প্রসূতি ও শিশুস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য, দ্বিতীয় বর্ষ, সপ্তম অধ্যায়

 সপ্তম অধ্যায়

প্রসূতি ও শিশুস্বাস্থ্য
(Maternity and Child Health Care)








প্রশ্ন-  প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য কি?

উত্তর: প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য- আমাদের দেশে বহু প্রসূতি মাতা ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্নের অভাবে অকালে প্রাণ হারায়। প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য হইল এইসব হতভাগা প্রসূতি ও শিশুদেরকে অকালে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করা। সময়মত তাহাদের স্বস্থ্যের সঠিক যত্ন নিলে অকাল মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমিয়া যাইবে। জাতির উন্নতির প্রধান উপায় হইল মাতৃজাতিকে এবং ভবিষ্যৎ বংশধর শিশুদেরকে সুস্থ ও সবল রাখা। আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত ও জাতির কর্ণধার। তাই তাহারা সুস্থ সবল না থাকিলে দেশ ও জাতির কল্যাণ আশা করা যায় না। প্রসূতি ও শিশু স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য হইল গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর পর্যায়ে মাতা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা। এই পরিচর্যার দ্বারা প্রসূতি মাতা ও শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করা সম্ভব। প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তরকালীন সৃষ্ট উপসর্গ ও অসুবিধাসমূহ ও বিপদসমূহ লাঘব করা এবং প্রসূতি মাতা ও শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা।



প্রশ্ন- মা ও শিশুকে এক ইউনিট রূপে গণ্য করা হয় কেন?

উত্তরঃ মা ও শিশুকে এক ইউনিট রূপে গণ্য করার কারণ- মা ও শিশুকে এক ইউনিট রূপে গণ্য করা হয়। কারণ-
১। গর্ভসঞ্চার হইতে প্রসবপূর্বকাল পর্যন্ত শিশু মায়ের গর্ভে থাকে তাই মায়ের দেহেরই একটা অংশ হিসাবে শিশুকে গণ্য করা হয়। কারণ ২৮০ দিন মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশু তাহাদের দেহ গঠনের সকল উপাদান মায়ের রক্ত হইতে পায়।
২। শিশুস্বাস্থ্য মায়ের স্বাস্থ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সুস্থ সবল মাতা সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়।
 ৩। জন্মের পর পরই শিশু সম্পূর্ণ রূপে মায়ের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করিয়া প্রথম ৮ হইতে ১০ মাস খাদ্য ও পুষ্টির জন্য এই নির্ভরশীলতা।
৪। শিশু জন্মের পর সব সময়ই মাতার পরিচর্যার সাথে সাথে শিশুরও পরিচর্যা করিতে হয়।
৫। মা শিশুর প্রথম শিক্ষিকা, যার সাথেই শিশুর প্রথম ভাবের আদানপ্রদান ঘটে, কথা হয় এবং মাতার আদর ও যত্নের মধ্য দিয়া শিশুর জীবন শুরু হয়।
৬। হামজুর, জণ্ডিস, জার্মান, মিজেলস্, সিফিলিস, হাঁপানী প্রভৃতির ন্যায় মাতার কতকগুলি সুনির্দিষ্ট পীড়া শিশুর উপর প্রভাব ফেলে।



প্রশ্ন- বাংলাদেশের মা ও শিশু চিত্র অংকন কর।

উত্তর : বাংলাদেশের মা ও শিশু চিত্র- বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ মা ও শিশুদের নিয়া। জনমিতির সংজ্ঞা অনুসারে ১৬-৪৫ বৎসর বয়স সীমার সন্তান প্রসবক্ষম মহিলাই মা এবং ০-১৪ বৎসরের উভয় লিঙ্গের সকলই শিশু। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪৩.৯% শিশু এবং ১৬.৮% মা।
বাংলাদেশে ১ হইতে ৯ বৎসর পর্যন্ত বয়সের সকল শিশুই ক্যালরি গ্রহণের দিক হইতে তৃতীয় গ্রেডের অপুষ্টির শিকার। শিশুদের ভিটামিন এ, বি-২, সি এর ঘাটতি প্রচুর। ভিটামিন 'এ' এর ঘাটতির জন্য বাংলাদেশের প্রায় ১৭,০০০ শিশু প্রতি বৎসর অন্ধ হইয়া যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে বিভিন্ন জরিপের উপাত্ত হইতে জানা যায়-
ক) সকল গর্ভবর্তী ও স্তন্যদায়িনী মাতা ক্যালরি, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিকারক খাদ্য উপাদানের ঘাটতিতে ব্যাপকভাবে ভোগে।
খ) বাংলাদেশে প্রায় ৫৯% পরিবার প্রয়োজনীয় নূন্যতম ক্যালরি চাহিদা মিটাইতে পারে না।
গ) ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বাংলাদেশের শিশুর ওজন বৃদ্ধির হার উন্নত দেশের সাথে তুলনীয় কিন্তু ৭-৪২ মাস বয়সে তহাদের বৃদ্ধির হার অনেক কম।
ঘ) ৫ বৎসর বয়সে পৌছাইতে মাত্র ২০% শিশু যথাযথ পুষ্টি পায়। ৬% শিশু প্রথম গ্রেডের, ৫৮% দ্বিতীয় গ্রেডের ও ১৬% শিশু তৃতীয় গ্রেডের অপুষ্টিতে ভোগে।
 ঙ) ১১ বৎসর বয়সে পৌঁছিলে এই হার ১২% প্রথম গ্রেডের, ৬২% ২য় গ্রেডের এবং ৪% তৃতীয় গ্রেডের অপুষ্টিতে ভোগে। বাংলাদেশের নারীদের অপরিণত বয়সে বিবাহ ও ঘন ঘন গর্ভধারণ তাহাদের ভাগ্যলিপি। গৃহের চারি-দেওয়ালের মধ্যেই তাহাদের জগৎ সীমাবদ্ধ। অপরদিকে মায়ের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খুবই অপর্যাপ্ত। চাহিদার তুলনায় শিশু ও মাতৃসদনের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য এবং সুযোগ সুবিধা ও সেবার মান অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মা ও শিশু দুর্বল ও ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। সুষম আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টির বিষয় দুইটিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় তবেই তাহা হইবে মাতৃমঙ্গল ও শিশু কল্যাণে প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনের উপযুক্ত হাতিয়ার।



