হৃদশূল বা এনজাইনা পেক্টোরিস - Angina Pectories, চতুর্থ বর্ষ - প্যাকটিস অব মেডিসিন

 

 হৃদশূল বা এনজাইনা পেক্টোরিস 
Angina Pectories







হৃদশূল সংজ্ঞা:- ইহার অপর নাম নিওরালজিয়া অব হার্ট। হঠাৎ হৃদপিণ্ড স্থানে বক্ষাস্থি বা স্টার্নমের নিচে অসহা আক্ষেপিক বেদনা হইয়া বামদিকের বা ডানদিকের স্কন্ধ ও হস্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, প্রচণ্ড বেদনাবোধ, মূর্ছা, ঘাম, হাত পা শীতল হইয়া যায়, ইহাকে হৃদশূল বা এনজাইনা পেক্টোরিস বলে।

হৃদশূল কারণ তত্ত্ব:- কারণতত্ত্ব:- নিম্নলিখিত কারণে এই পীড়া হইয়া থাকে।
১) হৃদমাংসপেশীর হঠাৎ অক্সিজেনের চাহিদা পড়িলে বা করোনারী ধমনীর রক স্রোত কমিয়া গেলে করোনারী ধমনীর হৃদমাংসপেশীকে রক্তের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করিতে অক্ষম হইলে এই পীড়া দেখা দিতে পারে।
২) মানসিক উদ্বেগ, ভয়, দৈহিক পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা, একসাথে অতিরিক্ত আহার, হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগানো, রক্ত স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে। 
৩) হাইপার টেনশন, টেকিকার্ডিয়া, হার্টব্লক, কনজেসটিভ কার্ডিয়াক ফেলিওর, নেফ্রাইটিস, রিউমেটিক ফিভার প্রভৃতি পীড়া হইলে।
৪) করোনারী ধমনীর কাঠিন্যতা হেতু।
৫) অতিরিক্ত মদ পান, তাম্রকটু সেবন, প্রভৃতি কারণে । 
৬) বংশগত কারণেও ইহা হইতে পারে।

হৃদশূল লক্ষণাবলী ক্লিনিক্যাল ফিচার:- হৃদশূলের লক্ষণাবলী নিম্নে প্রদত্ত হইল।
১) অকস্মাৎ হৃদপিণ্ড স্থানে আক্ষেপিক বেদনা ও হৃদস্পন্দন, কষিরা ধরার ন্যায় বেদনা। বেদনা ধীরে ধীরে বুক হইতে কাঁধ এবং হাত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ২) বেদনা হঠাৎ আরম্ভ হয়, রোগী অস্থির হইয়া পড়ে। মূখশ্রী বিবর্ণ, সর্ব শরীরে প্রচুর শীতল ঘর্ম হয়। প্রচুর ঘর্ম হইয়া ব্যথা ছাড়িয়া যায় ।
৩) আক্রমণের উপক্রম হইলেই রোগীর সর্ব শরীর আড়ষ্ট এবং দমবন্ধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে। নড়াচড়া করিতে পারে না।
৪) বেদনা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, হঠাৎ আসে আবার ধীরে ধীরে চলিয়া যায়। সাধারণতঃ কাজের সময় হঠাৎ বেদনা আরম্ভ হয়। বুকের বাম দিক হইতে বেদনা শুরু হয়। সুস্থ শরীরে বিশ্রামের সময় সাধারণতঃ দেখা যায় না ।
৫) রক্ত চাপ বৃদ্ধি পায়। নাড়ী শিথিল, দ্রুত অনিয়মিত ও মুখে যন্ত্রণাদায়ক লক্ষণ দৃষ্ট হয়।
৬) সাধারণতঃ ২/৩ মিনিট বা অধিকক্ষণ স্থায়ী হয়। কোন কোন সময় মাথাব্যথা, বমি ভাব, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস দৃষ্ট হয়।

হৃদশূল ডায়াগনোসিস:- পরিশ্রমের সময় রোগী এই পীড়ায় আক্রান্ত হয়। ব্যথার সময় নড়াচড়া করিতে পারে না। স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া থাকে। ব্যথা সামান্য ক্ষণ স্থায়ী হয়। ব্যথা আক্রমণের সময় ঘাম ও শ্বাসকষ্ট থাকে না, আক্রমণের পরে হাঁপাইতে থাকে ও ধর্ম হয়। দেহের তাপ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়। নিম্নলিখিত পরীক্ষায় রোগনির্ণয় করা যায়- Haemogram, Sugar, Urea, Cholesterol, ECG, Chest (PA).

