সন্যাস রোগ, তৃতীয় অধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ

এপোপ্লেক্সী বা সন্যাস রোগ 
Cerebral Haemorrhage: Apoplexy







প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজ বা এপোপ্লেক্সীর সংজ্ঞা দাও।

উত্তর: সেরিব্রাল হেমোরেজের অর্থ মস্তিষ্কের রক্তস্রাব। যে কোন কারণবশতঃ মস্তিষ্কে রক্তাধিক্য বা মস্তিষ্ক ধমনী ছিন্ন হইয়া মস্তিষ্ক মধ্যে রক্তস্রাব হইলে তাহাকে সেরিব্রাল হেমোরেজ বলে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে রক্ত স্রাব হইয়া মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়াতে হঠাৎ গতি, অনুভূতি ও চেতনা শক্তি বিলুপ্ত হইয়া যায় কিন্তু হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ চলিতে থাকে, রোগী মরার ন্যায় আচ্ছন্ন হইয়া যায় ইহারই নাম এপোপ্লেক্সী বা সন্যাস রোগ।



প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের প্রকারভেদ লিখ।

উত্তর: প্রকারভেদ- মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থান হইতে রক্তস্রাব হইতে পারে। সেই বিচারে ইহাকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

১) মস্তিষ্কঝিল্লী মধ্যে রক্তস্রাব।

২) সাব-ডুরাল হেমোরেজ।

৩) সাব-এরাকনয়েড হেমোরেজ।

৪) মস্তিষ্ক ধমনী ফাটিয়া গিয়া ঘিলুর মধ্যে রক্তস্রাব।



প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের কারণ তত্ত্ব লিখ।

উত্তর: কারণতত্ত্ব নিম্নলিখিত কারণে সেরিব্রাল হেমোরেজ হইতে পারে।

১) হাইব্লাড প্রেসারের কমপ্লিকেশন হিসাবে এই পীড়া হইয়া থাকে।

২ ) হেড ইনজুরির কারণে।

৩) মস্তিষ্ক মধ্যে ধমনী অর্বুদ ফাটিয়া যাওয়ার কারণে।

৪) বিভিন্ন প্রকার রক্তদুষ্টি ও সংক্রামক পীড়াহেতু ধমনীর প্রদাহ হইয়া।

৫) মস্তিষ্ক ধমনীর এথোরোমা বা কাঠিন্য ও তাহার নালী সূক্ষ্ম হইয়া রক্তচাপে ধমনী ফাটিয়া যাওয়ার কারণে।

৬) দুর্বল ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধিয়া থ্রম্বাস হওয়ার ফলে ঘিলুর কিয়দংশে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হইয়া ধমনী ছিঁড়িয়া গিয়া।



প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের লক্ষণাবলী বা উপসর্গ বা ক্লিনিক্যাল ফিচার লিখ।

উত্তর: লক্ষণাবলী- সচরাচর রোগী হঠাৎ মাটিতে পড়িয়া গিয়া গাঢ় নিদ্রিতের ন্যায় নিষ্পন্দ, মুখ রক্তবর্ণ, শ্বাসকষ্ট এবং নাড়ী পূর্ণ ও দ্রুত হয়। চক্ষু তারকা একটি প্রসারিত অপরটি স্বাভাবিক থাকে। মুখ একদিকে বাঁকিয়া যায় ও একদিকের অঙ্গের আক্ষেপ হয়। অনেক সময় পীড়া আক্রমণের পূর্বে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দেয়। যেমন- শিরঃপীড়া, বমন, বমনোদ্রেক, তন্দ্রাভাব, মাথায় কসিয়া ধরা, উত্তাপ ও চাপবোধ, স্বল্পপ্রস্রাব, অস্পষ্ট কথা, মানসিক গোলযোগ, মুখ পাংশুবর্ণ বা রক্তবর্ণ। দেহের শীতলতা, চক্ষু তারকার বিস্তৃতি, হাঁপানীবোধ, নাসিকার রক্তস্রাব প্রভৃতি। রোগীর হাত পা শিথিল হয়, নড়াচড়া থাকে না, একদিকের মাংসপেশী সংকুচিত কথা বলিতে অক্ষমতা। অনেক সময় গোঁ গোঁ শব্দ করে। মুখ দিয়া লালা নিঃসরণ হয়। দাঁতি লাগিয়া যায়। দৈহিক উত্তাপ হ্রাস পায়, গলদেশের ধমনীর স্পন্দন, দুর্বল ও ক্ষীণ নাড়ী। কখন কখন স্থানিক পক্ষাঘাত ও স্বরবন্ধ হইয়া যায়। মস্তকের যে পার্শ্বে রক্তস্রাব হয় তাহার বিপরীত পার্শ্ব অবশ এবং অবশ অঙ্গে মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়। ডানপাশের অবশতায় বাক্যের জড়তা ঘটে। আক্রমণকালীন অনেক সময় অজ্ঞাতসারে মলমূত্র ত্যাগ ও গলা ঘড়ঘড় করে, অনেক সময় প্রচুর ঘাম দেয়।




প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস লিখ।

উত্তর: রোগ নির্ণয়ঃ নিম্নলিখিত লক্ষণে এই রোগ নির্ণয় করা যায়।

১) হঠাৎ অজ্ঞান হইয়া পড়া।

২) চক্ষু তারকা অসমান হওয়া।

৩) একপাশের মাংসপেশী সংকোচন।

৪) স্থানিক পক্ষাঘাত।

৫) ব্লাডপ্রেসার অধিক থাকা।




প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের ভাবীফল লিখ।

উত্তর: ভাবীফল- এই পীড়ার ভাবীফল রোগীর মৃত্যুবরণ। ক্ষুদ্র ধমনী হইতে রক্তস্রাব আরম্ভ হইলে লক্ষণাবলী ধীরে ধীরে প্রকাশ পাইয়া পরে কোমা সৃষ্টি হয়। প্রাণের আশা প্রায়ই থাকে না। যদি একবার পীড়া আরম্ভ হয় তবে তাহা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাইরা কয়েক ঘণ্টা হইতে ৪/৫ দিনের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয়।



