প্রসূতিবিদ্যা (Midwifery) তৃতীয় বর্ষ - প্রথম অধ্যায়

প্রথম অধ্যায়
প্রসূতিবিদ্যা
(Midwifery)




প্রশ্ন- ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতিবিদ্যা বা মিডওয়াইফারী বা অবসটেট্রিক্স কাহাকে বলে?

উত্তর : ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতিবিদ্যা বা মিডওয়াইফারী বা অবসটেট্রিক্স-
ধাত্রীবিদ্যার ইংরেজী Obstetrics শব্দটি ল্যাটিন ওয়ার্ড Midwife হইতে আসিয়াছে। পূর্বে শব্দটি ব্যবহৃত হইত। বর্তমানে Obstetrics শব্দটি ব্যবহার হয়। এ যাবতকাল ধাত্রীবিদ্যা Obstetrics শব্দটি ব্যবহার হয়। এ যাবতকাল ধাত্রীবিদ্যা ও প্রসূতিবিদ্যাকে জন্মপূর্ব, জন্মলগ্ন ও প্রসবোত্তরকালীন অস্বাভাবিক লক্ষণ উপশম বা নিরাময়ের জন্য টেকনিক্যাল দক্ষতাকে কাজে লাগানোর বিদ্যাকে ধরিয়া নেওয়া হইত। কিন্তু বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যাকে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা ও পরিচর্যার বিস্তৃত জ্ঞানভাণ্ডার হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এই জ্ঞানকে তাহাদের রোগ প্রতিরোধক, আরোগ্যকারী ও স্বাস্থ্যেন্নয়নের বহুমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা হয়। ধাত্রীবিদ্যা একটি প্রাচীনতম চিকিৎসা বিদ্যা। সংক্ষেপে বলিতে গেলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে শাখায় মায়ের গর্ভ, প্রসব ও প্রসবোত্তরকালীন স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক অবস্থার উপস্থিতি ও ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়, মায়ের দেহের মধ্যে সন্তান কেমন করিয়া দিনে দিনে বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত কিভাবে একটা পৃথক প্রাণীরূপে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করে-সেই আলোচিত বিদ্যাকে ধাত্রীবিদ্যা বা Midwifery বা Obstetrics বলে।




প্রশ্ন- প্রসূতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আলোচনা কর।
বা, ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ে জ্ঞান লাভের প্রয়োজতীয়তা কি?

উত্তর : প্রসূতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব- সৃষ্টির আদিকাল হইতেই প্রাণীজগতে দুইটি নিয়ম প্রচলিত-একটি প্রাণীর জীবন-ধারণ আর একটি প্রাণীর জীবন শেষ হইবার পূর্বে তাহার মত একটি প্রাণীকে পৃথিবীতে রাখিয়া যাওয়া। একটি প্রাণী কিভাবে একটি প্রাণীকে পৃথিবীতে আনিতেছে আর তার আধারই বা কি তাহাও জানা দরকার। গর্ভাবস্থা হইতে প্রসবোত্তর কাল পর্যন্ত মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে যত্ন নেওয়া প্রসূতিবিদ্যা পাঠের মূল লক্ষ্য। মাতৃজাতিই দেশের ভবিষ্যত বংশধরদের জননী ও ধাত্রী, তাহারা সুস্থ সবল না থাকিলে দেশ ও জাতির কল্যাণ আশা করা যায় না। গর্ভবতীর পরিচর্যা, সন্তান প্রসব, নবজাতকের সেবা ইত্যাদি নিয়াই ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতি বিদ্যার ক্ষেত্র। এই ধরণের সেবা কার্যে প্রসূতি বিদ্যা সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানার্জন আবশ্যক। মায়ের স্বাভাবিক গর্ভকালীন যত্ন, শিশুর যত্ন, স্বাভাবিক প্রসবকালীন ব্যবস্থাপনা, প্রসবোত্তরকালীন যত্ন এবং গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন অস্বাভাবিক অবস্থার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় অনেক জননী ও শিশু অকালে প্রাণ হারায়। মা ও শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার জন্য এবং গর্ভবতীর জটিল অবস্থাগুলি নিরসরণের জন্য, প্রসব ও প্রসবোত্তরকালীন অসুবিধা ও বিপদ লাঘবের জন্য ধাত্রীবিদ্যার জ্ঞান অপরিহার্য। ধাত্রীবিদ্যার জ্ঞান মা ও শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতিতে যথেষ্ট সাহায্য করে। তাই সকল চিকিৎসক ও সেবাকারীদের প্রসূতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে।




