অষ্টম অধ্যায়
প্রসূতি মা ও নবজাতক
(Meternity and new Born)
প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্য
উত্তর: মা ও শিশুকে নিয়া এক ইউনিট রূপে গণ্য করার কারণ- জীবনের প্রথম মুহূর্ত হইতে কয়েক বৎসর শিশু স্বাস্থ্য মায়ের স্বাস্থ্যের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। মা ও শিশুকে নিম্নলিখিত কারণে এক ইউনিটরূপে গণ্য করা হয়।
১) গর্ভসঞ্চার হইতে প্রসব পূর্বকাল পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দেহেরই একটা অংশ হিসাবে ধরা হয়। কারণ ২৮০ দিন মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর দেহ গঠনের সকল প্রকার উপাদান মায়ের রক্ত হইতে পায়।
২) শিশু স্বাস্থ্য মায়ের স্বাস্থ্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুস্থ সবল মাতার গর্ভ হইতে সুস্থ সবল শিশু জন্ম গ্রহণ করে।
৩) জন্মের পর শিশুখাদ্য ও পুষ্টির জন্য মায়ের উপর নির্ভরশীল। প্রথম ৮-৯মাস এই নির্ভরশীলতা প্রায় সামগ্রিক।
৪) শিশু জন্মের পর এক বৎসর কাল এমন মুহূর্ত খুব কমই আসে যখন মায়ের পরিচর্যার সাথে শিশুর পরিচর্যা করিতে হয় না।
৫) মায়ের মত কতকগুলি পীড়া যেমন- জন্ডিস, সিফিলিস, জার্মান মিজেলস; হামজ্বর, ড্রাগ আসক্তি প্রভৃতির ন্যায় মায়ের কতকগুলি সুনির্দিষ্ট পীড়ার ফল শিশুর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
৬) শিশুর প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হইল না। মায়ের সাথেই শিশুর প্রথম ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, কথা হয় এবং মায়ের আদর যত্নের মধ্য দিয়া শিশুর জীবন শুরু হয়।
প্রশ্ন- প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য কি লিখ।
উত্তর: প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য- প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হইল মাতা ও শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করা। প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্যের যত্নের অভাবে আমাদের দেশে বহু মাতা ও শিশু অকালে প্রাণ হারায়। সময়মত তাহাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে এই অকাল মৃত্যুর হার অনেক কমিয়া যাইবে। মাতা ও শিশুরাই ছেলের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ বংশধরের জননী হইল মাতা এবং শিশুরা দেশের ভাবী নাগরিক। অতএব তাহারা সুস্থ না থাকিলে দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি আশা করা যায় না। প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য হইল গর্ভাবস্থা হইতে প্রসূতিকাল পর্যন্ত মাতার স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা ও পরিপূর্ণ সুস্থতা। আর ভাবী বংশধর যাহাতে সুস্থ সবল ও নীরোগ রূপে ভূমিষ্ট হইতে পারে তাহার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। গর্ভাবস্থা, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর অসুবিধাগুলি ও সমস্যাসমূহ নিরসন করা এবং প্রসূতি মাতা ও শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধন করা। এই যত্ন নেওয়ার ফলেই সু মানসিকতা ও সু স্বাস্থ্যের শিশু গড়িয়া উঠিতে পারে।
প্রশ্ন- প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি কি কি? প্রসবপূর্ব পরিচর্যার বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
উত্তর: প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ- প্রসূতির স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে প্রধানতঃ তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা-প্রসবপূর্ব পরিচর্যা, প্রসবকালীন পরিচর্যা ও প্রসবোত্তর পরিচর্যা।
প্রসবপূর্ব পরিচর্যার বিভিন্ন দিক:
১) গর্ভিনীকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিতে হইবে। দাঁত, যোনি, বক্ষ প্রভৃতি উত্তমরূপে পরিষ্কার করিতে হইবে।
২) কোষ্ঠ যাহাতে পরিষ্কার থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখার জন্য নিয়মিত শাক সবজি ও ফলমূল খাওয়া উচিত।
৩) প্রত্যেক মাসে গর্ভবতীর রক্তের চাপ, ওজন, প্রস্রাব ও শিশুর অবস্থান প্রভৃতি পরীক্ষা করিতে হইবে।
৪) রক্তস্বল্পতা থাকিলে তাহা দূর করিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৫) সহজে হজম হয় এইরূপ পুষ্টিকর খাদ্য খাইতে হইবে। ফল, দুধ, মাছ প্রভৃতি খাদ্য নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন।
৬) অতিরিক্ত পরিশ্রম কখনও উচিত নয়। কোন ভারী জিনিষ উঠানো নামানো ঠিক নয়।
৭) প্রতিদিন ৮ হইতে ১০ ঘণ্টা সুনিদ্রার প্রয়োজন।
৮) মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করিতে হইবে।
৯) নিয়মিত স্বাভাবিক কাজকর্ম করা উচিত।
১০) বেশী লাফালাফি ও সিঁড়ি দিয়া বেশী উঠানামা করা উচিত নয়।
১১) গর্ভাবস্থায় যত কম ঔষধ খাওয়া যায় ততই ভাল।
১২) গর্ভবতী মহিলাকে ১২ সপ্তাহ হইতে ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিমাসে ১ বার, ২৮ সপ্তাহ হইতে ৩৫ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ১৫ দিনে একবার এবং ৩৬ সপ্তাহ হইতে প্রসব পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার চিকিৎসককে দেখাইয়া পরামর্শ দিবার জন্য উপদেশ দিতে হইবে।
১৩) রক্ত পরীক্ষা- Blood sugar, Blood group, A, B, AB, O এবং Rh System করাইতে হইবে।
১৪) গর্ভের পাঁচ হইতে ছয় মাসের মধ্যে একমাস ব্যবধানে ২টি টিটি ইনজেকশান দিতে হইবে।
প্রশ্ন- প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রসবকালীন পরিচর্যার বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
উত্তর: প্রসবকালীন পরিচর্যার বিভিন্ন দিক:
১) প্রসবের পূর্বে গর্ভবতীর ভালভা ও পেরিনিয়ম জীবাণুমুক্ত করা।
২) প্রসব ব্যথা আরম্ভ হইলে শুধুমাত্র সামান্য পরিমাণে জল ব্যতীত সর্বপ্রকার খাওয়া বন্ধ রাখা।
৩) ধাত্রীর পরিশুদ্ধ মুখোশ ও পোষাক পরিধান করা এবং প্রসূতিকেও পরিশুদ্ধ পোষাক পরানো।
৪) জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা।
৫) প্রসবের সময় হাত জীবাণুমুক্ত করিয়া পরিশুদ্ধ দস্তানা পরিধান করা।
৬) প্রসবকালে জরায়ু মুখ বা পেরিনিয়াম ছিঁড়িয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭) প্রসবের সময় মাতাকে এবং শিশুকে ন্যূনতম আঘাতের হাত হইতে রক্ষা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
৮) প্রসবকালীন কোন প্রকার অস্বাভাবিকতার উদ্ভব হইলে, যেমন জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্ট, মাতার প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ প্রভৃতি হইলে তাহা দূরীকরণের ব্যবস্থা করা।
প্রশ্ন- প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রসবোত্তর পরিচর্যার বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
উত্তর: প্রসবোত্তর পরিচর্যার বিভিন্ন দিক:
১) দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা- নিয়মিতভাবে দেহের তাপ লওয়া উচিত।
উপসর্গহীন অবস্থায় স্বাভাবিক প্রসব হইলে দেহের তাপ ও হাতের নাড়ী স্বাভাবিক থাকে। তবে অনেক সময় প্রথম ২৪ ঘণ্টা তাপমাত্রা উঠিলেও শীঘ্রই আবার নামিয়া যায়। যদি কোন কারণে ক্রমাগত তিনদিন যাবত রোগিনীর দেহের উত্তাপ ৯৯.৪০ ডিগ্রীর উপর থাকে অথবা ২৪ ঘণ্টা যাবত ১০০.৪ ডিগ্রী জ্বর থাকে তবে তাহার চিকিৎসা করিতে হইবে।
২) যোনি প্রদেশের যত্ন- প্রসূতিকে আরামে রাখিবার জন্য যোনি প্রদেশে এবং শুকনা রক্তের চারিধারের ত্বক পরিষ্কার করা আবশ্যক। এমনভাবে পরিষ্কার করিতে হইবে যাহাতে কোন প্রকারেই জননপথ জীবাণুদুষ্ট না হইতে পারে।
৩) মূত্রাশয়ের যত্ন- সন্তান প্রসবের ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগিনীকে প্রস্রাব করাইতে হইবে। প্রসবের হয় হইতে আট ঘণ্টা পরে প্রসূতিকে প্রস্রাব করিবার জন্য বলিতে হইবে। সাধারণভাবে প্রস্রাব না হইলে যৌন প্রদেশে গরম সেঁক বা গরম ডুস বা তলপেটের উপর বরফ দিয়া প্রস্রাব আনিবার চেষ্টা করিতে হইবে।
৪) নিদ্রা- প্রসবোত্তরকালে প্রসূতির সুনিদ্রা হওয়া একান্ত আবশ্যক।
৫) পোষাক- প্রসূতিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করিতে হইবে। আরামদায়ক, পাতলা ও ঢিলাঢালা পোষাক পরানো উচিত।
৬) পথ্যাপথ্য- প্রসূতিকে সহজপ্রাচ্য পথ্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে। প্রসবের পর তিনদিন পর্যন্ত দুধ, সাগু, চা, পাউরুটি প্রভৃতি খাবার দেওয়া যাইতে পারে। কোষ্ঠ পরিষ্কার থাকিলে এবং খাওয়ার রুচি হইলে পরে ভাত, তাজা মাছের ঝোল, ফল, শাক সব্জি প্রভৃতি দেওয়া যায়।