প্রশ্ন- সেরিব্রাল হেমোরেজের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও পথ্য লিখ এবং পীড়ার সহিত সম্পূর্কযুক্ত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ লিখ।

উত্তর: চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা- সেরিব্রাল হেমোরেজ কঠিন পীড়া, সেজন্য প্রথম হইতেই খুব সাবধানে ও উপযুক্ত চিকিৎসা করানো দরকার। যেখানে রোগী আক্রান্ত হয় সে স্থান হইতে রোগীকে নাড়াচড়া করানো ঠিক নয়। অতি সাবধানে পরিধেয় বস্ত্র ঢিলা করিয়া দিতে হইবে। মাথার উপর আইসব্যাগ বা বরফ দেওয়া হিতকর। গলায় বেশী গড়ঘড় শব্দ হইলে মাথাটি সামান্য উঁচুতে রাখিয়া অবশ অঙ্গের দিকে কাত করিয়া শোয়াইতে হইবে। এনিমা দ্বারা পায়খানা ও ক্যাথিটার দ্বারা প্রস্রাব করানো উচিত। প্রথম আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইলে পরে যাহাতে আর আক্রমণ না ঘটে সেজন্য শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম এবং মন প্রফুল্ল রাখা উচিত। উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিতে হইবে।

পথ্য- আমিষজাতীয় খাদ্য ও লবণ বর্জন করা উচিত। সহজপাচ্য, লঘু ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা আবশ্যক। সব ধরনের মাদক দ্রব্য, চা, কফি, মদ বর্জনীয়।

ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ:

১) একোনাইট- ভয়, ক্রোধ, বিরক্তি বা কোন দ্বার হইতে রক্তস্রাব বন্ধ হইয়া পীড়া হওয়ার উপক্রম হইলে ইহা ব্যবহার্য। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের আধিক্য, মাথা গরম, দেহ উত্তপ্ত, পূর্ণ, দ্রুত ও সবল নাড়ী, গাত্রচর্ম শুষ্ক ও উষ্ণ, জিহ্বার পক্ষাঘাত হইয়া বাক্যের জড়তা প্রভৃতি লক্ষণে ইহা ব্যবহার্য।

২) বেলেডোনা- আক্রমণের ১২ ঘন্টার মধ্যেই ইহা ব্যবহার করা উচিত। রোগীর সম্পূর্ণ অজ্ঞান ভাব এবং অবসাদ না আসিলে ইহা প্রযোজ্য। বাকরোধ, মুখমণ্ডলের আরক্তিমতা ও স্ফীতি, মস্তক ও গ্রীবার রক্তবাহী শিরাসমূহের স্পন্দন ও স্ফীতি, চক্ষু তারকা বিস্তৃত, দৃষ্টি শক্তির হীনতা, হাত পা ও মুখের পেশীর আক্ষেপ, ডান হাত ও ডান পায়ের পক্ষাঘাত, একদিকের মুখ বাঁকা হইয়া যায়। অঘোর নিদ্রায় হঠাৎ চমকাইয়া উঠা, চীৎকার করে ও ভয় পাইয়া জাগিয়া উঠে প্রভৃতি লক্ষণে ইহা ব্যবহার্য।

৩) আর্নিকা মণ্ট- রোগীর মাথাটি গরম কিন্তু দেহ ঠাণ্ডা। পীড়ার আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে ইহার ক্ষমতা অসীম। আঘাতজনিত পীড়ায় ইহা উপকারী। পীড়ার লক্ষণ কমিয়া আসিতে শুরু করিলে রক্তের ডেলা শোষণ করিতে ইহার ক্ষমতা অসীম। অজ্ঞানভাব, মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস পড়ে ও বিড় বিড় করিয়া মৃদু প্রলাপ বকে। স্মৃতি লোপ, ভ্রান্তি ও মস্তিষ্কের গোলমাল। বাম অঙ্গের পক্ষাঘাত, দেহের নানাস্থানে চামড়ার নীচে রক্তস্রাবের দাগ।

৪) হায়োসিরামস- শরীরের প্রত্যেক পেশীর স্পন্দন, কর্কশ, চীৎকার দিয়া রোগী অজ্ঞান হইয়া পড়ে। মুখভঙ্গী, মুখ ছিটকানো, চমকাইয়া উঠা, দেহের একদিকের পেশীর স্পন্দন, মুখে ফেনা প্রভৃতি লক্ষণও ইহাতে দেখা যায়। মুখাবয়ব লাল ও নিম্ন চোয়াল ঝুলিয়া পড়ে। দ্রুত ও পূর্ণ নাড়ী, অসাড়ে বাহ্য, কোনকিছু গিলিতে কষ্ট।

৫) নাক্সডম- মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চয়জনিত পীড়ায় মত্তক হইতে রস বা রক্ত ক্ষরিত হইলে ইহা উপকারী। অতিরিক্ত মদ্যপান, রাত্রিজাগরণ, অপরিমিত আহার প্রভৃতি হেতু পীড়া।

ইহা ছাড়া লক্ষণানুযায়ী গ্লোনয়িন, লরোসিরেসাস, ওপিয়াম, ককুলাস, কোনায়াম, ল্যাকেসিস, কস্টিকাম প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহৃত হয়।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