প্রশ্ন- সামাজিক ধাত্রী বিদ্যা কি?

উত্তর : সামাজিক ধাত্রী বিদ্যা- ধাত্রীবিদ্যার লক্ষ্য মূলত গর্ভধারনের পর হইতে গর্ভাবস্থার ২৮০ দিন, প্রসবকাল ও প্রসবোত্তর ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাতার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং সুস্থ মাতার সুস্থ শিশু জন্মদানের মধ্য দিয়া গর্ভাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানো। মনুষ্য প্রজনন ও পরিবেশের মধ্যে অন্তঃক্রিয়াকে আমরা সামাজিক ধাত্রীবিদ্যার সংজ্ঞা বলিয়া ধরিতে পারি। বিবাহ কালীন বয়স, গর্ভধারণ, দুইটি সন্ত ান ধারণের মধ্যবর্তী ব্যবধান, পরিবারের আকার, প্রজনন ক্ষমতা, শিক্ষা, বিশ্বাস, প্রথা, সমাজের নারীর ভূমিকা প্রভৃতি পরিবেশগত নানা উপাদান মনুষ্য প্রজননের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই সকল উপাদান লইয়া অধ্যয়ন, গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সামাজিক ধাত্রীবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে বিবেচিত। পরিবার পরিকল্পনাসহ মাত্মঙ্গল ও শিশুকল্যাণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সার্ভিসের ব্যাপক সুযোগ সুবিধা সমগ্র লোক সমাজের হাতের নাগালে পৌঁছাইয়া দেওয়াই সামাজিক ধাত্রীবিদ্যার কাজ।



প্রশ্ন- প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা কি?

উত্তর : প্রতিরোধমূলক শিশুরোগবিদ্যা- শিশুদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ এবং তাহাদের দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাবোধের উন্নয়নই শিশুরোগ বিদ্যার উদ্দেশ্য। প্রতিরোধমূলক শিশুরোগ বিদ্যা দুই প্রকারের। যথা-
১) জন্মপূর্ব প্রতিরোধক শিশুরোগ বিদ্যা- গর্ভধারণের সাথে সাথেই ইহার প্রয়োগ শুরু হয়। গর্ভবস্থায় মাতার পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ প্রসব, স্তন্যদুগ্ধদানে ও মায়ের অন্যান্য দায়িত্ব পালনে মাতাকে শিক্ষিত ও প্রস্তুত করিয়া তোলা প্রভৃতি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
২) প্রসবোত্তর প্রতিরোধক শিশু রোগ বিদ্যা- শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টির তত্ত্বাবধান, ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে অনাক্রম্য করণ, আকস্মিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, শিশুদের মনস্তাত্বিক তত্ত্বাবধান প্রভৃতি বিষয় এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।



প্রশ্ন- সামাজিক শিশুরোগ বিদ্যা কি?

উত্তর: সামাজিক শিশুরোগবিদ্যা- লোক সমাজের সর্বপ্রকার রোগের প্রতিরোধ, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এবং লোকসমাজের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে শিশুরোগ বিদ্যাকে নিয়োজিত রাখা উচিত। ইহাই সামাজিক শিশুরোগ বিদ্যার দার্শনিক ভিত্তি। শিশুদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য চাহিদাগুলি হইল-
ক) পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর বাসগৃহ।
খ) সুখী ও সুস্থ্য পিতামাতা।
গ) পুষ্টিকর সুষম খাদ্য।
ঘ) আদর, ভালবাসা, অন্য শিশুদের সঙ্গ।
ঙ) নিরাপত্তা।
চ) স্বীকৃতি।
ছ) খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ ও চিত্তবিনোদনের সুব্যবস্থা।
জ) লেখাপড়া ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ।