প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিতে ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতিবিদ্যা (মিডওয়াইফারী) পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

উত্তর : হোমিওপ্যাথিতে ধাত্রীবিদ্যা বা প্রসূতিবিদ্যা (মিডওয়াইফারী) পাঠের প্রয়োজনীয়তা- হোমিওপ্যাথি সারা বিশ্বে বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠিত আদর্শ বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। রোগীকে বিনা ক্লেশে নিরোগ করত সুস্থ করিয়া তোলাই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা মায়ের গর্ভধারণ কাল হইতে সন্তান প্রসব ও নবজাতকের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রসূতিবিদ্যায় মাতৃজাতির গর্ভ, প্রসব ও প্রসবোত্তরকালীন স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক অবস্থার বিভিন্ন জটিলতা, সমস্যাবলী ও উহার ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়। গর্ভবতীর সুপরিচর্যা করতে এবং সুস্থ সন্তান প্রসব ও নবজাতকের বিবিধ উপসর্গের প্রতিকার করার জন্য জ্ঞান অর্জন ছাড়া সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ধাত্রীবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অবশ্যই মনে রাখা দরকার। সহজ প্রসব, গর্ভের স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক অবস্থা, প্রলম্বিত প্রসব প্রভৃতি, ক্ষেত্রে হোমিওপাথিতে কার্যকর ঔষধ রহিয়াছে। প্রসূতিবিদ্যার জ্ঞান থাকিলে গর্ভের বিভিন্ন অবস্থা এবং গর্ভিনী মাতার পেলভিস এবং এনাটমী সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় এবং বিভিন্ন অবস্থায় কোন ঔষধটি প্রযোজ্য তাহা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করিয়া সু-প্রসবের ব্যবস্থা করানো সম্ভব। প্রসূতিবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের আবশ্যকতা হোমিওপ্যাথি উপলব্ধি করে বলিয়াই আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেখানে অনেক সময় সার্জারী ছাড়া উপায় থাকে না। সেখানে হোমিওপ্যাথি অতি সহজেই সুনির্বাচিত ঔষধ দ্বারা প্রসব-কার্য সমাধা করিতেছে। তাই হোমিওপ্যাথিতে প্রসূতিবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।




প্রশ্ন-  পেলভিস বা বস্তিদেশ বলিতে কি বুঝ?

উত্তর: পেলভিস দেখিতে অনেকটা তলাবিহীন কাপের ন্যায়, ইহা একটি গহ্বর বিশেষ। ইহার চারিদিক অস্থি দ্বারা গঠিত। পেলভিসের ভিতরেই সন্তান উৎপাদনের সমস্ত যন্ত্রগুলি পরস্পর সাজানো আছে। শুধু তাহাই নয় প্রসব সময়ে সন্ত ান এই পেলভিসের মধ্য দিয়াই বাহিরে আসে।
পেলভিস বা বস্তিদেশ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা-
ক) ফলস পেলভিস, খ) ট্র পেলভিস।




প্রশ্ন-  ফলস পেলভিস  (False Pelvis) কি?

উত্তর: ফলস পেলভিস (False Pelvis): ইহা সাধারণ বস্তি। বস্তির সহিত প্রসব ক্রিয়ার কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই তবে প্রসব কার্যের সাহায্যকারী পেশীগুলিকে সংযুক্ত করে এবং গর্ভকালীন জরায়ুর ভার বহন করে। শুধু তাহাই নয় প্রসব ব্যথা উঠিবার সময় শিশুকে বাহিরে পথে চালনা করিতে সাহায্য করে। সাধারণ অবস্থায় ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ অস্ত্রের দ্বারা ফলস পেলভিস গহ্বর ভরিয়া থাকে, কিন্তু গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ঐ স্থান প্রধানত পরিবর্ধিত জরায়ু দ্বারা পূর্ণ থাকে।




প্রশ্ন-  ট্রু পেলভিস (True Pelvis) কি?