প্রহৃদশূল জটিলতা:- এই পীড়ায় নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দেয়।
১) হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিকতা অস্বাভাবিক রূপ লাভ করে এবং উৎকট উপসর্গের সৃষ্টি হয়।
২) করোনারী আর্টারী আক্রান্ত হইয়া স্ট্রোক হইতে পারে।
৩) করোনারী প্রম্বোসিস হইতে পারে। ৪) অনেক সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া হার্টফেল হইতে পারে।
প্রশ্ন-২.৭৮। হৃদশূল বা এনজাইনা পেক্টোরিসের ভাবীফল লিখ।
উত্তর : ভাবীফল- প্রথম আক্রমণের সময় তেমন মৃত্যুর আশংকা থাকে না। বংশানুক্রমিক পীড়ার আক্রমণ হইলে ভাবী ফল মারাত্মক হয়। আক্রমণের মধ্যেই অনেক সময় রোগী মারা যায়। এই অবস্থাটি করোনারি থ্রম্বোসিসে পরিণত হইলে ভয় বেশী। উপযুক্ত সময়ে সুচিকিৎসা করা হইলে আরোগ্য করা সম্ভ

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:- মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম, অতিভোজন, মাদকদ্রব্য সেবন, ঘুমপান, ঠাণ্ডা লাগানো প্রভৃতি বর্জন করিতে হইবে। আক্রমণাবস্থায় বুকে পরম পুলটিস প্রয়োগ, হাতে পায়ে গরম সেঁক এবং এমিল নাইট্রেটের ঘ্রাণ লওয়ানো উপকারী। স্বাস্থ্যকর স্থানে বসবাস করা উচিত। পীড়া আক্রমণের পর অন্তত পক্ষে ৫/৬ সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন।
পথ্য- লঘু সুপাচ্য ও বলকর পথ্য গ্রহণ করা উচিত। দুধ, মাছ ও ফলাদি সেবন বিধেয়। ডিম, মাংস, মসলাযুক্ত ও গুরুপাক খাদ্য বর্জনীয়। 
ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণাবলী:-
১) একোনাইট— ঠাণ্ডা লাগিয়া বুকে তীব্র বেদনা, বেদনাসহ মৃত্যুভয়, শ্বাসকষ্ট ও আতঙ্ক। চলাফেরায় যন্ত্রণার বৃদ্ধি। হৃদপিণ্ড হইতে বাম বাহু পর্যন্ত বেদনার সঞ্চালন এবং সেই সাথে হাতের আঙ্গুলের অবশতা। নাড়ী পূর্ণ, কঠিন ও লক্ষনশীল। ইহার নিম্নশক্তি ব্যবহার্য।
২) এমিল নাইট— পীড়ার আক্রমণাবস্থায় ইহা মূল্যবান ঔষধ। হৃদপিণ্ডের চারিধারে যন্ত্রণা ও সংকোচন। অত্যন্ত জোরে বুক ধড়ফড়ানি। বুকের মধ্যে যেন কি লাফাইতে থাকে। হৃদপিণ্ড ভার বোধ, বামকানের নীচের ধমনী ও গ্রন্থি দপদপ করে। রুমালে ৫/৬ ফোঁটা মূল ঔষধ চালিয়া ঘ্রাণ নিলে শীঘ্রই বেদনা অন্তর্হিত হয়।
৩) ক্যাকটাস গ্রান্ডি— হৃদপিণ্ডের উপর যেন ভারী কিছু চাপানো আছে।
বক্ষদেশ মনে হয় একবার জোরে মুঠা করিয়া চাপিতেছে, আবার ছাড়িয়া দিতেছে।
বুকে তীব্র বেদনা ও শ্বাসকষ্ট। বুক ধড়ফড়ানি। রোগী যেন দম বন্ধ হইয়া মূর্ছার মত
হইয়া পড়ে।
৪) গ্লোনয়িন- পীড়ার আক্রমণাবস্থায় ইহা উৎকৃষ্ট ঔষধ। হৃদশূল পীড়ায় রক্ত বেগে হৃদপিণ্ডে ধাবিত হওয়ায় হৃদপিণ্ডের মধ্য পাখীর ঝাপটানির ন্যায় স্পন্দন। মনে হয় হৃদপিণ্ড ফাটিয়া যাইবে। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, বুক হইতে বেদনা সারা দেহে ছড়াইয়া পঢ়ে। শেষে হাত পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
৫) ম্যাগফল- বক্ষে সংকোচনবৎ বেদনা, এই বেদনা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়। ইহা ছাড়া লক্ষণানুসারে এই পীড়ায় ক্রাটিগাস, স্পাইজেলিয়া, ক্যালমিয়া, ডিজিট্যালিস, লাইকোপাস প্রভৃতি ঔষধও ব্যবহৃত হয়।