প্রশ্ন- মাতৃত্ব চক্রের একটি বিবরণ দাও।

উত্তর : মাতৃত্ব চক্র- নারীদের মাতৃত্বচক্রের ৫টি পর্যায় রহিয়াছে। পর্যায়গুলি নিম্নরূপ-
(১) গর্ভাধান- জরায়ু নালীতে ডিম্বানু নিষিক্ত হইলে উহা ৮ হইতে ১০ দিনের মধ্যে জরায়ুতে গিয়া পৌছে এবং জরায়ুর প্রাচীরে গ্রোথিত হয়। কোষ বিভক্তি এবং পার্থক্য প্রাপ্তির মধ্য দিয়া বিভিন্ন কোষকলা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গঠন কাজ আরম্ভ হয়।
(২) সন্তান জন্ম পূর্ববর্তীকাল- ১৪ দিন পর্যন্ত জরায়ুতে নিষিক্ত ডিম, ১৪ দিন হইতে ৯ সপ্তাহ পর্যন্ত দ্রুণ এবং ৯ সপ্তাহ হইতে ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত 'ফিটাস' অবস্থান করে।
(৩) সন্তান জন্মকাল- এই ইনট্রানেটাল কাল প্রসবের শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত।
(৪) সন্তান জন্মকাল- শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সময় হইতে এই পোষ্টন্যাটাল কালের শুরু এবং উহা ৪০ দিন পর্যন্ত চলে।
৫। পুনরায় গর্ভধান- দুই গর্ভধারনের মধ্যবর্তী সময়কাল ইহার অন্তর্ভূক্ত। 



প্রশ্ন- গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবপূর্ব পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা লিখ।

উত্তর: গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবপূর্ব পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা- সন্তান গর্ভে আসিবার পর উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে মাতা এবং গর্ভস্থ শিশুর নানা প্রকার রোগ হইয়া থাকে এবং ইহার ফলে মাতা এবং শিশুর মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং গর্ভবর্তী নারীর পরিচর্যার উদ্দেশ্য হইল গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুকে সুস্থ ও সবল রাখা, স্বাভাবিকভাবে প্রসবে সাহায্য করা। সুস্থ এবং জীবিত শিশুকে সহজভাবে ভূমিষ্ট করানো এবং প্রসবের সময় ভাবী মাতাকে সর্বপ্রকার আঘাত হইতে রক্ষা করা।
i) গর্ভের প্রথম হইতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা বা হাসপাতালে যাওয়া। সাধারণতঃ গর্ভবর্তীকে ৮ মাস পর্যন্ত মাসে একবার করিয়া, নবম মাসে দুইবার এবং তাহার পর সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে একবার করিয়া হাসপাতালে যাইতে হয়।
ii) সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিতে হইবে। দাঁত, যোনী, বক্ষ প্রভৃতি নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করিতে হইবে।
iii) সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর আহার গ্রহণ করিতে হইবে। দুধ, ফল, মাছ, ডিম প্রভৃতি খাদ্য নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে আহার করা প্রয়োজন।
iv) কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখার জন্য নিয়মিত ফলমূল ও শাকসব্জি খাওয়া উচিত। ⅳ) রক্তস্বল্পতা থাকিলে তাহা দূর করার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
vi) রক্ত পরীক্ষা- Blood Sugar, Blood group A. B. AB, O এবং RH System করাইতে হইবে।
 vii) নিয়মিত স্বাভাবিক কাজ কর্ম করিতে হইবে।
viii) অতিরিক্ত পরিশ্রম বর্জনীয়। কোন ভারী জিনিষ উঠানো বা নামানো উচিত নয়।
ix) দৈনিক ৮ হইতে ১০ ঘণ্টা সুনিদ্রার প্রয়োজন।
x) প্রতিমাসে গর্ভবতীর রক্তের চাপ, ওজন, প্রস্রাব ও বাচ্চার অবস্থান প্রভৃতি পরীক্ষা করাইতে হইবে।
xi) দৌড়াদৌড়ি, লাফানো এবং সিঁড়ি বাহিয়া বেশী উঠানামা উচিত নয়।
xii) মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকিতে হইবে। কোনরূপ দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়।
xiii) গর্ভাবস্থায় যত কম ঔষধ খাওয়া যায় ততই ভাল।
xiv) গর্ভের পাঁচ হইতে ছয় মাসের মধ্যে একমাস ব্যবধানে দুইটি, টি টি, ইনজেকশান নিতে হইবে।



প্রশ্ন- গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবপূর্ব পরিচর্যায় অঙ্গ শিথিলকারী ব্যায়াম কি?

উত্তর : গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবপূর্ব পরিচর্যায় অঙ্গ শিখিলকারী ব্যায়াম- শরীর সুস্থ রাখার জন্য এবং সহজ প্রসবের জন্য গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করা অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় মুক্ত ও শীতল বায়ুতে একঘন্টা করিয়া বেড়াইলে ঠিকমত রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। ভাবী মাতা নীরোগ হইলে এবং স্বাস্থ্য মোটামোটি ভাল হইলে গর্ভের দ্বিতীয় মাসের শেষের দিক হইতেই গর্ভিণী ব্যায়ামগুলি অভ্যাস করিলে ফল ভাল হইবে। এগুলিকে অঙ্গ শিথিলকারী ব্যায়াম বলা হয়। যথা-
ক) পা জোড়া রাখিয়া একবার বাম হাত দিয়া একবার ডান হাত দিয়া কয়েকবার পায়ের আঙ্গুল স্পর্শ করিতে হইবে।
খ) পা জোড়া রাখিয়া মাতার পিছনে দুই হাত দিয়া ডান পাশে ঝোঁকা।
গ) কোমরে হাত দিয়া হাঁটু ভাঙ্গা এবং সোজা করা।
ঘ) পা জোড়া রাখিয়া পাশের দিকে ও উপর দিকে বাহু সম্প্রসারণ করা।
ঙ) চিৎ হইয়া শুইয়া একবার বাম পা, একবার ডান পা তোলা।
চ) দাঁড়াইয়া একবার বাম পা, একবার ডান পা উত্তোলন করা।
ছ) পা জুড়িয়া দাঁড়াইয়া দুই হাত দিয়া একবার ডান পায়ের একবার বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করা।
জ) পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াইয়া দুই হাত দিয়া একবার ডান পায়ের একবার বাগ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করা।
ঝ) দুই পা লম্বা করিয়া বসিয়া দুই হাতে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করা।
ঞ) শুইয়া দুই পা একসঙ্গে লম্বা করা ও ভাঁজ করা।