৭) স্তনের যত্ন- প্রসূতির স্তনের বোঁটা ও স্তন খুব ভালভাবে গরম জল ও তুলার দ্বারা মুছিয়া পরিষ্কার রাখিতে হইবে। স্তনের বোঁটায় ক্ষত হইলে সঙ্গে সঙ্গে তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। স্তনের বোঁটা যাহাতে ফাটিয়া না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে।
৮) ব্যায়াম- প্রসবোত্তর কালে বস্তি দেশের মেঝে ও পেটের পেশীগুলির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসার জন্য হালকা ব্যায়াম করা ভাল।
প্রশ্ন- শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
উত্তর : শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিভিন্ন দিক- জন্মের সাথে সাথেই শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হয়। যথা-
১) শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে জীবাণুমুক্ত তুলা দ্বারা চোখের পাতা মুছিয়া দিতে হইবে এবং নাক ও মুখ হইতে মিউকাস পরিষ্কার করিয়া দিতে হইবে।
২) শিশু প্রথম কাঁদিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে নাভি হইতে দেড় ইঞ্চি দূরে পরপর ১ ইঞ্চি ব্যবধানে দুইটি বাঁধন দিয়া কর্ড নাড় কাটিয়া শিশুকে পৃথক করিতে হইবে।
৩) কর্ড কেয়ার- শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নাড় কর্ড শুকাইয়া যায় এবং
সাত দিনের সময় শুকনা কর্ড খসিয়া পড়ে। এই কয়দিন কর্ড খোলা রাখিতে হইবে। কিন্তু গোছলের সময় পানি লাগানো যাইবে না। প্রতিদিন স্পিরিট দ্বারা কর্ড পরিষ্কার করা উচিত।
৪) ওজন- শিশু জন্মের পরই কর্ড বাঁধিয়া পরিষ্কার করিয়া শিশুর ওজন লইয়া
তাহা লিপিবদ্ধ করা উচিত।
৫) গোসল- আজকাল জন্মের পরই শিশুকে গোসল করানো হয় না। ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাহার গায়ে লাগা রক্ত জীবাণুমুক্ত তুলা দ্বারা মুছিয়া পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে গোসল করানো হয়। তারপর প্রতিদিনই গোসল করানো হয়। শিশু মলত্যাগ করিলে সমস্ত শরীর পানি দিয়া ধুইয়া পরিষ্কার করা হয়। পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ন্যাপকিন ও জামা পরানো হয়।
৬) শিশুর পায়খানা- জন্মের পর প্রথম দুইদিন আঠা আঠা সবুজ পায়খানা করে। তারপর হলুদ পায়খানা করে। দুধ খাওয়ানোর পরই পায়খানা হয়। আবার অনেক শিশু ১-২ দিন পর পর পায়খানা করে।
৭) শিশুর প্রস্রাব- জন্মের সময় অনেক শিশু প্রস্রাব করে। আবার অনেক সময় ২৪ ঘন্টা পরও প্রস্রাব হয়।
৮) শিশুর পথ্য- প্রসবের ৬ হইতে ৮ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত শিশুকে স্তন পান করানো হয়। চার মাসের পর হইতে স্তনপানের সহিত কৃত্রিম খাদ্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯) টিকা দেওয়া-শিশুর বয়স ২ মাস হইতে ২ বৎসরের মধ্যে শিশুকে বিসিজি, ডিপিটি, পোলিও এবং হামের টিকা দিতে হইবে।
প্রশ্ন- বাংলাদেশের মা ও শিশু চিত্র বর্ণনা কর।
উত্তর: বাংলাদেশের মা ও শিশু চিত্র- জনসংখ্যার দিক হইতে বাংলাদেশ
একটি অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ। গ্রাম প্রধান এ দেশের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ মা ও শিশুদেরকে নিয়া। সাধারণত মা বলিতে ১৬-৪৫ বৎসর বয়স সীমার সন্তান প্রসবক্ষম মহিলা এবং শিশু বলিতে ০-১৪ বৎসর বয়স্ক সকল শিশুই ক্যালরী গ্রহণের দিক হইতে তৃতীয় গ্রেডের অপুষ্টির শিকার। শিশু ভিটামিন এ, বি২ এবং সি এর ঘাটতিতে ভোগে। ভিটামিন এ এর অভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১৭,০০০ শিশু প্রতি বৎসর অন্ধ হয়। ইহার প্রধান কারণ হইল অশিক্ষা ও দারিদ্রতা।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে বিভিন্ন জরিপের উপাত্ত হইতে জানা যায়-
১) গ্রামাঞ্চলের ৫৯% পরিবার প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ক্যালরি চাহিদ্ধা মিটাইতে অক্ষম।
২) সকল গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী মাতাই ক্যালরি, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিকারক
খাদ্য উপাদানের ঘাটতিতে ভোগে।
৩) ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বাংলাদেশী শিশুর ওজন বৃদ্ধির হার উন্নত দেশের সাথে তুলনীয়। কিন্তু ৭-২৪ মাস বয়সে তাহাদের বৃদ্ধির হার অনেক কম।
৪) আমেরিকার বোস্টনের তুলনায় বাংলাদেশে সদ্যজাত শিশুর ওজন ৪%-১৫% কম।
৫) ৫ বৎসর বয়সে পৌঁছাইতে মাত্র ২০% শিশু যথাযথ পুষ্টি পায়। ৬% শিশু প্রথম গ্রেডের, ৫৮% শিশু দ্বিতীয় গ্রেডের ও ১৬% শিশু তৃতীয় গ্রেডের অপুষ্টিতে ভোগে।
বাংলাদেশের মহিলাদের এক বিরাট অংশের মাঝে শিক্ষার আলো এখনো পৌঁছায় নাই। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই তাহাদের জীবন। এখানে অল্প বয়সে বিবাহ, ঘন ঘন গর্ভধারণ তাহাদের ভাগ্যলিপি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাও অপর্যাপ্ত। তাই স্বাভাবিকভাবে তাহারা দুর্বল ও স্বাস্থ্যহীন হইয়া থাকে। মা ও শিশুর সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের দেশে বিশেষ মন্ত্রণালয় রহিয়াছে। শিশু একাডেমী ও কতিপয় শিশু সংগঠন কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সমষ্টিগতভাবে এই সকল সংস্থা মা ও শিশুর কল্যাণরীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করিয়া থাকে।
এদেশে চাহিদার তুলনায় শিশু মাতৃসদনের সংখ্যা অপর্যাপ্ত, সুযোগসুবিধা ও মান ভাল নয়। তবে শহরাঞ্চলে মান মোটামুটি ভাল।
সুষম আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টির বিষয় দুইটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হইলে মাতৃমঙ্গল ও শিশুকল্যাণের প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনের উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে তাহা পরিগণিত হইবে।
প্রশ্ন- প্রতিরোধমূলক শিশু রোগ বিদ্যা কি? আলোচনা কর।
উত্তর: প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা বলিতে বুঝায় শিশুদের ব্যাধি প্রতিরোধ এবং তাহাদের দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা বোধের উন্নয়ন। প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা দুই শ্রেণীর।
উত্তর: প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা বলিতে বুঝায় শিশুদের ব্যাধি প্রতিরোধ এবং তাহাদের দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা বোধের উন্নয়ন। প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা দুই শ্রেণীর।
যথা-১) জন্মপূর্ব প্রতিরোধক শিশুরোগ বিদ্যা ও ২) প্রসবোত্তর প্রতিরোধক শিশুরোগ বিদ্যা।
১) জন্মপূর্ব প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা- এই প্রতিরোধমূলক রোগবিদ্যার প্রয়োগ মাতার গর্ভধারণের সাথে সাথেই শুরু হয়। গর্ভাবস্থায় মাতাকে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ, সংক্রামক প্রতিরোধ, প্রসব, স্তনদুগ্ধ দান ও মাতার অন্যান্য দায়িত্ব পালনে মাতাকে শিক্ষিত ও প্রস্তুত করিয়া তোলা প্রভৃতি বিষয় জন্মপূর্ব প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যার অন্তর্ভূক্ত।
২) প্রসবোত্তর প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা- এই প্রতিরোধমূলক রোগবিদ্যার প্রয়োগ শিশু প্রসবের পর হইতে শুরু হয়। শিশুর মেডিক্যাল পরীক্ষা, পুষ্টির তত্ত্বাবধান, ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে অনাক্রমন্যকরণ, আকস্মিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, শিশুদের মনস্তাত্বিক তত্ত্বাবধান প্রভৃতি বিষয় প্রসবোত্তর প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন- অনাক্রমন্যকরণ কর্মসূচী বলিতে কি বুঝ?
বা, অনাক্রম্যকরণ নির্ঘন্ট কাহাকে বলে?
উত্তর : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পরামর্শে কয়েকটি মারাত্মক ক্ষতিকারক সংক্রামক রোগের হাত হইতে বাঁচার জন্য শিশুকাল হইতে কিছু টিকা দেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করা হইয়াছে। এই রোগ প্রতিষেধক টিকাগুলি শিশুকালের একটা নির্দিষ্ট সময় হইতে শুরু করিয়া নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর শিশুদের দেওয়া হয়। টিকা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় ও পদ্ধতি যে নির্ঘন্টে লিপিবদ্ধ করা হয় তাহাকে অনাক্রম্যকরণ নির্ঘণ্ট বলে।
প্রশ্ন- ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী বলিতে কি বুঝ?
