রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা - ৬ষ্ঠ অধ্যায় - ১ম বর্ষ


৬ষ্ঠ অধ্যায় 
রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা কর, 
রোগীকে আংশিক বা আঙ্গিক ভাবে নয়, 
সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসা কর। 
(Treat the Patient but not the disease, treat the Patient wholly, but not Partly)  






প্রশ্ন- রোগের নয় রোগীর চিকিৎসা কর এই কথার অর্থ কি?
বা, হোমিওপ্যাথিতে রোগীর চিকিৎসা করে, রোগের নয়-ব্যাখ্যা কর।

উত্তর ঃ হোমিওপ্যাথি হইল প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতি ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি । প্রাকৃতিক চিকিৎসার নিয়ম হইল লক্ষণসমষ্টি দিয়া চিকিৎসা করা। যদি রোগের নামে চিকিৎসা করা হয় তাহা হইলে প্রাকৃতিক আরোগ্য নীতিতে চিকিৎসা হয় না। মহাত্মা হ্যানিমানের উপদেশ হইল রোগীকে চিকিৎসা কর, রোগকে নয়। এই কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে হইলে আমাদের প্রথমে 'রোগ ও রোগী' সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারনা থাকা প্রয়োজন। 
প্রচলিত চিন্তা ধারায় রোগ বলিতে অল্প কয়েকটি নির্দিষ্ট লক্ষণকে বুঝায়, দেহের ও মনের সমস্ত কষ্টকে বুঝায় না। যেমন তরুণ সর্দি সহ প্রাদাহিক জ্বরকে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং শীত, কম্প, ঘর্ম পর্যায়ক্রমে আগমনকে ম্যালেরিয়া জ্বর বলে। কয়েকটি কষ্টকর নির্দিষ্ট লক্ষণ ছাড়া অন্যান্য কষ্টকে রোগের অন্তর্ভূক্ত করা হয় না। সুতরাং রোগ বলিতে দেহ ও মনের আংশিক লক্ষণ বুঝায়, সামগ্রিক সম্পূর্ণ লক্ষণ নয়। সুতরাং রোগ রোগীর সমস্ত কষ্টকর প্রতিনিধিত্ব করে না। রোগ চিকিৎসা বলিতে আংশিক কষ্ট দূর করাকে বুঝায়, সমস্ত কষ্টকে দূর করা বুঝায় না। 
রোগী বলিতে দৈহিক ও মানসিক কষ্ট, পরিবর্তিত অনুভূতি, মেজাজ ও স্বভাব এবং রোগের হ্রাস বৃদ্ধি সহ সমস্ত ব্যক্তিটিকে বুঝায়। এক কথায় সমস্ত কষ্টকর লক্ষণ সহ আক্রান্ত ব্যক্তিটিই হইল রোগী। সুতরাং রোগী চিকিৎসা বলিতে সামগ্রিক ভাবে সমস্ত কষ্টগুলি দূরীভূত করা। আংশিক লক্ষণাবলী দূর করাকে চিকিৎসা বলা যায় না। মহাত্মা হ্যানিমান দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়া সামগ্রিক ভাবে রোগকে বিচার করিতে চাহিয়াছেন। রোগকে সামগ্রিকভাবে দেখিতে গিয়াই তিনি রোগীকে দেখিয়াছেন। সামগ্রিক রোগের প্রতিনিধি হইল রোগী। সুতরাং রোগীকে সামগ্রিক ভাবে আরোগ্য করিতে না পারিলে রোগ সমূলে ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সুতরাং এক কথায় বলা যায় রোগী চিকিৎসা কর, রোগ চিকিৎসা নয়। ইহার প্রকৃত অর্থ হইল রোগকে সামগ্রিক ভাবে বিতাড়িত করিয়া রোগীকে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ করা।





প্রশ্ন- রোগীকে আংশিক বা আঙ্গিকভাবে নয় নামগ্রিকভাবে রোগীর চিকিৎসা কর কেন?