প্রশ্ন- গর্ভবর্তী মায়েদের অঙ্গ শিথিলকারী ব্যায়ামের উপকারিতা কি?

উত্তর : ভাবী মাতা নীরোগ হইলে এবং স্বাস্থ্য মোটামোটি ভাল হইলে গর্ভের দ্বিতীয় মাসের শেষের দিক হইতে গর্ভিনীর অঙ্গ শিথিলকারী ব্যায়ামের অভ্যাস করা ভাল। অঙ্গশিথিলকারী ব্যায়ামের উপকারিতা নিম্নরূপ-
i) গর্ভকালে ও প্রসবকালে পেটের ও যোনিপথের চতুষ্পার্শ্বস্থ পেশী সবল করে।
ii) দেহের অতিরিক্ত মেদ কমাইয়া দেহের গঠন সুন্দর করে।
iii) অঙ্গ প্রত্যঙ্গের জড়তা দূর হয়।
iv) ভাবী মাতা ইচ্ছামত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়া চাড়া করিতে পারে।
v) প্রসূতি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আয়ত্বে রাখিতে পারে।
vi) বসা, দাঁড়ানো ও হাঁটার ভঙ্গী সহজ ও সুন্দর হয়।
vii) স্তনের গঠন ভাল হয় এবং সন্তানও প্রচুর দুধ পায়।
viii) গর্ভবতীর মন প্রফুল্ল থাকে। মনের সতেজভাব ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়।
ix) খাদ্য ভাল হজম হয়, রুচি বৃদ্ধি পায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে না।



প্রশ্ন- গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবকালীন পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা লিখ।

উত্তর : গর্ভবর্তী মায়ের প্রসবকালীন পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা- প্রসবকালীন গর্ভবতীর নিম্নলিখিত পরিচর্যার জন্য প্রয়োজন-
i) প্রসব ব্যথা আরম্ভ হইলে শুধুমাত্র সামান্য মাত্রায় গরম পানি ব্যতীত সকল প্রকার খাওয়া বন্ধ রাখিতে হইবে।
ii) সর্বতোমুখী উন্নত ধরনের বিশেষ ধরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। এজন্য প্রয়োজন-
ক) প্রসবের সময় ধাত্রীর হাত জীবাণুমুক্ত করিয়া পরিশুদ্ধ দস্তানা পরিধান করা,
খ) পরিশুদ্ধ মুখোশ ও পোষাক পরিধান করা,
গ) জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা,
ঘ) প্রসবের পূর্বে গর্ভবতীর যোনিপ্রদেশ ও যোনি দ্বারের নরম তন্তু ভাল করিয়া জীবাণুমুক্ত করা,
ঙ) প্রসবকালে যোনিদ্বারের নরমতম্ভ বা জরায়ুমুখ ছিঁড়িয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
iii) প্রসবের সময়ে মাতা ও শিশুকে সামান্যতম আঘাতেরও হাত হইতে রক্ষা করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।
iv) প্রসবকালে কোন অস্বাভাবিকতার উদ্ভব হইলে যেমন জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্ট এবং মাতার প্রসবকালীন অত্যধিক রক্তক্ষরণ- তাহা দূরীকরণের ব্যবস্থা করা।



প্রশ্ন- প্রসূতি মায়ের প্রসবোত্তর পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা লিখ।