হৃদপেশীর পীড়া 
Myocardiac Infarction






হৃদপেশীর পীড়ার সংজ্ঞা:- হৃদপিণ্ড পেশীর তন্তুসমূহের প্রদাহ হইলে তাহাকে মায়োকার্ডিয়াক ইনফার্কশন বলে।
 
হৃদপেশীর পীড়ার কারণ তত্ত্ব:- মায়োকার্ডিয়াক ইনফার্কশনের কারণগুলি নিম্নরূপ-
১) পেরিকার্ডাইটিস বা এন্ডোকার্ডাইটিস অথবা উভয় প্রকারের প্রদাহ বিস্তৃত হইয়া এই পীড়া উৎপন্ন  
২) করোনারী থ্রম্বোসিস ও করোনারী এম্বোলিজম । 
৩) তরুণ রিউম্যাটিক বাত, ঠাণ্ডা লাগা, আঘাত বা অন্যান্য কারণে পীড়ার হয়। 
৪) ডিপথিরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া প্রভৃতি সংক্রামক পীড়ার উপসর্গরূপে ।
৫) রক্তক্ষরণ বা চরমভাবে রক্তের চাপ কমিয়া যাওয়া।

হৃদপেশীর পীড়ার লক্ষণাবলী ক্লিনিক্যাল ফিচার:- এই পীড়ায় নিম্নলিখিত লক্ষণাবলী দৃষ্ট হয় । 
১) হৃদপিণ্ডের বেদনাই প্রধান লক্ষণ। বেদনা হঠাৎ আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাইতে থাকে।
২) অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাম নিলয়ের উৎকট ব্যর্থতা দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুসের জলস্ফীতি ও বেদনা ।
৩) মাইট্রাল ভালব দুর্বল হইলে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন রক্তাধিক্য, লিভার স্ফীতি, জণ্ডিস, অস্ত্রমধ্যে পিত্ত নিয়মিত প্রবেশ না করিলে কোষ্ঠকাঠিন্য, শিরাস্ফীতি, পায়ে শোথ, সর্বাঙ্গের ফোলা, উদরী, স্বল্প প্রস্রাব, বুক ধড়ফড় করা। 
৪) ট্রাইকাসপিড ভালবের পীড়ায় হৃদপিণ্ড দুর্বল হইলে হাত পায়ের আঙ্গুল, ঠোঁট, মুখ নীলবর্ণ হয়। শিরাসমূহের রক্তাধিক্য ভাব, এলবুমিনুরিয়া ।
৫) এওটিক ভালবের পীড়ায় হৃদপিণ্ড দুর্বল হইলে হৃদযন্ত্রে বেদনা, ঐ বেদনা সমস্ত বাহুতে ছড়াইয়া পড়ে, বুক ধড়ফড়ানি, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, পা ফোলা, পক্ষাঘাত, অনিদ্রা প্রভৃতি দেখা দেয় ।