উত্তর: আমাদের দেশে প্রত্যেক শিশুকে ছয়টি সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রদানের জন্য যে কর্মসূচী গ্রহণ করা হইয়াছে তাহাকে সম্প্রসারিত টিকাদান বা ইপিআই (Expanded Programme on Immunisation) বলে।
প্রশ্ন- ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী দ্বারা কোন কোন ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর: এই কর্মসূচীর মাধ্যমে যক্ষ্মা, ডিপথিরিয়া, পোলিও, হাম, টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার ও হুপিং কাশি এই ছয়টি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
প্রশ্ন- শিশুর ইপিআই রোগুলির টিকার সিডিউল লিখ।
উত্তর: সব ধরণের ইপিআই রোগগুলির টিকা বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। শিশুর ইপিআই রোগগুলির টিকার বর্তমান সিডিউল পরের পৃষ্ঠায় দেওয়া হইল।
স্বাস্থ্য সমস্যা বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা। এদেশে শিশু মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী। শিশুমৃত্যু হার কমানোর জন্য নিম্নিলিখিত বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত।
১) শিশু প্রসবকালীন জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ।
২) মাতার পুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং গর্ভবতী মাতাকে পুষ্টিকর খাদ্য প্রদান।
৩) বাল্য বয়স বা অপরিণত বয়সে ভাবী মাতাদের বিবাহ না দেওয়া।
৪) উদরাময়, আমাশয়, কাশি, পেটের পীড়া, যক্ষ্মা, টাইফয়েড প্রভৃতি পীড়ার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা।
৫) উপযুক্ত চিকিৎসা, নার্স ও ঔষধপত্রের নিশ্চিয়তা বিধান করিয়া সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
৬) ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী বাধ্যতামূলক করিয়া শিশুদেরকে ছয়টি মারাত্মক পীড়ার হাত হইতে রক্ষা করা।
প্রশ্ন- মাতার বাত প্রসূতির মৃত্যুর কারণ কি কি?
উত্তর: মাতার বা প্রসূতির মৃত্যুর কারণগুলি হইল-
১) বাল্যবিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ ও প্রসবকালীন মৃত্যু।
২) দারিদ্রতার কারণে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যু।
৩) চিকিৎসক, ঔষধ, নার্স প্রভৃতির অপ্রতুলতা হেতু সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যু।
৪) পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব।
৫) সন্তান জন্মাদান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মৃত্যু।
৬) গর্ভাবস্থায় টক্সিমিয়া, এক্যাম্পশিয়া, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ প্রভৃতি হেতু মৃত্যু।
৭) প্রসবকালীন অস্বাভাবিকতা ও জটিলতা থাকিলে।
৮) পোস্ট পার্টাম হেমারেজ।
৯) শিক্ষিতা ধাত্রীর অভাব।
১০) কুসংস্কার।
প্রশ্ন- প্রসূতি মায়ের পুষ্টিহীনতার কারণসমূহ কি কি?
উত্তর: প্রসূতি মায়ের পুষ্টিহীনতার কারণগুলি হইল-
১) ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ জীবনযাপন।
২) অপরিণত বয়স বিবাহ ও ঘনঘন গর্ভধারণ।
৩। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত চিকিৎসা।
৪) দারিদ্রতার কারণে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ও ফলে পুষ্টিহীনতা।
৫) গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী মায়েদের ক্যালরি, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিকারক খাদ্য উপাদানের ঘাটতি।
৬) পুরুষ প্রধান পরিবারে পুরুষদের চেয়ে নারীদের স্বল্প পরিমাণে আহার্য গ্রহণ।
৭) গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করিলে প্রসবকালীন বৃহৎ শিশুর জন্মদানে কষ্ট হইবে মর্মে কুসংস্কার।
নবজাতকের পীড়া ও যত্ন
প্রশ্ন- সদ্যজাত শিশুর বা নবজাতকের সাধারণ রোগসমূহ কি কি?
উত্তর : সদ্যজাত বা নবজাতক শিশুর সাধারণ রোগসমূহ হইল-
১) নবজাত শিশুর ন্যাবা রোগ (Jundice of the New Born)
২) শিশুর স্তন ফোলা (Swelling of the Breast)
৩) নিওনেটাল ইনফেকশন (Neonatal Infection)
৪) নাভিতে জীবাণু সংক্রম (Pemphigus Neonatorum)
৫) পেমফিগাস নিওনেটেরাম (Pemphigus Neonatorum) (সংক্রামক চর্মরোগ)
৬) অপথালমিয়া নিওনেটোরাম (Opthalmia Neonatorum) (চোখের প্রদাহ)
৭) টিটেনাস নিওনেটেরাম (Tetanus Neonatorum)
৮) জলাভাব (Dyhydration)
৯) রিকেট বা অস্থিবিকৃতিরোগ (Rickets)
প্রশ্ন- নবজাত শিশুর জন্মগত বিকৃতিগুলি কি কি?
উত্তর : নবজাত শিশুর জন্মগত বিকৃতিগুলি নিম্নে প্রদত্ত হইল-
১) কাটা ঠোঁট (hare Lib)
২) কাটা তালু (Cleft Palate)
৩) রুদ্ধ মলদ্বার (Imperforate Anus)
৪) রুদ্ধ প্রস্রাব দ্বারা (Imperfoate Urethra)
৫) শিশ্নের চামড়া সংকোচন (Phimosis)
৬) নাভির গোঁড় (Umbilical Hernia)
৭) মাথায় জলাধিক্য (Hydrocephalus)
৮) অতিকায় শিশু (Monster)
৯) মস্তিষ্কের আবরণ বাহির হইয়া পড়া (Meningocele)
১০) কুশ পা (Talipes or Club Foot)
প্রশ্ন- নবজাতকের জন্মকালীন আঘাতগুলি এবং পীড়াগুলি কি কি?
উত্তর : নবজাত শিশু বা সদ্যপ্রসূত শিশু জন্মের সময় নিম্নলিখিত আঘাতগুলি পাইতে পারে।
১) কেপুট (Caput Succedaneum) স্বল্প পরিসর পেলভিস দিয়া বাহির হইবার সময় শিশুর মাথার যে অংশ জনন পথ দিয়া বাহিরে আসিতেছে তাহার সম্মুখে শক্ত কিছু না থাকায় তাহার উপর চাপ পড়ে না, যদিও তাহার চারিধারের তত্ত্বগুলিতে চাপ পড়ে। ইহার ফলে ঐ অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয় ও উহা ফুলিয়া উঠে। এই ফুলিয়া উঠা অংশের নাম ক্যাপুট।
২) রক্তের আব (Cephat Haematoma)
৩) মাথার চামড়া ছিঁড়িয়া যাওয়া (Laceration of the Scalp)
৪) হাড়ভাঙ্গা (Fracture of Bones)
৫) মাংসপেশী জখম (Muscular Injury)
৬) মুখের স্নায়ু জখম (Facial Nerve Injury)
৭) হাত অবশ হওয়া (Erb's Palsy)
৮) ব্রেকিয়াল পেকসাস (Brachial Plexus)
৯) মস্তিষ্কের ভিতর রক্তক্ষরণ (Haemorrhoage)
১০) রক্তক্ষরণ জনিত পীড়া (Haemorrhagic Disease)
প্রশ্ন- নিওনেটাল পিরিয়ড কাহাকে বলে?
উত্তর: শিশু জন্মের পর হইতে একমাস পর্যন্ত সময়কে নিওনেটাল পিরিয়ড বলা হয়।
প্রশ্ন- নিওনেটাল ইনফেকশনের কারণ কি?