উত্তরঃ প্রসূতি মায়ের প্রসবোত্তর পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা- প্রসবের পর প্রজনন সংক্রান্ত যন্ত্রাবলী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত পর্যায়কে প্রসবোত্তর কাল বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে ৬ হইতে ৮ সপ্তাহ সময় লাগে। প্রসূতি মায়ের প্রসবোত্তর পরিচর্যা নিম্নরূপ।
i) সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরে প্রসূতিকে অন্ততঃ ৩-৪ ঘণ্টা শান্তভাবে নিদ্রা যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্ততঃ দুই সপ্তাহকাল অধিকাংশ সময়ই প্রসূতির স্থিরভাবে শয়ন করিয়া থাকিতে হইবে। এই সময়ের মধ্যে জরায়ু হইতে প্রসবাস্তিক প্রাবাদি নির্গত হইয়া জরায়ু, ক্রমশঃ সংকুচিত হইয়া স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
ii) মূত্রাশয়ের যত্ন- সন্তান প্রসবের ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রসুতিকে প্রস্রাব করাইতে হইবে। প্রসূতির স্রাব যাহাতে পরিষ্কার থাকে সেইদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। প্রসবের ৬ হইতে ৮ ঘণ্টা পরে প্রসূতিকে প্রস্রাব করিবার জন্য বলিতে হইবে।
স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব না হইলে যোনি প্রদেশে গরম সেঁক বা গরম ডুস বা তলপেটের উপর বরফ দিয়া প্রস্রাব আনাইবার চেষ্টা করিতে হইবে।
iii) যোনি প্রদেশের যত্ন- প্রসূতিকে আরামে রাখিবার জন্য যোনি প্রদেশ এবং শুকনা রক্তের চারিপাশের ত্বক পরিষ্কার করা খুবই প্রয়োজন। এমনভাবে পরিষ্কার করিতে হইবে যাহাতে কোন প্রকারেই জননপথে জীবাণু দুষ্ট না হইতে পারে। সাবান পানি দিয়াই হোক বা বীজবারক আরক দ্বারা মুছাইয়া দিয়া হোক, চতুর্থ দিবস পর্যন্ত দিনে অন্ততঃ ২ বার যোনিপ্রদেশ এবং বিটপ পরিষ্কার করিতে হইবে।
iv) গাত্রতাপ পরীক্ষা- নিয়মিতভাবে প্রসূতির দেহের তাপ লওয়া উচিত। উপসর্গহীন অবস্থায় স্বাভাবিক প্রসব হইলে দেহের তাপ এবং হাতের নাড়ী স্বাভাবিক থাকে। তবে কখনও কখনও প্রথম ২৪ ঘণ্টায় দেহের তাপ সামান্য উঠিলেও তাহা আবার শীঘ্রই নামিয়া যায়। যদি কোন কারণে ক্রমাগত তিনদিন ধরিয়া রোগিনীর গাত্রোত্তাপ ৯৯.৪০ ডিগ্রীর উপরে থাকে, অথবা, ২৪ ঘণ্টা ধরিয়া ১০০.৪ ডিগ্রী জুর থাকে তবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। উচ্ছসিত ভাবাবেগ, স্তনে অতিরিক্ত দুধজমা, কোষ্ঠবদ্ধতা, সর্দি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা, মূত্রপথ ও স্তন জীবানুদুষ্ট হওয়া প্রভৃতি কারণে গাত্রতাপ বৃদ্ধি পাইতে পারে।
v) নিদ্রা- প্রসবোত্তরকালে প্রসূতির সুনিদ্রা হওয়া প্রয়োজন। যাহাতে নিদ্রার সামান্যতম ব্যাঘাতও না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অতিরিক্ত উদ্বেগ, অনিদ্রা অগ্নিমান্দ্য প্রভৃতি লক্ষণ মস্তিষ্ক বিকৃতির পূর্বাভাস।
vi) পথ্যাপথ্য- খুবই সহজ পাচ্য পথ্য রোগিনীকে দিতে হইবে। সন্তান প্রসবের পরে তিনদিন পর্যন্ত দুধ, সাগু, চা, পাউরুটি প্রভৃতি খাবার দেওয়া যাইতে পারে। কোষ্ঠ পরিষ্কার থাকিলে এবং খাওয়ার রুচি থাকেলে পরে ভাত মাছের ঝোল, শাকসব্জি, ফল প্রভৃতি দেওয়া যায়।
vii) পোশাক পরিচ্ছদ- পাতলা ও ঢিলা পেশাক যাহা আরামপ্রদ হয় প্রসূতিকে তাহাই ব্যবহার করিতে দিতে হইবে। পোষাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত।
viii) শোয়া বসা- প্রসবের পর প্রথম কয়েকঘন্টা মা একটি বা একসাথে দুইটি বালিশ ব্যবহার করে। ইহার পর হেলান দিয়া বসিবার জন্য মাকে পিছনের দিকে তিনটি বা চারটি বালিশ দিতে হয়। এইভাবে বসিলে জরায়ু হইতে সহজে স্রাব নির্গত হইতে সাহায্য করে।
ix) স্তনের যত্ন- স্তন ও স্তনের বোঁটা খুব ভালভাবে গরম পানি ও তুলার সাহায্য মুছিয়া পরিষ্কার রাখিতে হইবে। স্তনের বোঁটায় ক্ষত হইলে তৎক্ষণাৎ তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। স্তনের বোঁটা যাহাতে না ফাটে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। শিশুদের স্তন্য দিবার সময় এমনভাবে হাত দিয়া স্তন ধরিতে হইবে যাহাতে শিশুর স্তন্যপানে কোনপ্রকার অসুবিধা না হয়।
x) ব্যায়াম- প্রসবোত্তরকালে পেশীগুলির স্বাভাবিক শক্তি বিশেষ করিয়া বস্তি দেশের মাঝে এবং পেটের পেশীগুলির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসার জন্য হালকা ব্যায়াম প্রয়োজন।



প্রশ্ন- শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার বা নবজাতকের পরিচর্যার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা কর।