উত্তর: ট্র পেলভিস (True Pelvis): ইহার নাম প্রসব বস্তি। ফলস পেলভিস বা সাধারণ বস্তি যেখানে শেষ হইয়াছে সেখান হইতেই প্রসব বস্তি বা ট্র পেলভিস আরম্ভ হইয়াছে। প্রসব বস্তি যেখানে আরম্ভ হইয়াছে তাহাকে উহার প্রবেশ পথ এবং যেখানে উহা শেষ হইয়াছে তাহাকে উহার বহির্দ্দার বলে। প্রবেশ পথ ও বহির্দারের মধ্যস্থ স্থানটুকুই প্রসব বস্তি গহ্বর (Pelvic Cavity)। প্রসব বস্তিদেশের পশ্চাৎদিকে সেক্রাম ও ককসিক্স, পার্শ্বে ইস্কিয়াল অস্থি এবং সামনে পিউবিক অস্থি।
প্রবেশ পথ, বহির্দার এবং গহ্বর লইয়াই প্রসব বস্তি গঠিত হইয়াছে। এই বস্তি গহ্বরের সামনের দিকে কম চওড়া ও ফাঁক বেশী এবং ইহার পিছন দিকে সামনের দিকের চাইতে প্রায় দুই ইঞ্চি বেশী লম্বা। প্রসব বেদনার পূর্বে শিশুর মাথা প্রবেশপথের উপরে থাকে এবং ধীরে ধীরে বস্তি গহ্বরে প্রবেশ করে। ইহা একটি বাঁকা নলের মত লম্বা এবং ইহার ভিতর দিয়াই শিশু ভূমিষ্ট হইবার সময় বাহির হইয়া আসে।




প্রশ্ন-  সাধারণ বস্তির (ঋধংব চবষারং) সীমানা ও প্রসব বস্তির (True Pelvis) সীমানা আলোচনা কর।

উত্তর: সাধারণ বস্তির (Fase Pelvis) সীমানা- যে রেখা সাধারণ এবং প্রসব বস্তিকে আলাদা করিয়া রাখিয়াছে তাহার উপরের অংশটুকু সাধারণ বস্তি। ইহার পিছন দিকে শিরদাঁড়ার নিম্নাংশ, উভয় পার্শ্ব অনতিগভীর ইলিয়াক খাত এবং সম্মুখ দিকে উদর প্রাকারের নিম্নাংশ থাকে।
প্রসব বস্তি গহ্বরের (True Pelvis) সীমানা- সন্মুখে পিউবিক অস্থির উপরে নিচের প্রসারিত অংশদ্বয় ও উহাদের সন্ধিস্থল। পশ্চাতে-সেক্রাম বা ত্রিকাস্থি ও ককসিক্স এবং সম্মুখের দিক।
দুই পার্শ্বে- ইলিয়ামের দেহাংশ এবং ইস্কিয়ামের দেহাংশ ও উপরের দিকের প্রসারিত অংশে মিলাইয়া যে চতুষ্কোণ অস্থি তৈয়ারী হয়, তাহা বর্তমান আছে।




প্রশ্ন- স্বাভাবিক স্ত্রী বস্তিদেশের গঠন প্রণালী লিখ। কয়টি অস্থি নিয়া পেলভিস গঠিত?