উত্তর : নিওনেটাল ইনফেকশনের কারণসমূহ নিম্নরূপ-
১) নাভি কাটিবার সময়, নাভি শুকাইবার কালে বা নাভি পড়িয়া যাইবার পর নাভিতে জীবাণু সংক্রমণ।
২) পেমফিগাস নিওনেটোরাম-এক প্রকার সংক্রামক চর্মরোগ। নবজাত শিশুদের চর্মে জীবাণু দ্বারা এই রোগ সংক্রমিত হয়।
৩) জননপথ জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হইলে প্রসবকালে শিশুর চোখে জীবাণু সংক্রামিত হইয়া চোখের প্রদাহ হইতে পারে।
৪) শিশুর দেহের কোন স্থানের চামড়া ছিঁড়িয়া গেলে ঐ স্থান জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হইতে পারে।
৫) শিশুকে যাহারা কোলে নেয় তাহাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, হাত ও কাপড় চোপ হইতে জীবাণু গিয়া শিশুকে আক্রান্ত করিতে পারে। বিভিন্ন প্রকার জীবাণুর মধ্যে স্ট্যাফাইলোকক্কাস, বি. কোলাই ও মোনিলিয়া এলবিকাস প্রধানত দায়ী।
প্রশ্ন- নিওনেটাল জন্ডিসের প্রকারভেদ লিখ।
উত্তর: শিশু জন্মিবার তিন চারদিন পরে প্রায় শিশুরই রক্তকণিকার নাশ ঘটিয়া থাকে। এই রক্ত কণিকার ধ্বংসের জন্য শিশুর সমস্ত শরীর হলুদবর্ণ ধারণ করে, চক্ষুর সাদা অংশ ও মুখ হলুদ বর্ণের হয়। ইহাকেই নিওনেটাল জন্ডিস ও নবজাতকের ন্যাবা রোগ বলে।
নিওনেটাল জন্ডিসের প্রকারভেদ-
১) ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস- শিশু জন্মের পর এই অস্বাভাবিক জন্ডিস হইতে দেখা যায়। লিভারের গঠন প্রণালীর অসম্পূর্ণতার জন্য রক্তের অনুকোষ বেশী ভাঙ্গিয়া যায় ও বাইল পিগমেন্ট কম নির্গত হয়। অপরিণত শিশুদের ইহা বেশী হয়।
২) একপ্রকার নিওনেটাল জন্ডিস জন্মের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যায়। এই জাতীয় ন্যাবা রোগে শিশু স্তন টানে না, ঝিমাইয়া থাকে, ছটফট করে, বমি করে, প্রস্রাব লাল হয়, প্লীহা ও যকৃত বড় হয়। মল মাটি রং এর মত হয়।
৩) পোর্টাল ভেনে পূজ হইবার ফলে নাভিতে জীবাণু সংক্রমণের পর শিশুদের একপ্রকার ন্যাবা রোগ হয়।
৪) হেপাটাইটিস (ভাইরাস)।
৫) পিতৃদেহ হইতে সোরা ও সাইকোসিস সংমিশ্রণে দোষটি শিশুতে সংক্রমিত হইয়া পীড়া।
৬) সেপসিসের কারণে।
৭) হেপাটাইটিস।
৮) জন্মগত স্কোরোসাইটিক রক্তাক্ততার ফলে।
৯) সাইল ডাক্ট জন্মগতভাবে বন্ধ করে।
১০) মায়ের রক্তের গ্রুপের সাথে শিশুর রক্তের গ্রুপ গড়মিল থাকিলে।
প্রশ্ন- নিওনেটাল জন্ডিসের লক্ষণ লিখ।
উত্তর: নিওনেটাল জন্ডিসের লক্ষণ: এই পীড়ায় নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দৃষ্ট হয়।
১) শিশুর অঙ্গ স্পর্শ করিলে অনুভব করা যায় যে গাত্রত্বকটি সামান্য গরম।
২) প্রচ্ছন্নভাবের জ্বর ইহার সর্বপ্রথম লক্ষণ।
৩) শিশুর শরীর, চক্ষুর সাদা অংশ ও মুখ হলুদ বর্ণের হয়।
৪) শিশু স্তন টানে না, ঝিমাইয়া থাকে, ছটফট করে, বমি করে।
৫) মলের রং মাটির মত হয়। অজীর্ণ লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
৬) প্রস্রাব লালবর্ণের হইয়া থাকে।
৭) অনেক সময় কোষ্ঠবদ্ধতা ও শরীরের বিবর্ণতা দেখা দেয়।
৮) যকৃত শক্ত ও স্পর্শসহিষ্ণু।
প্রশ্ন- নিওনেটাল জন্ডিসের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা লিখ।
উত্তর: নিওনেটাল জন্ডিসের চিকিৎসা ব্যবস্থা- শিশুদের এই রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হইয়া চিকিৎসা করিতে হইবে। সাধারণতঃ যে যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এই পীড়ায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি নিম্নে উলেখ করা গেল। অভিজ্ঞ চিকিৎসক লক্ষণানুসারে উপযুক্ত ঔষধটি বাছিয়া নিবেন। ঔষধগুলি হইল-
এলুমিনা, এন্টিম ক্রুড, অরাম মেট, ব্যারাইটা কার্ব, ব্রায়োনিয়া, ক্যালকেরিয়া কার্ব, ক্যালকেরিয়া ফস, চেলিডোনিয়াম, হিপার সালফ, আয়োডিন, আর্স আয়োড, ডিজিট্যালিস, ল্যাকেসিস, লাইকোপোডিয়াম, ম্যাগ কার্ব, ম্যাগ মিউর, মার্ক সল, নেট্রাম কার্ব, নেট্রাম মিউর, এসিড নাইট্রিক, নাক্সভম, সোরিণাম, সালফার, পুজা, টিউবারকুলিনাম প্রভৃতি।
প্রশ্ন- প্রসবের পর কি কি কারণে শিশুর ফুসফুসের ক্রিয়া বিলম্বিত হইতে পারে?
উত্তর : সাধারণতঃ নিম্নলিখিত কারণে শিশুর জন্মের পর ফুসফুসের ক্রিয়া আরম্ভ হইতে ২০ মিনিট বা তারও অধিক সময় দেরী হইতে পারে।
১) ফরসেপস প্রয়োগে প্রসব।
২) অস্বাভাবিক প্রসব।
৩) বিলম্বিত প্রসব।
৪) অক্সিজেনের অভাবে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে গর্ভফুল পৃথক হইবার ফলে এবং অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে।
৫) প্রসবের সময় মাতাকে ঘুমের ঔষধ প্রয়োগ করিলে বা মাতাকে অজ্ঞান করিয়া প্রসবকার্য সমাধা করিলে।
নবজাতকের শ্বাসরোধ বা অ্যাসফিক্সিয়া নিউনেটোরাম
প্রশ্ন- ফিটাল অ্যাসফিক্সিয়া কাহাকে বলে? ইহার কারণ, লক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা লিখ।
উত্তর: ফিটাল অ্যাসফিক্সিয়া: গর্ভস্থ শিশুর জরায়ুর মধ্যে শ্বাসকষ্টের জন্য যে অবস্থার সৃষ্টি হয় সেই অবস্থাকে ফিটাল অ্যাসফিক্সিয়া বলে।
ফিটাল অ্যাসফিক্সিয়ার কারণ:
১) কোন কারণে জরায়ু এবং গর্ভফুলের আংশিক বা পূর্ণ রক্তসঞ্চালনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হইলে।
২) গর্ভস্থ শিশুর মাথায় দীর্ঘ সময় ব্যাপিয়া চাপ পড়িবার দরুণ মাথায় রক্ত সঞ্চালনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হইলে।
ফিটাস অ্যাসফিক্সিয়ার লক্ষণ- জরায়ু মধ্যে শিশুর শ্বাসকষ্ট হইলে নিন্মলিখিত লক্ষণগুলি হইতে আমরা তাহা বুঝিতে পারি। যথা-
১) গর্ভস্থ শিশুর ধীর, অনিয়মিত এবং মৃদু হৃদস্পন্দন।
২) যোনিপথে শিশুর মল দর্শন।
৩) দুইটি জরায়ু সংকোচনের মধ্যবর্তী বিরতিকালে যদি শিশুর হৃদস্পন্দনের হার মিনিটে ১০০ এর নিচে হয় তবে তাহাকে আসন্ন শ্বাসকষ্টের লক্ষণ বলিয়া মনে করিতে হইবে।
ব্যবস্থাপনা-জরায়ুর মধ্যে শিশুর শ্বাসকষ্ট হইতেছে ইহা বুঝিতে পারিলে কালবিমল্ব না করিয়া জীবন্ত শিশুকে বাহির করিবার জন্য সিজারিয়ান সেকশন বা ফরসেপস প্রয়োগ করা যাইতে পারে।
প্রশ্ন- অ্যাসফিক্সিয়া নিউনেটোরাম বা শিশুর শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসবন্ধ কাহাকে বলে? ইহার কারণ ও শ্রেণীবিভাগ কর।
উত্তর: অ্যাসফিক্সিয়া লিওনটোরাম- শিশু জন্মিবার পর শিশুর স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস আরম্ভ হইতে একটু বিলম্ব হওয়ার দরুন যে অবস্থার সৃষ্টি হয় বা জন্মের সময় যে অসন্তোষজনক শ্বাসক্রিয়া উদ্ভব হয় তাহাকে অ্যাসন ক্রিয়া নিওনেটোরাম বলে।
অ্যাসফিক্সিয়া নিওটোরামের কারণ- নিম্নলিখিত কারণে শিশুর অসন্তোষজনক শ্বাসক্রিয়া হইতে পারে।
১) শ্বাসযন্ত্রের কেন্দ্র অবস্বাদগ্রস্ত হইলে।
২) বায়ু সংঘবদ্ধভাবে।
৩) শিশুর জন্মের পর ফুসফুস প্রশস্ত হইতে না পারে।
অ্যাসফিক্সিয়া নিউটোরামের প্রকারভেদ- সাধারণত ইহাকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১) অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডা বা নীল শ্বাসকষ্ট- শ্বাসযন্ত্রের দোষ থাকিবার দরুন নীল মূর্তি ধারণ করাকে অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডা বলে।
২) অ্যাসফিক্সিয়া প্যাডিলা বা সাদা শ্বাসকষ্ট- অভিঘাত বা শক এর জন্য শিশুর - শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া ঠিকমত না হইলে বা একেবারেই বন্ধ থাকিলে এবং শিশুর গায়ের রং সাদা ফ্যাকাশে হইলে ইহাকে অ্যাসফিক্সিয়া প্যালিডা বলে।
প্রশ্ন- অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডা কি? ইহার চিকিৎসা লিখ।
উত্তর: অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডা- অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডা হইতে বিশুদ্ধ বর্ণ নীল হয়, চক্ষুদ্বয় আধখোলা অবস্থায় থাকে, শিশু সামান্য সামান্য শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, নাড়ীর গতি মৃদু থাকে, কিন্তু নাড়ী টিপিলে দপদপ শব্দ করে হাত-পা স্বাভাবিকভাবে শক্ত থাকে ও মুখ নড়ে। শ্বাসযন্ত্রের দোষ থাকে এবং শিশু নীলমূর্তি ধারণ করে।
এই অবস্থায় ভূমিষ্ট হইবার পর শিশু ভাল করিয়া না কাঁদিলে বুঝিতে হইবে যে শ্বাসকষ্টের জন্য হাঁপ আছে। হিমোগ্লোবিন কম থাকার কারণে এবং শ্বাসযন্ত্রের দোষের কারণে ইহা হইয়া থাকে।
অ্যাসফিক্সিয়া লিভিডার চিকিৎসা:
১) শিশুর মাথা বাহির হইবা মাত্র একখানি পরিশুদ্ধ ন্যাকড়া বোরিক লোশনে ভিজাইয়া আঙ্গুলের সাহায্যে নাকমুখ হইতে তরল শেখা বাহির করিয়া দিতে হইবে। একহাতে শিশুর দুইটি পা উঁচু করিয়া মাথা নিচের দিকে ঝুলাইয়া অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়া অনায়াসেই এই ঘড়ঘড়ানি ভাঙানো যায়।
২) শিশুকে সাথে সাথে অক্সিজেন দিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৩) শিশুকে একটি কম্বলে আবৃত করিয়া শ্বাসনালীতে একটি ছোট রবার ক্যাথিটার ঢুকাইয়া টানিয়া লইলে যে তরল পদার্থ শ্বাসনালী বন্ধ করিয়া ছিল তাহা বাহির হইয়া আসে।
৪) এডোট্রাকিয়্যাল টিউবের সাহায্যে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস দেওয়া যাইতে পারে।
৫) শিশুকে ইনকিউবেটরে রাখা নিরাপদ ও উত্তম।
৬) এই অবস্থায় বেশী নাড়াচাড়া করা উচিত নয়।
প্রশ্ন- ভ্রুনের মৃত্যু বা ফিটাল ডেথের কারণ কি?
