনাম প্রয়োগ করিবার পূর্বে তাহার পূর্ব পুরুষে কাহারও মস্তিষ্ক বিকৃতি বা পূর্ণ বিকশিত যক্ষ্মারোগের ইতিহাস আছে কিনা তাহা জানিবার চেষ্টা করা উচিত। শিশু সন্তানদের শরীরে অবস্থিত বংশগত বিশৃঙ্খলাটি বা দোষগত অবস্থাটি জীবন প্রভাতে সংশোধন করিতে পারিলে তাহারা সহজেই সুস্থ মানবত্ব প্রাপ্ত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শতকরা ৮০টি শিশু ঐ বিষয়ে উপেক্ষিত থাকিয়া যায়। ফলে তাহারা শৈশবকালীন যকৃত বৃদ্ধি, ক্রমিক শীর্ণতা টনসিল স্ফীতি, গ্ল্যাণ্ড বিবৃদ্ধি, সর্দি প্রবণতা, ক্রুদ্ধতা এবং আরও নানা নামের পীড়ায় কষ্ট পাইতে থাকে। এক্ষেত্রে একটি ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া যায় যে অন্তর্নিহিত তা শীর্ণতার প্রাধান্যযুক্ত ঔষধসমূহের মধ্যে টিউবারকুলিনাম বোভিনামের স্থান সকলের উপরে।

প্রাতঃকালীন উদরাময় ও কোষ্ঠবদ্ধতার লক্ষণ:- টিউবারকুলিনামের রোগীর দীর্ঘদিন যাবত রাক্ষুসে ক্ষুধা চলিতে থাকিলে শেষ পর্যন্ত আন্ত্রিক গোলযোগের অন্যতম কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং নিদারুণ কোষ্ঠবদ্ধতা, না হয় প্রাতঃকালীন উদরাময়-এই দুই অবস্থার মধ্য দিয়াই সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। ঐ দুইটি বিশৃঙ্খলাই টিউবারকুলার রোগীকে মৃত্যু মুখে পরিচালিত করে, আবার ইহাও লক্ষ্য করা গিয়াছে যে, যখনই ঐ দুইটির মধ্যে কোনও একটিকে অপসারিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে তখনই রোগীর মৃত্যু পথের গতিটি আরও ত্বরান্বিত হইয়াছে। অতএব চিকিৎসক হিসাবে উপশমকারী ঔষধের সাহায্যে ঐ দুইটিকে অপসারিত করিতে চেষ্টা না করিয়া তৎপরিবর্তে সমগ্র রোগীটির ধাতুগত লক্ষণ সংগ্রহ করিয়া ধাতুগত ঔষধই প্রয়োগ করা উচিত। টিউবারকুলিনামের প্রাতকালীন উদরাময়ের বৈশিষ্ট্য এই যে, মলত্যাগে রোগীর মোটেই মনষটি আসে না। কোষ্ঠবদ্ধ অবস্থায় ইহার রোগীর ছোট ছোট বলের মত গুটলি আকারে মল বাহির হয়। কুন্থন ঐ নিষ্ফল মলবেগ লাভ করে, তবে ঐ দোষজ উদরাময়ের বৈশিষ্ট্য এই যে, মলত্যাগের মধ্যবর্তী সময়ে প্রচুর বায়ু নিঃসরণ হইয়া মলবেগ চলিয়া যায়। আবার সোরা দোষজ রোগী মলত্যাগে যথেষ্ট উপমশ বোধ করে।