উত্তর: বস্তিদেশ অস্থি, শক্ত বন্ধনী বা লিগামেন্ট ও পেশী দিয়া ঘেরা। ইহার আকার তলহীন পেয়ালার ন্যায়। বস্তি গহ্বরের ভিতর স্ত্রী লোকের যে জরায়ু এবং ডিম্বাধারাদি রহিয়াছে তাহা এই বস্তিদেশই রক্ষা করে। এই বস্তি গহ্বরের চারিদিক অস্থি দ্বারা সুরক্ষিত। ইহার ভিতরের দিক মসৃণ এবং বাহিরের দিক অমসৃণ, বাহিরের দিক অমসৃণ হওয়ায় মাংসপেশী দৃঢ়ভাবে আটকাইয়া থাকিতে পারে। বস্তি গহ্বরের পিছনদিক সামনের দিকে চেয়ে বেশী গভীর, বেশী লম্বা এবং মজবুত। দাঁড়াইয়া থাকিবার সময় বা চলাফেরা করার সময় দেহের ভার এই বস্তিদেশের মাধ্যমে নিম্নাংশে স্থানান্তরিত হয়।










অস্থিসমূহ- চারিটি অস্থি লইয়া অস্থিময় বস্তিদেশ গঠিত। বস্তিদেশের দুইপাশে দুইটি হিপবোন, পিছনে সেক্রামের নিচে ককসিক্স। হিপ বোনকে তিন ভাগে ভাগ করা হইয়াছে। যথা-ক) ইলিয়াম, খ) ইস্কিয়াম, গ) পিউবিক অস্থি।




প্রশ্ন- স্ত্রী পেলভিসের প্রকারভেদ লিখ।

উত্তর: স্ত্রী পেলভিসের প্রকারভেদ- স্ত্রী পেলভিস চার রকম হইয়া থাকে।
ক) গাইনিকয়েড, খ) অ্যানড্রয়েড, গ) অ্যানথ্রোপয়েড, ঘ) পাটিপেলয়েড।
১) গাইনিকয়েড (Gynaecoid): ইহাই স্বাভাবিক পেলভিস। প্রায় ৫০% মহিলার বস্তি এইরূপ।
২) অ্যানড্রয়েড (Android): ইহা পুরুষদের পেলভিসের মত। এই প্রকার বস্তির প্রবেশপথের আকার ক্রিকোণাকার হওয়ায় বস্তিদেশের জায়গা হ্রাস পায়। এই ধরনের বস্তিদেশের ভিতর দিয়া মাথা বাহির হওয়া খুবই কঠিন। ফলে যোনীদ্বার ও
মলদ্বারের মর্ধবর্তী ছিঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রায় ২০% বস্তি এই ধরনের।
৩) অ্যানথ্রোপয়েড (Anthropoid): ইহা বানরের পেলভিসের মত। শিশুর মস্তক প্রবেশপথে সম্মুখ হইতে পিছনের ব্যাস বরাবর থাকে। কখনও কখনও পিছনের অক্সিপিট পিছন দিকে থাকিলে এই অবস্থাতেই মস্তক বস্তিদেশ দিয়া বাহির হয় এবং মুখ পিউবিসের দিকে রাখিয়া শিশু প্রসব হয়। এই প্রকার বস্তির সংখ্যা ২৫%।
 ৪) পাটিপেলয়েড (Platypeloid): ইহা ফ্ল্যাট অর্থাৎ সমতল পেলভিসের মত। বস্তিদেশের দৈর্ঘ্য বা সম্মুখ হইতে পশ্চাৎ দিকের ব্যাস কম এবং প্রবেশ পথের গ্রন্থ বাসে শিশুর মাথা আঁটিয়া বসে। ইহার সংখ্যা ৫%।




প্রশ্ন-  বস্তিদেশের সংকোচন বা পেলভিক কন্ট্রাকশন কাহাকে বলে? 

উত্তর: বস্তিদেশের সংকোচন বা পেলভিক কন্ট্রাকশন- বস্তিদেশের ব্যাস যখন এত ছোট হয় বা কমিয়া যায় যে, প্রসবকালীন সময়ে উহার মধ্য দিয়া সন্তান ডেলিভারী সহজতর হয় না বা স্বাভাবিক প্রসব কৌশল ব্যাহত হয় এবং প্রসবে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করিতে হয়। বস্তিদেশের এই অবস্থা হইলে তাহাকে পেলভিক কন্ট্রাকশন বলে।