উত্তর: নিম্নলিখিত করণে ভ্রুণের মৃত্যু হইতে পারে-
১) প্রসবে ব্যথা।
২) অস্বাভাবিক প্রেজেন্টেশন।
৩) রক্তহীনতা।
৪) হাইডেটিফরম মোল।
৫) ডায়াবেটিস মেলিটাস।
৬) হাইপারটেনশন।
৭) জ্যুর টিউমার।
৮) এন্টিপার্টম হেমারেজ।
৯) সিফিলিস।
১০) ক্রণিক নেফ্রাইটিস প্রভৃতি।
নবজাতক শিশুর যত্ন
প্রশ্ন- সদ্যজাত শিশুর যত্ন (Immediate care) কিভাবে নিবে আলোচনা কর।
উত্তর: সদ্যজাত শিশুর যত্ন (Immediate care): প্রসব পথ দিয়া শিশুর মাথা বাহির হইবামাত্র পরিশুদ্ধ তুলা দ্বারা শিশুর চোখের পাতা পরিষ্কার করিতে হইবে। ইহার পর পরিশুদ্ধ বোরিক লোশনে তুলা ভিজাইয়া শিশুর চোখ ভাল করিয়া মুছাইতে হইবে। প্রসবকালে শিশুর শ্বাসনালীতে রক্ত, মিউকাস ও পানি দিয়া শ্বাসকষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং শিশু ভূমিষ্ট হইবার পর মুখের ভিতরটা একাধিকবার পরিষ্কার করিয়া দিতে হয়। ইহার ফলে শিশু জোরে কাঁদিয়া উঠে। নাভি নাড়ীর রক্ত চলাচল বন্ধ হইবার পর যখন নাভি নাড়ীতে আর স্পন্দন অনুভূত হয় না তখন ধাত্রী নাভি হইতে দুই ইঞ্চি দূরে পরিশুদ্ধ সূতা দ্বারা নূতন করিয়া একটি বাঁধন দিবেন এবং ঐ বাঁধন হইতে প্রায় ১ ইঞ্চি বাদ দিয়া নাভি নাড়ী কাটিয়া উহাকে মাতৃদেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিবেন। ইহার পর নাভি নাড়ীর এ কাটা জায়গাটা পরিশুদ্ধ গজ দিয়া পরিষ্কার করিয়া ট্রিপল ডাস্টিং পাউডার দিয়া ঢাকিয়া ব্যান্ডেজ করিতে হইবে।
ভূমিষ্ট শিশুর নাড়ির গোড়া পরিষ্কার করবার পর ধাত্রীকে নিশ্চিত হইতে হইবে যে, রক্তক্ষরণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়াছে। ইহার পর তৃতীয় দিন হইতে প্রত্যহ নাভির গোড়া এন্টিসেপটিক দ্বারা পরিষ্কার করিতে হইবে এবং উহাতে যেন কোন জীবাণু সংক্রমণ না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে। এক সপ্তাহের পূর্বেই সাধারণত নাভির গোড়া আলাদা হইয়া যায়।
রোগজীবাণুর উৎপত্তিস্থান হইতেছে- ১) সাহায্যকারিনীর হাত, নাক ও গলদেশ,, ২) ধুলিকণা, ৩) যন্ত্রপাতি এবং দুধ খওয়াইবার বোতল ৪) রোগাক্রান্ত অন্যান্য শিশু। সুতরাং জীবাণু সংক্রমণের হাত হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইলে সাহায্যকারিনী বা যাহারা শিশুর সান্নিধ্যে আসিবেন তাহারা মুখোশ ব্যবহার করিবেন এবং জীবাণুমুক্ত হইবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন। শিশুর ঘর সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখিতে হইবে এবং ঘরের যাতীয় জিনিষপত্র পরিশুদ্ধ করিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
নাভির গোড়া পরিষ্কার করিবার পর শিশুকে ভাল করিয়া অলিভ অয়েল মাখাইয়া ত্বক ক্লেদ তুলিয়া ভাল সাবান বা হাল্কা গরম পানিতে পরিষ্কার করা হয়। নাভির গোড়াতে যাহাতে পানি না লাগে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে। লক্ষ্য রাখিতে হইবে গোসলের ঘরে ঠাণ্ডা বাতাস যেন প্রবেশ না করে। ইহাতে শিশুর হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগিয়া সর্দি হইতে পারে। মা তাহার হাঁটুর উপর মোটা তোয়ালে রাখিয়া শিশুর জামা খুলিয়া শিশুকে নরম তোয়ালে দ্বারা জড়াইবেন। শিশুর গায়ে পাউডার ব্যবহার করিলেও শিশুর পিছনে সাদা ভেসেলিন বা ক্রীম লাগানো ভাল। সবেশেষে শিশুকে নরম ও হাল্কা জামা কাপড় পরাইতে হয়।
প্রশ্ন- নবজাত শিশুর সাধারণ যত্ন (General Care) কিভাবে নিতে হয় আলোচনা কর।
উত্তর : নবজাত শিশুর সাধারণ যত্ন (General Care): নিম্নলিখিত উপায়ে নবজাত শিশুর সাধারণ যত্ন নিতে হয়। যথা-
১) শিশুর নিদ্রা- প্রসবকালে শিশুকে বেশ ধকল পোহাইতে হয়। তাই তাহার বিশ্রামের প্রয়োজন। তখন শিশু শুধু ঘুমাইতে চায়। শিশু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২০ ঘণ্টা ঘুমায়। উজ্জ্বল আলো, বেশী শব্দ, ভিজা জামা কাপড়, অস্বস্তিকর বিছানা, পেটের ব্যথা প্রভৃতি কারণে শিশু রাত্রিতে অনিদ্রায় কষ্ট পাইতে পারে। সুতরাং শিশুর সুনিদ্রার জন্য যে যে ব্যবস্থা করা সম্ভব তাহা করিতে হইবে।
২) শিশুকে খাওয়ানো- শিশুর জন্মের পূর্ব হইতেই আলাহ পাক মাতৃস্তনে সর্বোত্তম খাবার প্রস্তুত করিয়া রাখেন। মায়ের স্তনে ২য় বা ৩য় দিনে দুধ আসিলেও কোন ক্ষতি নাই। কারণ, জন্মের পর কয়েক ঘণ্টা শিশুকে খাওয়ানো দরকার হয় না। প্রথম দিনে স্তনে সামান্য দুধ থাকে তাহাই যথেষ্ট। স্তন মুখে দিলে শিশু আপনা হইতে চুষিতে শুরু করিবে। প্রথম দিনে ২ বার এবং তৃতীয় দিনে ৩-৪ বার দুধ দিলেই যথেষ্ট। ক্রমে ক্রমে দুধ দেওয়ার সময় বাড়াইতে হইবে। শিশু যদি দুর্বল হয় ও দুধ টানিতে অসমর্থ হয় তাহা হইলে স্তনদুগ্ধ ড্রপারে করিয়া খাওয়ানো যায়।
৩) গোসল- খুব গরম ও খুব ঠাণ্ডা পানি শিশুর কোমল দেহের জন্য ভাল নয়। গোসলে পানি ঈষৎ উষ্ণ হওয়াই বিধেয়।
৪) চোখ, নাক ও মুখের ভিতরের যত্ন- চোখে ময়লা বা পিচুটি পড়িলে পরিশুদ্ধ লবণ পানির লোশন (Sterilized normal saline) ব্যবহার করিতে হয়। ড্রপারের সাহায্যে ঐ লোশন দিয়া চোখ ধুইয়া দিতে হয়। ফুটানো পানি ঠাণ্ডা করিয়া উক্ত পানিতে পরিশুদ্ধ তুলা ভিজাইয়া চোখ পরিষ্কার করা যাইতে পারে। শিশুর যদি শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা নাক দিয়া পানি পড়ে তাহা হইলে পরিশুদ্ধ তুলা বা কাপড় পাকাইয়া ইহাকে পরিশুদ্ধ পানিতে ভিজাইয়া শিশুর নাকের ভিতরটা পরিষ্কার করিয়া দিতে হয়। দুধ খাওয়াইবার পর শিশুকে একটু পানি খাওয়াইয়া দিলেই শিশুর মুখ পরিষ্কার হয়। মুখের ভিতর আঙ্গুল দিয়া বা কাপড় দিয়া পরিষ্কার করিলে হ্রাস বা অন্যান্য জীবাণু সংক্রমণের আশংকা থাকে।
৫) নাভির যত্ন- নাভির গোড়া সর্বদা শুকনা রাখিতে হয়। নাভির গোড়া শুকনা থাকিলে নাভি শীঘ্র শুকাইয়া যায়। এইজন্য প্রত্যহ স্পিরিট দিয়া পরিষ্কার করিয়া শুকনা করিয়া পাউডার দিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া রাখিতে হয়। নাভির গোড়া খসিয়া পড়িবার পর যদি ঐ স্থান ভিজা থাকে এবং দুর্গন্ধযুক্ত হয় অথবা রক্ত বা পুঁজ পড়ে তাহা হইলে জীবাণুদুষ্ট হইয়াছে মনে করিতে হইবে। এই স্থলে চিকিৎসককে খবর দেওয়া উচিত।
৬) শিশুর মল- শিশুর প্রথম দিনের মলের রং গাঢ় সবুজ বর্ণের। দ্বিতীয় দিন হইতে হলদে রঙের হয়। শিশু যদি মায়ের দুধ এবং পানি পান করে তাহা হইলে কোষ্ঠকাঠিন্য হইতে পারে না। কোষ্ঠকাঠিন্য বা ২/১দিন পায়খানা না হইলে গ্লিসারিনে পূর্ণ সরু রবার ক্যাথিটার এক দেড় ইঞ্চি ঢুকাইবার পরেই মলত্যাগ করে।
৭) শিশুর শয্যা- জন্মের পর প্রথম কয়েকদিন শিশু মায়ের কাছে থাকিবে। শিশুর বিছানা এমন স্থানে হইতে হইবে যাহাতে বাহিরের শীতল বাতাস সরাসরি গায়ে না লাগে। শিশুর বিছানা হালকা, গরম ও আরামদায়ক হইবে। শিশু ঘনঘন প্রস্রাব করে তাই বিছানা কয়েক প্রস্থ থাকা ভাল।
৮) শিশুর ক্রমোন্নতি- শিশুর শারীরিক উন্নতি পর্যবেক্ষণের জন্য ২৪ঘন্টা অন্তর এবং পরে সপ্তাহ অন্তর একবার ওজন লইতে হইবে। প্রথম সপ্তাহে শিশুর ওজন কমিবে, কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহ হইতে শিশুর ওজন বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। একটি স্বাভাবিক পুষ্ট শিশুর জন্মকালীন ওজন ৭ পাউন্ড। নিম্নে একটি স্বাভাবিক শিশুর বয়স অনুসারে ওজন বৃদ্ধির তালিকা দেওয়া হইল-
৯) দাঁত উঠিবার সময়- সচরাচর ৬ হইতে ৮ মাসে দাঁত উঠে। এক বছরের শেষে বেশীর ভাগ শিশুরই ৬টি দাঁত উঠিয়া থাকে। প্রথম বছরের শেষেও যদি দাঁত না উঠে তবে শিশুর উপযুক্ত খাদ্যের অভাব হইতেছে মনে করিতে হইবে অবিলম্বে পরামর্শ নিতে হইবে।
প্রশ্ন- শিশুর শরীর গঠন ও পুষ্টির জন্য স্তনদুগ্ধ কেন প্রয়োজন? স্তনদুগ্ধ উহার কতটুকু পূরণ করিতে পারে?