উত্তরঃ শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার বা নবজাতকের পরিচর্যা- জন্মের পর শিশু এক নুতন পরিবেশে আসে। ইতিপূর্বে জরায়ুর অন্ধকার থলির মধ্যে ছিল তাহার আবাস। নূতন পরিবেশে মানিয়া নিতে বেশ সময় লাগে। তাই এই সময় সাৱধান না হইলে শিশু রোগাক্রান্ত হইতে পারে।
i) সদ্যজাত শিশুর দেহে একরকম আঠাল পদার্থ লাগিয়া থাকে। তাই ঈষদুষ্ণ পানি দ্বারা শিশুর দেহ পরিষ্কার করিয়া দেওয়া উচিত। শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে জীবাণুমুক্ত তুলা দ্বারা চোখের পাতা মুছিয়া দিতে হইবে এবং নাক ও মুখ হইকে মিউকাস পরিষ্কার করিয়া দিতে হইবে।
ii) শিশু প্রথম কাঁদিয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে নাভি হইতে ১ ইঞ্চি দূরে পরপর ১ ইঞ্চি ব্যবধানে দুইটি বাঁধন দিয়া কর্ডনাড়ী কাটিয়া শিশুকে মাতা হইতে পৃথক করিতে হইবে।
iii) গোছল- জন্মের সময় শিশুর শরীর তৈলাক্ত বস্তু এবং রক্তদ্বারা মাখানো থাকে। গায়ে লাগা রক্ত জীবাণুমুক্ত তুলা দ্বারা মুছিয়া পরিষ্কার করা উচিত। জন্মের ১ অথবা ২ ঘণ্টা পর শিশুকে গোসল করাইতে হয়। গোছলের পানির সাথে কোন এন্টিসেপটিক মিশাইয়া জীবাণু সংক্রমণ কমানো যায়। পরবর্তীতে প্রতিদিন শিশুকে গোছল করানো হয়। প্লাষ্টিকের বাথটাবে ঈষদুষ্ণ পানিতে শিশুর মাথা ও মুখ ধোয়ানো হয়। শিশুর মলত্যাগ করিলে সমস্ত শরীর পানি দিয়া ধুইয়া পরিষ্কার করিতে হয়। তারপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামা ও ন্যাপকিন পরানো হয়।
iv) ঘুম- প্রসবকালে শিশুকে বেশ ধকল পোহাইতে হয় তাই তাহার বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে। তখন শিশু শুধু ঘুমাইতে চায়। শিশু ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০ ঘণ্টা ঘুমায়।
ঘ) কর্ডকেয়ার- শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নাড়কর্ড শুকাইয়া যায় এবং সাতদিনের সময় শুকানো কর্ড খসিয়া পড়ে। এই কয়দিন কর্ড খোলা রাখিতে হইবে। কিন্তু গোছলের সময় পানি লাগানো যাইবে না। প্রতিদিন স্পিরিট দিয়া কর্ড পরিষ্কার করিয়া দেওয়া ভাল।
vi) শিশুর পায়খানা- জন্মের পর প্রথম দুইদিন শিশু আঠাআঠা সবুজ পায়খানা কয়েকবার করিয়া প্রতিদিন করে। ইহাকে মেকোনিয়াম বলে। তারপর হলুদ পায়খানা করে। দুধ খাওয়ানোর পরই পায়খানা হয়। মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশু দিনে ১ বার মলত্যাগ করে বা ২৪ ঘণ্টায় ৫/৬ বার করিলেও তাহা স্বাভাবিক।
vii) শিশুর প্রস্রাব- নবজাত শিশু সাধারণতঃ জন্মের একটু পরেই প্রস্রাব ত্যাগ করে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার না হইলে অনেকে প্রস্রাব নাও করিতে পারে।
viii) সদ্যেজাত শিশুকে খাওয়ানো- মায়ের স্তনে দুগ্ধ ২য় বা তৃতীয় দিনে আসিলেও ক্ষতির কিছু নাই। কারণ জন্মের পর কয়েকঘণ্টা শিশুকে খাওয়ানো দরকার হয় না। প্রথমদিন স্তনে যেটুকু দুধ থাকে তাহাই যথেষ্ট। স্তন মুখে দিলে শিশু আপনা হইতেই স্তন চুষিতে শুরু করিবে। প্রথম দিন ২ বার এবং দ্বিতীয় দিনে ৩/৭ বার দুধ দিলেই যথেষ্ট। ক্রমেই দুধ দেওয়ার সময় বাড়াইতে হইবে।
ix) টিকা দেওয়া- শিশুর বয়স ২ মাস হইতে ২ বৎসরের মধ্যে বিসিজি ডিপিটি, পোলিও এবং হামের টিকা দিতে হইবে।
x) ত্বকের পরিবর্তন- ত্বকের রং শীঘ্রই লালবর্ণ হইতে ফ্যাকাশে রং ধারণ করে। ত্বক শুকিয়া যায় এবং স্কেলী হয় এবং বিভিন্ন প্রকারের র‍্যাস দেখা দিতে পারে। এগুলির জন্য কোন চিকিৎসার দরকার হয় না।



প্রশ্ন- আঁতুড় ঘরে পল্লীগ্রামের বদভ্যাসসমূহ কি কি?