প্রশ্ন- সংকুচিত বস্তিদেশের বা কন্ট্রাকটেড পেলভিসের প্রকারভেদ লিখ। 

উত্তর: সংকুচিত বস্তিদেশের বা কন্ট্রাকটেড পেলভিসের প্রকারভেদ- বস্তি দেশের এক বা একাধিক ব্যাস এত কমিয়া যায় যে স্বাভাবিক প্রসব কৌশল ব্যাহত হয়। বস্তিদেশের এই অবস্থা হইলে তাহাকে বস্তিদেশের সংকোচন বলা হয়। নিম্নে সংকুচিত বস্তিদেশের প্রকারভেদ আলোচনা করা হইল।
১) র‍্যাকাইটিস ফ্ল্যাট পেলভিস- শিশুদের অস্থি বিকৃতি রোগের ফলে বস্তি দেশের দৈর্ঘ্য বা সম্মুখ হইতে পশ্চাৎ দিকের ব্যাস কমিয়া যায়। এক সময়ে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অধিক ছিল। বর্তমানে উপযুক্ত খাদ্য ও ভিটামিন 'ডি' ব্যবহারের ফলে এই রোগের হার অনেক কম।
২) জেনারেল কনট্রাকটেড পেলভিস খর্বাকৃতি স্ত্রীলোকদের বস্তিদেশ সাধারণতঃ স্বাভাবিক স্ত্রী বস্তিদেশ অপেক্ষা ছোট। ইহার স্বাভাবিক গঠন ঠিক থাকিলেও সবগুলি ব্যাসই সমানুপাতিক ভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। এই রকম বস্তি মোটামুটি স্বাভাবিক অথচ সংকুচিত।
৩) অ্যাসিমেট্রিক্যাল পেলভিস- বস্তিদেশের বাড়িবার মুখে যদি উহার অসম চাপ পড়ে তাহা হইলে বস্তিদেশে অসম হয় এবং তাহাকে অসম বস্তিদেশ বলে। হিপ ও স্পাইনের অসুখের জন্য এইজন্য এইরূপ হইয়া থাকে।




প্রশ্ন- সংকুচিত বস্তিদেশের বা কন্ট্রাকটেড পেলভিসের বিরল অস্বাভাবিকতাগুলি কি।

উত্তর: অন্যান্য বিরল অস্বাভাবিকতা- সংকুচিত বস্তিদেশের বা কন্ট্রাকটেড পেলভিসের বিরল অস্বাভাবিকতাগুলি নিম্নরূপ। যথা-
ক) অস্টিওম্যালেসিক পেলভিস- অস্টিওম্যালেসিয়া রোগের দরুন বস্তিদেশের পার্শ্ব দুইটি ভিতরের দিকে ঢুকিয়া যায় এবং অপরদিকে দেহের ভার স্পাইনের মাধ্যমে প্রোমোন্টারির উপর পড়ায় প্রোমোন্টারির ত্রিকাস্থি সামনের দিকে সরিয়া যাইবার দরুন বস্তিদেশের সংকোচন হয়। ইহাই অস্টিওম্যালেসিক পেলভিস।
খ) স্পনডিলোলিসথেটিক পেলভিস পাঁচটি কটিদেশীয় অস্থির সর্বাপেক্ষা নিচেরটির সম্মুখের দিকে হড়কাইয়া ত্রিকাস্থির উপর চলিয়া যাইবার ফলে ট্র কনজুগেটের অত্যধিক সংকোচন হয়। এইরূপ সংকুচিত পেলভিসকে স্পনডিলোলিসথেটিক পেলভিস বলে।
গ) নেগেলিস পেলভিস- একপার্শ্বে ত্রিকাস্থির ডানার মত অংশ বাড়িতে ঠিক মত বৃদ্ধি না হইবার ফলে ত্রিকাস্থি ও ইলিয়ামের সন্ধি দুইটি একসাথে মিলিয়া যাওয়ার বস্তিদেশের যে অত্যধিক সংকোচন হয় তাহার নাম রবার্টস পেলভিস।
ঘ) রবার্টস পেলভিস- বস্তিদেশের উভয়দিকে ত্রিকাস্থির ডানার মত অংশের ঠিক মত বৃদ্ধি না হইবার ফলে ত্রিকাস্থি ও ইলিয়ামের সন্ধি দুইটি একসাথে মিলিয়া যাওয়ায় বস্তিদেশের সংকোচন হয় তাহার নাম রবার্টস পেলভিস।



প্রশ্ন-  বস্তিদেশের সংকোচন বা পেলভিস কন্ট্রাকশনের কারণ কি কি? 