উত্তর: স্তনদুগ্ধে প্রোটিন, ফ্যাট, সুগার, খনিজ লবণ এবং ভিটামিনস্ব র্তমান আছে। স্তনদুগ্ধে আয়রন ছাড়া আর সবকিছুই পরিমিত পরিমাণে বর্তমান রহিয়াছে। শিশুর জন্মের শেষের তিন মাসে শিশুর লিভারে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ জমা হইয়া থাকে। সুতরাং স্তনদুগ্ধে আয়রনের অভাবহেতু শিশুর কোন ক্ষতি হয় না। অতএব শিশু যাহাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্তন্যদুগ্ধ পায় সেদিকে বিশেষ যত্নশীল হওয়া উচিত। মাতাকে ইহার জন্য দৈনিক প্রচুর পরিমাণে পানি পান করিতে হইবে। নিজের পানাহারের সম্বন্ধে মাতার বিশেষ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ তাহার নিজের খাদ্যের উপর স্তন্যদুগ্ধের উৎকর্ষ নির্ভর করিবে। তাহার নিজের দেহে ক্যালসিয়ামের সববরাহ অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য তাহাকে দৈনিক আধা কিলোগ্রাম দুধ পান করিতে হইবে।
প্রশ্ন- নবজাত শিশুর কান্নার কারণসমূহ কি কি?
উত্তর: নবজাত শিশুর কান্নার কারণসমূহ- নিম্নলিখিত কারণে নবজাত শিশুরা কান্না করিয়া থাকে। যথা-
১) পেট ভরিয়া না খাওয়া।
২) খুব গরম বা খুব ঠাণ্ডা অস্বস্তিকর বিছানা।
৩) ভিজা বিছানা।
৪) পিঁপড়া, মশা, ছারপোকা বা আরশোলার কামড়।
৫) পেটে গ্যাস হওয়া।
৬) পেটে হাওয়া ঢোকা।
৭) কানে বা দেহে প্রদাহজনিত বেদনা।
৮) কোনও কারণে প্রস্রাব বন্ধ হইয়া মূত্রাশয়ে জমা হওয়া।
৯) কৃমি বা সংক্রামক জীবাণুর আক্রমণ।
প্রশ্ন- শিশুর মঙ্গলের জন্য মায়ের পক্ষে কি কি নিষিদ্ধ?
উত্তর: শিশুর মঙ্গলের জন্য মাতা নিম্নলিখিত বিধি নিষেধগুলি মানিয়া চলিবেন। যথা-
১) শিশু কাঁদে বলিয়া তাহাকে লইয়া শয়ন করিবেন না।
২) দুলাইয়া দুলাইয়া ঘুম পাড়াইবেন না।
৩) গভীর রাত্রিতে জাগিলে তাহাকে খাওয়াইবেন না।
৪) ফুটানো পানি ছাড়া শিশুকে অন্য পানি খাইতে দিবেন না।
৫) গরম অথবা বদ্ধ আবহাওয়ায় শিশুকে রাখিবেন না।
৬) অতিরিক্ত খাবার বা খেলনা দিয়া তাহার কান্না থামাইবার চেষ্টা করিবেন না।
৭) মুখে বোতল দিয়া শিশুকে ঘুমাইতে দিবেন না।
৮) শিশুকে মুখে চুম্বন করিবেন না।
শিশু খাদ্য
প্রশ্ন- শিশুর জন্মের পর কলোস্ট্রামের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর: শিশুর জন্মের পর কলোস্ট্রামের ভূমিকা- শিশুর জন্মের প্রথম দুইদিন প্রসূতির স্তনে একপ্রকার আঠাল পদার্থ থাকে ইহার নাম কলোস্ট্রাম। এই কলোস্ট্রাম ধীরে ধীরে স্তনদুগ্ধে পরিণত হয়। শিশুর জন্য এই কলোস্ট্রামই যথেষ্ট।
কলোস্ট্রাম পীতাভ রঙের তরল পদার্থ। ইহাতে প্রোটিন ৬%, সুগার ৩%, ফ্যাট ২.৫% মিনারেল সল্ট ও পানি থাকে। ইহাতে প্রোটেকটিভ (সংক্রামক রোগের ইমিউনিটি স্বরূপ) থাকে যাহা মাতৃরক্ত হইতে আসে। শিশুর গঠনের জন্য ও পুষ্টির জন্য প্রোটিন, ফ্যাট, খনিজ লবণ, সুগার, ভিটামিন অত্যাবশ্যক। ইহাতে প্রোটিনের ভাগ খুব বেশী। ইহা হজম হইতে সময় লাগে। সাধারণতঃ তৃতীয় দিনে ইহার ভিতর অতি সামান্য পরিমাণে কেসিনোজেন বর্তমান থাকে। পাকস্থলীর কেসিন হজম করিবার কাজ ঐদিন হইতেই সর্বপ্রথম আরম্ভ হয়।
প্রশ্ন- স্তনদুগ্ধ ও গো দুগ্ধের উপাদানের তুলনামুলক আলোচনা কর।
অথবা, মায়ের দুধ ও গরুর দুধে পার্থক্য কি?
উত্তর: স্তনদুগ্ধ ও গো দুগ্ধের মধ্যে পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হইল। যথা-
প্রশ্ন- মাতৃদুগ্ধ অন্য দুধের চাইতে সেরা কেন আলোচনা কর।
অথবা, মাতৃদুগ্ধের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কি?