হৃদপেশীর পীড়ার ডায়াগনোসিস:-
১) রোগীর লক্ষণ দ্বারা রোগ নির্ণয় করা যায়।
২) রক্ত পরীক্ষায় TC, DC. এবং ESR বাড়ে। SGOT এবং SGPT বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।
৩) ইসিজি করিলে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন দেখা যায় ।
৪) বুকের এক্সরে করিলে তাহাতে পালমোনারী ঈডিমা পাওয়া যায়। 

জটিলতা:- এই পীড়ায় নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দেয়। ১) কার্ডিওজেনিক শক হইতে পারে।
২) কার্ডিয়াক ফেলিওর হইতে পারে।
৩) পালমোনারী এম্বোলিজম।
৪) এরিদমিয়া।
৫) রাপচার অব দি হার্ট।
৬) পোস্ট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন সিনড্রোম প্রভৃতি । 

হৃদপেশীর পীড়ার ভাবীফল:-পীড়া গুরুতর আকার ধারণ করিলে রোগীর মৃত্যু হয়। তাহা ছাড়া কনজেসটিভ কার্ডিয়াক ফেলিওরের লক্ষণাদি প্রকাশ পায়। শক, সিভিয়ার হার্ট ফেলিওর, ডায়াবেটিস মেলিটাস, পালমোনারী এম্বোলিজম, এরিদমিয়া, হার্ট ব্লক প্রভৃতি রোগ সঙ্গে থাকিলে মৃত্যুর আশংকা অধিক । 

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও পথ্য:- উত্তেজক কোন আহার দেওয়া উচিত নয়। রোগীর যাহাতে পায়খানা প্রস্রাব ঠিকমত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। ভাল হজম করিতে পারে এমন লঘু পথ্য অল্প অল্প করিয়া বার বার দিতে হইবে। অতিভোজন রোগ বৃদ্ধির কারণ। রোগীকে পূর্ণ বিশ্যামে থাকিতে হইবে। বার বার উঠা বসা করিলে হৃদপিণ্ডের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পরিশ্রমের কাজ, সিড়ি বা পর্বতারোহণ, দৌড় ঝাঁপ নিষেধ। প্রয়োজন হইলে শক ও বুক ব্যথার উপশমের জন্য কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন দিতে হইবে।
ব্যবহৃত ৫টি ঔষধের নির্দেশক লক্ষণ:-
১) একোনাইট— হঠাৎ পীড়ার আক্রমণ, বেদনায় রোগী ছটফট করে, মৃত্যুভয়, শ্বাসকষ্ট ও আতঙ্ক।
২) আর্ণিকা- আঘাত, পতন ও নিষ্পেষণজনিত হৃদরোগ। কেহ স্পর্শ করিলে বা কাছে আসিলে ভয় পায়। হৃদপিণ্ডে খোঁচামারা ব্যথা, নাড়ী দুর্বল, শ্বাসকষ্ট।
৩) এসাফিটিডা- রোগী হিস্টিরিয়া ও অবসাদ বায়ুমন্ত। হৃদপিণ্ডে আক্ষেপিক সংকোচন। ফুসফুস যেন যথাযথভাবে প্রসারিত হইতে পারে না। মস্তকের ভিতর দিক হইতে বাহিরে চাপবোধ।
৪) ক্যাকটাস প্রাপ্তি- হৃদপিণ্ড ও ধমনীর উপর বিশেষ ক্রিয়া। নির্দিষ্ট সময়ে রোগাক্রমণ ও আক্ষেপ জনক বেদনা। হৃদপিণ্ডে রক্তাধিক্য, ধমনীগুলি দপদপ করে।
৫) ডিজিট্যালিস- বুক ধড়ফড় করে, নাড়ী ক্ষীণ ও শ্বাসকষ্ট। বুকে সুঁচ ফোটানো ব্যথা অনুভব। মুখ ও ঠোঁট বেগুনীবর্ণ হয়। ইহা ছাড়া এই পীড়ায় লক্ষণানুসারে স্পাইজেলিয়া, হিপার সালফ, অরাম মেট, ক্যানাবিস প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহৃত হয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