শিরঃপীড়ায় লক্ষণ:- শিরঃপীড়ার যাবতীয় চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াই টিউবারকুলার রোগী নিয়তই সামান্য কারণে শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হইয়া পড়ে। বাড়ীর কোনও ব্যক্তির সহিত ঝগড়া হইবার পর অথবা সামান্য অধিক পরিশ্রমের পর বা স্বাভাবিক সময় অপেক্ষা অধিক সময় ধরিয়া পরিশ্রম হেতু ইহার রোগীর মাথাব্যথা আরম্ভ হয়। আবার পথ্যাপথ্যের সামান্য অনিয়মে, বিশেষ করিয়া ঠিক সময়ে আহার না পাইলে টিউবারকুলিনামের রোগী নিশ্চয়ই শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হইয়া পড়ে। ইহার শিরঃপীড়ায় নিজস্ব চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রায়শঃই একটি তীব্র বেদনা ডান চোখের উপর হইতে আরম্ভ মাথার ভিতর দিয়া বাম কানের পিছন দিক পর্যন্ত ধাবিত হয়। ডাঃ বার্নেটের মতে শিরঃপীড়ার সময় ইহার রোগীর মৌনতাপূর্ণ। অসন্তুষ্টি, নিরতিশয় খিটখিটে ও কোপন স্বভাব এবং ভীরুতাপূর্ণ মেজাজটি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। টিউবারকুলিনাম রোগীর তরুণ মেনিনজাইটিসের সহিত মস্তকে জল জমিতে আরম্ভ করে এবং মস্তিষ্কের ভিতর এভাবের রক্তসঞ্চয় হয় যে, মাথাটি ক্রমান্বয়ে বড় হইয়া একেবারে দানবের মাথার আকার ধারন করে। টিউবারকুলিনামে চরিত্রগতভাবে মাদুরের বুনানি সদৃশ কেশসমূহের অপরিচ্ছন্ন অবস্থা এবং মাথার জট বাঁধার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ইহার রোগীর কুকুরের ভয় এত বেশী যে, কুকুর দেখিলেই তাহার শিরঃপীড়া আরম্ভ হয়। যদি রোগীর ক্ষয় বা যক্ষ্মার ইতিহাস থাকে তাহার শিরঃপীড়া আরম্ভ হয়। যদি রোগীর ক্ষয় বা যক্ষ্মার ইতিহাস থাকে তাহা হইলে ইহাই একমাত্র ঔষধ।

পেটের গোলযোগে লক্ষণ:- অতি প্রত্যুষে হঠাৎ পাতলা বাহ্য, মল ঘোর পিঙ্গলবর্ণ, দুর্গন্ধযুক্ত এবং বেগে নির্গত হয়। কোষ্ঠবদ্ধতার পর উদরাময়। পুরাতন উদরাময়, প্রচুর ঘাম হয়। মলত্যাগে রোগীর মোটেই মনতুষ্টি আসে না।

মস্তিষ্কঝিল্লীর উপর ক্রিয়া:- মস্তিষ্ক ঝিল্পীর প্রদাহ। রোগের মারাত্মক অবস্থায় ঘর্ম, মূত্রাধিক্য, উদরাময়, চর্ম পুষ্পিকা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দিলে ইহা ব্যবহার্য। রাত্রিকালে অলিক বস্তুসমূহ দেখে এবং ভয় পাইয়া জাগিয়া উঠে।

কাশি লক্ষণ:- শুষ্ক খুসখুসে কাশি, কাশিবার সময় শরীরে ঝাঁকানি লাগে। কখনো হলদে বা হরিদ্রাভ গয়ার উঠে। ভয়ানক ঘঙঘণ্ডে কাশির সঙ্গে প্রচুর ঘাম হইলে ও শরীরের ওজন কমিতে আরম্ভ করিলে, বুকে ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেলে টিউবারকুলিন উৎকৃষ্ট ঔষধ ।

চক্ষুপীড়ার লক্ষণ:- ঝাপসা দৃষ্টিহস মাথা ধরা টিউবারকুলিনামের একটি প্রধান চরিত্রগত লক্ষণ। জিঙ্কাম এবং এগারিকাসেও উহা বর্তমান থাকে। টিউবারকুলিনামের রোগীর চক্ষু গোলকের উপরিভাগের স্বচ্ছ আবরক ত্বকের ঔজ্জ্বল্যহীনতাও অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় এবং ঐ লক্ষণটির দ্বারা টিউবারকুলার দোষের মধ্যে সিফিলিস দোষের অবস্থিতি জ্ঞাপিত হয়। কেননা ঐ অবস্থাটি শরীরে মূলতঃ সিফিলিস দোষ না থাকিলে আসিতে পারে না।