উত্তর: বস্তিদেশের সংকোচন বা পেলভিস কন্ট্রাকশনের কারণ-
ক) জন্মগত ত্রুটি-
১) ছোট গোল পেলভিস।
২) পুরুষের মত বা ফানেল আকৃতি পেলভিস।
৩) ছোট এন্ডোপয়েড পেলভিস।
৪) চ্যাপ্টা পেলভিস।
খ) আঘাত বা পীড়া-
১) ভাঙ্গা পেলভিস।
খ) রিকেটিক চ্যাপ্টা পেলভিস।




প্রশ্ন- বস্তিদেশের সংকোচন বা পেলভিস কন্ট্রাকশনের ডায়াগনোসিস ও ব্যবস্থাপনা লিখ।

উত্তর: পেলভিক কন্ট্রাকশনের ডায়ানোসিস-
১) প্রসবের পূর্বে বস্তিদেশ পরীক্ষা করিলে (এক্সরে দ্বারা) কন্টাকশন ধরা পড়ে।
২) গর্ভাবস্থায় ছয় সপ্তাহের পরও শিশুর মাথা বস্তিদেশে অবস্থান করে না এবং প্রসব নিকটবর্তী হইলেও সন্তানের মাথা এনগেজ হয় না।
৩) যোনিপথ পরীক্ষা দ্বারা বস্তিদেশের এবং ডায়াগগোনাল কনজুগেটের প্রশস্ত তা নির্ণয় করা। আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দেখিতে হইবে হইবে যে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সেক্রামের অন্তর্মুখী উন্নত অংশের উপর রাখা সম্ভব কিনা।
৪) প্রথম গর্ভবতী নারী যদি খুবই খর্বাকৃতি হয়।
৫) শিশুর অবস্থিতি পেটের উপর হাত দিয়া ঘুরাইয়া স্বাভাবিক অবস্থিতিতে আনিবার চেষ্টা ব্যর্থ হইবার পরও প্রথম গর্ভবতীর যদি বস্তি উপস্থিতি থাকে।
পেলভিক কন্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা-
গর্ভস্থ শিশুর মাথা ছোট হইলে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব। প্রসবের দ্বিতীয় ধাপে দেরী হইলে মাতার বা শিশু ডিসট্রেস দেখা দিলে প্রসব সময় কমানোর জন্য ফরসেপসের সাহায্য নেওয়া যাইতে পারে।




প্রশ্ন-  বস্তিদেশ সংকোচনে বা পেলভিক কনট্রাকশনে প্রসবের সম্ভাব্য ফলাফল কিরূপ?

উত্তর: শুধুমাত্র বস্তিদেশের আকার ও গঠনের উপর প্রসবের ফলাফল ঠিক করা সম্ভব নয়। কতকগুলি কারণের উপর প্রসবের উপর প্রসবের ফলাফল নির্ভর করে। যেমন-
১) প্রসবের আকার, ২) শিশুর মস্তকের অবস্থান, ৩) জরায়ুর উপরাংশের শক্তি- যে শক্তি বলে শিশুর দেহ লম্বা হইয়া যায় এবং মাথা নিচের দিকে নামে। ৪) শিশুর মাথা হেট এর পরিমাণ এবং শিশুর চিবুক বুকের উপর ঝুঁকিয়া পড়িবার পরিমাণ, ৫) শিশুর মস্তকের মোলডিং বা মস্তকের আয়তন কমিয়া যাওয়া।
স্বাভাবিক প্রসবের অন্তরায় সৃষ্টি হয় যদি-
ক) শিশুর আকার বড় হয়।
খ) জরায়ুর সংকোচন খুব কম হয়।
গ) শিশুর মস্তকের পশ্চাৎভাগের টিবি পশ্চাত দিকে অবস্থান করে।