উত্তর: আঁতুড় ঘরে পল্লীগ্রামের বদভ্যাসসমূহ- পল্লীগ্রামে আঁতুড় ঘরে কিছু কিছু বদভ্যাস দৃষ্ট হয়। বদভ্যাসসমূহ হইল-
১) শিশুকে ধরার জীবাণুযুক্ত অপরিষ্কার বস্ত্রাদি ব্যবহার করা।
২) পরিশুদ্ধ হস্তাবরণী না পরিয়া বার বার অশিক্ষিতা দাই কর্তৃক যোনীপথে পরীক্ষা করা। একবার পরীক্ষান্তে জীবাণু নাশক পানিতে হাত না ধুইয়াই তাহারা আবার যোনীপথ পরীক্ষা করিয়া থাকে। এই সময়ে যত কম সম্ভব যোনীপথে পরীক্ষা করিতে হয় এই জ্ঞানও তাহাদের নাই।
৩) যোনীদ্বার বিস্তৃত করার জন্য অনেক সময় বহুবিধ তৈলাদি ব্যবহার করা হয়। ইহাও বন্ধ করা উচিত।
৪) প্রসূতিকে অশুচি জ্ঞান করিবার জন্য বেশভূষা ও পোশাক যতদূর সম্ভব। অপরিষ্কার করিয়া রাখা হয়। ইহাও কুঅভ্যাস।
৫) 'কাঁচা নাড়ী' ভাল করিয়া শুকাইবার জন্য অনেকে প্রসূতিকে পানি পান করিতে দেয় না। ইহা ঠিক নহে।
৬। আঁতুড় ঘর গরম রাখার জন্য এবং শিশুর নাভিতে সেঁক দিবার জন্য ঘর বন্ধ করিয়া কাঠের বা কয়লার আগুন জ্বালা হয়। এই ব্যবস্থায় মা ও শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিতে পারে।
৭) বহু প্রসূতিই ৯/১০ দিন বিশ্রাম নিয়া 'গোসল করিয়া' গৃহকর্মে লাগিয়া যান। উপযুক্ত বিশ্রামের অভাবে জরায়ু উপযুক্ত পরিমাণে শুকাইতে না পারায় বহুবিধ স্ত্রীরোগের সৃষ্টি হয়।
৮) ফেলিয়া দিতে হইবে বলিয়া দুর্গন্ধযুক্ত অপরিষ্কার লেপ, তোষক, বালিশ এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুধু মাদুর বিছাইয়া প্রসূতিকে শয়ন করিতে দেওয়া হয়। এই অভ্যাস বর্জন করিয়া প্রসূতির জন্য ভাল বিছানার ব্যবস্থা করা উচিত।



প্রশ্ন- প্রসব ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ কি কি আলোচনা কর।
বা, কি কি মূলনীতিসমূহ প্রসব ব্যবস্থায় মানিয়া চলা উচিত?

উত্তর : প্রসব ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ- প্রসবের বিভিন্ন স্তর এবং বিভিন্ন স্তরের কৌশল অবহিত হইবার পূর্বে যে মূলনীতি গুলির উপর ভিত্তি করিয়া প্রসবের বিভিন্ন স্তরের ছক করা হইয়াছে তাহা আমাদের জানা দরকার। প্রসব ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহ হইল-
১) প্রসূতির মানসিক প্রয়োজন সম্যকভাবে উপলব্দি করা এবং প্রয়োজন মিটাইবার ব্যবস্থা করা।
২) প্রসূতির পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া ঠিক বাড়ীর ন্যায় হাসপাতালেও স্নেহপ্রীতি দরদের ছোঁয়ায় পূর্ণ করা। এই আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন-
ক) সর্বপ্রকার আরামের ব্যবস্থা করা। ক্লান্তি কমাইবার জন্য ব্যথার দরুণ যে কষ্ট তাহার উপশম করা এবং অযথা রক্তক্ষয় বা শরীরের যেমন কোন ক্ষতি না হয় সেইদিকে নজর রাখা।
খ) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ নজর রাখা। জীবাণু নাশের জন্য জীবাণুনাশক ঔষধের ব্যবস্থা করা এবং সংক্রামক রোগ জীবাণু ধ্বংস করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা।
গ) প্রসূতির ব্যথার গতি প্রকৃতির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখা।
৩) প্রসূতিকে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতির উপর ছাড়িয়া দেওয়া এবং তাহার অযথা বিরক্তি উৎপাদন না করা।
৪) বিশেষ অবস্থা অনুযায়ী বিশেষ ব্যবস্থার কোন ত্রুটি না হওয়া।



প্রশ্ন- আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলি কি কি?

উত্তর : আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ- আমাদের দেশে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ। যথা-
i) সংক্রামক রোগের কারণে শিশু মৃত্যু ঘটে।
ii) জন্যকালীন আঘাত প্রাপ্ত হইলে মৃত্যু ঘটিতে পারে।
iii) ডিপথিরিয়া, টিটেনাস, হুপিংকাশি প্রভৃতিতে আক্রান্ত হইলে শিশু মৃত্যু ঘটে।
iv) অপুষ্টিজনিত কারণে শিশু মৃত্যু ঘটে।
v) দীর্ঘদিন উদরাময়ে আক্রান্ত থাকিলে মৃত্যু ঘটিতে পারে।
vi) উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে এবং দারিদ্রতার কারণে শিশুমৃত্যু ঘটিতে পারে।
vii) নাভিরঞ্জুর কর্তিত প্রান্তে গোবর লাগানো, খারাপ বাসস্থান প্রভৃতি কারণে শিশু মৃত্যু ঘটিয়া থাকে।



প্রশ্ন- আমাদের দেশে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর কারণ কি?