ক্ষুধার লক্ষণ:- খামখেয়ালী ক্ষুধা, কখনও রাক্ষুসে ক্ষুধা, আবার কোন সময় ক্ষুধার অভাব টিউবারকুলিনামের রোগীর স্বরণযোগ্য লক্ষণ। মোট কথা ক্ষুধা থাক বা না থাক, ইহার রোগীর শরীরটি ক্রমান্বয়ে শুকাইতে থাকে। পাকস্থলীটি ইহার এতই দুর্বল যে, রোগী খাদ্য বস্তু হজম করিতে পারে না। খাদ্যবস্তুসমূহ রোগীতে পাকস্থলী ও অস্ত্রের মধ্য দিয়া শুধু বাহিতই হইয়া চলে।

ক্ষয় ও টিউবারকুলার দোষ হেতু রোগী দেহে আগত অবস্থাসমূহ:
১) অস্ত্রের ক্ষয়, ২) শিশু যকৃত পীড়া, ৩) দন্তরাজির ক্ষয়, ৪) জয়ঢাক সদৃশ উদর, ৫) শরীরের যে কোন দ্বার দিয়া অবিরত রক্তস্রাব, ৬) বারংবার শৈশবকালীন কলেরা, ৭) শুষ্ক কাশি, বিশেষত জ্বরোদ্বয়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি, ৮) নাসিকায় কাঁচা সর্দির প্রবণতা, ৯) শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ছিদ্র হইবার প্রবণতা, ১০) শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত যাবতীয় লক্ষণের সহিত শ্বাসকষ্ট, ১১) নিদ্রাভঙ্গ না হইয়াই ঘুমের মধ্যে শিশুদের সজোরে ও শুষ্ক কাশি, ১২) বুক ধড়ফড়ানি, ১৩) নিশাঘর্ম, ১৪) সবিরাম জ্বরের প্রবণতা, ১৫) দাদ, একজিমা, ১৬) গ্লাণ্ডসমূহের কাঠিন্যতা ও স্ফীতিভাব, ১৭) মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে ত্রিকোণাকার অস্থিতে যন্ত্রণা ও একটি চাপ বোধ, প্রথম নড়াচড়ার প্রারম্ভেই বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়, ১৮) সুস্পষ্ট কোনও কারণ ব্যতীতই যখন তখন হাঁটুতে ঘিনঘিনে বেদনাবোধ ও ঐ স্থান ফুলিয়া যাওয়া, ১৯) সামান্য কারণে ক্রুদ্ধ মেজাজ, ২০) নিরতিশয় ক্লান্তি। বিশেষ করিয়া নিম্নাঙ্গের অবসন্নতা। ২১) বোধগম্য কারণ ব্যতীত সুস্পষ্ট শীর্ণতা। ২২) টিউবারকুলার প্রকৃতিযুক্ত আকাংখা ও ক্ষুধা অর্থাৎ যাহাতে রোগ লক্ষণের বৃদ্ধি তৎপ্রতিই অদম্য অভিলাষ ।

শিশু যকৃত পীড়ায় লক্ষণ:- শিশু যকৃত পীড়াকে শুধু লিভারের পীড়া মনে করিলে ভুল করা হইবে। ইহা শৈশবকালে আবির্ভূত এক প্রকার ক্ষয়রোগ এবং ঐ বয়সে শুধু যকৃত যন্ত্রণাটির উপরই এই রোগীকে ক্রিয়াশীল থাকিতে দেখা যায়। এই অবস্থায় প্রথম দিকে যকৃতটির কার্যগত বিশৃঙ্খলা আসে এবং ধীরে ধীরে উহার আকারগতি পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। আরোগ্যকারী ও ব্যবহার যোগ্য প্রত্যেক টিউবারকুলার দোষযুক্ত ঔষধের উহাই প্রকৃতি। টিউবারকুলার দোষযুক্ত শিশুদের যুকতটি আক্রান্ত হইবার আর একটি কারণ এই যে, বংশগত সিফিলিস দোষ এবং সিফিলিস ও পারদের সংমিশ্রণজাত দোষের যকৃত যন্ত্রটিকে আক্রমণ করিবার একটি বিশেষ ঝোঁক থাকে। কাজেই ঐ ঐ দোষজ শিশুদের যকৃতটিই সর্বপ্রথম আক্রান্ত হইয়া পড়ে এবং উহাদের হজমের গোলযোগ ও শীর্ণতা লক্ষণ দেখা যায়।