প্রশ্ন-  জরায়ুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

উত্তর: জরায়ুর বর্ণনা- জরায়ু একটি পেশী জাতীয় ফাঁপা অংগ। কুমারী অবস্থায় জরায়ুর আকৃতি অনেকটা উল্টানো নাশপাতির ন্যায়। ইহার সামনে মূত্রথলী এবং পেছনে মলাশয় অবস্থিত। ইহা ৭.৫ সে.মি. লম্বা, ৫ সে.মি. চওড়া ও ২.৫ সে.মি. পুরু।

জরায়ুর তিনটি অংশ। যথা- ফান্ডাস, বডি ও সারভিক্স।

ফান্ডাস- জরায়ুর যেখানে ডিম্ববাহী নল দুইটি সংযুক্ত হইয়াছে তাহার উপরের অংশকে ফান্ডাস বলে।

বডি- ফান্ডাসের নিচের অংশকে বডি বলা হয়। বডির নিচের অংশ ক্রমশ সরু।

সারাভিক্স- বডির নিচের সরু অংশকে সারাভিক্স বলা হয়। সারাভিক্সের ফাঁকা স্থানের এক প্রান্ত উপরের দিকে জরায়ুর গহ্বরে সংযুক্ত হয়, ইহাকে ভিতরের অস বলা হয় এবং অপর প্রান্ত যোনিপথের সঙ্গে সংযুক্ত। ইহাকে বাহিবের অস বলা হয়।

জরায়ুর গঠন- তিনটি উপাদান দ্বারা জরায়ু গঠিত হইয়াছে। যথা- ১) মাসকুলার স্ট্রাকচার, ২) লাইনিং মেমব্রেন ও ৩) কভারিং মেমব্রেন।

১) মাসকুলার স্ট্রাকচার- জরায়ুর প্রাচীর মাসল ফাইবার দ্বারা গঠিত। ইহার প্রধান কাজ প্রসবের সময় ভ্রুণ এবং প্লাসেন্টাকে (ফুল) বাহির পথে চালিত করা। প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ করা।
২) লাইনিং মেমব্রেন- ইহা মিউকাস মেমব্রেন। ইহাতে বলা হয় এন্ডোমেট্রিয়াম। ইহা জরায়ু দেহ জুড়িয়া বিস্তৃত আছে। ইহা কলামনার সেল দ্বারা গঠিত। সেলগুলির সাহায্যেই গ্ল্যান্ডের উৎপত্তি হইয়াছে এবং গ্ল্যান্ডগুলি আকারে টিউবের মত।
৩) কভারিং মেমব্রেন বা সিরাস স্তর- ইহা পেরিটোনিয়ামকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে। ইহা দৃঢ় সিরাস মেমব্রেন ইহার পার্শ্বদয় দ্বারা ব্রড লিগামেন্ট গঠিত পেরিটোনিয়াম জরায়ুর পাশে যুক্ত থাকে না, ফলে গর্ভাবস্থায় জরায়ু বাড়িতে পারে।