উত্তর : জীবনীশক্তির বিশৃংঙ্খলাই হইল রোগ। এই জীবনীশক্তি মানবদেহকে স্বীয়কার্য সাধনে সঞ্জীবিত রাখে। জীবনীশক্তি অতীন্দ্রিয় ও অজড়। অİড় রোগশক্তি অজড় জীবনীশক্তিকে পরাভূত করে, ফলে জীবনীশক্তি পীড়িত হয়। জীবনীশক্তির অসুস্থতার কারণে দেহ রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খলা বিশেষ বিশেষ ব্যাধির প্রকৃতি অনুসারে বিশেষ বিশেষ অঙ্গে বিকৃতি আকারে প্রকাশ পায়। এখানে রোগ কোন আঙ্গিক বিষয় নয়, তা সমগ্র দেহের পীড়িতাবস্থাকেই প্রকাশ করে। জীবনীশক্তির এই রোগাক্রান্ত হওয়ার নিদর্শন হিসাবে আমরা যে সকল লক্ষণ প্রত্যক্ষ করি তাহার প্রকাশস্থল বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সুতরাং রোগ সমগ্র মানুষটির, তাহার কোন অঙ্গের বা অংশের নয়। বিকৃত লক্ষণসমূহ দ্বারা জীবনীশক্তি সাহায্য প্রার্থনা করে। লক্ষণসমষ্টিই অসুস্থ জীবনীশক্তির সাহায্য প্রার্থনার ভাষা। চিকিৎসকের কর্তব্য হইল জীবনীশক্তির এই বিকৃত লক্ষণসমূহের সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করা। অতএব পীড়িত জীবনীশক্তির চিকিৎসা করা হয় অর্থাৎ রোগীর সমগ্র দেহ ও মনের চিকিৎসা করা হয়। কোন অঙ্গের বা অংশের নয়।
 




প্রশ্ন- রোগ সম্বন্ধে হোমিওপ্যাথিতে কিরূপ ধারণা পোষণ করা হয়?

উত্তর : অদৃশ্য জীবনীশক্তি মানবদেহে অতি সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থিত। জীবনীশক্তির এই গতি ভিতর হইতে বাহিরের দিকে। কোন ব্যক্তি পীড়িত হইলে আমাদিগকে প্রথমেই বুঝিতে হইবে জীবনীশক্তির বিপর্যস্ত অবস্থা। জীবনীশক্তি ইহার স্বীয় শক্তি বলে স্বাভাবিক জীবন ক্রিয়া পরিচালিত করে। রোগ শক্তির বিরুদ্ধে সব সময় জীবনীশক্তি যুদ্ধ করিয়া আসিতেছে এবং রোগ শক্তিকে প্রতিহত করিয়া জীবন ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখিতেছে। যদি রোগ শক্তিটি জীবনীশক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী হয়। তবে জীবনীশক্তির সুশৃঙ্খল কর্মকান্ডের বিপর্যয় ঘটিলে সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে জানাইয়া দেয়। প্রাকৃতিক রোগশক্তি সূক্ষ্ম ও অজড়। এই অজড় রোগশক্তির প্রভাবেই অজড় জীবনীশক্তি বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এর মাধ্যমে লক্ষণ সমষ্টির সাহায্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রকাশ করে। যাহার ফলে মানবদেহে ও মনের বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হয়, অনুভূতির বিকৃতি ঘটে ও বিশৃঙ্খল ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। দেহের বিভিন্ন অংশে এই বিশৃঙ্খলা জনিত লক্ষণ সমষ্টি দৃষ্টিগোচর হয়। এই সকল বিকৃতি অনুভূতি বিশৃংঙ্খল কার্যপলাপ অর্থাৎ জীবনীশক্তির বিকৃতাবস্থা জনিত সৃষ্ট লক্ষণসমষ্টিকেই আমরা রোগ বলি ।





প্রশ্ন- জড়দেহকে রোগী বলার অসুবিধা কি আর অজড় মানুষকে রোগী বলার সুবিধা কোথায়?

উত্তর : জড়দেহকে রোগী বলা যায় না। জড় দেহকে রোগী বলিলে কোন বিশেষ অঙ্গের চিকিৎসাই করিতে হয়। কোন বিশেষ অঙ্গের চিকিৎসায় সার্বিক মানুষটি আরোগ্য লাভ করিতে পারে না। তাই জড় দেহকে রোগী বলিলে চিকিৎসকের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইয়া যায়। আর অজড় মানুষটিকে রোগী বলিলে চিকিৎসা কার্যের উদ্দেশ্য সফলতা লাভ করে। ইহাতে কোন বিশেষ অঙ্গের চিকিৎসা করা হয় না, রোগীর বিভিন্ন অঙ্গের অস্বাভাবিকতা বা বিকৃতি অজড় পীড়ার বিভিন্ন লক্ষণ মাত্র। এই লক্ষণ সমষ্টির মধ্যেই অজড় পীড়ার প্রকৃত স্বরূপ পাওয়া যায়। অজড় মানুষটি হইল দেহ, মন ও প্রাণের সমন্বয়ে গড়া এক অখন্ড চৈতন্যময় সত্তা। ইহার কোন অংশে কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সমগ্র সত্তায় তার প্রতিফলন ঘটে। মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন গোটা মানুষটিই অসুস্থ হইয়া পড়ে। পীড়ার এই ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য চিত্রের অনুরূপ চিত্র বিশিষ্ট একটি মাত্র ঔষধ নির্বাচন করাই প্রকৃতির বিধান। প্রাকৃতিক এই বিধান অনুযায়ী প্রকৃত আরোগ্য সাধিত হয়। সেজন্য অজড় মানুষকেই রোগী বলা যুক্তিসংগত।
 



সমাপ্ত




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