উত্তর : আমাদের দেশে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর কারণ- আমাদের দেশে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর কারণগুলি নিম্নরূপ। যথা-
i) নারীদের অজ্ঞতার কারণে অকালে মৃত্যু ঘটে।
ii) অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যু ঘটিতে পারে।
iii) শিক্ষিতা ধাত্রীর অভাবে এই মৃত্যু ঘটে।
iv) কুসংস্কার ও অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
v) প্রসবকালীন অস্বাভাবিকতা ও জটিলতা থাকিলে মায়েদের মৃত্যু ঘটে।
vi) অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মায়ের মৃত্যু ঘটে।
vii) গর্ভাবস্থায় রক্ত স্বল্পতার কারণে মৃত্যু ঘটিতে পারে।
viii) বিভিন্ন রোগ জীবাণু সংক্রমণের কারণে মায়েদের মৃত্যু ঘটে।
ix) গর্ভকালীন রক্ত বিষাক্ততা বা টক্সিমিয়া, প্রাসূতিক জীবাণু দূষণ, শিরার রক্ত প্রবাহ রোধ, অভিঘাত প্রভৃতি কারণে প্রসূতি মৃত্যু ঘটে।
x) খুব কম বা বেশী বয়সে গর্ভধারণ, প্রথম গর্ভধারণ, স্বল্প ব্যবধানে গর্ভধারণ, যমজ সন্তান প্রসব প্রভৃতির কারণে প্রসূতির মৃত্যু ঘটে।



প্রশ্ন- অনাক্রম্যকরণ কর্মসূচী বলিতে কি বুঝ?
বা, অনাক্রম্যকরণ নির্ঘন্ট কাহাকে বলে?

উত্তর : অনাক্রম্যকরণ কর্মসূচী- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে কয়েকটি মারাত্মক ক্ষতিকারক সংক্রামক রোগের হাত হইতে বাঁচার জন্য শিশুকাল হইতে কিছু টিকা দেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করা হইয়াছে। এই রোগ প্রতিষেধক টিকাগুলি শিশুকালের একটা নির্দিষ্ট সময় হইতে শুরু করিয়া নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর শিশুদের দেওয়া হয়। টিকা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় ও পদ্ধতি যে নির্ঘণ্টে লিপিবদ্ধ করা হয় তাহাকে অনাক্রম্যকরণ নির্ঘণ্ট বলে।



প্রশ্ন- ই.পি.আই. বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী বলিতে কি বুঝ?

উত্তর : ই.পি.আই. বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী- আমাদের দেশে প্রত্যেক শিশুকে ছয়টি সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রধানের জন্য যে কর্মসূচী গ্রহণ করা হইয়াছে তাহাকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী বা ই.পি.আই. (Expanded Programme on Immunisation) বলে।



প্রশ্ন- কোন ধরনের রোগ ই.পি.আই, বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী দ্বারা প্রতিরোধ করা যায়?

উত্তর: ই.পি.আই. বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী দ্বারা প্রতিরোধ করা যায়- যক্ষ্মা, ডিপথিরিয়া, পোলিও, হাম, টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার ও হুপিংকাশি এই ছয়টি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।



প্রশ্ন- শিশু স্বাস্থ্যে ই.পি.আই এর গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তর: শিশু স্বাস্থ্যে ই.পি.আই এর গুরুত্ব আলোচনা- শিশু স্বাস্থ্যে ই.পি.আই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন ধরনের উপদেশ ই.পি.আই কর্মসূচীতে প্রদান করা হয়। যেমন- পাতলা পায়খানা করিলে শিশুকে লবণ পানির সরবত খাওয়ানো, মাতৃ দুগ্ধের কোন বিকল্প নাই, ভিটামিন-'এ' এর অভাবে শিশুর অন্ধত্ব রোগ হয়, প্রতিদিন সবুজ শাকসব্জি খাইলে ভিটামিন এ এর অভার দূর হয় এবং অন্ধত্বের হাত হইতে রক্ষা পায়, ছোট পরিবার সুখী পরিবার প্রভৃতি। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী কয়েকটি মারাত্মক ক্ষতিকারক সংক্রামক রোগের হাত হইতে বাঁচার জন্য শিশুকাল হইতে কিছু টিকা দেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করিয়াছে। এই রোগ প্রতিষেধক টিকাগুলি শিশুকালের একটা নির্দিষ্ট সময় হইতে শুরু করিয়া নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর পর দেওয়া হয়। সকল টিকা সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এই টিকাগুলি হইল বি.সি.জি., ডিপিটি, পোলিও, হাম, টিটি ও হুপিংকাশি। শিশুদের এই টিকাগুলি দেওয়া হইলে শিশু সারা জীবনের জন্য যক্ষ্মা ডিপথিরিয়া, হুপিং কফ, হাম, পলিওমায়েলাইটিস ও টিটেনাস এই ছয়টি রোগ হইতে মুক্তি পায়। কাজেই শিশু স্বাস্থ্যের ই.পি.আই.-এর গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