প্রশ্ন-  জরায়ু বন্ধনী বা লিগামেন্টসমূহ কি কি বর্ণনা দাও।

উত্তর : জরায়ু বন্ধনী বা লিগামেন্টসমূহ- বস্তি গহ্বরের তলদেশ পরোক্ষভাবে জরায়ুকে যথাস্থানে অবস্থিতিতে সাহায্য করিলেও কয়েকটি বন্ধনী প্রত্যক্ষভাবে জরায়ুকে যথাস্থানে রাখিতে সাহায্য করে। সাহায্যকারী বন্ধনীগুলি হইল-১) ব্রড লিগামেন্টস, ২) ট্রানসভার্স সার্ভাইক্যাল লিগামেন্টস, ৩) রাউন্ড লিগামেন্টস, ৪) ইউটারো সেক্রাল লিগামেন্টস।
১) ব্রড লিগামেন্টস- ইহা পেরিটোনিয়ামে জোড়া ভাঁজ। ইহা জরায়ুর পাশ হইতে বাহির হইয়া সেক্রো-ইলিয়াক জয়েন্টের সামনে পেলভিসের দুই পার্শ্বে যুক্ত আছে। ইহা ফ্যালোপিয়ান টিউব, ওভারি ও রাউন্ড লিগামেন্টের উপর চাদরের মত আবরণ স্বরূপ।
২) ট্রানসভার্স সার্ভাইক্যাল লিগামেন্টস- ব্রড লিগামেন্টের তলভাগ ফাসা,
ফাইব্রাস টিসু এবং পেশী দ্বারা অধিকতর সুদৃঢ় হইয়াছে। ইহা জরায়ুকে যথাস্থানে ধারণ করিয়া আছে। প্রসবের সময় যদি কোন কারণে ইহার ক্ষতি হয় তাহা হইলে জরায়ুর স্থানচ্যুতি ঘটে, জরায়ু নিচের দিকে নামিয়া যায়।
৩) রাউন্ড লিগামেন্টস- ইহা জরায়ু ফান্ডাসের নিকট হইতে আরম্ভ হইয়া লোবিয়া মেজোরে শেষ হইয়াছে। জরায়ুকে এন্টিভার্টেস এবং এন্টিফ্লেক্সড পজিশানে রাখিতে সাহায্য করে।
৪) ইউটারো সেক্রাল লিগামেন্টস- ইহা জরায়ুর পশ্চাৎভাগ হইতে আরম্ভ হইয়া সেক্রামে গিয়া শেষ হইয়াছে। ইহারা জরায়ু গ্রীবাকে পিছন দিকে টানিয়া রাখিয়া জরায়ুর সর্বোচ্চ অংশ (ফান্ডাস) সামনের দিকে হেলানো অবস্থায় রাখিতে সাহায্য করে।




প্রশ্ন- জরায়ুর কার্যাবলী কি কি লিখ।

উত্তর: জরায়ুর কার্যাবলী নিম্নে উল্লেখ করা হইল-
ক) জরায়ু ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশে বিশেষভাবে অংশ গ্রহণ করে।
খ) নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুতে প্রবিষ্ট হওয়ার পর বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে পূর্ব প্রস্তুতিকৃত আন্তজরায়ু স্তরের একটি বিশেষ স্থানে রোপিত হয়। ইহার পর ভ্রূণ ও. আন্তর্জরায়ু স্তরের কোষের সমন্বয়ে অমরা গঠিত হইলে তাহার মাধ্যমে প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত ভ্রূণের পুষ্টি, শ্বাসক্রিয়া ও রেচনকার্য সাধিত হয়।
গ) জরায়ু কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত ক্ষারকীয় শুক্রাণুর চলৎশক্তি বৃদ্ধি করে।
ঘ) জরায়ু মাসিকের সময় রক্তের ক্লেদ বাহির করিয়া দেয়।
৫) গর্ভাবস্থায় জরায়ু সন্তান ৯ মাস পর্যন্ত বহন করে। প্রসবের পর জরায়ু পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া আসে। ইহার নাম ইনভলিউশান।





প্রশ্ন-  জরায়ুর বিভিন্ন প্রকার অবস্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

উত্তর: জরায়ুর বিভিন্ন প্রকার অবস্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা- কোন স্ত্রীলোক সোজা হইয়া যখন দাঁড়ায় তখন জরায়ু মাটির সহিত প্রায় সমান্তরাল অবস্থায় থাকে।
যখন উপরিভাগ (ফান্ডাস) সামনের দিকে হেলিয়া পড়ে এবং জরায়ু মুখ (অস) সেক্রামের দিকে যায়-জরায়ুর এই অবস্থানকে অ্যান্টিভার্সন বলা হয়।
আবার যখন জরায়ু গহবরের রাস্তা সোজা থাকে না এবং জরায়ুর দেহাংশ (বডি) জরায়ুর গ্রীবার সামনের দিকে বাঁকিয়া যায়-জরায়ুর এই অবস্থানকে অ্যান্টিফ্লেকশন বলা হয়।


সমাপ্ত। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