প্রশ্ন-১৭.২৮। সবিরাম জ্বরে টিউবারকুলিনামের লক্ষণ লিখ ।
উত্তর : সবিরাম জ্বরে টিউবারকুলিনামের লক্ষণ- টিউবারকুলিনাম বোভিনাম জ্বরে রোগীদের নির্ভরযোগ্য শেষ আশ্রয়স্থল। কোনও রোগীতে টিউবারকুলার দোষজ প্রবণতা না থাকিলে সবিরাম প্রকৃতির জ্বর কখনই আসিতে পারে না। এই দোষজ বহু সংখ্যক রোগীর আবার অল্প বিরাম যুক্ত জ্বরও আসিতে দেখা যায় এবং ঐ অবস্থায় টিউবারকুলার দোষের দুটি নিদর্শন দেখিলেই টিউবারকুলিনাম বোভিনাম প্রয়োগের সিদ্ধান্ত উপনীত হইতে পারা যায়। 
উহারা হইল- ১) প্রচণ্ড একগুঁয়ে স্বভাব এবং 
২) কয়েক সপ্তাহ স্বল্পবিরাম জ্বর ভোগ করার পর জ্বর তাপের ঘুসঘুসে অবস্থার পরিবর্তন এবং উহা ৯৯ বা ১০০ ডিগ্রীর বেশী না হওয়া এবং ঐ অবস্থাটি আবার কয়েক ঘণ্টা চলিবার পর সবিরাম প্রকৃতি লইয়া প্রাতঃকালে অতিশয় নিম্নাভিমুখী হইয়া পড়া এবং বিরক্তকর শুষ্ক কাশির সহিত বৈকালেরর দিকে পুনরোদয়, কিন্তু ঐ জ্বর কোন অবস্থাতেই সাধারণ সবিরাম জ্বরের সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন তাপাঙ্ককে স্পর্শ করে না। উক্ত অবস্থার সহিত টিউবারকুলার দোষের বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক পরিবর্তনশীল মেজাজ, সব কিছুতেই একটা পরিবর্তনশীলতা, সর্ব বিষয়ে অসন্তুষ্টি, নির্দিষ্ট কোনও বস্তুর উপর সুনির্দিষ্ট কোন আকাংখা না থাকা, আকাংখিত প্রতিটি দ্রব্যেই রোগীর রোগ লক্ষণের বৃদ্ধি, অতিমাত্রায় ভীতি, বিরক্তিপূর্ণ মেজাজ, দিন দিন শীর্ণতা প্রভৃতি লক্ষণাবলী বর্তমান থাকিলে টিউবারকুলিনাম একমাত্র প্রয়োগযোগ্য নির্বাচিত ঔষধ ।

চর্মপীড়ায় লক্ষণ:- ইহার রোগীর চর্মের উপরে গুটিকাজনিত উদ্ভেদ দেখা দেয়। ঐ উদ্ভেদ ঈষৎ বেগুনী ও লাল, সব সময় রোগী আগুনের পাশে বসিয়া থাকিতে চায়। ঠাণ্ডা বাতাসে চুলকানির বৃদ্ধি হয় এবং আগুনে নিকট থাকিলে উপশম বোধ হয়। রোগী মনে করে যেন চর্মের উপর পোকা হাঁটিতেছে।