উত্তর: দুগ্ধে যে প্রোটিন থাকে তাহা দুই প্রকারের। ১) ল্যাক্ট এলবুমিন এবং ২) কেসিনোজেন। ল্যাক্ট এলবুমিন কেসিনোজেন অপেক্ষা পাতলা এবং অতি সহজপাচ্য। গোদুগ্ধ অপেক্ষা স্তনদুগ্ধে এই ল্যাক্ট এলবুমিনের পরিমাণ অনেক বেশী থাকে এবং স্তনদুগ্ধ স্বভাবতই জীবাণুমুক্ত। ইহা ছাড়া স্তনদুগ্ধের আরও একটি বিশেষত্ব এই যে, শিশুর বয়স এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ইহার পরিবর্তন হইয়া থাকে। আবার গরুর দুধ ফুটাইতে হয় বলিয়া ইহার ভিটামিন নষ্ট হয়। কিন্তু স্তনদুগ্ধ ফুটাইতে হয় না এবং ইহার ভিটামিনও নষ্ট হয় না।
ইহাছাড়া স্তনদুগ্ধের উষ্ণতা আগাগোড়া একরূপ থাকায় শিশু স্তন্যদুগ্ধ আরামে পান করিয়া থাকে। আবার স্তন্যপায়ী শিশুদের অপেক্ষা কৃত্রিম দুগ্ধপায়ী শিশুদেরই পেটের অসুখ, বমি, রিকেট প্রভৃতি রোগ বেশী হইয়া থাকে। মায়ের দুধ এসিডিক নয় কিন্তু গরুর দুগ্ধ এসিডিক। মায়ের দুধের রোগ প্রতিরোধ শক্তি আছে। এই হেতু স্ত ন্যদুগ্ধই নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হয়।
প্রশ্ন- মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা বর্ণনা কর।
উত্তর: মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা নিম্নে বর্ণনা করা হইল। যথা-
১) মাতৃদুগ্ধ সর্বাপেক্ষা প্রকৃতি সম্মত খাদ্য।
২) শিশু নিজের হজম ও পুষ্টির উপযোগী সর্বপ্রকার পুষ্টিকর বস্তুই উহাতে পাইয়া থাকে।
৩) ভিটামিন ও নানা রোগের প্রতিষেধক বস্তু শিশুর দেহে অবিকৃত অবস্থায় প্রবেশ করে।
৪) স্তন্যদানের সময় মাতার বিশ্রাম হয়। ইহা ছাড়া ইহা জীবাণুমুক্ত। জীবাণু সংক্রমণের কোন ভয় থাকে না।
৫) মা শিশুকে স্তন দিলে মায়ের দেহযন্ত্রাদি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া আসিতে সাহায্য লাভ করে এবং জরায়ু সংকোচনে সাহায্য করে।
৬) দেহের তাপমাত্রায় মাতৃদুগ্ধ উষ্ণ থাকে।
৭) ইহা সস্তা। মাতৃদুগ্ধের জন্য কোন অর্থ ব্যয় করিতে হয় না।
৮) শিশুকে স্তন দিলে মা ও সন্তানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে স্নেহ ও ভালবাসা অধিক পরিমাণে গড়িয়া উঠে, পূর্ণতার আনন্দে একদিকে শিশুর অন্যদিকে মায়ের দেহ ও মনের উন্নতি ঘটে।
প্রশ্ন- শিশুকে স্তনপান করানোর নিয়ম বর্ণনা কর।
বা, প্রসূত সন্তানের স্তন্যপানের ব্যবস্থাপনা লিখ।
উত্তর: প্রসূতি যতদিন বিছানায় শুইয়া থাকিবে ধাত্রী ততদিন তাহার কাছে শিশুকে লইয়া মাতার স্তন খাওয়াইবে। মাতার স্তনে শিশুর নাক, মুখ যাহাতে চাপা না পড়ে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। প্রতিবার স্তন্যপান করাইবার পূর্বে শিশুকে প্রস্রাব করাইতে হইবে। কারণ স্তন দিবার পরই উহাকে বিছানায় শোয়াইয়া ঘুম পাড়াইয়া দিতে হইবে। খাওয়ানো শেষ হইলে শিশুকে কয়েক মিনিট কাঁধের উপর তুলিয়া ধরিতে হয়, ইহার উদ্দেশ্য হইল পেটের হাওয়া বাহির করিয়া দেওয়া। স্তনে মুখ রাখিয়া শিশুকে ঘুমাইতে দেওয়া উচিত নয়।
প্রসবের ৮-১০ ঘণ্টা প্রসূতির পূর্ণবিশ্রামের পর শিশুকে স্তন দিতে হয়। প্রথম দুইদিন শিশু দুই চারি ফোঁটা দুধ পায়। তৃতীয় দিনে স্তনে ভালভাবে দুধ আসিলে প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর প্রতিটি স্তন ৭ মিনিট করিয়া শিশুর মুখে রাখিয়া ক্রমশঃ প্রতিবারে ১০ মিনিট করিয়া রাখা বিধেয়।
প্রতিটি তিনঘণ্টা অন্তর স্তন দিলে দিনে ৮ বার শিশুকে স্তন দেওয়া যায়।
সাধারণতঃ রাত ১০টার পরই শিশুকে খাওয়ানো নিষিদ্ধ বলিয়া দুই বার বাদ দিয়া দিনে ৬ বার খাওয়ানো হইলেই চলে। বেশী রাতে স্তন দিলে শিশুর হজমের ক্ষতি হয়। প্রসূতির নিদ্রারও ব্যাঘাত ঘটে।
শিশুকে স্তন দেওয়ার সময় নির্জনে বসিয়া সুস্থ ও প্রফুল্ল মনে স্তন দেওয়া উচিত। গোলমাল ও তীব্র আলোতে শিশু অন্যমনস্ক হয় ও স্তন চুষিতে পারে না।
প্রসূতি ভালভাবে বসিয়া শিশুকে কনুই এর ভাঁজে আরামদায়ক ভাবে শোয়াইয়া স্তনের বোঁটা ফুটানো ঠাণ্ডা পানিতে ধুইয়া শিশুর মুখে দিতে হয়।
প্রত্যেক মায়েরই উচিত অন্তত ৬/৭ মাস শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো।
প্রশ্ন- মাতৃস্তনের অভাব ঘটিলে কি উপায়ে মাতৃস্তনের অভাব পূরণ করা যায়?
বা, মায়ের দুধের পরিবর্তে অন্য দ্রব্য দেওয়ার নিয়মাবলী বর্ণনা কর।
উত্তর : মাতৃস্তনের অভাব ঘটিলে নিম্নলিখিত উপায়ে মাতৃস্তনের অভাব পূরণ করা যায় বা অন্য দুধ দেওয়া যাইতে পারে।
১) গরুর দুধ-সুস্থ গরুর টাটকা দুধ মায়ের মত সহজপাচ্য করিয়া নিতে হয়।
শুধু গরুর দুধ দিলে শিশু হজম করিতে পারে না। গরুর দুধকে যদি বাড়ীতে মায়ের মত করিয়া খাওয়াইতে হয় তাহা হইলে ১০ আউন্স ফুটানো দুধের মধ্যে ১০ আউন্স পানি মিশাইতে হইবে। ইহার সাথে ১ আউন্স ল্যাকটোজ এবং অর্ধ হইতে এক আউন্স ক্রীম (৫০% ক্রীম) মিশাইলে গরুর দুধ ঠিক মায়ের মত হইবে। শিশুর হজমের শক্তি বুঝিয়া ক্রমশ পানির ভাগ কমানো যাইতে পারে। ল্যাকটোজের অভাবে সাধারণ চিনি পানি মিশানো যাইতে পারে।
২) ধাত্রীস্তন্য পান- মাতৃদুগ্ধের অভাবে অন্য রমণীর স্তন্যদুগ্ধ পান করাইয়া শিশুকে পালন করিবার প্রথা আছে। তবে অজ্ঞাত কুলশীল ধাত্রীস্তন্য শিশুকে পান করিতে দিলে বিপদের সম্ভাবনা। ধাত্রী ঠিক করার পূর্বে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন উক্ত ধাত্রী স্তন্যধাত্রী শিশুর মাতার সমবয়সী হয়, ধাত্রীর যাহাতে উপদংশাদি কোন পীড়া না থাকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, স্তনের বোঁটায় কোন ময়লা বা ক্ষত না থাকে।
৩) কৃত্রিম দুগ্ধ পান করানো- আজকাল অনেক ভাল ক্রীমযুক্ত বা ক্রীম ছাড়া গুঁড়া দুধ পাওয়া যায়। শিশুর বয়স ও ওজন অনুসারে কি পদ্ধতিতে দুধ তৈরী করিয়া খাওয়াইতে হইবে টিনের গায়ে বা প্যাকেটের গায়ে তাহার তালিকা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী দুধ তৈরী করা ভাল। নিজের আন্দাজ মত গুঁড়া দুধ পানিতে মিশাইয়া শিশুর আহার্য প্রস্তুত না করাই উত্তম। প্রায় সব মা-ই তালিকা না দেখিয়া নিজের অনুমান মত গুঁড়া দুধ পানিতে মিশাইয়া শিশুর আহার প্রস্তুত করেন। ইহাতে দুধের পরিমাণ পাতলা বা ভারী হয়। এই হেতু কখনও পুষ্টি কম হয়, কখনও বা অতিরিক্ত দুধে হজমের গোলমাল হইয়া পেটের অসুখ করে।
প্রশ্ন- শিশুকে ধাত্রীদুধ প্রদানের নীতিমালা বর্ণনা কর।
উত্তর: শিশুকে ধাত্রীদুধ প্রদানের নীতিমালা নিচে বর্ণিত হইল। যথা-
১) স্তন্যদাত্রী ধাত্রী শিশুর মাতার সমবয়সী হইতে হইলে ভাল হয়।
২) স্তন্যদাত্রী শিশুর মাতার সহিত সম প্রসবিনী হইলে আরও ভাল হয়।
৩) স্তন্যধাত্রী স্বভাবত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইবে।
৪) তাহার স্তন্যে পালিত শিশুর ও তাহার নিজের সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত দুগ্ধ থাকা প্রয়োজন।
৫) তাহার স্বাস্থ্য অটুট থাকিবার প্রয়োজন আছে।
৬) তাহার শরীরে উপদংশ প্রভৃতি রোগ থাকিবে না।
৭) তাহার স্তনে বা স্তনের বোঁটায় কোনও ময়লা, প্রদাহ বা ক্ষত থাকিবে না।
প্রশ্ন- কিভাবে বোতলে দুধ খাওয়াইতে হয়?