ধাতুদোষের মোকাবিলা:- বিভিন্ন ধরনের ধাতুদোষ সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস ও টিউবারকুলার দোষ এই ঔষধে মোকাবেলা করা যায়। টিউবারকুলার দোষযুক্ত রোগীদের জন্য ইহা উল্লেখযোগ্য ঔষধ। টিউবারকুলার দোষের প্রধান নিদর্শন হইল- ১) প্রচণ্ড একগুঁয়ে স্বভাব, ২) পরিবর্তনশীল মেজাজ, ৩) সর্ব বিষয়ে অসন্তুষ্টি, ৪) মানসিক দুর্বলতা ও অবসাদ, ৫) স্মৃতিশক্তির অভাব, ৬) পরিপূর্ণ স্বার্থপরতা, ৭) নানাজাতীয় মনোবিশৃঙ্খলা, বিশেষতঃ মস্তিষ্ক বিকৃতি ।
টিউবারকুলার রোগী মাত্রেই অল্প কয়েকদিন পর পর নিজের পোষাক পরিচ্ছদ, বাসস্থান, চিকিৎসক, বন্ধুবান্ধব এবং সমস্ত কিছুই পরিবর্তন করিয়া চলে। টিউবারকুলিনাম বোভিনাম রোগীর নির্দিষ্ট কোনও বস্তুর উপর সুনির্দিষ্ট আকাংখা নাই। সেজন্যই কতকগুলি টিউবারকুলিনাম রোগীকে ঠাণ্ডা পানীয়ের প্রতি, আবার উভয় প্রকার দ্রব্যেই বিতৃষ্ণা আসে। রোগীর দেহটি অতি শীঘ্র শীর্ণ হইয়া যাওয়া, উত্তম আহার সত্ত্বেও দেহের ক্ষয় প্রাপ্তি, অত্যন্ত ক্ষুধা, প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগা, সহজেই সর্দি হওয়া, প্রত্যেক ঋতু পরিবর্তনে অসুখ করা, যে বস্তুতে রোগলক্ষণ বৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা, তাহার প্রতিই অতিশয় আকৃষ্ট হওয়া প্রভৃতি ধাতুদোষ মোকাবিলায় টিউবারকুলিনাম একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঔষধ। শুষ্ক আবহাওয়ায় অর্থাৎ শীতের দিনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থায় টিউবারকুলিনাম বোভিনাম এবং বর্ষাকালে বা ভিজা আবহাওয়ায় আবির্ভূত লক্ষণে ব্যাসিলিনাম ভাল কাজ করে।

বৃদ্ধি:- আবদ্ধ ঘরে, ভিজা ঠাণ্ডাযুক্ত আবহাওয়ায়, পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায়, ঝড় বিদ্যুৎপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বে, অতিশয় গরম ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, বসন্তকালে, পরিশ্রমে, সঞ্চালনে, ডানপার্শ্বে শয়নে, শোকতাপে ভাবাবেগের আতিশয্যে, মানসিক উত্তেজনা আনয়নকারী ঘটনার কথা চিন্তা করিলে, শব্দে, আলোকে, সংগীত শ্রবণে, বক্ষদেশে চাপ দিলে, স্নানে, মাংস, ডিম, আটা ও ময়দাজাত খাদ্য চর্বি, ফল, আলু মিষ্টি দ্রব্য ভিনিগার ইত্যাদিতে।

উপশম:- মুক্ত বাতাসে, ঠাণ্ডা বাতাসে, অশ্বারোহনে, সন্ধ্যার প্রাক্কালে ভ্রমণে, ঘর্ম নিঃসরণকালে, মৃদু সঞ্চালনে, উত্তাপে ।

তুলনীয় ঔষধসমূহ:- 'থুজা (টিকাবীজ দুষ্ট অবস্থা হইতে টিউবারকুলিনের ক্রিয়া পথ অবরুদ্ধ হইতে পারে, এইজন্য এইরূপ স্থানে দেখা গিয়াছে যতক্ষণ না থুজা প্রয়োগ করা হয় ততক্ষণ এই অবস্থা চলিতে থাকে, কিন্তু থুজা প্রয়োগ করিলে পরে ঐ টিউবারকুলিনাম পুনরায় তেজের সহিত কাজ করিতে থাকে), ব্যাসিলিনাম, সোরিনাম, ল্যাকেসিস ।

অনুপূরক ঔষধ:- ক্যালকেরিয়া কার্ব, চায়না, ব্রায়োনিয়া, সোরিনাম, সালফার, হাইড্রাসটিস, বেলেডোনা।

পরবর্তী ঔষধ:- ক্যালকেরিয়া ফস, ক্যালকেরিয়া কার্ব, সাইলিসিয়া।

ক্রিয়ানাশক ঔষধ:-ক্যাফর।

ব্যবহারের শক্তি বা ক্রম:- ২০০ শক্তির নিচে ইহা ব্যবহার করা উচিত নয়। ১০০০ বা তদুর্ধ শক্তি। পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ নিষিদ্ধ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