উত্তর: আজকাল অনেক ভাল ক্রীমযুক্ত বা ক্রীম ছাড়া গুঁড়া দুধ পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট বয়সের বা ওজনের শিশুকে কি প্রণালীতে দুধ তৈরী করিয়া খাওয়াইতে হইবে টিনের গায়ে তাহার তালিকা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী দুধ তৈরী করা ভাল। কিন্তু অনেক মাই তালিকা না দেখিয়া নিজের মত গুঁড়া দুধ পানিতে মিশাইয়া শিশুর আহার প্রস্তুত করে। ইহাতে দুধের পরিমাণ পাতলা বা ভারী হয়। এইহেতু কখনও পুষ্টি কম হয়। কখনও বা অতিরিক্ত দুধে হজমের গোলমাল হইয়া পেটের অসুখ করে।
ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়াইলে মাকে খুব সতর্ক থাকিতে হয়। ভাল বোতল ও চুষি দেখিয়া লইতে হয়। চুষির মুখ ভাল না থাকিলে শিশু প্রচুর বাতাস টানিয়া পেট ভারী করিয়া ফেলে এবং এইহেতু বমি হইতে পারে। চুষি দিয়া যদি খুব বেশী দুধ আসে তাহা হইলে শিশুর চুষিতে কষ্ট হয়। শিশুর মুখে চুষি দিবার আগে ইহার উত্তাপ, সহজ ঝরণা, বাতাস শূণ্য অবস্থা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া লইয়া শিশুর মুখে দিতে হয়। প্রত্যেকবার শিশুকে খাওয়াইবার পর গরম পানিতে সামান্য সোডা মিশাইয়া ভাল করিয়া বোতল ও চুষি ধুইয়া রাখিতে হইবে। রবারের চুষিতে লবণ ঘষিয়া রাখা ভাল। দুধ দিবার আগে আবার চুষি ধুইয়া লইতে হয়। বোতল পরিচ্ছন্ন না হইলে শিশুর পেট খারাপ করে।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মত মাথা উঁচু করিয়া কোলে লইয়া দুধ ভর্তি বোতলের চুষি শিশুর মুখের মধ্যে দিয়া বোতলটি কাত করিয়া ধরিতে হইতে যাহাতে বোতলের মুখ ভর্তি থাকে। বোতলের মুখ কিছুতেই ফাঁকা রাখা যাইবে না। কারণ এই ফাঁক দিয়া বাতাস শিশুর পেটে প্রবেশ করতঃ পেট ফাঁপাইবে। দুধ খাওয়ানোর মাঝে ও শেষে শিশুর ঢেকুর তুলিতে হইবে। বোতল হইতে দুধ খাওয়ানোর পর বোতলের শেষে অবশিষ্ট দুধ শিশু আর খাইতে চাহিবে না। উহা ফেলিয়া দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন- বোতলের দুধ বা কৃত্রিম দুধ খাওয়ানোর অসুবিধা কি?
উত্তর : বোতলে দুধ খাওয়ানোর প্রধান অসুবিধা হইল বোতলে নিপল ও দুধ হইতে ইনফেকশন শিশুর মুখে ও অস্ত্রে যায়। ফলে শিশুর ডায়রিয়া হইতে পারে।
প্রশ্ন- দুধ ছাড়া কখন হইতে শিশুকে ফলের রস দেওয়া যায়?
উত্তর: শিশুর বয়স একমাস হইতে কমলালেবুর রস ১ চামচ খাওয়াইতে হইবে। পরে ৩-৪ চামচ পর্যন্ত বৃদ্ধি করিতে হইবে। যদি ফলের রস দেওয়া সম্ভব না হয় তবে বোতলে দুধ খাওয়ানোর সময় ৫ ফোঁটা ভিটামিন সি মিশাইয়া শিশুকে খাওয়াইতে হইবে। পরে ৩/৪ চামচ পর্যন্ত বৃদ্ধি করিতে হইবে।
প্রশ্ন- কিভাবে শিশুকে বোতল বা বুকের দুধ ছাড়ানো হয়?
উত্তর: ছয় মাস পরে শিশুকে বোতল ছাড়াইয়া আস্তে আস্তে কাপ বা গ্লাস হইতে দুধ ও পানি পান করিতে দিতে হইবে। ৬ মাসের পর সপ্তাহে একবার বুকের দুধের পরিবর্তে গরু বা টিনজাত দুধ দিতে হইবে। এইভাবে ক্রমশ ৩/৪ মাসে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়াইতে হইবে।
প্রশ্ন- শিশুকে স্তন্য পান করানোর নিষেধগুলি কি কি?
উত্তর: মায়ের নিম্নলিখিত অবস্থায় শিশুকে স্তন্য পান করানো নিষেধ। যথা-
১) স্তনের ক্যান্সার হইলে।
২) মা পুনরায় গর্ভবতী হইলে।
৩) স্তনের বোঁটা ফাটিয়া গেলে।
৪) জল বসন্ত বা গুটি বসন্ত হইলে।
৫) থাইসিস বা যক্ষ্মাকাশি হইলে।
৬) ডিপথিরিয়া হইলে।
৭) যদি একটি স্তনে প্রদাহ হয় এবং উহা ফুলিয়া উঠে, ব্যথা হয়, চর্মের রং লাল হয় ও শরীরে জ্বর হয় তবে সেই স্তন বা অন্য স্তন দেওয়া ঠিক নয়।
প্রশ্ন- শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর নিয়ম কি?
উত্তর: মায়ের দুধই শিশুর জন্য উত্তম ও যথেষ্ট। জ্জ মাস পর শিশুকে ধীরে ধীরে শক্ত খাবার দিতে হইবে কারণ শুধু দুধে কোষ্ঠকাঠিন্য ও রক্ত স্বল্পতা দেখা দিবে। শিশুকে পাকা কলা, আপেল, পেঁপে, সিল্ক সুজি, ভাতের পায়েস প্রভৃতি দেওয়া যায়। ৫/৬ মাস বয়সের সময় তাহাকে খাবারের সময় সিদ্ধ ভাত, গলা ভাত, খিচুড়ি, সিদ্ধ ডিমের কুসুম, সব রকমের শাক সবজি সিদ্ধ করতঃ মণ্ড করিয়া খাওয়াইতে হইবে। এই খাবারে অল্প লবণ ও মাখন মিশাইতে হইবে। ৭/৮ মাস বয়সে ব্রেক ফাস্ট, দুপুরে, বিকালে ও সন্ধ্যায় বুকের বা বোতলের দুধের সাথে ৪ বার শক্ত খাবার দিতে হইবে। এই শক্ত খাবার হইল-ভাত, ডাল, রুটি, মাছ সিদ্ধ, ডিম সিদ্ধ এবং ফল। ৯ হইতে ১২ মাস বয়সে শিশুকে তাহার খাবাবের সালে মাছ ও গোসত সিদ্ধ করিয়া খাওয়াইতে হইবে। সারাদিনে ৮ আঃ দুধ পান করিতে হইবে।
শক্ত খাবার খাওয়ানোর পর হইতে দুধের পরিমাণও কমানো হইবে।
প্রি-ম্যাচিউর বেবী বা অপূর্ণাঙ্গ শিশু
প্রশ্ন- অপূর্ণাঙ্গ বা প্রি-ম্যাচিউর বেবী কাহাকে বলে? অপূর্ণাঙ্গ শিশুর লক্ষণ কি?
উত্তর: প্রি-ম্যাচিউর বেবী বা অপূর্ণাঙ্গ শিশু- শিশু ভূমিষ্ট হইবার সময় তাহার ওজন ৫.৫ পাউন্ড বা উহার কম হইলে তাহাকে অপরিণত শিশু বা প্রি-ম্যাচিউর বেশী বলে।
অপূর্ণাঙ্গ শিশুর লক্ষণ-
১) শিশুর দৈর্ঘ্য ৫৪.৬ সে.মি. অথবা কম।
২) ওজন ৫.৫০ পাঃ বা কম।
৩) চামড়া লাল ও ঢিলা।
৪) নখ ছোট।
৫) স্কাল বোন নরম।
৬) চক্ষু বোজা প্রভৃতি।
প্রশ্ন- অপূর্ণাঙ্গ শিশু বা প্রি-ম্যাচিউর বেবীর শুশ্রূষা ও ব্যবস্থাপনা লিখ।
উত্তর: অপূর্ণাঙ্গ শিশুর শুশ্রূষাকালে কতকগুলি বিষয়কে শুশ্রূষার মুখ্য উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করিতে হইবে। অধিকাংশ অপরিণত শিশু সাধারণতঃ অ্যাসফিক্সিয়া নিওনেটোরাম হেতু ভূমিষ্ট হইবার ২৪ ঘণ্টার ভিতর মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সুতরাং শিশু ভূমিষ্ট হইবার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুর মুখ ও গলা পরিষ্কার করিয়া দিতে হইবে এবং প্রয়োজনবোধে ইহার জন্য মিউকাস ক্যাথিটার ব্যবহার করিয়া শিশুর মুখ ও গলার শ্লেষ্মা বাহির করিয়া দিতে হইবে। শিশুকে অক্সিজেন টেস্টে রাখিতে হইবে। এই ধরনের শিশুকে যতদূর সম্ভব কম নাড়াচাড়া করিতে হয়। কিন্তু শিশুর দুইটি ফুসফুস অক্সিজেন দ্বারা যাহাতে সমভাবে প্রসারিত হইতে পারে সেই হেতু শিশুকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাইতে হইবে।
শিশুকে জীবাণুর আক্রমণের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইলে শিশুর সেবক সেবিকাদের সব সময় জীবাণুমুক্ত পরিধেয় ব্যবহার করিতে হইবে এবং শিশুর ঘর জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
মিডওয়াইফারী ২৫৯
শিশুর শরীরে তাপ রক্ষা করার জন্য শিশুকে আলগা গরম পরিধেয় পরাইতে হইবে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আর্দ্রতা ও অক্সিজেন গ্যাসের পরিমণ্ডলে রাখিবার যন্ত্রে বা ইনকিউবিটরে শিশুকে রাখিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। গরম পানির বোতল শিশুর দুই পার্শ্বে এবং পায়ের দিকে এমনভাবে রাখিতে হইবে যাহাতে গায়ে না ঠেকে। প্রতি ঘণ্টায় বোতল বদলানো বিধেয়।
শিশুকে বেশী নাড়াচাড়া করিলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া শিশুর মৃত্যু ঘটিতে পারে। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে নাড়াচাড়া করা উচিত নয়। এই ধরনের শিশুকে ভূমিষ্ট হইবার অন্ততঃ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কিছু খাইতে দেওয়া সঙ্গত নয়। কারণ তাহার হজম সংক্রান্ত ক্রিয়া শুরু হইতে দেরী হয়। তাই অপরিণত শিশুকে অল্প অল্প করিয়া বার বার খাওয়ানো উচিত। শিশুর অবস্থার উন্নতি হইলে দ্বিতীয় সপ্তাহের পর হইতে শিশুকে ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী এ,বি,সি,ডি খাওয়াইতে হইবে।
0 মন্তব্যসমূহ